somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভয়নীচ ম্যানিউসক্রিপ্টঃপৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় পাণ্ডুলিপি।

০৬ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ১০:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি-
মধ্য ইউরোপের কোথাও ১৫ শতকের শেষদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় একটি পাণ্ডুলিপি লেখা হয়।১৯১২ সালে পুরানো বই বিক্রেতা উইলফ্রেড এম,ভয়নীচ এই হাতে লেখা পান্ডলিপিটির মালিক হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে এটি বড় ধরনের আলোচনায় আসে এবং এটি ভয়নীচ ম্যানিউসক্রিপ্ট নামে পরিচিত লাভ করে।এখন পর্যন্ত বইটিতে লাল,নীল,বাদামী,হলুদ ও সবুজ রং এ আকা মানুষ,উদ্ভিদ ও গ্রহ নক্ষত্রের আকা ছবির তাৎপর্য এবং এর বিচিত্র অক্ষরসমূহর সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া কারো পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি।এই পাণ্ডুলিপির অক্ষরের সাথে পৃথিবীর আর কোনও বর্ণের পরিপূর্ণ কোনও মিলও খুঁজে পাওয়া যায় নি।

ক্যালিগ্রাফির আদলে লেখা মধ্যযুগীয় এই পাণ্ডুলিপি হয়ত কোনও সংকেতলিপি অথবা এমন ও হতে পারে কোনও চতুর লোকের অযথা ধাঁধা সৃষ্টির প্রয়াস।ছোট এই পাণ্ডুলিপির আকার ৭ বাই দশ ইঞ্চি।বর্তমানে যদিও ২৪৬ টি পৃষ্ঠার অস্তিত্ব আছে পাণ্ডুলিপিটির কিন্তু গবেষকদের ধারনা লেখার সময় পান্ডলিপিটির মোট ২৭২টি পৃষ্ঠা ছিল। কারণ পাণ্ডুলিপিটির পৃষ্ঠা নাম্বারে ফাঁক আছে শুধু তাই নয় বর্তমানে পাণ্ডুলিপিটির পৃষ্ঠা যেভাবে সাজানো আছে তা যে সময় পাণ্ডুলিপিটি লেখা হয়েছিল তার সাথে যে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় তারও অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। ধারাবাহিকতার এই অভাব পাণ্ডুলিপিটির ব্যাখ্যা উদঘাটনে সমস্যা আরও বাড়িয়েছে।
পাণ্ডুলিপিটি মূলত বেঢপ আকৃতিতে আকা অচেনা গাছ (যা সম্ভবত হার্বাল রেসিপি বুঝাতে আকা হয়েছে),বাথটাবে আনন্দরত বেটে নগ্ন মহিলা, রহস্যময় মানচিত্র যাতে মাইক্রোস্কোপ দ্বারা দেখা যাওয়া কোষ ও অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজেক্ট এবং রাশিচক্র ভিত্তিক কেলেন্ডার এর উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে।
পাণ্ডুলিপিটির ফটোকপি অজস্র কোডব্রেকার পরীক্ষা করেছেন। সংকেতলিপি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা তারা বরাবরই করে আসলেও লাভ হয়নি কিছুই। মাঝে মাঝে যদিও অনেকেই দাবি করেছে এটি তারা পড়তে সক্ষম হয়েছেন কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে পাণ্ডুলিপিটির সম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণ অনুবাদ কেউ আজ অবধি করতে পারেন নি।

