somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক বাংলাদেশঃ দুই মেরু

০৪ ঠা মার্চ, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোট বেলা থেকেই ঢাকা শহরে মানুষ হয়েছি। গ্রাম সম্পর্কে জানার পরিধিটা ছিল খুব সীমিত। বছরে খুব অল্প দিনের জন্য বাবা-মায়ের সাথে দেশের বাড়িতে যাওয়া হত। আমাদের গ্রাম টা এখনো খুবই অজপাড়া। এখনো ইলেকট্রিসিটি পৌছাইনি।

মনে আছে ছোট বেলায় যখন যেতাম প্রায় দুই মাইল আগে বাস থেকে নেমে কাচা রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে হত। এখনো মনে আছে বর্যা হলে হেটে যাওয়ার সময় দুই পা ভরে কাদা ভরে যেত। দাদা বাড়িতে ঢুকার আগে পুকুরে হাত পা ধুয়ে জুতা-মোজা পরে ভদ্র বাবু সেজে ঢুকতাম। শহুরে মানুষ আমি কাদামাখা অবস্থায় গেলে আমার ইজ্জত পাংচার হয়ে যাবে তাই।;)

যে দুই তিন দিন থাকতাম দাদা-নানা বাড়ি মিলে হই হুল্লোড় করে কেটে যেত। যখন চলে আসতাম খুব কান্না পেত, ইস! আবার কবে আসব!

গ্রাম ছিল আমার কাছে শুধুই ছুটি কাটানোর জায়গা। তাই যা দেখতাম তাই ভালো লাগত। আমার মনে হত এত সুন্দর জায়গায় যারা থাকে তাদের মনে হয় কোন কষ্ট নেই, শুধুই আনন্দ।

আমাদের গ্রামটা এখনো অজপাড়া হলেও পাকা রাস্তা হয়েছে। সেই কাদা মাখা রাস্তা দিয়ে আর হেটে যেতে হয়না। তার পরিবর্তে নসিমন, মোটরসাইকেল এ করে বাস থেকে নেমে ১০ মিনিট এর মধ্যে বাড়িতে পৌছানো যায়।

এই যোগাযোগের সহজগম্যতার কারণে গ্রামে যাওয়া আসাটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে একটু একটু করে বাড়তে লাগল। আর এই একটু বেশি আসা যাওয়ার কারণে গ্রামের পিঠা-পায়েস, পুকুরে মাছ ধরা, পুকুরে গোসল করা এই আনন্দ করার বাইরেও আরেকটু বেশি গ্রাম কে বুঝতে পারার সুযোগ ঘটল।

এই বুঝতে যেয়ে দেখি এতদিন যে গ্রাম আমার কাছে ছিল একটা "সবুজ শিশুপার্ক" তা আদতে অন্যরকম।

চাচাত ভাইয়ের সাথে যেয়ে গ্রামের বাজারের চায়ের দোকানে সন্ধ্যার পর যেতাম তাদের আলোচনাগুলা শোনার বোঝারা চেষ্টা করতাম। মিথ্যে বলব না উনাদের অনেক আলোচনা হাসির উদ্রেক করত। ভাবতাম এসব গাজাখুরি জিনিস তারা বিশ্বাস করে কিভাবে?

সে সময় তাদেরকে যতটা Unsmart ভাবতাম নিজেকে ঠিক ততটাই Smart ভাবতাম। মিথ্যে বলব না, আমার কিশোর মন তখন এই গ্রামের মানুষকে একটু অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতেই দেখত।

পরে যখন আরেকটু বড় হলাম নিজের যুক্তি খাটিয়ে আর পারিপার্শ্বিকতা দিয়ে বুঝতে পারলাম তাদের এই পিছিয়ে থাকাটা তাদের দোষ না। বরং সেরকম কোন সুযোগ তারা পাচ্ছে না এগিয়ে যাওয়ার জন্য।

