somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বন্ধুত্বের নীতি ও আদর্শ

০৫ ই মে, ২০১৬ সকাল ১০:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১. বন্ধুদের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার করবে এবং বন্ধদের জন্য বন্ধত্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে থাকবে। সেই ব্যক্তি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যাকে তার বন্ধুবান্ধব ভালবাসে এবং সেও বন্ধু-বান্ধবকে ভালবাসে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যবান সে যার প্রতি লোকেরা অসন্তুষ্ট এবং সেও লোকদের থেকে দূরে থাকে। যার ধন-সম্পদ নেই সে নিঃস্ব বরং প্রকৃত নিঃস হলো ঐ ব্যক্তি যার কোন বন্ধু নেই, বন্ধুর জীবন সৌন্দর্য্য জীবন-যাত্রার সাহয়ক এবং আল্লাহর নেয়ামত। বন্ধু তৈরী করুন এবং বন্ধু হয়ে থাকুন।

পবিত্র কুরআনে আছে-

“মুমিন পুরুষ ও নারীগণ পরস্পর একে অন্যের বন্ধু ও সাহায্যকারী”।

(সূরা তওবাহ)

রাসূল (সাঃ) তাঁর সাহাবীগণকে অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং প্রত্যেকেই অনুভব করত যে রাসূল (সাঃ) তাকেই সকলের থেকে বেশী ভালবাসেন।

হযরত আমর বিন আছ (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ) আমার সাথে এরূপ মনোযোগ ও একাগ্রতার সাথে আলাপ করতেন এবং খেয়াল রাখতেন যে, আমার মনে হতে লাগলো আমিই আমার কওমের সর্বাধিক উত্তম ব্যক্তি। একদিন আমি রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করে বসলাম যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি সর্বাধিক উত্তম না আবু বকর (রাঃ)? রাসূল (সাঃ) উত্তর দিলেন, আবু বকর। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আমি উত্তম না কি ওমর (রাঃ)? তিনি উত্তর দিলেন, ওমর (রাঃ)। আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি রাসূল (সাঃ) থেকে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে মূল তথ্য জানলাম, তিনি পক্ষপাতহীনভাবে পরীক্ষার কথা বলেছিলেন। তখন আমি আমার এ অশোভনীয় পদক্ষেপে অত্যন্ত লজ্জিত হলাম এবং মনে মনে বলতে লাগলাম যে, এরূপ কথা জিজ্জেস করার আমার কি এমন প্রয়োজন ছিল!

২. বন্ধুদের সাথে অন্তরঙ্গ পরিবেশে জীবন-যাপন করবে এবং অকৃত্রিম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করার চেষ্ট করবে।

রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “যে মুসলমান লোকদের সাথে মিলেমিশে থাকে এবং তাদের পক্ষ থেকে আগত কষ্ট মেনে নেয় সে ঐ ব্যক্তির চেয়ে কতইনা উত্তম যে ব্যক্তি লোকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে এবং তাদের পক্ষ থেকে আগত কষ্টে অধৈর্য্য ও অস্থির হয়ে পড়ে।

(তিরমিযি)

৩. সর্বদা সৎ ও নেককার লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করবে এবং বন্ধু নির্বাচনে এ কথার প্রতি অবশ্যই খেয়াল রাখবে যে, যাদের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক বাড়াচ্ছ তারা দীন ও চারিত্রিক দিক থেকে তোমার জন্য কতটুকু উপকারী হতে পারে? “কারো চারিত্রিক অবস্থা জানতে হলে তার বন্ধদের চারিত্রিক অবস্থা জেনে নাও”। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “মানুষ তার বন্ধুর দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়, সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তির চিন্তা করা দরকার, সে কার সাথে বন্ধুত্ব করছে”।

(মুসনাদে আহমদ, মেশকাত)

বন্ধুর দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ এই যে, সে যখন বন্ধুর সাহচর্যে আসবে তখন তার মধ্যে ঐ আবেগ ও চিন্তাধারা আর ঐ আস্বাদন ক্ষমতা ও প্রবণতাই সৃষ্টি হবে যা তার বন্ধুর মধ্যে বিদ্যমান। আর পছন্দ অপছন্দের নিরিখ তাই-ই হবে যা তার বন্ধুর আছে। সুতরাং মানুষের বন্ধু নির্বাচনে অত্যন্ত গভীর চিন্তা ও বিবেচনা করা উচিত আর এমন ব্যক্তির সাথে আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত যার চিন্তাধারা ও ধ্যান-ধারণা এবং চেষ্টা-তদবীর দীন ও ঈমানের শর্ত অনুযায়ী হয়। রাসূল (সাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন যে, “মুমিন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক মজবুত কর। তার সাথেই পানাহার করো”।

রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “মুমিনের সাহচর্যে থাকো আর যেন তোমাদের দস্তরখানে পরহেজগার লোকেরাই আগে খানা খায়”।

এক দস্তরখানে বসে পানাহার করা আন্তরিক সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী আর এ সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব স্বরূপ মুমিনদের সাথেই হওয়া উচিত যে আল্লাহকে ভয় করে। অমনোযোগী, দায়িত্বহীন, বে-আমল ও চরিত্রহীন লোকদের নিকট থেকে সর্বদা দূরে থাক। রাসূল (সাঃ) ভাল ও মন্দ বন্ধুরসাতে সম্পর্কের অবস্থাকে একটি সুন্দর উদাহরণ দ্বারা বর্ণনা করেছেনঃ

ভাল এবং মন্দ বন্ধুর উদাহরণ কস্তুরি (মেশক) বিক্রেতা ও কামারের চিমনী বিক্রেতা। কস্তুরি বিক্রেতার সাহচর্যে তুমি কোন উপকার পেতে পার হয়তো কস্তুরি খরিদ করবে অথবা তার সুগন্ধ পাবে, কিন্তু কামারের চিমনী তোমার বাড়ী ঘর অথবা কাপড় জ্বালিয়ে দেবে অথবা তোমার মস্তিষ্কে দুর্গন্ধ পৌঁছবে।

(বুখারী, মুসলিম)

আবু দাউদ শরীফের হাদীসের শব্দসমূহ এরূপ আছেঃ

নেককার (সৎ) বন্ধুর উদাহরণ এরূপ তার যেমন কস্তুরী বিক্রেতা বন্ধুর দোকান থেকে আর কোন উপকার না পেলেও সুগন্ধিতো অবশ্যই আসবে আর অসৎ বন্ধুর উদাহরণ এরূপ যেমন, কামারের চিমনী থেকে আগুন না লাগলেও তার ধুঁয়াতে কাপড় তো অবশ্যই কালো হয়ে যাবে”।

