২০২২ সাল বিশ্ব অনেক এগিয়ে। বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তি হাজির হচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের দ্বার গোড়ায় । এখন আর ট্রানজিস্টার অর্থাৎ রেডিওর সামনে বসে বিবিসি বা ভয়েজ অফ আমেরিকার খবরের জন্য কাউকে অপেক্ষা করতে হয় না। সোস্যাল মিডিয়া এই যুগে মুহুর্তে ই সব ঘটনা ছড়িয়ে পরছে বিশ্বের আনাচে কানাচে। অথচ এই সময়ে ও আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে থাকা মনুষেরা আমাদের বোকা ভাবে! সত্যিকারেই কি আমরা তেমন যেমনটি তারা আমাদের ভাবেন ? আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও রাষ্ট্র পরিচালকরা আমাদের সাধারন মানুষদের বোকা ভাবলে ও আমরা ততোটা বোকা না। হয়তো আমদের সাধারন জনগনের অনেকেই বোকার ভান ধরে আছে। আবার কেউ বোকা সেজে নিজের আখের ঠিক ই গুছিয়ে নিয়েছেন ও নিচ্ছেন । এবার প্রসঙ্গে আসি কেন আমাদের বোকা ভাবেন তারা? গত বেশ কয়েক মাস যাবত নানান কারনে অস্থির আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তা বাদী দল অর্থাৎ বিএনপি দীর্ঘদিন রাজনৈতিক ময়দানে নিশ্চুপ অবস্হানে ছিল। গত কয়েক মাস যাবৎ তারা রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের শক্ত সক্রিয় অবস্হানের জানান দিচ্ছপন ইতোমধ্যে তাদের দলীয় নেতা কর্মী সমর্থক সহ সাধারন মানুষের ও সমর্থন পেয়েছেন। বিএনপির এই রাজনৈতিক আন্দোলনে সাধারন মানুষের সমর্থনের বেশ কিছু বিশেষ কারন রয়েছে। অবশ্যই সেই বিশেষ কারন গুলি আমার দৃষ্টিতে আমি বিশ্লেষণের চেষ্টা করবো। তা হয়তো অধিকাংশ সাধারন মানুষের মতের সাথে মিলবে বলে ই আমার বিশ্বাস। বর্তমান আওয়ামী জোট সরকারের প্রতি অধিকাংশ সাধারন মানুষের অসন্তোষের জন্ম নেয় ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মধ্য থেকে। যদি ও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন ছিল এর ই পূর্ববর্তী ধারা। তারপর ও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে যেহেতু বিএনপি সহ তাদের জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন নাই তাই ঐ নির্বাচনকে সাধারন মানুষ ততোটা বাঁকা চোখে দেখছে বলে আমার মনে হয় না। তার মধ্যে ঐ সময় বিএনপি নির্বাচন নিয়ে কোন সমঝোতার চেষ্টা না করে একটি অস্বাভাবিক আন্দোলনের ডাক দিয়ে ছিল যা সাধারন মানুষের সমর্থন যোগাতে অনেকটা ই ব্যর্থ হয়েছিল। তবে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সাধারন মানুষের ভিতর একটা উৎসাহ জন্ম নিয়েছিল। আর সেই উৎসাহ নিয়ে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোট না দিতে পেরে বরং সরকার দলীয় কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে বাড়ী ফিরতে হয়েছে তখন থেকেই এই বৈরি মনোভাব অনেকটা জোরালো হয়। এর পর আর কোন উপ নির্বাচন বা স্হানীয় সরকার নির্বাচনে সাধারন মানুষ সুষ্ঠু ভাবে তাদের ভোট অধিকার প্রয়োগ করতে পারে নি বা করার আগ্রহ প্রকাশ ও করে নাই। কারন সাধারন মানুষ এখন নির্বাচন কে জনগন অর্থের অপচয় আর কোন কোন ক্ষেত্রে সরকার দলীয় নেতা কর্মীদের হানাহানি ছাড়া আর তেমন কিছুই ভাবতে পারে না। অথচ এই দেশের জনগন ই ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনামলে ১৯৭০ সনে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিয়ে আওয়ামিলীগ কে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ উভয় ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দেয়। আর সেই নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির নির্বাচন। অথচ আজ স্বাধীন বাংলাদেশে ও নির্বাচনের নামে শুধুই আমরা দেখছি প্রহসন যার সর্বশেষ নজির ছিল গাইবান্ধা - ৫ আসনের স্থগিত হওয়া উপ নির্বাচন।
