শাহেদ আজকের ইন্টারভিউতেও টিকলো না ।এ পর্যন্ত প্রায় একশটার মত চাকুরীর ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে সে । ইন্টারভিউ বোর্ডের ব্যবহার প্রতিবারই এত মনোমুগ্ধকর হয় যে যেন এখনি তাকে জবটা দিয়ে দিচ্ছে । কিন্তু প্রতিবারই শাহেদ দেখে আসছে তাকে না করে দিতে ।এইটাই কি তাহলে বাস্তবতা নাকি মুখোশের আড়ালের লুকোচুরী খেলা শাহেদের কাছে এখনো তা অস্পষ্ট । এইবারও তারই পুনরাবৃত্তি হলো । শাহেদ পুলকিত মনে ফলাফলের জন্য বাহিরে অপেক্ষা করছে । তার কাছে মনে হচ্ছে এইবার বোধয় জবটা হয়েই যাবে । কিন্তু অনেক্ষন অপেক্ষা করার পর ভেতরে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারে পজিশন ফিল আপ হয়ে গেছে । কথাটি শুনে তার খুব মেজাজ খারাপ হয় কারন তারা তাকে এতক্ষন কেন অপেক্ষা করালো? চাকরী না হয় না ই দিলি কিন্তু এইটুকু সৌজন্যতাবোধও কি তোরা দেখাতে পারিস না ?
শাহেদ এখন তার নিয়মিত বন্ধু হতাশাকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তার একপাশ ধরে হাঁটছে ।চারপাশের মানুষগুলো হুমড়ি খেয়ে যার যার কাজে ছুটে চলেছে শুধু শাহেদের কোন কাজ নেই । হয়তো এদের ভীড়েও আরও অনেক শাহেদ আছে তারাও শাহেদকে দেখে একিই কথাই ভাবছে ।শাহেদ শার্টের হাতার বোতাম খুলতে খুলতে তার শার্ট প্যান্টের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে তারপর চিন্তা করতে থাকে এইগুলোর জন্যই মনে হয় তার জব হয় না ।প্রতিবারই তো সে তার ট্যালেন্টের পরিচয় দেয় বোর্ড কর্মকর্তারাও বাহবা দেয় কিন্তু জব এর ডাক আর পড়ে না । তাই আজ সে তার জামাকাপড় গুলোকেই দোষারোপ করছে । তার ফরমাল জামাকাপড় বলতে আছে শুধু গায়ে পড়ে থাকা এই একসেটই ।শু জোড়াও নেক্সট টাইম আর রং করবেনা বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে মুচিমশাই তারও নাকি প্রেস্টিজে লাগে ।ধোয়া এবং আয়রনের চাপে জামাগুলো ফ্যাকাশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে এসেছে। এইগুলো দিয়েই সে এতদিন ইন্টারভিউ চালিয়ে আসছে ।প্রথম ইন্টারভিউতে যাওয়া উপলক্ষে প্রায় দুই বছর আগে বঙ্গবাজার থেকে তার মামা এই এক জোড়া শার্ট প্যান্ট আর শু কিনে দেয় ।
শাহেদের পকেটে থাকা নোকিয়া ৩৩১০ মোবাইলটা হঠাৎশরীর কাঁপিয়ে উঠে । শাহেদের নিজের সম্পত্তি বলতে আছে শুধু এই মোবাইল সেটটা । অনেকদিন ধরে টিউশনির কিছু টাকা জমিয়ে তার এক পরিচিত বড় ভাই থেকে ধর কষাকষি করে ৪৫০ টাকা দিয়ে সেকেন্ডহ্যান্ড মোবাইলটি কেনে সে ।ফোন করেছে আরফান কাকা গ্রামের বাড়ি থেকে । ফোন ধরতেই জানতে পারে তার মা আর নেই ।শাহেদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার একমাত্র সান্তনা তার মা আজ তাকে ছেড়ে চলে গেছে । তার শরীর এখন খুব শীত করছে । তার কাছে মনে হচ্ছে সে আসলে পৃথিবীতে নেই সে অন্যকোথাও হারিয়ে গেছে । কিন্তু জায়গাটা কোথায় সে তা জানে না তবে সেখানের রং যে শুধুই গাঢ় অন্ধকার সেটা সে খুবই বুঝতে পারছে ।