৪. বন্ধুদের সাথে শুধু আল্লাহর জন্যই বন্ধুত্ব করবে, আল্লাহর প্রিয় বান্দাহগণ তারা যারা আল্লাহর দীনের জন্য একত্রিত হয় এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অন্তরের সাথে অন্তর মিলিয়ে আল্লাহর দীনের প্রতিষ্ঠা ও কর্তব্য সম্পাদন করে যে, তাদেরকে সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় মজবুত মনে হয়।

পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছেঃ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাদেরকেই ভালবাসেন যারা আল্লাহর পতে দৃঢ়ভাবে সারিবদ্ধ হয়ে লড়াই করে, যেন সীসা ঢালা প্রাচীর।

(সূরায়ে ছফ-৪)

রাসূল (সাঃ) বলেছেন-

“কিয়ামতের দিন যাদের গৌরবময় জাঁকজমকপূর্ণ মর্যাদা লাভ হবে তাদের সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ

আল্লাহর বান্দাহদের মধ্য থেকে সেই সকল বান্দাহ এমন সৌভাগ্যবান যারা নবীও নন শহীদও নন কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে এমন মর্যাদায় সমাসীন করবেন, যে নবী ও শহীদগণও তাদের মর্যাদায় ঈর্ষান্বিত হবেন। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কারা? আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, এরা ঐ সকল লোক যারা শুধু আল্লাহর দীনের ভিত্তিতে একে অন্যকে ভালবাসতো, তারা পরস্পর আত্মীয়-স্বজনও ছিল না এবং তাদের মধ্যে কোন অর্থ সম্পদের লেন-দেনও ছিল না। আল্লাহর শপথ কিয়ামতের দিন তাদের চেহারা নূরে ঝকঝক করতে থাকবে, তাদের আপাদমস্তক শুধু নূর হবে আর সমস্ত লোক যখন ভয়ে ভীত হয়ে কাঁপতে থাকবে তখন তাদের কোন ভয়ই হবে না এবং সকল লোক যখন দুঃখে পতিত হবে তখন তাদের কোন দুঃখই হবে না। অতঃপর তিনি পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করলেনঃ (আবু দাউদ)

“সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহর বন্ধুগণের কোন ভয় নেই আর তাঁরা চিন্তিতও হবে না”।

হযরত আবু দরদা (রাঃ) বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ

কিয়ামতের দিন কিছু লোক তারেদ কবর থেকে এমন অবস্থায় উঠবেন যে, তাদের মুখমণ্ডল নূরে ঝকঝক করতে থাকবে। তাদেরকে মুক্তা খচিত মিম্বরে বসানো হবে এবং লোকেরা এদের মর্যাদা দেখে ঈর্ষা করবে, অথচ এরা নবীও নন এবং শহীদও নন, এক বেদুঈন জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অথচ এরা কোন লোক? আমাদেরকে এদের পরিচয় দিন। তিনি উত্তর দিলেন, এরা তারা যারা পরস্পর আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব করতো”।

(তিবরানী)

৫. সৎ লোকদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করাকে পরকালের মুক্তি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপায় মনে করবে এবং আল্লাহর নিকট দোআ করবে যে, আয় আল্লাহ! আমাকে সৎ লোকদের বন্ধুত্ব দান করুন এবং তাদের অন্তর্ভূক্ত করুন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, “এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বলতে লাগলো যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এক ব্যক্তি কোন নেক লোকের সাথে তার নেকীর কারণে বন্ধুত্ব করে, কিন্তু সে নিজেই ঐ ব্যক্তির মত নেক কাজ করে না। আল্লাহর নবী বললেন, কোন ক্ষতি নেই, মানুষ কিয়ামতের দিন তার সাথেই হবে যাকে সে ভালবাসবে।

(বুখারী)

একরাতে রাসূল (সাঃ) আল্লাহর দীদার লাভ করলেন, আল্লাহ তাআলা রাসূল (সাঃ) কে বললেন, কিছু দোয়া করুন। তখন রাসূল (সাঃ) এই দো’আ করলেনঃ

“আয় আল্লাহ! আমি তোমার নিকট নেক কাজ করার তাওফীক চাই। খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে চাই। মিসকিনদের ভালবাসা চাই, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। কোন জাতিকে আযাব দেবার মনস্থ করলে আমাকে তার আগে উঠিয়ে নিও। আমি তোমার নিকট তোমার বন্ধুত্বের কামনা করি, আর তার বন্ধুত্ব কামনা করি, যে তোমার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে আর যে আমল দ্বারা বন্ধুত্বের নিকটবর্তী হওয়া যায় সেরূপ আমল করার তাওফীক প্রার্থনা করি”।

(মুসনাদে আহমদ)

হযরত মুআয বিন জাবাল (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহ বলেন, আমার উচিত যে, আমি তাদেরকে ভালবাসব যারা আমার জন্য পরস্পর ভালবাসা ও বন্ধুত্ব স্থাপন করে, যারা আমার আলোচনায় একত্রিত হয়, যারা আমার বন্ধত্বের কারণে পরস্পর সাক্ষাত করে আর আমার সন্তুষ্টির জন্য পরস্পর সদ্ব্যবহার করে”।

(আহমদ তিরমিযি)

রাসূল (সাঃ) দু’বন্ধুর সাক্ষাতের এক উত্তম চিত্র তুলে ধরে বলেছেনঃ

“এক ব্যক্তি অন্যস্থানে তার বন্ধুর সাথে সাক্ষাত করার জন্যে রওয়ানা হলো। আল্লাহ তার পেছনে একজন ফিরিশতা নিয়োগ করলেন। ফিরিশতা তাকে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা করেছো? সে উত্তর দিল, ঐ মহল্লায় আমার এক বন্ধু থাকে তার সাথে সাক্ষাত করতে যাচ্ছি। ফিরিশতা বলেন, তোমার কি তার নিকট কিছু পাওনা আছে যা তুমি আদায় করতে যাচ্ছ? সে বলে, না, আমি তাকে আল্লাহর জন্য ভালবাসি। অতঃপর ফিরিশতা বলেন, তাহলে শুন! আল্লাহ তাআলা আমাকে তোমার কাছে প্রেরণ করেছেন এবং এ সংবাদ দান করেছেন যে তিনি (আল্লাহ) তোমার সাথে ঐরকম বন্ধুত্ব রাখেন যেমন তুমি তোমার বন্ধুর সাথে আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব রাখছো”।