ইতিহাস-
পাণ্ডুলিপিটির রচয়িতা বা সময়কাল সম্পর্কে নিশ্চিত জানা না গেলেও বেশ কিছু ধারনা পাওয়া গেছে এর রচনার সময় নিয়ে। পাণ্ডুলিপিটি বর্তমানে সংরক্ষিত আছে ইয়েল ইউনিভার্সিটির বায়েনিক লাইব্রেরীতে।এইচ,পি ক্রাস নামে এক অ্যান্টিক সংগ্রহকারী ১৯৬১ সালে এটি ভয়নীচ এর মেয়ের বান্ধবী অ্যান নিল এর কাছ থেকে ২৪৫০০ ডলারে কিনেন। পরবর্তীতে তিনি তার চাহিদামত দাম না পেয়ে ১৯৬৯ সালে পাণ্ডুলিপিটি ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে দান করে দিয়ে যান।পাণ্ডুলিপিটির দলিল পত্র ঘেঁটে যা জানা যায় তা হল বোহেমিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফ(১৫৫২-১৬১২) এই পাণ্ডুলিপিটি একজন অচেনা ব্যক্তির কাছ থেকে ৩০০শত স্বর্ণমুদ্রার বিনিময় কিনেন।১৬০৮ সালের পর পাণ্ডুলিপিটি সম্রাটের বোটানিক্যাল গার্ডেন এর পরিচালক জেকবস দে টিপেয এর কাছে সংরক্ষিত ছিল।সম্রাটের কাছে এই পাণ্ডুলিপিটির থাকার কথা জানিয়ে প্রাগ ইউনিভার্সিটির রেক্টর জোহানেস মার্কাস মার্চি ১৬৬৫ সালের ১৯ আগস্ট চিটি লেখেন যিশুট স্কলার অ্যাথেনেসিয়াস কারকার এর কাছে।তিনি পত্রে পাণ্ডুলিপিটি সম্পর্কে তাদের ধারনা বলেন এবং উনার মতামত জানতে চান এবং পত্রের সাথে পাণ্ডুলিপিটিও কারকার এর কাছে পাঠান।
পাণ্ডুলিপিটির সাথে থাকা একটি কাগজ যা ভয়নীচ এই পাণ্ডুলিপিটি কেনার সময়ও সংযুক্ত ছিল যা থেকে জানা যায় এটি একসময় জেসাস সোসাইটির ২২তম জেনারেল পেট্রাস বেক এস.জে.(১৭৯৫-১৮৮৭) এর ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে ছিল। তার পর থেকে ১৯১২ সালে ভয়নীচ এটি কেনার আগ পর্যন্ত পাণ্ডুলিপিটি কোথায় ছিল তার সুস্পষ্ট কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে ধারনা করা এর পর থেকে এটি বেশ কিছু লাইব্রেরী ঘুরে অবশেষে ইটালির রোম এর নিকটবর্তী ভিলা মনড্রাগন এ ছিল।

আকার ও বিষয়বস্তু-

পাণ্ডুলিপিটি ৬ বাই ৯ ইঞ্চি আকারের বাছুরের চামড়ার উপর লেখা। মোট যে ২৪৬ টি পৃষ্ঠা বর্তমানে আছে তার মধ্যে ২১২টি পৃষ্ঠাই ছবি আর লেখা সংবলিত ৩৩টি পৃষ্ঠা শুধু লেখা এবং শেষ পৃষ্ঠাটি নির্দেশিকা সংবলিত।
এটি লেখা হয়েছে বাম দিক থেকে এবং ডান পাশে হালকা মার্জিন ব্যবহারও করা হয়েছে।পাণ্ডুলিপিটি স্পষ্টত ৫টি ভাগে বিভক্ত। যার মধ্যে প্রথমটি ১৩০ পৃষ্ঠা ব্যাপী।

এই অংশের নামকরণ করা হয়েছে বোটানিক্যাল ডিভিশন নামে।যার প্রত্যেক পৃষ্ঠায় এক বা একাধিক অচেনা উদ্ভিদ এর ছবি আকা হয়েছে এবং সাথে লেখা আছে।২৬ পৃষ্ঠা ব্যাপী দ্বিতীয় অংশকে ডাকা হয় অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইন নেচার নামে।এই অংশে লেখার সাথে একাধিক বৃত্তাকার ডায়াগ্রাম আছে।

