somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পরিমল ইস্যু আর আমার এলোমেলো ভাবনাঃএলেবেলে

১৬ ই জুলাই, ২০১১ সকাল ১০:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেকটা দায়ে পড়েই টিউশনিটা শুরু করব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম, এতদিন তো অনেক শুয়ে বসেই কাটালাম, আর কত? অবশ্য দিন দিন খরচের মাত্রা যে হারে বাড়ছে, এ ছাড়া আর উপায় কি? আজ বন্ধুরা সবাই একসাথে খেতে যাবে, কাল টিশার্ট বানাবে,প্রোগ্রাম নামাবে, পরশু জার্সি, তরশু বলবে চল হয়ে যাক একটা ট্যুর। এত এত খরচের হ্যাপা সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। আব্বুর কাছে আর কত হাত পাতা যায়? আর অন্য বন্ধুরা যেখানে বাড়ি থেকে টাকা না নিয়ে স্রেফ টিউশনির টাকা দিয়ে মনের নানান শখ মিটিয়ে চলেছে, আমার করাতে সমস্যা কি?

শুরু হল পূর্ণ উদ্যমে টিউশনি খোঁজা, বন্ধু-বান্ধবকে বলে রাখলাম। দুই দিন না যেতেই বন্ধু রাযীর ফোন, 'দোস্ত, আসাদ গেটে একটা টিউশনি আছে, স্টুডেন্ট (মেয়ে) ইংলিশ ভার্শন, ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার, স্যালারি ভাল দিবে,পড়াবি?'

দুরু দুরু বুকেই রাজি হয়ে গেলাম রাযীর কথায়, জীবনের প্রথম টিউশনি, তাও আবার স্টুডেন্ট, আল্লাহই জানেন, কতটুকু ভাল পড়াতে পারবো।

শুরু হয়ে গেল টিউশনি জীবন, স্টুডেন্ট স্যার বলে, শুনতে ভালই লাগে, নিজেকে টিচার টিচার লাগে, পরিমলের মত (!!!) টিচার। ক্যাম্পাসে যখন ক্লাস করি, গালি দিয়ে স্যারদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করি, এত বোরিং লাগে ক্লাসগুলো! সেই সঙ্গে খেয়াল করি কোন দিকগুলো ছাত্রদের কাছে খারাপ লাগে। স্রেফ কয়টা টাকার জন্যই টিউশনি করানো, চাইনি উদ্দেশ্যটা এমন হয়ে যাক, চেয়েছি স্টুডেন্ট যাতে আমার কাছে ভাল কিছু পায় সে দিকটা নিশ্চিত করতে।

সেই সাথে মনে পরে প্রথম দিনের কথা, আন্টি (স্টুডেন্টের মা) বলেছিলেন, বাবা, নিজের বোনের মত করে যত্ন নিয়ে পড়িও, মেয়েটাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। বাধ্য ছেলের মত মাথা দুলিয়ে বলেছিলাম, অবশ্যই, আমার বোনটাও তো এবার এসএসসির গণ্ডি পেরিয়ে ইন্টারে পা রাখলো, ওকে আমার বোন ভেবেই সিরিয়াসলি পড়াবো।

দিন ভালোই কাটছিল, কতটুকু ভাল পড়াই সেটা স্টুডেন্টই ভাল বলতে পারবে, তবে রেজাল্ট ভালই করছিল, আন্টিও বেশ খুশি_ই ছিলেন, রেগুলার জোর করে নাস্তা খে্তে বাধ্য করতেন, হলে কি খাই না খাই, পড়াশুনা ঠিকমত চলছে কিনা সে ব্যাপারে খোঁজ নিতেন, বাড়ি থেকে বহুদূর এসে একজন মাদার ফিগার পেয়ে মনটা মাঝে মাঝেই আম্মুর জন্য কেঁদে উঠত। B-)

হঠাৎ করেই একদিন ঢাকার বুকে আবির্ভাব ঘটলো পরিমল নামের এক মহামানবের(!!!), রাতারাতি সে হিরো হয়ে গেল, স্টুডেন্ট - টিচার এর মধ্যে এতদিন পিতা-সন্তান টাইপ যে অনন্য সম্মানের একটা সম্পর্ক ছিল, সেটা যেন পেল নতুন মাত্রা।

গুরু পরিমল তার গুরুদক্ষিণা (!) পেতে চেয়েছিল, জোর করেই। আমরা বুঝে গেলাম স্টুডেন্ট - টিচার মানে আর পিতা-সন্তান না, তারা আর আমাদের পিতৃতুল্য নেই, এমনকি আমি ছেলে নাকি মেয়ে তা নিয়েও তাদের মাথাব্যাথা নাই(হুজুররা নাকি ছেলেদের প্রতিই বেশি আকর্ষণ অনুভব করছেন বলে খবরে আসছে)।

সেই সাথে আমরা দেখলাম একজন ধর্ষকের প্রতি মানবিক (!) সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেয়া একদল অসাধারণ মানুষ(!)। তাদের ভাব দেখে মনে হল, পরিমল এত কষ্ট করে জ্ঞানের আলো বিলিয়ে গেছে মেয়েগুলোর মাঝে, এটুকু করার মত অধিকার তার জন্মাতেই পারে। আমরা পেলাম একবিংশ শতাব্দীর নতুন এক তত্ত্ব, হোসনে আরা'স ''মিউচুয়াল সেক্স" থিয়রি।

বললে আরো অনেক কিছুই বলা যায়, ভাবছেন স্টুডেন্ট পড়ানোর কাহিনী থেকে পরিমল ভায়া এল কোথা থেকে? এর পর_ই তো ঘটল আসল ঘটনা। পিতা-পুত্র কিংবা পিতা-কন্যা সম্পর্কটাই যেখানে হুমকির মুখে, নিজের ভাই চাচাতো ভাই হতে কতক্ষন লাগে?