আমি আগেই বলেছি বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি দীর্ঘদিন রাজনৈতিক ময়দানে নিশ্চুপ ছিলেন । জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসতেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় সেই লক্ষ্যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দাবীতে বিএনপি সহ অনেক রাজনৈতিক দল ই মাঠে। তবে বিএনপি ইতোমধ্যে রাজনৈতিক ময়দান বেশ উত্তপ্ত করতে পেরেছে। বিভিন্ন সমাবেশের সাথে সাথে দেশের সকল বিভাগীয় শহরে তারা সমাবেশের আয়োজনের ঘোথনা দিয়ে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগে অকল্পনিয় জনগনের উপস্থিতিতে সুশৃঙ্খল সমাবেশ করে রাজনৈতিক ময়দানে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। আমি বিএনপির সমাবেশে বিপুল জনমানুষের উপস্থিতির কারন বিশ্লেষণের আগে বিএনপির সমাবেশ উপলক্ষে আমরা সাধারন জনগন যে গন ভোগান্তির শিকার হয়েছি তা নিয়ে একটু বলতে চাই। ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহ শহরের পলিটেকনিক মাঠে বিএনপির ময়মনসিংহ বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। যদি ও নয় দিন আগে আবেদন করেও ময়মনসিংহে বিভাগীয় সমাবেশের জন্য সার্কিট হাউস মাঠের অনুমতি পায় নাই বিএনপি। শেষ মুহূর্তে সমাবেশের জন্য মিলে শহরের পলিটেকনিক মাঠে। এই সমাবেশে বিএনপির নেতাকর্মী আগমন ঠেকাতে রাত থেকে জেলার ভেতর ও জেলা থেকে বাইরে গন পরিবহন যাওয়া-আসা বন্ধ করে দেয় মোটরযান মালিক বাস মালিক সমিতি। তাদের দাবী, " নিরাপত্তার শঙ্কায় গণপরিবহন বন্ধ করা হয়েছে। " যদি ও বলার অপেক্ষা রাখেনা করা এই সকল সমিতির নেতৃত্বের স্হান দখল করে আছে আর কাদের খুশি করতে গন পরিবহন বন্ধ করে এই গন ভোগান্তি! বিএনপির সমাবেশে শেষে আমরা দেখলাম যে তাদের সমাবেশ ছিল খুবই সুশৃঙ্খল। তবে বিভিন্ন জেলা থেকে সভাস্থলে আসা বিএনপির নেতাকর্মীদের উপর সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা যেই ধরনের নির্যাতন ও বাঁধার সৃষ্টি করে যে সংঘাত সৃষ্টির পায়তারা করেছিল তা সত্যি নিন্দনীয়।
গত ২২ অক্টোবর ছিল বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সমাবেশ এই সমবেশে জাতি পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের এক নতুন অধ্যায় দেখলাম। খুলনা জেলা বাস-মিনিবাস-কোচ-মাইক্রোবাস মালিক সমিতি খুলনার বিএনপির সমাবেশের আগের দিন ২১ অক্টোবর থেকে হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সড়ক-মহাসড়কে অবৈধভাবে নসিমন, করিমন, মাহেন্দ্র, ইজিবাইক ও বিআরটিসির গাড়ি চলাচলের প্রতিবাদে দু’দিনের ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। আর ১০ দফা দাবিতে বাংলাদেশ লঞ্চ শ্রমিক সমিতির খুলনা শাখা যাত্রীবাহী লঞ্চে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট ডাকে। আমি আগেই বলেছি একুশ শতকে এসে কিন্তু আজ আর বাংলাদেশের মানুষ এতটা বোকা নয় যে তারা বাস লঞ্চের ধর্মঘটের উদ্দেশ্য বুঝবেন না। এর পর ও রাস্তায় রাস্তায় সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের শত বাঁধা ও নির্যাতন সহ্য করে ২২ অক্টোবর বিএনপির খুলনার সমাবেশ জনসমুদ্র পরিনত হয়। গত ২৯ অক্টোবরের বিএনপির রংপুর বিভাগের মহাসমাবেশে ও আগের তিন সমাবেশের বাহিরে ভিন্ন কিছুই হয় নাই । আগামী ৫ নভেম্বর বরিশালে বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সেই সমাবেশকে ঘিরে ও আগের দিন থেকে দুদিন বরিশালে গণপরিবহন বন্ধ রাখার ঘোষণা আগেই দিয়েছে বাস মালিক সমিতি। এবার একই সময়ে থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে বরিশাল জেলা মিশুক, বেবিট্যাক্সি, ট্যাক্সিকার ও সিএনজি চালক শ্রমিক ইউনিয়ন। থ্রি-হুইলার ধর্মঘটের কারণ হিসেবে সংগঠনটি জানিয়েছে, বাস মালিক গ্রুপ সড়কে থ্রি-হুইলার বন্ধের দাবিতে ডাকা ধর্মঘটের প্রতিবাদে তারা পাল্টা ধর্মঘট ডেকেছেন। পুর্বের দাবীতে হয়তো লঞ্চ মালিক শ্রমিকদের ও ধর্মঘটের ইচ্ছা হতে পারে বা হবে । বাস, লঞ্চ, থ্রী হুইলার বন্ধ হবে। তবে এই সকল প্রতিবন্ধকতা মোটে ও বিএনপির সমাবেশে জনসমাগম বন্ধ করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না । বরং আরো বাড়ার সম্ভবনা বপশি। কারন আমাদের দেশের সাধারন মানুষের মনে আবেগ ও কৌতূহল অনেক বেশি কাজ করে। তবে আতংকের বিষয় হলো ইতোমধ্যে বরিশালের সরকারি দল অর্থাৎ আওয়ামিলীগের নেতা কর্মীরা ঘোষনা দিয়েছে তারা ও বিএনপির সমাবেশের সময় মাঠে থাকবে। জানিনা কি উদ্দেশ্যে মাঠে থাকবেন তারা? আর আওয়ামিলীগ ও তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা কর্মীরা মাঠে থাকার ফলে ৫ নভেম্বর বিএনপির সমাবেশে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে তা হলে ঐ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দায় কে নিবে?