যেগুলো সূর্য, তারা ও চাঁদ সংক্রান্ত।১২টি রাশিচক্র নিয়ে রয়েছে একটি চিত্র। এর মধ্যে একটি চিত্র খুবই আকর্ষক। যাতে সমকেন্দ্রে দাঁড়ানো ৩০ জন নগ্ন মহিলার ছবি আকা আছে। যাদের একজনের হাত আরেকজনের হাতে ধরা এবং তারা একটি তারার সাথে সংযুক্ত।৪ পৃষ্ঠা ব্যাপী তৃতীয় অংশকে ডাকা হয় বায়োলজিক্যাল ইন ন্যাচার নামে।

এই অংশে লেখার সাথে একাধিক ছোট পুল ও টিউবে স্লানরত নগ্ন মহিলার(যাদের কারো কারো মাথায় মুকুট পরিহিত) ছবি আকা হয়েছে যেগুলো একটি আরেকটির সাথে নলের মাধ্যমে সংযুক্ত।৩৪ পৃষ্ঠা ব্যাপী চতুর্থ অংশকে ডাকা হয় ফার্মাসিউটিক্যাল ইন নেচার নামে।এই অংশে লেখার সাথে একাধিক গাছের ছবি ও গাছের পাতা এবং শিকড়ের ছবি আকা হয়েছে।২৩ পৃষ্ঠা ব্যাপী পঞ্চম অংশ যা ছোট ছোট প্যারায় লেখা এই অংশকে ডাকা হয় বিগেনিং উইথ এ স্টার নামে।এর একটি অংশে আকা আছে ৯টি দ্বীপ,কেল্লা,উঁচু রাস্থা এবং আগ্নেয়গিরির ছবি। এই অংশর একটি ভাগকে রেসিপি বলে ধরা হয়। ছোট প্যারাগুলোর প্রত্যেকটি শুরু হয়েছে ফুল এর ছবি দিয়ে।

কার লেখা?-
বোহেমিয়ার সম্রাট ও তার কিছু সভাসদদের ধারনা ছিল পাণ্ডুলিপিটি বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক রজার বেকন এর লেখা। আবার কারো ধারনা ছিল এটি প্রাগ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বিখ্যাত অ্যাস্ট্রলজার ও গণিতবিদ জন ডি’র লেখা।যিনি এই পাণ্ডুলিপিটি সম্রাটের হাতে আসার দুই বছর আগে প্রাগে যোগদান করেন এবং তিনি রজার বেকন এর উপর লেকচার দিতেন।
কেউ কেউ মনে করেন এটি ষোড়শ শতকের ইংরেজ লেখক এন্থনি অ্যাশাম এর লেখা যিনি হার্বাল মেডিসিন সম্পর্কে ভাল ধারনা রাখতেন।ইটালিয়ার স্থপতি অ্যান্থনিও এভারলিনো এটির লেখক এমনটিও দাবি করা হয়। কিছু গবেষক পান্ডুলিপিতে আকা কিছু ছবির নীচে সাক্ষর থেকে ধারনা করেন যে এই পাণ্ডুলিপির সাথে বিখ্যাত চিত্রকর লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি জড়িত ছিলেন।

বেশ কিছু ছবির নীচে লিওনার্দো নামটি লেখা আছে।
এটি অবশ্য একটি বড় ধাঁধা। কারণ যেখানে পাণ্ডুলিপিতে কোন শব্দই স্পষ্ট বুঝার উপায় নেই সেখানে বেশ কিছু ছবির নীচে লিওনার্দো সাক্ষরটি বুঝা যায়। অনেকেই দাবি করেন এই পাণ্ডুলিপির লেখার সাথে পূর্ব এশিয়ান ভাষার( থাই,চাইনা,ভিয়েতনাম) বেশ মিল পাওয়া যায় তাই এই পান্ডলিপির লেখক পূর্ব এশিয়ান কেউ হতে পারেন যিনি মিশনারি সংস্থার সাথে এসে ইউরোপে বসবাস করতেন