(মুসলিম)

৬. ইসলামের দৃষ্টিতে বন্ধত্বের উপযুক্ত লোকদের সাথেই বন্ধুত্ব স্থাপন করবে। অতঃপর সারা জীবন ঐ বন্ধুত্ব অটুট রাখার জন্য চেষ্টাও করবে। বন্ধুত্বের জন্যে যেমন সৎ লোক নির্বাচন করা প্রয়োজন তদ্রূপ উক্ত বন্ধুত্বকে অটুট ও স্থায়ী রাখাও প্রয়োজন।

রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহর আরশের ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না, তখন সাত প্রকারের লোক আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া পাবে। তার মধ্যে এক প্রকারের লোক হলো যারা দু’জন এক অন্যকে শুধু আল্লাহর জন্য ভালবাসতো। আল্লাহর মহব্বত তাদেরকে পরস্পরের সংযোগ করেছে এবং এ ভিত্তির উপরই তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে। অর্থাৎ তাদের বন্ধুত্ব আল্লাহর জন্যই হবে আর তারা জীবনভর এ বন্ধুত্বকেও অটুট রাখতে চেষ্টা করবে। আর যখন এদের মধ্যে কোন একজন মৃত্যুবরণ করবে তকন বন্ধুত্বের অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করবে।

৭. বন্ধুদের ওপর বিশ্বাস রাখবে, তাদের সঙ্গে হাসি-খুশি থাকবে। নিরুৎসাহ থাকতে এবং বন্ধুদেরকে নিরুৎসাহ করা থেকে বিরত থাকবে,বন্ধুদের সাহচর্যে আনন্দিত ও প্রফুল্ল থাকবে। বন্ধু-বান্ধবদেরও প্রফুল্ল সহচর হতে চেষ্টা করবে। তাদের সাহচর্যে বিরক্ত না হয়ে বরং আনন্দময় জীবন ও আকর্ষণ অনুভব করবে।

হযরত আবদুল্লাহ বিন হারেস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)-এর চেয়ে বেশী মুচকি হাসতে আর কাউকে দেখিনি।

(তিরমিযি)

হযরত জাবের বিন সামুর (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ) এর সাহচর্যে আমি এক শতেরও অধিক মজলিসে বসেছি, এ সকল মজলিসে সাহাবায়ে কেরামগণ কবিতা পাঠ করতেন এবং জাহেলীযুগের কিচ্ছা-কাহিনীও শুনাতেন। রাসূল (সাঃ) চুপ থেকে এসব শুনতেন এবং কখনো তিনি তাদের সাথে হাসিতেও অংশ গ্রহণ করতেন।

(তিরমিযি)

হযরত শারীদ (রাঃ) বলেন যে, আমি একবার রাসূল (সাঃ)-এর সওয়ারীর উপর তাঁর পেছনে বসার সুযোগ পেয়েছিলাম। সওয়ারীর উপর বসে বসে আমি রাসূল (সাঃ)-কে উমাই বিন ছালাহর একশত কবিতা শুনালাম। প্রত্যেক কবিতার পর তিনি বলতেন, আরো কিছু শুনাও আর আমি শুনাতাম।

রাসূল (সাঃ) তাঁর মজলিসে নিজেও কিচ্ছা-কাহিনী শুনাতেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন যে, একবার তিনি পরিবার এর লোকদেরকে একটি কাহিনী শুনালেন। এক মহিলা বলে উঠলেন, এ বিস্ময়কর অদ্ভুত কাহিনী বিস্তৃতভাবে শুনালেন। এরূপ একবার হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে এগার রমণীর এক চিত্তাকর্ষক কা্হিনী শুনালেন।

হযরত বকর বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-এর আনন্দ-স্ফূর্তির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ

সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) হাসি ও আনন্দ-স্ফূর্তির আবেগে একে অন্যের প্রতি তরমুজের খোসা পর্যন্ত নিক্ষেপ করতেন। সে লড়াই প্রতিরোধ করার দায়িত্বশীলও হতেন সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)।

(আল-আদাবুল মুফরাদ)

হযরত মোহাম্মদ বিন যিয়াদ (রহঃ) বলেছেনঃ আমি পূর্ববর্তী নেককার লোকদেরকে দেখেছি যে, কয়েক পরিবার বাড়ীতে বসবাস করত। অনেক সময় এরূপ হতো যে, কারো ঘরে মেহমান এবং অন্য কারো ঘরের চুলায় হাঁড়ি চড়ানো থাকতো। তখন মেহমানওয়ালা তার মেহমানদের জন্য বন্ধুর হাঁড়ি নামিয়ে নিয়ে যেতো, পরে হাঁড়ির মালিক হাঁড়ির খোঁজ করে ফিরত এবং লোকদেরকে জিজ্ঞেস করত যে, আমার হাঁড়ি কে নিয়ে গিয়েছে? ঐ মেজবান বন্ধু তখন বলতো যে, ভাই। আমার মেহমানের জন্য আমি নিয়ে গিয়েছিলাম। ঐ সময় হাঁড়ির মালিক বলতো, আল্লাহ তোমার জন্য বরকত দিক। মোহাম্মদ বিন যিয়াদ (রহঃ) বলেছেন যে, তারা যখন রুটি বানাতো তখনও প্রায়ই এ অবস্থা হতো।

(আল আদাবুল মুফরাদ)

হযরত আলী (রাঃ) বলেন, “কখনও কখনও অন্তরকে স্বাধীনভাবে উন্মুক্ত কর। আনন্দদায়ক রসিকতারও চিন্তা করো। কেননা শরীরের মত অন্তরও ক্লান্ত হয়ে যায়।

৮. রুক্ষ স্বভাব ও মনমরা হয়ে থাকবে না। আনন্দ ও হাসি-খুশি থাকবে। কিন্তু এ বিষয়ে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করবে যে, নিজের আনন্দিত হওয়া যেনো সীমাহীন না হয়। সীমালংঘন না করে। প্রফুল্লতা ও আমোদ-প্রমোদের সাথে সাথে দীনি গাম্ভীর্য, মর্যাদাবোধ, লজ্জাবোধ এবং সমতা ও মিথ্যাচারের প্রতিও সতর্ক লক্ষ্য রাখবে।