বিএনপির সমাবেশে জনসমাগম প্রতিহত করতে নানা ধরনের জন ভোগান্তি সাধারন মানুষ কিভাবে নিবে সেটা অবশ্যই ক্ষমতাসীনদের বুঝার কথা। বিএনপির সমাবেশে এমন জনস্রোত প্রবাহিত হবে তা হয়তো ক্ষমতাসীনরা কল্পনা ও করতে পারে নাই। সরকারের নানান ধরনের দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, দ্রব্য মুল্যের দাম অস্বর বৃদ্ধি সহ নানান কর্মকাণ্ডে এদেশের সাধারন মানুষের মনের ভিতর বর্তমান সরকারের প্রতি একটি সুপ্ত ক্ষোভের জন্ম নিয়েছে তা হয়তো এর আগে সরকরের কর্তাব্যক্তিরা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু যখন ই বিএনপির বিভিন্ন স্হানের সমাবেশ জনসমুদ্রে পরিনত হয়েছে তাতেই হয়তো তাদের টনক নড়েছে। তাই তারা আজ বিভিন্ন জায়গার সমাবেশে জনস্রোত ঠেকাতে বিভিন্ন ভাবে জন দুর্ভোগের ব্যবস্হা করছে। এতে যে হিতে বিপরীত মনোভাব জনমনে সৃষ্টি হচ্ছে তা হয়তো আমাদের ক্ষমতাসীনরা বুঝতে অনেকটাই ব্যর্থ।
গত ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে আওয়ামিলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদের বলেন, " মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সব শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ হারাতে পারবে না "। তার মানে তিনি বলতে চেয়েছেন ১৪ দল একত্রে থাকলে কেউ তাদের হারাতে পারবেনা। আমি জনাব ওবায়দুল কাদের বক্তব্য একটু বিশ্লেষণ করতে চাই। এখানে তিনি আমাদের সবচেয়ে দুর্বলতার জায়গায় মুক্তিযুদ্ধকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আমাদের মাহান মুক্তিযুদ্ধ কোন দল বা ব্যক্তির নিজস্ব সম্পদ বা অর্জন নয় এটা সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের অর্জন আমাদের অগ্রজদের আত্মত্যাগের ফসল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের মহান স্বাধীনতা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মুল উদ্দেশ্য ই ছিল একটি অবাধ গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কে প্রতিষ্ঠিত করা। যেখানে সাধারণ মানুষ পাবে তার ভাত ভোট ও কথা বলার অধিকার। বাংলাদেশ আওয়ামিলীগ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান কারী রাজনৈতিক দল। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলে ও সত্যি এই আওয়ামিলীগ ই ২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন ভাবে আমাদের ভোটের অধিকার আমাদের কথা বলার অধিকার প্রায় সংকুচিত করে ফেলেছে। যার এক মাত্র কারন ই হলো তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করা। তবে সকলের ই একটা কথা মনে রাখা উচিত ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে চিরস্থায়ী নয়। সেই দীর্ঘস্হায়ী ক্ষমতা যদি সাধারন জনগণের সম্মতিতে হয় তাতে কোন সমস্যা নয় কিন্থু সেখানে সাধারন মানুষের মতামত উপেক্ষিত হলে তখন জন্ম নেয় নানা প্রতিবন্ধকতা। বাংলাদেশ আওয়ামিলীগ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিশাল তাই বাংলাদেশ আওয়ামিলীগের কাছে এদেশের জনগনের আকাংখা ও অনেক কিন্তু বর্তমানে তারা দীর্ঘ ১৪ বছর একটানা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে কি সাধারন জনগনের সেই আকাংখা পুরন করতে পেরেছে? স্বাধীন অর্ধশতাব্দী পরে এসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে নিজেদের নুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবী করলেই হবে না। আমাদের মহান স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য কে বাস্তবায়ন করতে পালেই নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে দাবী করা সম্ভব নয় তো তা হবে আমাদের স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবমাননা ছাড়া আর কিছুই নয়।