কোন ভাষায় লেখা?-
এটি একটি বর্নমালাভিত্তিক সংকেতলিপি তাতে কোনও সন্দেহ নেই তবে আমাদের জানা কোনও
বর্ণমালার সাথে এর কোনও মিল নাই। ইউরোপিয়ান বা ইংরেজি কোনও লেটার সিস্টেম এর সাথে এর হুবহু সামঞ্জস্য নেই।পরীক্ষা করে দেখা গেছে পাণ্ডুলিপিটি দুটি ভিন্ন ভাষায় লিখিত এবং একের অধিক লেখক লিখেছেন। এটিতে সংশোধন এর খুব একটা চিহ্ন নাই এর ফলে এটা ধরা যায় পাণ্ডুলিপিটি আগেই খসড়া করেছিল লেখকদ্বয়।
পাণ্ডুলিপিটির লিখিত ভাষার সাথে কিছু প্রাকৃতিক ভাষা যেমন ল্যাটিন,চায়না,জার্মান,হিব্রু,আরবি ভাষার গঠনের সাথে কিছু মিল আছে।আবার কিছু অপ ও কৃত্রিম ভাষার সাথেও মিল পড়ে। আবার কিছুটা সাদৃশ্যটা আছে বিভিন্ন কৃত্রিম সংকেতলিপির সাথে।
এতগুলো ভাষার মধ্যে কোনোটির সাথেই আবার হুবহু কোনও মিল পাওয়া যায় না। যার ফলে পুরো ব্যাপারটিই আরও গোলমেলে ঠেকেছে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কোনও প্রাকৃতিক ভাষার সাথেই এর পুরোপুরি মিল কেউ বের করতে পারেননি তবে এই পাণ্ডুলিপির সাথে প্রাকৃতিক ভাষার মধ্যে সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ চীনের মাঞ্চু ভাষা বলে দাবি করেন পোল্যান্ড এর গবেষক ইসবিনিউ বেনাসেক।উল্লেখযোগ্য একটি ব্যাপার হলও ষোড়শ শতকের শেষ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপজুড়ে যে সকল সংকেতলিপি লেখা হয়েছিল তার সবগুলোই প্রভাবিত ছিল স্পনহ্যাম এর বিশপ জোহানেস ট্রেথমিয়াস এর লেখা “দি স্টিনগ্রাফিকা” দ্বারা কিন্তু ভয়নীচ পাণ্ডুলিপিটির সাথে জোহানেস এর আবিষ্কৃত কোড এর কোনও মিল সাদৃশ্যমান নয়।
কিছু গবেষক এর ধারনা এই বই এর ভাষা গ্লসসোলেলিয়া। যা খ্রিস্ট ধর্মীয় যাজকরা সম্মোহন সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন এই দাবি যদি আসলেই সত্যি হয় তাহলে ধরে নেওয়া যায় এই বই এ যা লেখা আছে তার পুরোটাই অর্থহীন। আবার কিছু গবেষক এর ধারনা এটি মিডল ডাচ ওল্ড ফ্রেঞ্চ ও ওল্ড হাই জার্মান ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি একধরনের হাইব্রিড পরবর্তীতে বিখ্যাত ক্রিপ্টোলজিস্ট ডব্লিউ ফ্রিডম্যান ও জে টিল্টম্যান পান্ডুলিপিটি পরীক্ষা করে জানান
সংকেতলিপিটি অক্ষর ভিত্তিক একটি নির্মাণাধীন আর্টিফিশিয়াল ভাষায় লেখা হয়েছিল।যার সাথে দ্বাদশ শতকে হিলডিগার্ড অব বিনেন এর লেখা আর্টিফিশিয়াল ল্যাংগুয়েজ “লিঙ্গুয়া ইগনটার” সাথে সামান্য কিছু মিল পাওয়া যায়। তিনি আরও জানান এটি পলিআলাফাব্যাটিক সংকেতলিপি। এবং একে আরও দুর্বোধ্য করার জন্য স্বরবর্ণ পরিহার করা হয়েছে। ল্যাংগুয়েজ। সাধারণত এ ধরনের ভাষার শব্দভাণ্ডার একটি ক্যাটাগরিতে সাজানো থাকে। কিন্তু তা এই পাণ্ডুলিপিতে নেই। ফ্রিডম্যান এর সাথে এই পান্ডলিপির ব্যাপারে যোগাযোগ ছিল ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর থিওডোর পিটারসেন এর। এবং এদের অনুবাদ চেষ্টার নমুনা অনলাইনে পাওয়াও যায়।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য দাবি করা হয় এটি একটি প্রতিকল্পিত সংকেতলিপি যার অল্প কিছু শব্দর পাঠোদ্ধার তারা করতে পেরেছেন।
যাই হোক সকলের চেষ্টায় পাণ্ডুলিপিটি বিশ্লেষণ করে যা পাওয়া গেল তার সারমর্ম হল-
*লেখার বাক্যবিন্যাস যেকোনো ইউরোপিয়ান ভাষার চেয়ে অনেক নীচুমানের।
*লেখাটি “জিফস ল অব ওয়ার্ড ফ্রিকোয়েন্সির” প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে লেখা।
*শব্দের দৈর্ঘ্য ল্যাটিন শব্দের চেয়ে সামান্য ছোট।
*দুটি শব্দের মাঝে ফাকা স্থান যেটুকু রাখা আছে তা যেকোনো নেচারেল ভাষায় লেখাতে ব্যবহৃত হয়।
*লেখাটি দুইটি ভিন্ন ভাষায়(যার পার্থক্য খুবই কম) এবং কমপক্ষে দুজন লেখকের লেখার চিহ্ন রয়েছে।
*লেখায় সংশোধনের চিহ্ন খুবই কম,বলতে গেলে নাইই।এবং যতিচিহ্নের ব্যবহার নাই।
*লেখকদ্বয় শব্দ গঠনে ছিলেন অনমনীয়।
*একই লাইনে একই শব্দ একাধিকার ব্যবহারের নমুনা অহরহ পাওয়া যায়। এবং কখনো কখনো তা একই লাইনে তিনবার পর্যন্ত।
*নির্দেশিকায় ব্যবহৃত কিছু অক্ষর পাণ্ডুলিপিটির আর কোথাও দেখা যায় না।