(তিরমিযি)

রাসূর (সাঃ)-এর সাহাবী হযরত আবদুর রহমান (রাঃ) বলেন যে, রাসূল (সাঃ)-এর সাহাবীগণ কখনো রুক্ষ স্বভাবের ছিলেন না এবং মরার মতও চলতেন না। তারা তাদের মজলিসে কবিতাও পাঠ করতেন এবং জাহেলী যুগের কিচ্ছা-কাহিনীও বর্ণনা করতেন। কিন্তু কোন ব্যাপারে যখন তাদের নিকট থেকে সত্যের বিপরীত কোন কথার দাবী উঠতো তখন তাদের চেহারা জ্বীনে ধরা ব্যক্তির ন্যায় বিবর্ণ হয়ে যেত।

(আল আদাবুল মুফরাদ)

প্রসিদ্ধ হাদীস বিশারদ (মশহুর মুহাদ্দিস) হযরত সুফিয়ান বিন ওয়াইনার নিকট কোন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, হাসি-ঠাট্টা কি এক প্রকার বিপদ? তিনি উত্তর দিলেন, না বরং সুন্নাত কিন্তু ঐ ব্যক্তির জন্য যে তার মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত আছে এবং উত্তম ঠাট্টা করতে পারে।

(শরহে শামায়েলে তিরমিযি)

৯. তুমি যে ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব কর তার নিকট তোমার বন্ধুত্বের কথা প্রকাশ করবে। তাতে তার মানসিক প্রভাব এমন হবে যে, তার মধ্যে নৈকট্যের ও আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি হবে। উভয়পক্ষের আকর্ষণ ও অনুভূতির বিনিময়ে বন্ধুত্ব বৃদ্ধি পাবে। অতঃপর বন্ধুত্ব শুধু এক আন্তরিক অবস্থা থাকবে না বরং তার দাবী কর্মজীবনের উপর প্রভাবশীল হবে আর এভাবে ব্যক্তিগত ব্যাপারে মনোযেগ দিতে ও একে অন্যের সর্বাধিক নিকটবর্তী হবার সুযোগ পাবে।

রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “যখন কোন ব্যক্তির অন্তরে তার দীনি ভাইদের জন্য বন্ধুত্বের আকর্ষণ সৃষ্টি হয় তখন তার উচিত তার বন্ধুকে এ বিষয়ে অবহিত করা যে, সে তার সাথে বন্ধুত্ব রাখে।

(আবু দাউদ)

একবার রাসূল (সাঃ) এর সামনে দিয়ে এক ব্যক্তি যাচ্ছিল, ঐ সময় কিছু লোক তার সম্মুখে বসা ছিল। তন্মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বলে উঠলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই ব্যক্তির সাথে আমার শুধু আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব আছে। শুনে রাসূল (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ঐ ব্যক্তিকে একথা জানিয়ে দিয়েছো? সে বলল, না। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, যাও, তার নিকট প্রকাশ করে দাও যে, তুমি আল্লাহর জন্যে তার সাথে বন্ধুত্ব করেছো। সে ব্যক্তি তাড়াতাড়ি গিয়ে পথে ঐ ব্যক্তির নিকট নিজের আবেগের কথা প্রকাশ করলো। তার উত্তরে ঐ ব্যক্তি বললো, তোমার সাথে তিনি বন্ধুত্ব করুন যার জন্যে তুমি আমার সাথে বন্ধুত্ব করেছো।

(তিরমিযি, আবু দাউদ)

বন্ধুত্বের সম্পর্ককে সর্বাধিক মজবুত এবং ফলপ্রসূ করা ও বন্ধুদের নিকটবর্তী হওয়ার জন্য প্রয়োজন হলো, বন্ধুদের ব্যক্তিগত ও অন্যান্য ব্যাপারে পছন্দ-অপছন্দনীয় সীমারেখা পর্যন্ত মনোযোগ দেবে এবং তাদের সাথে নৈকট্য ও বিশেষ সম্পর্কের কথা অবলীলায় প্রকাশ করবে।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন-

“একজন মানুষ যখন অন্য মানুষের সাথে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের সংযোগ স্থাপন করে তখন তার কাছ থেকে তার নাম, তার পিতার নাম এবং তার পারিবারিক অবস্থার কথা জেনে নেবে, এতে করে পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধন মজবুত ও দৃঢ় হয়।

(তিরমিযি)

১০. বন্ধত্বের প্রকাশ ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে সর্বদা মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে, এরূপ নিরুত্তাপ ভাব প্রদর্শন করবে না, যাতে নিজের বন্ধুত্ব ও সম্বন্ধ সন্দেহজনকবাবে দৃষ্টিগোচর হয় আর বন্ধুত্বের আবেগে এতটুকু অগ্রসর হবে না যে, বন্ধুত্ব ও ভালবাসা উন্মাদনার আকার ধারণ করে। যদি কোন সময় অনুশোচনা করতে হয়, সমতাও মধ্যম পন্থার প্রতি সর্বদা দৃষ্টি রাখবে এবং স্থির মস্তিষ্কে এরূপ ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা যা সব সময় সম্পাদন করতে পারবে। হযরত আসলাম (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, তোমাদের বন্ধুত্বের মাঝে যেনো উন্মাদনা প্রকাশ না পায় আর তোমাদের শত্রুতা যেনো কষ্টদায়ক না হয়। আমি বললাম হযরত কিভাবে? তিনি বললেন, যখন তোমরা বন্ধুত্ব করতে আরম্ভ করো তকন শিশুদের মত জড়িয়ে ধরো এবং আবেগে শিশু সুলভ আচরণ করতে আরম্ভ করো। আর কারো সাথে যদি মনোমালিন্য হয় তা হলে তার প্রাণ ও ধন-সম্পদ ধ্বংস করতে প্রবৃত্ত হয়ে যাও।

(আল আদাবুল মুফরাদ)

হযরত ওবাইদ কিন্দী (রহঃ) বলেন, “আমি হযরত আলী (রাঃ) নিকট থেকে শুনেছি, তোমার বন্ধুর সাথে বন্ধুত্বে নম্রতা ও মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো, কেননা সে কোন সময় তোমার শত্রুও হয়ে যেতে পারে। তদ্রূপ শত্রুর সাথে শত্রুতায় নম্রতা ও মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো সম্ভবতঃ সে কোন সময় তোমার বন্ধুও হয়ে যেতে পারে”।

