বাংলাদেশের রাজনীতি সহ সমস্ত অঙ্গনে এই মুহুর্তে আলেচনার মুল বিষয় ই হলো বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি আর গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। যদি ও এই দুইটা ঘটনাই একই সুত্রে গাঁথা। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ভিসা নীতি প্রনয়ণ করেছেন। এই ভিসা নীতির মুল উদ্দেশ্য ই হলো আমাদের দেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমারা সাধারণ মানুষ যাতে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভাবে মত প্রকাশ অর্থাৎ ভোট দানের স্বাধীনতা। এর আগে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যা সহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আমাদের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং এর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে । অবশ্য ঐ নিষেধাজ্ঞার পরপর ই দেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড লক্ষণীয়ভাবে কমে আসলে ও আমাদের ভোটাধিকার সহ অন্যান অনেক বিষয় ই নির্ভর করছে সরকারের ইচ্ছের উপর।
পর পর গত দুইটি জাতীয় নির্বাচন সহ বিভিন্ন স্হানীয় সরকার নির্বাচন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্হাকে কোথায় নিয়ে দাড় করিছে তা প্রতিটি সুস্থ বিবেকবান মানুষের জানা। ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারী তৎকালীন বিএনপি সরকার একটি একতরফা বিবেক বর্জিত নির্বাচনের আয়োজন করে। ঐ নির্বাচনকে বিবেক বর্জিত বলার কারন হলো তার মাত্র বছর পাঁচেক আগে আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণের আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এর ই ফলশ্রুতিতে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ( বিএনপি ) । কিন্তু ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ আসনে উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আনেন তৎকালীন বিরোধীদল বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ। এর পর ১৯৯৬ সালে বিএনপি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করলে আওয়ামীলীগ সহ অন্যান অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ঐ নির্বাচন বর্জন করে। পরবর্তী কঠিন আন্দোলন ও রাজনৈতিক দলগুলির সমঝোতার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্হার মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামিলীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তার পর সব কিছু ঠিকঠাক চললে ও ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে দেশে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক অরাজক পরিস্হিতির দিকে ধাবিত হতে থাকে এর ফলশ্রুতিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন মোড় নিয়ে সেনাসমর্থিত একটি সরকার গঠিত হয়। এর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঐ সেনাসমর্থিত সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যেই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামিলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৬১ টি আসন নিয়ে একক ভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। আর মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাদের সেই ১৯৯৬ সালের দাবী এবং আমাদের নির্বাচন ব্যবস্হার একটি স্যাটেল ইস্যু নির্বাচন কালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্হা নিয়ে গড়িমসি শুরু হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সর্ম্পকিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেছে। তবে একই সাথে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন হতে পারে বলে ও মত দিয়েছেন। এর পরবর্তীতে দলীয় সরকারের অধীনে আমাদের দুইটি প্রহসনের জাতীয় নির্বাচন দেখতে হলো। যে নির্বাচন আমাদের গনতন্ত্র ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
এবার আসি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বাংলাদেশের জন্য প্রনোদিত নতুন ভিসা নীতি নিয়ে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি প্রনয়ণ করছে। এই ভিসা নীতি প্রনয়নের মুল উদ্দেশ্য ই হলো আমাদের দেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কে অবাধ সুষ্ঠু ও যোগ্য করা। আর যারা ই অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করবে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকাশিত ভিসা নীতির বিবৃতিতে সুস্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছেন কারা এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার মাধ্যে পরবে। যেমন ভুয়া ভোট প্রদান, ভোটার ও নির্বাচনী এজেন্টদের বাধা দান, নির্বাচনী সমাবেশ ও প্রচারনায় হামলা, গায়েবি মামলা প্রদান, নির্যাতন-নিপীড়ন, স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা দান ইত্যাদি কাজ সম্পাদনকারী ব্যক্তি ও তাদের পরিবার ই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে। এসব কাজে জড়িত থাকলে মন্ত্রী, এমপি, আমলা, পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনী, বিচার বিভাগ এমনকি বিরোধী দলের নেতা কর্মী সহ যে কেউ এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসতে পারে।