পাঠোদ্ধার-
১৯১২ সালের পর পাণ্ডুলিপিটি যখন আবার আলোচনায় আসল তখন থেকে একাধিক ক্রিপ্টোলজিস্ট পান্ডলিপির লেখা উদ্ধারে কাজে লেগে যান। প্রথম অনেকেই ভেবেছিল যেহেতু এটি অক্ষর ভিত্তিক কোড ল্যাংগুয়েজ তাই এর অনুবাদ বেশ সহজেই হয়ে যাবে। কিন্তু পরে দেখা গেল ল্যাটিন,ইংরেজি,জার্মান বা অন্য কোনও ইউরোপিয়ান ভাষাতেই এই পাণ্ডুলিপির রূপান্তর করা সম্ভব না।
যাই হোক প্রথম সমাধান এর কথা দাবি করেন ফিলসফির অধ্যাপক উইলিয়াম রোমেনি নিউবোল্ড।ভদ্রলোক ১৯১৯ সালে জানান তিনি পাণ্ডুলিপি অনুবাদ করতে সক্ষম হয়েছেন।তার মতে লেখাটি হল মাইক্রোগ্রাফি। এধরনের লেখার বৈশিষ্ট্য হল খালি চোখে অক্ষরগুলো অর্থহীন মনে হলেও ম্যাগনিফাই গ্লাস এর দ্বারা দেখলে প্রত্যেকটি অক্ষর মিলে আলাদা একটি সিরিজ হয়।মাইক্রোগ্রাফি মূলত প্রাচীন গ্রিক শর্ট হ্যান্ড এর একটি কৌশল।যদিও এই পাণ্ডুলিপির ব্যাপারে নিউবোল্ড এর এই দাবি ভুল বলে উড়িয়ে দেন শিকাগো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জন ম্যানলি।যাই হোক নিউবোল্ড এর সারমর্ম অনুযায়ী পাণ্ডুলিপিটি রজার বেকন এরই লেখা। এবং পাণ্ডুলিপিটির বায়োলজিক্যাল অধ্যায়ে সেমেনিফেরাস টিউবস,মাইক্রোস্কপিক কোষ,নিউক্লিয়াস ও স্পার্মাটোজোআ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অংশে ছায়াপথ,সূর্যগ্রহণ, এবং ধূমকেতু নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির শঙ্কিল গঠন এর সচিত্র বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যদিও আধুনিক টেলিস্কোপ আবিষ্কারের আগে এটি দেখার কথা কারো নয়।
তবে একটি ব্যাপার খুব রহস্যময় এই পাণ্ডুলিপিতে আকা বেশ কিছু গাছের ছবি যেগুলোর অস্তিত্ব ইউরোপে না থাকলেও পরে ঠিকই অন্যান্য মহাদেশে আবিষ্কৃত হয়েছে।
বায়োলজিক্যাল অংশে আকা বেসিন ও টিউব দেখে ধারনা করা হয় এই অংশের সাথে আলকেমির যোগসূত্র আছে। বোটানিক্যাল অংশটি যদি হার্বাল মেডিসিন নিয়ে আলোচনা করা হয় তবে এই দাবি সত্য বলে মেনে নেওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে সমস্যা হল মধ্যযুগে আলকেমিক্যাল বই এর সাথে এই পান্ডলিপিতে আকা চিত্রের কোনও মিল নাই।
