বিশ্বের অস্ত্র বাণিজ্যসংক্রান্ত শীর্ষস্থানীয় বিশ্লেষক আইএইচএস ইনকর্পোরেটেড এর জরিপ অনুযায়ী সৌদি আরব বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশের স্থান দখল করে নিয়েছে। গত বছর সৌদি আরবের অস্ত্র আমদানি বাবদ ব্যয় এক লাফে ৫৪ শতাংশ বেড়ে সাড়ে ছয়শ’ কোটি ডলার স্পর্শ করেছে! প্রতিবেদনটির বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আরো বলা হয়, অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে সৌদি আরবের নাটকীয় উন্নয়ন ঘটেছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছরে সৌদি অস্ত্র আমদানি ৫২ শতাংশ বেড়ে ৯৮০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে। এছাড়া বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অস্ত্র আমদানিকারক দেশের মধ্যে পাঁচটিই মধ্যপ্রাচ্যে বলে এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এতে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, আগামী এক দশকে মধ্যপ্রাচ্যে ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্রের বাজার তৈরি হবে। আর মধ্যপ্রাচ্যে এই অস্ত্র আমদানিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ।
আলকায়েদা, তালেবানের পর এবার মধ্যপ্রাচ্যে মুর্তমান আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইসলামি স্টেট বা আই এস। ইতিমধ্যেই তারা সিরিয়া এবং ইরাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজেদের দখলে নিয়ে কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং বর্বরতায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে সারা বিশ্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে স্থানীয় বাহিনী সেখানে ক্রমাগত লড়ে যাচ্ছে নিজ মাটি এবং জনগণকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে। তাদের ঘৃণিত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিনই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসূচী পালিত হচ্ছে। এ হচ্ছে পর্দার একপাশের চিত্র। অপর পাশের চিত্র দেখতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। আশির দশকে রুশ-আফগান যুদ্ধের সময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই. আফগানদেরকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন গণমাধ্যমের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ আমরা যে আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি কুড়ি বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমরাই তাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাদেরকে অর্থ যুগিয়েছি।’ [১ জুন ২০১৪, ফক্স নিউজ, সি.এন.এন]। ১৯৮০ থেকে ১৯৯৪ এই সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানে একটি সশস্ত্র বাহিনী তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৫৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর দ্য নিউইয়র্ক টাইমস অনলাইনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে আইএস গড়ে ওঠার পেছনে সিআইএর সহযোগিতার আভাস মেলে। সেখানে রয়েছে, আগ্রাসন চালানোর পথ সুগম করতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামের জঙ্গি সংগঠনটি গড়ে ওঠা-সংক্রান্ত সন্দেহ আরও জোরালো হয়েছে। যদিও আইএস দমনে ইরাকে অনবরত বিমান হামলা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকের উপপ্রধানমন্ত্রী বাহা আল আরাজি বলেন, ‘আমরা জানি, এটি কে তৈরি করেছে।’ আইএস দমনের অজুহাতে ইরাকে সম্ভাব্য মার্কিন সেনা মোতায়েনের যেকোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এক সমাবেশে হুঁশিয়ারি করেছেন দেশটির প্রভাবশালী শিয়া নেতা মুকতাদা আল সদর। তিনিও প্রকাশ্যে আইএস সৃষ্টির জন্য সিআইএকে দায়ী করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে এই সন্দেহ আছে। কোনো কোনো পশ্চিমা বিশ্লেষক মনে করছেন, ইরাকের পর এবার সিরিয়ায় আগ্রাসন চালাতে আইএসকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনভিত্তিক খ্যাতিমান ফ্রিল্যান্স লেখক মাইক হুইটনির মতে, জর্জ ডব্লিউ বুশের মতো মার্কিনিদের বিভ্রান্ত করতে যাচ্ছেন ওবামা। তিনি আইএস জঙ্গিদের দমনের কথা বলছেন। কিন্তু তাঁর মূল উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়। অঞ্চলটিতে নৈরাজ্য সৃষ্টি, বিদ্যমান সীমান্ত নিশ্চিহ্ন করা ও ক্রীড়নক সরকার বসাতে ওবামা প্রশাসন তৎপর। হুইটনির দাবি, আরেকটি রক্তক্ষয়ী আগ্রাসনের পথ সুগম করতেই মূলত পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের সহযোগীরা আইএসকে সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষক প্যাট্রিক মার্টিনের ভাষ্য, আইএস হলো মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের অজুহাত। গত মাসের ২৫ তারিখে রেডিও তেহরানের এক খবরে বলা হয়েছে, ইরাকের নিরাপত্তা বাহিনী ওয়াহাবি-তাকফিরি আইএসকে অস্ত্র সরবরাহ করতে আসা দু’টি ব্রিটিশ বিমান ধ্বংস করে দিয়েছে। বিমান