(আল আদাবুল মুফরাদ)

১১. বন্ধুদের সাথে বিশ্বস্ততা ও শুভাকাংখী সুলভ ব্যবহার করবে। বন্ধুর সাথে সর্বাধিক মঙ্গল কামনা কর যে, তাকে চারিত্রিক দিক থেকে সর্বাধিক উপরে উঠাতে চেষ্টা করবে আর তার পার্থিব উন্নতি থেকে পরকালীন উন্নতির অধিক চিন্তা কর। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “দীন সম্পূর্ণটাই মঙ্গল কামনা”। মঙ্গল কামনার মূল এই যে, যা তুমি বন্ধুর জন্যে পছন্দ কর তা তুমি তোমার জন্যে পছন্দ করবে। কেননা মানুষ কখনো নিজের মন্দ কামনা করে না।

রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “সেই সত্তার শপথ আমার প্রাণ যার হস্তে। কোন ব্যক্তি খাঁটি মুমিন হতে পারে না যে পর্যন্ত সে তার ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ না করে যা সে নিজের জন্য করে”।

এক মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের ছয়টি অধিকারের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “সে তার ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করবে, সে অনুপস্থিত বা উপস্থিত থাকুক”। তিনি আরো বলেছেনঃ নিশ্চিত আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির ওপর জাহান্নামের আগুন ওয়াজিব ও বেহেশত হারাম করে দিয়েছেন যে শপথ করে কোন মুসলমানের অধিকারে আঘাত করেছে (সাহাবাদের মধ্য থেকে একজন জিজ্ঞেস করলেন) যদি উহা কোন সাধারণ বস্তু হয়? হুযুর (সাঃ) বললেন, উহা পিলুর সাধারণ ডালও হোকনা কেন (পিলু এক প্রকার লতা জাতীয় গাছ যার দ্বারা মেসওয়াক তৈরী করা হয়।)

১২. বন্ধুদের দুঃখে-কষ্টে এবং আনন্দে ও খুশীতে অংশ গ্রহণ করবে। তাদের শোকে শরীক হয়ে সান্ত্বনা দানের চেষ্টা করবে, তাদের আনন্দ স্ফূর্তিতে অংশ গ্রহণ করে তা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করবে। প্রত্যেক বন্ধুই তার খাঁটি বন্ধুদের থেকে স্বাভাবিকভাবেই এ আশা পোষণ করে যে, তারা বিপদের সময় তার সাথে থাকবে এবং প্রয়োজনের সময়ও তার সঙ্গ ত্যাগ করবে না। অনুরূপ সে এও আশা করে যে, বন্ধু তার আনন্দ-স্ফূর্তি বৃদ্ধি করেবে এবং সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগদান করে অনুষ্ঠানের শোভা ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করবে।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন-

এক মুসলমান অপর মুসলমানের জন্য ইমরাত স্বরূপ। যেমন ইমারতের এক ইট অন্য ইটের শক্তি ও সহায়তা যোগায়। এরপর তিনি এক হাতের আঙ্গুলগুলো অপর হাতের আঙ্গুলগুলোর মধ্যে প্রবেশ করালেন। (আর মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ককে ও ঘনিষ্ঠতাকে পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিলেন।)

(বুখারী, মুসলিম)

তিনি আরো বলেছেনঃ “তোমরা মুসলমানদের পরস্পরে দয়াদ্র হৃদয় বন্ধুত্ব ও ভালবাসা এবং পরস্পর কষ্টের অনুভূতিতে এমন হবে যেমন এক শরীর, যদি তার এক অঙ্গ অসুস্থ হয় তা হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে থাকে”।

(বুখারী, মুসলিম)

১৩. বন্ধুদের সাথে সন্তুষ্টি, ন্ম্র স্বভাব, আনন্দ প্রফুল্লতা ও অকৃত্রিমভাবে মিশবে আর অত্যন্ত মনোযোগ ও হাসিমুখে তার অভ্যর্থনা করবে। বেপরোয়াভাব ও রুক্ষতা থেকে দূরে থাকবে। এসব অন্তর বিদীর্ণকারী কুস্বভাব। সাক্ষাতের সময় সর্বদা আনন্দ উল্লাস, শান্তি এবং শুকরিয়া ও হামদ এর শব্দসমূহ ব্যবহার করবে। দুঃখ-কষ্ট ও মনে ব্যথা পায় এমন কথা কখনো মুখে আনবে না। সাক্ষাতের সময় এরূপ চালচলন করবে যে, বন্ধু আনন্দ অনুভব করে। এমন নির্জীব ভাবে তাকে অভ্যর্থনা করনে না যে, তার মন দুর্বল হয়ে যায় এবং সে তার সাক্ষাতকে নিজের জন্য আযাব মনে করে।

রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “নেকসমূহের মধ্য থেকে কোন নেকে তুচ্ছ মনে করবে না তা এমনই হোক না যে, তুমি তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে মিলিত হচ্ছ”।

(মুসলিম)

অন্য একস্থানে রাসূল (সাঃ) বলেছেঃ “তোমার আপন ভাইকে দেখে হাসি দেওয়অও সদক্বাহ”।

(তিরমিযি)

নম্র স্বভাব এবং উত্তম চরিত্রর দ্বারাই অন্তরে ভালবাসা ও বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয় আর এসব গুণের কারণে সুন্দর সমাজ সৃষ্টি হয়।

রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “আমি তোমাদেরকে ঐ ব্যক্তির পরিচয় দিচ্ছি যার ওপর জাহান্নামের আগুন হারাম এবং জাহান্নামের আগুনের ওপরও সে হারাম, এ ব্যক্তি হলো সেই ব্যক্তি যে নম্র প্রকৃতি, নম্র স্বভাব ও নম্র চরিত্রের”।

(তিরমিযি)

সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) বলেছেন, রাসূল (সাঃ) সাক্ষাতের সময় যখন কারো দিকে নিবিষ্ট হতেন তখন সম্পূর্ণ শরীর তার দিকে ফিরাতেন আর যখন কেউ তাঁর সাথে আলাপ করত তখন তিনি পূর্ণ মনোযোগী হয়ে তার কথা শুনতেন।

