somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভূতচতুর্দশীর মহাফিকশন : বাঘবাহাদুর

১৬ ই অক্টোবর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তারপর সামন্তপুরের রিনা তালুকদার, গ্রামের এক মাত্র বহুরূপীটি, কদিনের জন্যে শহর থেকে ঘুরে আসবে স্থির করে। এ কদিন খুব খাটুনি গিয়েছে যা হোক।

শহরে নাকি তার দিদির রাজকুমার থাকে।

*****

তিনটে পাশ দিতে দিতেও হয়নি রিনার দিদির। বিনোদিনী বিএতে ব্যাক পেয়েছিল। পড়াশোনার সেইখানেই ইতি। কিছুদিন পাঁপড়-বড়ি এটাসেটা বেচে স্থির করলো কলকাতায় গিয়ে চিৎপুরের দি গ্র্যান্ড অপেরার ম্যানেজার রবি অনির্বাণ দয়ালের পায়ে কেঁদেকেটে পড়বে।

ছোটোখাটো একটা রোলও পেয়ে গেল সে - হিরোইনের মামাতো বোনের। এই ভাবেই দিন চলছিল। কিন্তু সুখ শব্দটার সাথে যেন বিনোদিনীর সাত জন্মের আড়ি।

গ্রামে ফিরে আসার সময় একটা লিপস্টিক নিয়ে এসেছিল আঁচলে বেঁধে। সেই সাথে যাত্রায় শেখা যাবতীয় ছলাকলা।

মিটার গেজের সামন্তপুরে এ ব্যাপারটা একেবারেই নতুন। মেয়েমানুষের মুখে রঙচঙ মেখে পরী সাজা দেখতে সারা গ্রাম ভিড় করতো। কাজল পড়লে ফিলামেন্টের বিষণ্ণ আলোয় চোখ দুটো মায়াবী হয়ে যেতো বিনোদিনীর।

দুবেলা দুমুঠো জোটানোর চিন্তা আর থাকলো না। গ্রামের সবাই এখন তার একটু হাসি দেখতে বুক চিরে রক্ত দিতেও রাজি। যা:! তাই আবার হয় নাকি? কিন্তু বিনোদিনী তো তাই মনে করে।

গ্রামের পলিটেকনিক-পাশ ভুজঙ্গ, পেয়ারের ইয়াররা শ্রীভুজ বলেই ডাকে, ফিউজ সারাইটারাই ছোটোখাটো টুকটাক ইলেক্ট্রিকের কাজকর্ম করে - যদিও ডিপ্লোমার সার্টিফিকেটটা দেখতে চাইলেই তার ভীষণ জরুরী কাজগুলো মনে পড়ে যায় তখন।

পয়সা জমিয়ে একটা শিফন শাড়ি কিনেছিল বিনোদিনী রবিবারের হাট থেকে। তোলাই থাকতো সেটা সব সময়, মাঝে মাঝে ট্রাঙ্ক থেকে বের করে হাত বুলোতো, চোখ বুজলেই ট্রামের ঘরঘর শব্দ শুনতে পেতো।

সেই শাড়িই তার কাল হলো।

ভুজঙ্গ অনেক দিন থেকেই বিনোদিনীর সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে। বিনোদিনী পাত্তাও দেয় না আবার ধমকও মারে না।

দাঁতের মাজন ফুরিয়ে গেছিল, বিনোদিনীরও মনটা সকাল থেকে ম্যাজম্যাজ করছিলো, ভাবলো শাড়িটার এবার পাট ভেঙেই ফেলি - স্টেশনে গিয়ে দুটো নতুন লোকও দেখা হবে।

ভুজঙ্গকে দেখেই মেজাজটা যেন আরো খিঁচড়ে গেল। চোখ দুটো ভাঁটার মতো লাল, জামাকাপড় থেকে কিরম যেন একটা গন্ধ বেরোচ্ছে, ঠিক এই গন্ধটা প্রম্পটারের মুখ থেকেও পেতো মাঝে মাঝে।

ঠাস করে কষে একটা চড় বসিয়ে দেবে নাকি ভাবলো বিনোদিনী - শাড়িটা ছাড়ো ভুজঙ্গদা।

একটু ভয় ভয়ও করছে, এরম অবস্থায় কোনো দিন পড়তে হয়নি তো কখনও।

হঠাৎ কোথা থেকে একটা মোটরবাইক এসে ব্রেক কষলো। চোখের পলক ফেলতেই দেখে ভুজঙ্গ মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে।

সে রাতে রিন ঘুমিয়ে কাদা হওয়ার পরে, বোনকে এই নামেই আদর করে ডাকে বিনোদিনী, অনেক ক্ষণ ধরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছিলো হাতে ধরা কার্ডটাকে - ঐ ডক্টর লেখা জায়গাটা।

কোথা থেকে যে এলো তার লাল হুন্ডা চাপা গুন্ডা, আর হুশ করেই কোথায় যে চলে গেলো, কিছুই জানা হলো না - স্মৃতি শুধু মাটিতে পড়ে যাওয়া ভিজিটিঙ কার্ডটা।

কোথায় তুমি গুন্ডা? নামটা তো আর জানা হলো না, তাই মনে মনে গুন্ডা বলেই ডাকে বিনোদিনী, তার রবিনহুড - ঠিক এরকম এক জন মাচোর প্রতীক্ষাতেই তো সে ছিল এতো দিন।