আমাদের গ্রামে এই সেদিন পর্যন্ত কোন এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার ছিল না। যে একজন পল্লী চিকিতসক ছিলেন তার কাছে গিয়ে দেখেছি চিকিৎসার নামে কি হচ্ছে। উনার ট্রিটমেন্ট না ছিল এলাপ্যাথিক, না হোমিওপ্যাথিক। ছিলনা কোন ভাল মানের স্কুল।

এই যে অবস্থা বললাম এ অবস্থা বাংলাদেশের কমবেশি সব গ্রামের অবস্থা।

**************************************************

অনেকেই হয়ত ভাববেন কি বলছেন গ্রাম-গ্রাম। আরে ভাই মুক্ত অর্থনীতির যুগে সব উন্নয়ন তো শহরকেন্দ্রিক হয়, গ্রাম এর স্থান সেখানে কোথায়। তাদের হয়ত জানা থাকবে বাংলাদেশের ৭৩% মানুষ এখনো গ্রামে বাস করে।

এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে আর যাই হোক দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব না।

**************************************************
গত পরশু থেকেই শুনছিলাম গ্রাম থেকে বাসায় বারবার ফোন করে জানাচ্ছে ওখান কার সবাই নাকি চাদে সাইদীর চেহারা দেখতে পাচ্ছেন। শোনার পর আমার হো হো করে হাসি আর মায়ের "নাউযুবিল্লাহ"।

তখন ব্যাপারটা হাসির মনে হলেও একটা বারের জন্য মনে হয়নি এই ব্যাপারটা পরে মারাত্মক কোন ঘটনার জন্ম দিবে।

সবাই এখন জেনেছি বগুড়া অঞ্চলে শুধু এই একটা গুজব কি পরিমাণ ক্ষতি করে দিয়েছে।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেলোয়ার হোসেন সাইদীর গুরুত্ব কেমন তা আমার খুব বেশি কখনোই জানা ছিলনা। তবে দেখতাম গ্রামে গঞ্জে চায়ের দোকানে উনার ওয়াজের ক্যাসেট বাজত।

গ্রামের মসজিদ গুলাতে কখনোই দেখিনি সেই মানের খতীব আছেন যারা বিভিন্ন দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিবেন। অনেক হুজুর কেই দেখতাম বাংলা খুতবার সময় একটা বই হাতে নিয়ে কিছু জিনিস পড়ে পড়ে সবাইকে শুনাতেন।

অথচ এই শুক্রবারের খুতবাটা কিন্তু খুব সহজেই গ্রামের মানুষজনকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক জিনিস বোঝানোর একটা সুন্দর মাধ্যম হতে পারত।

দোষটা কোথায়?

আমাদের দেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাজ হচ্ছে এই সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করা।

তাদের ওয়েবসাইট এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্যারাটা তুলে ধরছিঃ
"১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ প্রণীত হয় ইসলামিক ফাউন্ডেশন অ্যাক্ট। এই অ্যাক্ট অনুযায়ী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিম্নরূপ:

মসজিদ ও ইসলামি কেন্দ্র, একাডেমী , ইন্স্টিটিউট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ বা সেগুলোকে আর্থিক সাহায্য প্রদান-যাতে সেগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন উপায়ে ইসলামের প্রচার-প্রসার সম্ভব হয়;

সংস্কৃতি, মনন, বিজ্ঞান ও সভ্যতার ক্ষেত্রে ইসলাম ও মুসলিম অবদান সম্পর্কে গবেষণার ব্যবস্থা;

সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব, সহনশীলতা ও ন্যায় বিচার সংক্রামত্ম ইসলামের মৌলিক আদর্শের প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা;

ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, আইন ও বিচার ব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ, অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য বৃত্তি প্রদান, গবেষণাক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ আবদানের জন্য পুরস্কার এবং পদক প্রবর্তন ও প্রদান, এ সমসত্ম বিষয়ে আলোচনা, বক্তৃতা, বিতর্ক-সভা, সেমিনার ইত্যাদির আয়োজন, গবেষণা ও আলোচনাপ্রসূত গ্রন্থ, প্রবন্ধ ইত্যাদি প্রকাশ, অনুবাদ, সংকলন, সাময়িকী এবং পুসিত্মকা প্রকাশ ইত্যাদি;