শাহেদ তার পকেটে হাত দিতেই হোঁশ ফিরে পায় ।এখনি তাকে গ্রামের বাড়ীতে রওয়ানা দিতে হবে কিন্তু পকেটে টাকা নেই। শাহেদদের বন্ধুও সাধারনত তেমন একটা থাকে না ।আর যে কটা আছে তারা তার চিরন্তন পাওনাদার । তাই তাদেরকে সে একটু এড়িয়েই চলতে চেষ্টা করে । কিন্তু আজকে তো এইসব ভাবলে চলবে না ।মায়ের কথা বললে বন্ধুদের থেকে অবশ্যই টাকা পাওয়া যাবে । তারা এত নিষ্ঠুর নয় ।
শাহেদ বাড়ীর উদ্দেশ্যে দৌড় লাগায় ।তার মায়ের কথা আজ খুব মনে পড়ছে যদিও অন্যদিনও মস্তিস্কজুড়ে তার হতভাগা এই মা ই থাকে । তবে আজকে একটু অন্যভাবে মনে পড়ছে । শাহেদ তার মস্তিস্কে মায়ের শত যন্ত্রনা চাপানো পুলকিত হাসিটি দেখছে না, যেন যন্ত্রনাগুলোকে ছুটি দিয়ে মা নিস্তব্দতায় নীরব হয়ে গেছে । মুখে কোন হাসি নেই যন্ত্রমূর্তির মত তাকিয়ে আছে, যেন বলছে খোকা মন খারাপ করিস নে তোর মা তোর সাথে সবসময়ই আছে ।খোকাকে ছেড়ে কি তার মা কখনো যেতে পারে ?বাসের জানালা দিয়ে তীব্র বাতাস এসে শাহেদের চোখের পানি মুছে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে । কিন্তু বাতাস কি জানে এই কান্না কাকে জড়িয়ে, হয়তো জানে তাইতো চোখের পানি মুছে দিতে চাইছে ।
শাহেদের মনে পড়ে তাকে ঘিরে তার জনমদুঃখী মায়ের সংগ্রামের দিনগুলো ।তার বাবা যখন পৃথিবী ত্যাগ করে তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ বছর । সেই থেকে মা তাকে অতি যতনে আগলে রেখে বড় করেছে, আজ শিক্ষিত এক যুবকে পরিনত করেছে ।এই পৃথিবী মায়ের সেই ত্যাগ না বুঝলেও শাহেদ বুঝে তার প্রতিটি রক্ত ফোটায় শুধুই তার মায়ের পায়চারি। তার মনে পড়ে শত অভাবক্লেষ্টতায়ও তার মা তাকে কখনো কাজে নামার কথা বলতো না । শুধুই মনযোগ দিয়ে পড়তে বলতো ।শাহেদের মা ফাইভ পাশ কাম শিক্ষিত ছিল কিন্তু শিক্ষার প্রতি তাঁর দরদ ছিল অতুলনীয় ।
শাহেদ গড়নে হ্যাংলা পাতলা ছিল অন্যদের তুলনায় ।তাই তার মা তাকে প্রায়ই বলতো, ফুতরে তুই তো অন্যদের থেকে দুর্বল, পড়াশোনা না করলে কামলা খেটেও তো খাইতে পারবি না । আমিতো আর সারাজীবন বেঁচে থাকবো না ।শাহেদের আবার ঘনঘন অসুখ করার বেরামও ছিল তাই কোন না কোন অসুখ লেগেই থাকতো । তার মা তাকে ঔষধ খাইয়ে সারারাত বুকে জড়িয়ে রেখে উষ্ণতা দিত আর সকাল হলেই সে সুস্থ হয়ে যেত । সে ভাবতো মায়ের বুকের উষ্ণতায় সে সুস্থ হয়ে গিয়েছে ।জোসনা দেখা ঘরে মায়ের উষ্ণতায় মোড়ানো জায়গাটিই শাহেদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুময় স্থান মনে হত । মায়ের সেই উষ্ণতা সে কখনো ভুলতে পারে না । এখনো অসুখ হলে মায়ের সেই উষ্ণতা শাহেদ খুব অনুভব করে আর তাতেই সে সুস্থ বোধ করে ।