১৯৩১ সালে মিসেস ভয়নীচ ওয়াশিংটনের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটিতে পাণ্ডুলিপিটির ফটোকপি নিয়ে যান। সেখানে প্রফেসর থিওডোর পিটারসেন দীর্ঘ চারবছর ধরে এটির অনুবাদে কাজ করেন। তিনি দাবি করেন বেশ কিছু শব্দর অর্থ উদ্ধারে তিনি সক্ষম হয়েছেন। যদিও পরবর্তীতে তার কাছ থেকে এ ব্যাপারে আর কোনও অগ্রগতির কথা শুনা যায় নি।
সাম্প্রতিককালে এই পাণ্ডুলিপির রহস্য উদ্ধারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য হল এখানে আকা ১২৬টি উদ্ভিদের মাঝে ১২৪টিই সনাক্ত করা হয়েছে। অবশ্য পাণ্ডুলিপিতে আকা প্রায় সব ছবিগুলো বিকৃত করে আকা। অনেক ছবিই পাতা হয়ত এক প্রজাতির ফুল আরেক প্রজাতির আবার শিকড়ের ছবিই আরেক প্রজাতির উদ্ভিদ এর। যা আনাড়ি শিল্পীর কাজ হিসাবে ধরে নেওয়ার চেয়ে শিল্পী গাছগুলোর পরিচয় সহজে দিতে চাননি বলাটাই যুক্তিসংগত হবে।
১৯৪৪ সালে বিখ্যাত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হিউ ও নিয়েল জানান এই পাণ্ডুলিপিতে আকা কিছু গাছের মধ্যে আমেরিকায় জন্মায় এমন একধরনের সূর্যমুখী ও লাল মরিচের গাছ রয়েছে। এই আবিষ্কারের ফলে একটি ব্যাপার পরিষ্কার হয় যদি পাণ্ডুলিপিটি কোনও ইউরোপিয়ান লেখে থাকেন তবে তা ১৪৯৩ সালের পর যখন কলম্বাস আমেরিকা থেকে ফিরে আসেন তারপর লেখা ও আকা হয়েছে।অবশ্য এই পাণ্ডুলিপি আকা অনেক গাছই ইউরোপিয়ান না। ৩২ নং ফলিও তে আকা একটি ফুল গাছ(স্কাই ফ্লাওয়ার) যা পরে পাওয়া গেছে ইন্ডিয়াতে।৩আর ফলিওতে আকা ফেঁদোরই অ্যামরেন্ত একটি আগাছা জাতীয় গুল্ম যা আফ্রিকাতে পাওয়া যায়।ফলিও ১১ ভি তে আকা আছে সাউথ এশিয়ায় জন্মায় এমন প্রজাতির একটি হলুদ গাছের ছবি।১৩ আর এ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে জন্মায় এমন একটি কলা গাছ। এছাড়াও একাধিক উদ্ভিদ এর ছবি আকা আছে যা ইউরোপে ঐ সময় ছিল না।
১৯৯০ সাল থেকেই ইন্টারনেটভিত্তিক একাধিক সংকেতলিপি বিশেষজ্ঞ এই পাণ্ডুলিপির মেশিন রিডেবল অনুবাদ ও লেখাটিতে বর্ণিত বিষয় নিয়ে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ফলাফল এখনো পাওয়া যায় নি।