একবার তিনি মসজিদে বসা ছিলেন। এমন সময় একজন লোক আসায় তিনি শরীরকে নাড়া দিয়ে একটু সংকোচিত হলেন, লোকটি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! জায়গা তো আছে। রাসুল (সাঃ) বললেনঃ “মুসলমান এমন হবে যে, তার ভাই যখন তাকে আসতে দেখে তখন সে তার জন্যে নিজের শরীরকে একটু নাড়া দেবে”।

(বায়হাকী)

মুমিনদের প্রশংসায় পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ “তারা মুমিনদের জন্য অত্যন্ত নরম স্বভাবের”।

রাসূল (সাঃ) এর মূল তত্ত্বকে এভাবে প্রকাশ করেছেন।

“মুমিন ঐ উটের ন্যায় সহনশীল ও নরম স্বভাবের হবে যার নাকে দড়ি লাগান হয়েছে, তাকে টানলে চলে আবার পাথরের ওপর বসালেও সে বসে যায়”।

(তিরমিযী)

১৪. কখনো যদি কোন কথায় মতভেদ হয় তা হলে সত্বর আপোষ করে নেবে। সর্বদা ক্ষমা চাইতে ও নিজের অন্যায় স্বীকার করতে অগ্রণী ভূমিক পালন করবে।

১৫. বন্ধুদের কোন কথা যদি তোমার স্বভাব ও রুচির বিরুদ্ধ হয় তা হলে তুমি তোমার মুখের জবানকে সংযত রাখবে আর উত্তরে কখনো কর্কশ কথা অথবা মুখ খারাপ করবে না বরং বিজ্ঞতা ও নম্রতার সাথে কথা পরিহার করে যাবে! ক্ষমা করে দেবে।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন-

“হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট জিজ্ঞেস করলেন, আয় আমার প্রতিপালক! আপনার বান্দাদের মধ্য থেকে কে আপনার নিকট সবচেয়ে প্রিয়? আল্লাহ জবাব দিলেন, যে প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মাফ করে দেবে।

রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন-

“মুমিনের পাল্লায় কিয়ামতের দিন সর্বাধিক ওজনীয় যে বস্তু রাখা যাবে তা হলো তার উত্তম চরিত্র। যে নির্লজ্জ মুখে কথা বলে এবং গালি দেয় আল্লাহর নিকট সে ব্যক্তি অত্যন্ত ঘৃণিত”।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন মুবারক (রাহ) সচ্চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন তিনটি বাক্য দ্বারাঃ

১. যখন মানুষ কারো সাথে সাক্ষাৎ করে তখন হাসি মুখে সাক্ষাৎ করে’।

২.অভাব গ্রস্ত ও কপর্দকহীন বান্দাদের জন্য খরচ করে।

৩. কাউকে কষ্ট দেয় না।

হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন কিয়অমতের দিন আল্লাহ তালার দৃষ্টিতে সর্বাধিক খারাপ লোক হলো সেই ব্যক্তি যার গালি ও কর্কশ কথার কারণে মানুষ তার নিকটে আসা ছেড়ে দিয়েছে।

(বুখারী ও মুসলিম)

১৬.তুমি বন্ধুদের সংশোধন ও প্রশিক্ষণ কাজে কখনো অলসতা করবে না, আর নিজের বন্ধুদের মধ্যে এমন রোগ সৃষ্টি হতে কখনো দেবেনা যা সংশোধন বা প্রশিক্ষণের পথ সর্বাধিক প্রতবিন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ আত্মার সন্তুষ্টি ও অহংকার। বন্ধুদের সর্বদা উৎসাহ দান করতে থাকবে, তারা যেনো তাদের ভুলত্রুটিসমূহ স্বীকার করে। নিজেদের ভুল স্বীকার করতে যেনো বীরত্ব প্রদর্শন করে। এ মূলতত্ত্বকে সর্বদা নজরে রাখবে যে, নিজের ভুল স্বীকার না করা এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য হঠকারিতার আশ্রয় নেয়ার দ্বারা প্রবৃত্তি ও আত্মা অত্যন্ত খারাপ খোরাক পায়।

প্রকৃতপক্ষে লোক দেখানো বিনয় ও মিনতি প্রকাশ করা, নিজেকে তুচ্ছ বলা, চলাফেরা ও চালচলনে বিনয় ও মিনতি প্রকাশ করা অত্যন্ত সহজ কিন্তু নিজের মানসিকতার উপর আঘাত সহ্য করা, নিজের ত্রুটিসমূহ ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে শুনা এবং স্বীকার করে নেয়া এবং নিজের মানসিকতার বিপরীত বন্ধুদের সমালোচনা সহ্য করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তিনিই প্রকৃত বন্ধু যিনি সচেতন মস্তিষ্কে একে অন্যের প্রতি খেয়াল রাখেন।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন-

তিনটি জিনিস মানুষকে ধ্বংস করে দেয়ঃ

১. এমন সব আকাংখা যা মানুষকে অনুগত ও দাস করে রাখে।

২. এমন লোভ যাকে পরিচালক মেনে মানুষ তার অনুসরণ করতে থাকে।

৩. আত্ম-সন্তুষ্টি এ রোগ তিনটির মধ্যে সর্বাধিক ভয়ংকর।

সমালোচনা ও হিসাব-নিকাশ এমন এক অমোঘ অস্ত্রোপচার যা চারিত্রিক দেহের ক্ষতিকর পদার্থগুলোকে সমূলে বের করে দেয়। চারিত্রিক বলিষ্ঠতায় যথার্থ পরিবর্ধন করে ব্যক্তিগত ও সামাজিকতায় নব জীবন দান করে। বন্ধুদের হিসাব-নিকাশ ও সমালোচনায় অসন্তুষ্ট হওয়া, ভ্রু কুঁচকানো আর নিজেকে তার থেকে বেপরোয়া মনে করাও ধ্বংস বা ক্ষতিকর এবং এ পছন্দনীয় কর্তব্য সম্পাদনে ত্রুটি করাও ধ্বংস বা ক্ষতিকর। বন্ধুদের আঁচলে ঘৃণ্য দাগ দৃষ্টিগোচর হলে অস্থিরতা অনুভব করবে, এবং সেগুলো দূর করার জন্য বিজ্ঞোচিত ব্যবস্থা অবলম্বন করবে। অনুরূপ নিজেও খোলা মন ও বিনয়ের সাথে বন্ধুদেরকে সব সময় এ সুযোগ দিবে, তারা যেনো তোমার দাগ-কলঙ্ককে তোমার নিকট তুলে ধরে। রাসূল (সাঃ) বন্ধুত্বের এ অবস্থাকে এক উদাহরণের মাধ্যমে এভাবে প্রকাশ করেছেনঃ