শাহেদের মা তাকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পাটি বিছিয়ে পড়তে বসাতেন। পাশে একটা আগুনের খুপি জ্বলতো আর মা পাখা হাতে বাতাস করতেন । সাথে একটা বসার উঁচু পিড়ি রাখতেন সেটার উপর খাতা রেখে শাহেদ লিখতো ।শাহেদের মা তাকে রুটিনমাফিক সবকিছু করাতো, পড়ার সময় পড়া খেলার সময় খেলা। তখনও শাহেদদের বাড়িতে কোন ঘড়ি ছিল না । তার মা সূর্যের ছায়া দেখে টাইম হিসেব করতো । তাকে কোন জায়গায় পাঠালে বলতো সূর্যের ছায়া এই পর্যন্ত আসার আগে যেন সে বাড়ী ফেরে, লাঠি দিয়ে একটা দাগ টেনে দিত ।শাহেদের মা সবসময় লাঠি ব্যবহার করতো কারন তিনি কোমরের সমস্যায় ভুগতেন । মাঝে মাঝে খুব ব্যথা উঠতো । শাহেদকে বলতো গরম সরিষার তেল দিয়ে একটু মালিশ করে দিতে । কিন্তু কখনো ডাক্তার দেখাতেন না ।মামারা ডাক্তার দেখানোর জন্য টাকা পয়সা দিলেও ডাক্তার দেখাতেন না ।শাহেদের জন্য টাকাগুলো রেখে দিতেন । সেগুলো দিয়ে তার কলম খাতা বই কিনে দিতেন । আর শাহেদের জন্য কিছু পুষ্টিকর খাবার ঘরে রাখতেন। শাহেদের মামারা এইসব দেখে বলতো, শাহেদেরে এত লেখাপড়া করাইয়া কি করবা তুমিই যদি না বাঁচো । তখন মা বড়াই করে বলতো, আমি বাঁচন লাগবো না তোরা দেখবি একদিন আমার খোকা অনেক বড় মানুষ অইবো ।
শাহেদকে তার মা অনেক সময় শাসনও করতেন । সেই শাসনগুলোর কথা মনে পড়লে শাহেদের এখনো হাসি পায় । সে দুষ্টামী করলে তার মা তার দিকে হাতের লাঠি ছুড়ে মারতো এমনভাবে মারতো যেন তার গায়ে না লাগে । মায়ের শাসনেও যেন মধুর ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে । তারপর রাতে ঘুমানোর সময় গল্পের চলে মা তাকে ভুলগুলো শুধরে দিতেন আর ভালো ভালো উপদেশের গল্প শুনাতেন । শাহেদ এখনো সেই উপদেশগুলো মেনে চলার চেষ্টা করে ।তার মা তাকে শুধু শিক্ষিতই করেননি একজন ভালো মানুষও বানিয়ে দিয়েছেন ।
শাহেদ বাস থেকে নেমে বাড়ির দিকে খুব জোরে ছুটতে থাকে যেন ছোটকালের খোকা শাহেদ মায়ের কোলে ফিরছে ।কিন্তু আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এলাকার হুজুর মুরব্বীরা সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে দেখে তার মায়ের দাফন সম্পূর্ন করে ফেলেছে তারা বলেছে মৃতমানুষকে বেশীক্ষন রাখতে নাই এতে আত্মা কষ্ট পায় ।তার মা অছিয়ত করে গিয়েছিলেন তাঁকে যেন বাড়ির উঠোনের এককোনে দাফন করা হয় যাতে সে খোকা আসলে খোকাকে সবসময় দেখতে পায় । তাঁর অছিয়ত মতই তাঁকে দাফন করা হয় ।
শাহেদ উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে এইমাত্র ।সে নিজেকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে হতভাগা সন্তান মনে করে যে কিনা তার মায়ের মৃত মুখটিও দেখতে পারলো না, পৃথিবী এত নিষ্ঠুর কেন ।অনেকে তাকে সান্তনা দিতে এগিয়ে এসেছে । তারা কি আসলে জানে এর কোন সান্তনা থাকতে পারে ? কবরের দিকে তাকিয়ে আছে শাহেদ অপলক দৃষ্টিতে । তার ইচ্ছে করছে কবর খুঁড়ে তার মাকে বের করে নেড়েচেড়ে দেখতে, তার মা মরতে পারে না । ওরা তার মাকে ভালো করে না দেখে কবর দিয়ে দিয়েছে । যে মা অসহনীয় যন্ত্রনার সম্মুখীন হয়েও হার মানেনি সে কিভাবে সামান্য মৃত্যু কাছে হার মানে? শাহেদের মাথায় কিছুই কাজ করছে না ।তার কাছে মনে হচ্ছে তার মা তাকে এখনো বুকে জড়িয়ে গরম উষ্ণতা দিচ্ছে কিন্তু সে শুধুই শীতল হয়ে যাচ্ছে…