ধ্বংসের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দেশটির সংসদের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কমিশনের প্রধান হাকাম আজ জামিলি। এলাকার জনগণের দাবি অনুযায়ী, মার্কিন ও ব্রিটিশ বিমানগুলো আইএস-এর জন্য প্রতিদিনই অস্ত্র পাঠায়। ইরাকের কর্মকর্তারা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, অজ্ঞাত কিছু বিমান আইএস-এর কাছে অস্ত্র পৌঁছে দেয়। এর আগেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে আইএস-এর জন্য মার্কিন বিমান থেকে অস্ত্রের বাক্স নিক্ষেপের কিছু ছবি প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দাবি করা হয়েছে, সিরিয়ার কোবানিতে ও ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চলে ইতিমধ্যে আইএসআইএল এর জন্য মার্কিন বিমান থেকে কমপক্ষে সাতবার অস্ত্রের চালান নিক্ষেপ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আইএস জঙ্গিদের মার্কিন ও তাদের মিত্র শক্তি যে নীরব সমর্থন যোগাচ্ছে তা স্পষ্ট। এমনকি সিরিয়ার তেল স্থাপনা দখলে নেয়ার পর আইএস জঙ্গিদের তেল বিক্রিকে পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহযোগিতা দিচ্ছে এবং অভিযোগ রয়েছে যে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে হটানোর কার্যকর অস্ত্র এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অস্ত্র ব্যবসার ভালো বাজার তৈরি করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্ররা আইএস জঙ্গিদের ব্যবহার করছে। পাশাপাশি জঙ্গিদের কাছ থেকে সিরিয়ার তেল নেয়ার মাধ্যমে আরো মজবুত করছে নিজেদের সামরিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি। একদিকে তারা আইএস জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে অপর দিকে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য ধনী দেশগুলোকে অস্ত্রের মজুদ বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করছে। আর তাদের উদ্ধুদ্ধ করার পেছনে তারা ব্যবহার করছে তাদের শক্তিশালি গণমাধ্যমকে। সৌদি আরবের নিরাপত্তা নিয়ে মার্কিন গণমাধ্যমের কিছু রিপোর্টেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে মার্কিন গণমাধ্যম ফক্স নিউজ বলছে, ইসলামিক স্টেট বা আইএস মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ সৌদি আরবে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আইএস যোদ্ধাদের কার্যক্রম নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান দ্য সার্চ ফর ইন্টারন্যাশনাল টেররিস্ট এন্টিটিস (এসআইটিই)-এর বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যমটি জানিয়েছে, আইএসের একটি অংশ সম্প্রতি একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যাতে সৌদি আরবে হামলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে বিদ্রোহী এ সংগঠনটি। সিরিয়া ও ইরাকের আইএস যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া সৌদি যোদ্ধারা ওই ভিডিওটি প্রকাশ করেছে। সেই সঙ্গে সৌদি আরবের ভেতরে তাদের (আইএস) যে শুভাকাক্সক্ষী রয়েছে তাদের প্রতি হামলায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে ওই ভিডিওতে। মার্কিনি বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমগুলো বলছে, আইএস মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সম্পদশালী দেশ সৌদি আরবে তাদের থাবা বিস্তার করতে চাচ্ছে। কারণ ঐতিহ্যগতভাবেই সৌদি আরব (মক্কা ও মদিনা) মুসলিম বিশ্বের পবিত্রতম স্থান। ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজের রিসার্চ ফেলো এবং ‘দ্য আদার সৌদিজ’ গ্রন্থের লেখক টবি ম্যাথিসেন বলেছেন, ‘ইসলামিক স্টেট মক্কা ও মদিনার দখল নিতে পারে এটি চিন্তা করা খুব কঠিন বিষয় নয়।’ এভাবে প্রতিনিয়ত মার্কিন গণমাধ্যম বিভিন্ন নিউজ প্রকাশ করছে যেখানে সৌদি আরবের নিরাপত্তার বিষয়ের পাশাপাশি মক্কা মদিনার নিরাপত্তার বিষয়টিকে বারবার সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। যেখানে মার্কিনিদের সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তি ইসলাম এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে সোচ্চার সেখানে তাদের মক্কা-মদিনা এবং সৌদি নিয়ে তাদের এই অতিরিক্ত দরদ অবশ্যই সন্দেহের দাবিদার। সম্প্রতি সে সন্দেহের বিষয়টি খোলাসা হয়েছে এবং বেরিয়ে পড়েছে সৌদি আরব এবং মক্কা-মদিনা নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশের মূল কারণ। আইএইচএস এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত বছর মধ্যপ্রাচ্যে ৮৪০ কোটি ডলারের অস্ত্র রফতানি করেছে ওয়াশিংটন। অথচ ২০১৩ সালে এ বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬০০ কোটি ডলার। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ অস্ত্র রফতানি করে যুক্তরাষ্ট্র এবং দেশটির অস্ত্র রফতানি ১৯ শতাংশ বেড়ে বর্তমানে ২৩৭০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। আগামী দশ বছরে যা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ৮:৪৪