আগের মতই যাই টিউশনিতে, কিন্তু পরিমল বাবুর আবির্ভাবের পর থেকেই কোথায় যেন একটা পরিবর্তন টের পেলাম ছাত্রীর বাড়িতে। শুধু অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি, মনে হচ্ছিল কয়েকজোড়া চোখ আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখছে আমার দিকে। ছাত্রীর মাঝেও খেয়াল করলাম আড়ষ্ট একটা ভাব, কোন কিছু বুঝালে আগের মত রেসপন্স পাই না, একটু যেন ভীতচকিত ভাব।

এমনিভাবে কেটে গেল আরো দু'টো দিন, বাধ্য হয়ে আন্টিকে ডেকে বললাম ছাত্রীর অমনোযোগিতার কথা, বললাম আমার অস্বস্তির কথা, প্রসংগত উল্লেখ্য, ও বাড়িতে ভাল ছেলে, ভাল টিচার হিসেবে আমার বেশ কদর ছিল।

জবাবে খানিকটা ইতঃস্তত করেই আন্টি বললেন, বাবা চারপাশে যা হচ্ছে, আমরা সবাই ভীষণ উদ্বিগ্ন। মেয়েকে নিয়ে খুব ভয়ে আছি। দিনকাল যেদিকে যাচ্ছে আজকাল তো আর কাউকে বিশ্বাস নাই। পাশ থেকে ছাত্রী মৃদু আপত্তি জানাল, আন্টি তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন, মা হলে তুমিও বুঝতে বাবা-মার টেনশনের কথা। বুঝলাম, আন্টি পরিমল বাবুর মহান কীর্তির প্রতি ইঙ্গিত করে সমগ্র শিক্ষক সমাজের প্রতি তাঁর চরম অনাস্থার কথাটাই বললেন, যে বিশাল শিক্ষক সমাজের অতি ক্ষুদ্র এক অংশ আমি, পরিমল বাবুর কাজটির জন্য সামান্য হলেও আমি ভাগীদার। মুহূর্তের মাঝে মাথা নিচু হয়ে গেল আপনা থেকেই, লজ্জা, অপমান আর পরিমল টাইপ অমানুষ গুলোর প্রতি তীব্র ঘৃণায় চোখের কোণে হয়ত দু'এক ফোঁটা জল জমে থাকবে, চশমার ভেতর দুনিয়াটা তাই ঝাপসা হয়ে এল। /:)

তারপর কি কথা হল, সেটা অজানাই থাকুক, টিউশনিটা ছেড়ে দিলাম, হয়তো নিজের মাঝে যে পরিমল লুকিয়ে আছে সেটা নগ্নভাবে বেরিয়ে আসার আগেই যে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা পেয়েছি সেটাকেই ধরে রাখতেই এ সিদ্ধান্তটাই ভালো লেগেছিল তখন। অন্তত পরিমলের জায়গায় নিজেকে দেখতে চাই না আমি।

ফেরার পথে লক্কর ঝক্কর মার্কা বাসের জানালায় মাথা রেখে মনের মাঝে নানান ভাবনার ভেলা পসরা সাজিয়ে বসলো। সত্যিতো, আন্টির কোন দোষ নেই। মেয়েটা যদি আমার হত, আমি কি পারতাম আজকের এই অবস্থায় কোন শিক্ষককে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে? জানি সবাই তো এমন পরিমল না, বেশিরভাগ শিক্ষক শিক্ষকতাকে আজো মহান পেশা হিসেবেই দেখেন, ছাত্র-ছাত্রীদের সন্তানের মত ভাবেন। কিন্তু কিছু পরিমলের জন্য সমগ্র শিক্ষক সমাজ সন্দেহের মুখে, আজ বাবা-মা অসীম শ্রদ্ধা আর সম্মানের যোগ্য শিক্ষকদের প্রতি কি একটু হলেও অসম্মানবোধ করছেন না? সেটাই তো স্বাভাবিক।

সেই সঙ্গে ভাবি, আমাদের সবার মাঝেই তো লুকিয়ে রয়েছে একটা করে পরিমল, আমাদের মাঝেই লুকিয়ে আছে হোসনে আরা, শুধু উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই হিংস্র থাবা মেলে ছুটে যাবে, ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলবে সম্মান আর ভালোবাসার জায়গাটা।

তাই আজ শুধু পরিমল, হোসনে আরাকে শাস্তি দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করলে চলবে না। নিজেদের নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। ভেবে দেখতে হবে আমাদের মাঝে লুকিয়ে থাকা পরিমল সত্ত্বার কথা, ভেবে দেখতে হবে অশালীন আর নোংরামির দিকে দ্রুতই ছুটে যাওয়া সমাজটার কথা, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কথা। নইলে জন্মাবে আরো অনেক পরিমল, জন্মাবে আরো অনেক সমকামী হুজুর (হুজুরটার নাম মনে নেই, তাই, আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থী)। আসুন, সবার আগে নিজেকে গড়ি, আমি পরিমল হবো না, কাউকে হতেও দিব না, এই প্রতিজ্ঞাটা করে ফেলি।

তারপর দেখি কোন ব্যাটায় পরিমল হয়।

[বিঃদ্রঃ গল্পটা রুপক।]
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×