দিন যায়, সপ্তাহ আসে, হপ্তা ঘুরে বছর - রাজার কুমার আর আসে না ফিরে।

বিনোদিনীর শো বন্ধ হয়ে গেলো। সকাল থেকে রাত অব্ধি স্টেশনে কাটায়। হাজার অচেনা মুখের ভিড়ে একটা চেনা মুখ খুঁজে নিতে চায়। ডালভাতের চিন্তাটা অবশ্য করতে হয় না।

রিন প্রথমটায় রাজি হয়নি। বাঙলা অনার্সে ভর্তি হয়েছিল বিনোদিনী, বোনকে বোঝাতে মিনিট দশেকের বেশি সময় লাগেনি, শরৎ চাটুজ্যের শ্রীনাথ বহুরূপীর কথা কলেজ লাইব্রেরিতেই পড়ে নিয়েছিল ফার্স্ট ইয়ারে।

*****

এসব কথাগুলো রোজ শুনতে শুনতে বলতে গেলে মুখস্থই হয়ে গেছে রিনার। তাও দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে যায়। এখনো যে বিনোদিনী কোথাও ডক্টর লেখাটা দেখলেই চমকে চমকে ওঠে। হো লাল ঘোড়েকা সওয়ার! জাগতে রহো!!

ঘুম আসে না বিনোদিনীর। কুঁজোর পাশে রাশি রাশি খালি স্ট্রীপ পড়ে থাকে - ঘুমের ওষুধের। চশমার খাপে জড়িয়ে থাকে সাদা চুল।

পরদিন আবারও ভোর হয়, চায়ের দোকানে উনুনে আঁচ পড়ে, হাবু-বিশু-পিন্টুরা আধপোড়া জিভ নিয়ে দৌড়য় - সাতটার লোকালটা মিস করলে সোজা জুট মিল থেকে ছাঁটাই।

আবারও রাত আসে। আজ ভূতচতুর্দশী, শ্যামাপূজার আগের নিশা।

বেশ আলতো করে বাতাসটা আজকাল কামড় দিতে আরম্ভ করেছে। চড়কের অবশ্য বহু দেরি।

ট্রাঙ্ক হাঁটকায় রিনা। দুহাতে আলতো করে বের করে আনে জিনিসটা।

খড়ের ওপরে হলুদ কাপড় বাঁধা যেটাকে বের করে আনে, বিমল রায়ের যেকোনো জুনিয়র টেকনিশিয়ান সেটাকে হাতে ধরে ছুঁয়েও
দেখবে না।

ফিলিপ্সের রেডিওতে সজারুর কাঁটা শোনা গ্রামবাসীদের অনভিজ্ঞ
চোখকে তুষ্ট করতে তাই যথেষ্ঠ।

দ্বিতীয়ার ঠিক পরে পরেই, ফোঁটাপর্ব শেষ হলে যখন ছুটির আমেজ কেটে যাবে, কার্তিকের শুরুতেই নতুন অ্যাক্টো নামাবে রিনা - সুন্দরবনের আর্জান সর্দার।

সে নিজেই বনবিবি নিজেই দক্ষিণ রায়। খালি ঐ পার্টটা করার সময় মাথার ওপর থেকে কানওয়ালা মুখোশটা টেনে নামিয়ে নিতে হয়। গর্জনটা প্র্যাক্টিস করতে গিয়ে প্রথম প্রথম অনেক বারই গলা ভেঙেছে।

ছট পরবের সময় আবার দুচার দিন তার খেলা দেখানো বন্ধ থাকে।

গ্রামে মাত্র এক ঘর ওরা। কেন জানি না রিনা আবার বিহারীদের কোনো কিছুই সহ্য করতে পারে না। পরবের পুরো সময়টাই দোর এঁটে গোমড়াথেরিয়াম হয়ে বসে থাকে সে।

দিদির সাথে থেকে থেকে তাকেও বোধ হয় খুব একটা শক্ত কোনো মাথার ব্যামোতে ধরেছে ভেতরে ভেতরে। এক বার এক বৌদ্ধ সন্যাসী তাদের গাঁয়ে এসেছিলো। দেখা মাত্রই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।

একটা কালো চুল আয়নাটাতে আটকে আছে। হাত দিয়ে সরিয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। বা:! বেশ লাগছে তো। একটু নেচে নেয়, দেওয়ালে বাড়ি মেরে পরখ করে নেয়, শক্ত করে আটকানো আছে তো? দুম করে খুলে গিয়ে লোকহাসানোর ভয়টা আজকাল প্রায়ই তাড়া করে বেড়ায় রিনাকে।

হাঁড়ির ভাত যে পুড়ে একেবারে আঙরা। খেয়ালই ছিল না। পড়িমড়ি করে সব ধরাচুড়ো খুলে রান্নাঘরের দিকে দৌড়য় রিনা।

দিদিকে ভাত খাইয়ে নিজে খেয়ে ঘরে যখন ফিরে আসে, হাতের জল ঝরে ঝরে পড়তে থাকে, চোখেরটাও।

একটা উড়ন-তুবড়ি জানলা দিয়ে ঢুকে পড়েছিলো কখন। সারা ঘরে পোড়া খড়ের গন্ধ। ছাইগুলো ঝেঁটিয়ে ফেলে দিতে দিতে ভাবে, শহর থেকে এবার একটা শক্তপোক্ত দেখে প্লাস্টিকের কিছু নিয়ে আসবে, আর এই সুযোগে যদি জামাইবাবুর সাথেও দেখা হয়ে যায়?

এক অসম্ভব আশায় ভর করে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায় রিন। হাতে লেগে থাকা ছাইগুলো তখনও যেন মুচকি মুচকি হাসছে তার দুর্দশায়।
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×