উপরিউক্ত কর্মসূচি সংক্রামত্ম প্রকল্প রচনা, সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাসত্মবায়নে সাহায্য-সহায়তা দান এবং ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের অনুকূল অন্য যে-কোনো কর্মসূচি গ্রহণ। "


ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কিন্তু ঠিকই আছে, কিন্তু গলদ টা হচ্ছে তাদের কার্যক্রম।

মাঝে মাঝে তাদের কিছু ইমাম প্রশিক্ষণ কার্যক্রম দেখি, কিন্তু তা যে যথেষ্ট নয় তার বড় প্রমাণ গ্রাম গঞ্জের মসজিদের খতীবদের উদ্দেশ্যহীন খুতবা।

এটাও ঠিক বাংলাদেশ এ গ্রাম আছে প্রায় ৮৫,০০০। প্রতি গ্রামে একটা করে মসজিদ ধরলেও ৮৫,০০০ খতীব শুধু গ্রামেই দরকার। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক যোগ্য খতীব পাওয়া এত সহজ নয়।

সেক্ষেত্রে একটা উপায় থাকত, তা হল ইসলামিক ফাউন্ডেশন ইউনিয়ন ভিত্তিতে তিন মাসে অন্ততঃ একবার ওয়াজ মাহফিল এর আয়োজন করতে পারত।

কিন্তু বাস্তব হল এধরনের উদ্যোগ তারা কখনোই গ্রহণ করিনি। আর এজায়গাটা ই হল দেলোয়ার হোসেন সাইদীর একটা বড় প্লাস পয়েন্ট। আমার জানামতে যে কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ও তার ওয়াজ এ যোগদান করেছে, নিদেনপক্ষে তার ওয়াজের ক্যাসেট শুনেছে।

একটা বার ভেবে দেখুন ধর্মীয় ভাবে পরিপূর্ণ অজ্ঞ এক বিশাল জনগোষ্ঠী ধর্মীয় নির্দেশনা পাওয়ার জন্য তার উপর আস্থা রাখত। এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার ওয়াজের ভিতর উনি ভুল না ঠিক বলছেন এটা বোঝার ক্ষমতা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর থাকবে এটা আশা করা বোকামি হবে।

এই গ্রামের মানুষজনকে উনার মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অবস্থান যতই আপনি বলতে চান না কেন তারা সহজেই মানবে বলে মনে হয়না। কারণ তাদের চোখে তিনিই একমাত্র তাদের "ধর্মের পথ প্রদর্শনকারী"

একবার ভাবুন তো এই বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তার ফাসির খবরকে তাদের চিন্তাধারা অনুযায়ী "ধর্মের উপর আঘাত" হিসেবেই দেখেছে।

তাদের আবেগ তাদেরকে একটাবারের জন্যও এই জিনিসটা বুঝতে দেয়নি, চাদের গায়ের কালো দাগ কে মন চাইলে যে কোন রূপেই চিন্তা করা যায়। তা সে সাইদীর ছবি হোক কিংবা অন্য কারো চেহারা।

হাসছেন?

একবার ভাবুননা আমাদের সব উন্নয়নমুখী কার্যক্রম শহরকেন্দ্রিক করার ফলে এই গ্রামীন জন গোষ্ঠি কি পরিমাণ অশিক্ষা আর কুশিক্ষায় নিজেদের ডুবিয়ে রেখেছে।

এ দায় তাদের? কক্ষণই নয়, এ দায় আমাদের।

শুধু ধর্ম নয়, যে কোন সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় বিষয়ে এই বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে যদি আমরা সচেতন করতে না পারি তাহলে এরকম দুর্ঘটনা বারবার ঘটতে থাকবে।

ফলাফল হবে দেশ সবারই থাকবে বাংলাদেশ। কিন্তু সবাই হয়ে যাব দুই মেরুর বাসিন্দা।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৪:৪৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×