তবে একটি ব্যাপারে তারা নিশ্চিত পান্ডলিপিতে আকা ছায়াপথটি আমাদের মিল্ক ওয়ে গ্যালাক্সির। যদিও পাশাপাশি অবস্থানে ইমেজ দুটিতে খুব সামান্য কিছু পার্থক্য দেখা যায় তবে তা উপেক্ষা যোগ্য।

শেষকথা-
লেখা ও অন্যান্য বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য কোনও সমাধান না পেয়ে অনেকেই দাবি করেন এই পাণ্ডুলিপিটি একটি ধাপ্পাবাজি। হয় এই নিছক ছলনাটি করা হয়েছিল পনের শতকে কোনও ধূর্ত ব্যাকটি যে কিনা সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফ এর বিচিত্র বস্তুর প্রতি আকর্ষণ জানত এবং সম্রাটের কাছে চড়া দামে বেচার জন্য এমন উদ্ভট কাজ করেছিল অথবা ভয়নীচ নিজেই আলোচনায় আসা ও চড়া দামে বেচার জন্য এ কাজটি করেছিল।
যদিও পরে অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটি ২০০৯ সালে পান্ডলিপিটির কার্বন ডেটিং টেস্ট করে জানায় এই পাণ্ডুলিপিতে ব্যবহৃত চামড়া ১৪০৪-১৪৩৮ সালের মধ্যে তৈরি হয়েছিল।শিকাগোর ম্যাক্রন রিসার্চ ইন্সটিটিউট কালি পরীক্ষা করে নিশ্চিত করে পাণ্ডুলিপিটি চামড়াটি তৈরি করার অল্প কিছুসময় পরেই লেখা হয়েছিল। তাছাড়া পাণ্ডুলিপিটির ইতিহাস এর সাথে থাকা চিটি ভয়নীচ এর জালিয়াতির দাবিটিকে পুরো ভিত্তিহীন প্রমাণ করে।আর আগের জালিয়াতির বিরুদ্ধেও শক্ত প্রমাণ দাড় করা যায়। কারণ পান্ডলিপিতে থাকা শব্দ ভাণ্ডার বেশ কিছু প্রাকৃতিক ভাষার সাথে সাদৃশ্যমান তাছাড়া এই পাণ্ডুলিপিটি জিফস ল মেনে চলে যা কোনও হোকস ল্যাংগুয়েজের মেনে চলার কথা নয়।

সূত্র-ইন্টারনেট।
৪৭টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×