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞায় আমাদের তেমন কি হবে? এই ভিসা নীতি আমাদের অনেককে উৎফুল্ল করলে ও একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য একটা লজ্জা ও দুঃখের বিষয়। এর আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির করার দায়ে নাইজেরিয়া, উগান্ডা, বেলারুশ, নিকারাগুয়া ও সোমালিয়াকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো মুখে আমরা গনতন্ত্র উন্নয়নের যত কিছু বলি না কেন শেষ পর্যন্ত বিশ্বের কাছে আমাদের ঠাই হলো উগান্ডা, নাইজেরিয়া মত দেশের কাতার। আমাদের তথাকথিত এলিট শ্রেণীর মানুষ সহ বিভিন্ন পার্যায়ের ব্যক্তিদের এই ভিসা নীতির কারনে কেউ উৎফুল্লিত কেউ বা চিন্তিত? তবে মার্কিন ভিসা নীতি আমাদের সাধারণ মানুষের আতংকের তেমন কারন না হলেও আমাদের কর্তাব্যক্তিদের অনেকের ই রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কারন তাদের অনেকেই আমাদের দেশ লুট করে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা আমেরিকার, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ সহ নানান উন্নত দেশে বেগম পাড়া বানিয়ে আয়েশি জীবন যাপন করছেন। তাদের সন্তানে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়ে ঐ সকল দেশে উচ্চ শিক্ষা ব্যবসা বানিজ্য কত কি ই না করেছেন। এখন যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নির্বাচনী অনিয়মের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা হলে সেই সম্পত্তি সন্তানদের ভবিষ্যৎ কি হবে এটাই তাদের মুল চিন্তা। আর আমাদের সাধারন মানুষের চিন্তার কারন হলো যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশ গুলি থেকেই আমাদের রপ্তানি আয় আসে সরচেয়ে বেশি সে ক্ষেত্রে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলি আমাদের সাথে ভিসা সহ বানিজ্যিক সম্পর্কে কড়াকড়ি পথ অবলম্বন করে তা হলে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্হার বারোটা নিশ্চিত বাজবে এই নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পর দিন অর্থাৎ ২৫ মে ছিল গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। সেখানে আলোচিত প্রার্থী ছিলেন আওয়ামীলীগের আজমত উল্লাহ খান আর সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। নির্বাচনী প্রচারের সময় আমরা প্রতিদিন ই দেখেছি আওয়ামিলীগের কর্মীদের দ্বারা জায়েদা খাতুনের প্রচারণা মিছিল বা সমাবেশে হামলা। এমনকি নির্বাচনে দিন শুরুতেই আমরা অনেক সংবাদমাধ্যমে দেখেছি অনেক কেন্দ্রে ই নাকি জায়েদা খাতুনের এজেন্ট ছিল না। কিন্তু অবশেষে গভীর রাতে ঘোষনা এলে হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনী লড়ায়ে জয় লাভ করেছেন জায়েদা খাতুন। যিনি একজন সহজ সরল গৃহিনী একজন সাধারন মা। অবশ্য জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন পত্র বতিলের কান্ড ও আমাদের খুবই পরিস্কার মনে আছে। তাই অনেকের মনেই প্রশ্ন নির্বাচন নিয়ে মার্কিন বতুন ভিসা নীতির কারনেই কি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফলের এমন অবস্হা? এর আগে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও বগুড়া- ৪ আসনের উপনির্বাচনের ঘটনা আমাদের স্মরণ আছে। বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনে গভীর রাতে মাত্র ৮৩৪ ভোটে নাকি পরজিত হন হিরো আলম। এর আগে ২০২২ সালে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে আওয়ামিলীগ প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতের কাছে পরাজিত হন সাবেক মেয়র ও স্বতন্ত্র প্রাথী মনিরুল হক সাক্কু। যদি ও কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সাক্কু সহ অধিকাংশ সাধারণ মানুষ ই নানা প্রশ্ন তুলেছেন। এখানে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন তুলবেন নির্বানে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে কি আওয়ামিলীগ প্রার্থী জয়ী হতে পারেন না? অবশ্যই পারেন এবং এই পারা টা ই স্বাভাবিক। তবে বিগত বছর গুলিতে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের অধীনে আমরা যেই নির্বাচন গুলি দেখেছি তাতে আমাদের সেই বিশ্বাসটা এখন একেবারে ই তলানিতে।
বাংলাদেশ আওয়ামিলীগ একটি গৌরবময় প্রাচীন রাজনৈতিক দল। এই দলের নেতৃত্বে ই আমাদের অগ্রজের ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়ে গেছেন। অথচ সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো এই আওয়ামীলীগের শাসনামলে ই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আজ প্রায় গনতন্ত্রহীন, মানুষের বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার সহ অনেকে মৌলিক অধিকার আজ ভুলন্ঠিত । স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন এমন দিনের জন্য ই কি আমাদের অগ্রজের নিজের জীবন উৎসর্গ করে আমাদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দিয়ে গেছেন? না মোটে ও না। আমরা যাতে একটি স্বাধীন গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারি এর জন্যই ছিল আমাদের অগ্রজদের আত্মত্যাগ। কোন রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ভয়ে নয় কারো স্বার্থ রক্ষার জন্য নয় এদের সাধারন মানুষের স্বার্থ রক্ষায় এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের রক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমাদের দেশে আগামী নির্বাচন একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে এটাই একজন নাগরিক হিসেবে প্রত্যাশা।