“তোমরা প্রত্যেকেই আপন ভাইয়ের আয়না।

সুতরাং সে যদি তার ভাইয়ের মধ্যে কোন খারাপ কিছু দেখে তা হলে তার থেকে দূর করে দেবে”।

(তিরমিযি)

এ উদাহরণে পাঁচটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় যাকে সামনে রেখে তুমি তোমার বন্ধুত্বকে প্রকৃত বন্ধুত্বে রূপদান করতে পার।

(১) আয়না তোমার দাগ ও কলংক তখনই প্রকাশ করে যখন তুমি তোমার দাগ, কলংক দেখার উদ্দেশ্যে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, আর তুমি যখন তার সম্মুখ থেকে সরে যাও তখন সেও পরিপূর্ণ নীরবতা পালন করে।

অনুরূপভাবে তুমি তোমার বন্ধুর দোষসমূহ তখনই প্রকাশ করবে যখন সে নিজেকে সমালোচনার জন্য তোমার সামনে পেশ করে এবং খোলা মনে সমালোচনা ও হিসাব নিকাশের সুযোগ দেয় আর তুমিও অনুভব কর যে, এ সময় বোধশক্তি সমালোচনা শুুনার জন্য এবং অন্তরে সংশোধন কবুল করার জন্য প্রস্তুত আছে, তুমি যদি অবস্থা না পা্ও তাহলে বুদ্ধিমত্তার সাথে নিজের কথাকে অন্য কোন সুযোগের অপেক্ষায় রাখবে এবং নীরবতা অবলম্বন করবে। তার অনুপস্থিতিতে এরূপ সতর্কতা অবলম্বন করবে যে তোমার মুখে যেন এমন কোন শব্দও না আসে যার দ্বারা তার কোন দোষের দিকে ইঙ্গিত করা হয়, কেননা ইহা হলো গীবত (পরোক্ষ নিন্দা) আর গীবতের দ্বারা অন্তরের মিলন হয় না বরং বিচ্ছেদ হয়।

(২) আয়না মুখমণ্ডলে সেসব দাগ ও কলঙ্কের সঠিক চিত্র তুলে ধরে বা পেশ করে যা প্রকৃতপক্ষে মুখমণ্ডলে বর্তমান আছে সে কমও বলেনা এবং তার সংখ্যা বড়িয়েও পেশ করেনা। আবার সে মুখমণ্ডলের সেসব দোষগুলোকেই প্রকাশ করে যা তার মুখে থাকে। সে গুপ্ত দোষসমূহের অনুসন্ধান করে না এবং তন্ন তন্ন করে দোষসমূহের কোন কল্পনাপ্রসূত চিত্র প্রকাশ করে না। অনুরূপভাবে তুমি ও তোমার বন্ধুর দোষসমূহ কম বর্ণনা কর। অনর্থক খোশামোদে পড়ে দোষ গোপন করবে না আবার নিজের ভাষণ বা্গ্মীতার জোরে তার কোন বৃদ্ধিও করবে না। আবার শুধু ঐ সকল দোষই বর্ণনা করবে না যা সাধারণ জীবন ধারায় তোমার সামনে এসেছে। তন্ন তন্ন করে খোঁজ করা ও ছিদ্রান্বেষণে অবতীর্ণ হবে না। গোপন দোষ খোঁজ করা চারিত্রিক খেদমত নয় বরং এক ধ্বংসাত্মক ও চরিত্র বিধ্বংসী অস্ত্র।

রাসূল (সাঃ) একবার মিম্বরে আরোহণ করে অত্যন্ত উচ্চস্বরে উপস্থিত জনতাকে সাবধান করে বললেনঃ

“মুসলমাদের দোষ ত্রুটির পিছে পড়বে না। যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইদের দোষ ত্রুটির পিছে লাগে তখন আল্লাহ তার দোষসমূহ প্রকাশ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান এবং স্বয়ং আল্লাহ যার দোষ প্রকাশ করতে মনস্থ করেন তাকে তিনি অপদস্ত করেই ছাড়েন। যতই সে ঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে থাকুক না কেন”।

(তিরমিযি)

(৩) আয়না প্রত্যেক উদ্দেশ্য থেকে পবিত্র হয়ে নিরপেক্ষভাবে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করে। আর যে ব্যক্তিই তার সামনে নিজের চেহারা পেশ করে সে কোন উদ্দেশ্য ব্যতীতই সঠিক চিত্র সামনে তুলে ধরে। সে কারো সাথে হিংসা বিদ্বেষ রাখেনা এবং কারো থেকে প্রতিশোধও গ্রহণ করেনা। তুমিও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য, প্রতিশোধ, হিংসা বিদ্বেষ এবং সর্বপ্রকার অসদুদ্দেশ্যে নিজেকে পরিপাটি করে নিতে পারো যেমন আয়না দেখে মানুষ নিজেকে পরিপাটি ও সজ্জিত করে নেয়।

(৪) আয়নায় নিজের সঠিক চিত্র দেখে কেউ অসন্তুষ্ট হয় না আর রাগে অস্থির হয়ে আয়না ভেঙ্গে দেয়ার মত নির্বুদ্ধিতাও কেউ করেনা। বরং তাড়াতাড়ি নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়ার কাজে লেগে যায় এবং আয়নায় মর্যাদা ও মূল্য অনুভব করে মনে মনে তার শুকরিয়া আদায় করে এবং ভাবে সত্যি আয়না আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়ার জন্য বড় সাহায্য করেছে ও তার স্বাভাবিক কর্তব্য সম্পাদন করেছে। অতঃপর তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর যে, সে বন্ধুত্বের হক আদায় করেছে এবং শুধু মুখে নয় বরং আন্তরিকতার সাথে সাথে তার শুকরিয়াও আদায় করে এ মুহূর্ত থেকেই নিজের সংশোধন ও প্রশিক্ষনের জন্য উদ্বেগাকুল হয়ে যায় এবং অত্যন্ত প্রশান্ত অন্তরে ও উপকার স্বীকারের সাথে বন্ধুর নিকট আবেদন কর যে ভবিষ্যতেও সে যেন তার মূল্যবান পরামর্শ দ্বারা পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে।