শাহেদ তার বিলাশবহুল ছয়তল বিশিষ্ট বাড়ীর ছাদে রকিং চেয়ারে বসে আছে । সে ডায়েরীর লেখা বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে আকাশে তারাগুলোর দিকে । তার কাছে মনে হয় সব তারাগুলোই যেন তার মা, এত তারা দিয়েও মনে হয় মায়ের মর্যাদাসিদ্ধ হবে না ।শাহেদের কাছে মনে হচ্ছে চারপাশে উষ্ণ হাওয়া তাকে ঘিরে ধরেছে । শাহেদ মিটিমিটি হাসে আর বলে মা তোমার খোকাকে তুমি এখনো বুকের উষ্ণতা দাও !শাহেদ আস্তে আস্তে ছাঁদ থেকে নিচে নামতে থাকে ।
শাহেদ এখন কোটিপতিদেরও কোটিপতি । সে দেশের সনামধন্য ধনকুব। শাহেদ তার মায়ের কবরের সামনে এসে দাঁড়ায় মাকে বলছে, মা তুমি আমাদের ঘরের ভাঙ্গা বেড়ায় হাত বুলিয়ে বলতে না, ফুতরে কবে একটা বিল্ডিং দিবি আমি একটু আরাম করতাম । তখন আমি তোমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম । তুমি আজ তাকিয়ে দেখো মা তোমার খোকা তোমার সামনে কত সুন্দর বাড়ি বানিয়েছে । তুমি কি জানো বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল বাড়ি এটি এর সবকিছুই অনেক দামী । তুমি কি দেখতে পাও মা শাহেদ খুব চিৎকার করে বলে । তখনই শাহেদ সেই চিরচেনা উষ্ণতা অনুভব করে ।
বৌ আর সন্তান দুটো নিয়ে শাহেদের সংসার । শাহেদ পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকে । কিন্তু সে তার সবচেয়ে বিলাশবহুল বাড়ীটি গ্রামের বাড়িতেই বানিয়েছে ঠিক তার মায়ের কবরের সামনে ।প্রতি সপ্তাহেই সে এই বাড়িতে আসে মায়ের সাথে একান্ত আলাপে, মায়ের উষ্ণতা পেতে ।
শাহেদের সন্তানগুলো এখন স্কুলে পড়ে । সে তাদের প্রায় সময় স্কুল থেকে নিয়ে আসতে যায় । ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে শাহেদ তার সন্তানদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফেরে । সে তার সন্তানদের পখর রৌদের স্বাদ দেয় । রাস্তার পাশে বাস করা মানুষগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, সন্তানদের দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করায় । অবহেলিত শিশুদের সাথে তাদেরকে নিয়ে খেলে, ওদের খাওয়া দেয়, ভরন পোষনের জন্য টাকা দেয়, স্কুলে পড়ার খরচ দেয় ।এইভাবে সন্তানদের নিয়ে মজা করতে করতে শাহেদ বাসায় ফেরে। শাহেদ ডজনখানেক এতিমখানাও চালায় সবগুলোর নামই মায়ের নামে রেখেছেন ।সেগুলোতে শাহেদ বৌ সন্তানদের নিয়ে সময় কাটাতে যান। ওদের সাথে খেলাধুলা করেন, একসাথে খাওয়া-দাওয়া করেন, সন্ধ্যাজুড়ে গল্প করেন । শাহেদের সন্তানগুলো অনেক মজা করে এই এতিমখানাগুলোতে এসে । শাহেদ তাদের দেখে মনে মনে ভাবে এর থেকে কি বেশী বিনোদন পৃথিবীর আর কোথাও আছে ?
শাহেদের বৌ মাঝে মাঝে এইসব নিয়ে তার সাথে চিল্লাচিল্লি করে । তবে সন্তানরা তখন তার পক্ষ নিয়ে মায়ের সাথে ফাইট করে । তারা মাকে বলে আমাদের এইসব করতে অনেক ভালো লাগে, তুমি আব্বুকে বকা দাও কেন, তুমি একটা পঁচা । তখন শাহেদ চোখে পানি নিয়ে তার বৌয়ের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকে আর গায়ে তার চিরচেনা উষ্ণতা অনুভব করে….