(৫) সর্বশেষ ইঙ্গিত এই যে, “মুসলমানদের প্রত্যেকেই তার ভাইয়ের আয়না” ভাই ভাইয়ের জন্য বন্ধুত্বের প্রতিচ্ছবি, বিশ্বস্ত ও হিতাকাঙ্খী এবং ব্যথাতুর হয়। ভাইকে বিপদে দেখে অস্থির হয়ে উঠে এবং সন্তুষ্ট দেখে খুশী হয়ে যায়। সুতরাং ভাই এবং বন্ধু যে সমালোচনা করবে তাতে তোমার উপকার হবে। বন্ধুত্বসূলভ এমনি সমালোচনা দ্বারা বন্ধুত্ব লাভ ও জীবন গঠনের আশা করা যেতে পারে।

১৭. বন্ধুদের সাথেও ভালবাসা প্রকাশ করা এবং বন্ধুত্ব আরো বৃদ্ধি করার জন্য হাদিয়া-তোহফার লেনদেন করবে। হাদিয়ার লেন-দেনে ভালবাসা এবং বন্ধুত্ব বৃদ্ধি পায়।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন-

“এক অন্যকে হাদিয়া আদান প্রদান করলে পরস্পর বন্ধুত্ব সৃষ্টি হবে আর অন্তরে বিষন্নতা দূর হয়ে যাবে।

(মেশকাত)

রাসূল (সাঃ) নিজেও তাঁর আসহাবকে হাদিয়া দিতেন। তাঁর সাহাবগণও পরস্পর হাদিয়া দিতেন ও নিতেন। হাদিয়া মূল্যবান না হওয়ার কারণে বন্ধুর হাদিয়াকেও কখনো তুচ্ছ মনে করবে না। তার আন্তরিকতা ও ভালবাসার প্রতি দৃষ্টি রাখবে।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন-

“কেউ যদি আমাকে তোহফা স্বরূপ ছাগলের একটি পাও প্রদান করে তা হলে অবশ্যই তা গ্রহণ করবো। কেউ যদি আমাকে দাওয়াত করে একটি পাও খাওয়ায় তা হলে আমি অবশ্যই ঐ দাওয়াতে যাব।

(তিরমিযী)

হাদিয়অর পরিবর্তে হাদিয়অ অবশ্যই দেবে। রাসূল (সাঃ) এর গুরুত্ব প্রদান করতেন। তাঁর নিকট অধিক পছন্দনীয় তোহফা ছিল সুগন্ধিদ্রব্যের তোহফা। তুমিও এ তোহফাকে পছন্দনীয় কনে করবে। বর্তমান কালে দীনি কিতাবও উত্তম তোহফা।

কখনো কখনো এক সাথে বসে খানা পিনার ব্যবস্তা করবে। বন্ধুদেরকে তোমার ঘরে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দিবে। বন্ধু-বান্ধবদের কেউ দাওয়াত দিলে অত্যন্ত খুশী মনে তা গ্রহণ করবে। এর দ্বারা বন্ধুত্বের আবেগ বৃ্দ্ধি ও দৃঢ় হয়। বরং এ ধরণের স্থানসমূহে অসাধারণ লৌকিকতা প্রদর্শন এবং পানাহারের সাজ সরঞ্জামে প্রাচুর্য দেখানোর স্থলে তুমি অকৃত্রিমতা ও বন্ধুত্বের গাঢ়ত্ব বৃদ্ধির প্রতি অধিক মনোযোগ দিবে।

১৮. বন্ধুদের খোঁজ-খবর নেবে। প্রয়োজনে তাদের উপকার করবে। জান ও মাল দ্বারা তাদের সাহায্য করবে। ইবনে হানী (রাঃ)-এর এক বর্ণনায় আছে যে, হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)-এর নিকট এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞেস করলো যে আবদুল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় কে? তিনি উত্তর দিলেনঃ

“মানুষে মধ্যে অধিক প্রিয় সেই ব্যক্তি যে মানুষের বেশী উপকার করে আর আমলের মধ্যে অধিক প্রিয় আমল হলো কোন মুসলমানকে সন্তুষ্ট করা এবং এটা এভাবে যে, তুমি তার বিপদ ও অসুবিধা দূর করে দেবে। অথবা তার ক্ষুধা নিবারণ করে দেবে আর কোন ভাইয়ের সাথে তার প্রয়োজন পূরণ করার জন্য যাবে”।

রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে আল্লাহ তাআলা তার প্রয়োজনও পূরণ করতে থাকবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের বিপদ দূর করবে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের বিপদসমূহ থেকে যে কোন একটি বিপদ তার দূর করে দেবেন”।

(বুখারী, মুসলিম)

তিনি এও বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের সাহায্য ততক্ষণ পর্যন্ত করতে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা তার ভাইকে সাহায্য করতে থাকে”।

হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, কোন মুসলমানের প্রয়োজন পূরণ করার পুরস্কার ও সওয়াব এর পরিমাণ দশ বৎসরের ইতেকাফ থেকেও বেশী”।

(তিরবানী)

হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের নিকট খুশী ও আনন্দের কথা পৌছে দেয় এবং তাকে সন্তুষ্ট করে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাকে সন্তুষ্ট করেন দেবেন”।

(তিবরানী)

১৯. উত্তম বিশ্বস্ত বন্ধু হও। বিশ্বাস করে তোমার নিকট মনের কথা বলে দিলে তার হেফাজত করবে। কখনো বন্ধুর বিশ্বাসে আঘাত দেবেনা। নিজের বক্ষকে গুপ্ত রহস্যের ভাণ্ডার হিসেবে তৈরী কর যেনো বন্ধু নিঃসংশয়ে তার প্রত্যেক ব্যাপারে পরামর্শ নিতে পারে আর তুমি বন্ধুকে সৎপরামর্শ দিতে পার ও সহযোগিতা করতে পারো।

হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, হাফসা (রাঃ) যখন বিধবা হলেন তখন আমি হযরত ওসমান (রাঃ) কে বললাম যে তুমি যদি ইচ্ছা করো তা হলে হাফসা (রাঃ)-এর বিয়ে তোমার সাথে দিই, ওসমান (রাঃ) জবাবে বললেন, এ ব্যাপারে আমি চিন্তা করে জানাবো। আমি কয়েক রাত পর্যন্ত তার অপেক্ষা করলাম, অতঃপর ওসমান (রাঃ) বললেন আমার বিয়ে করার খেয়াল নেই। আমি আবার আবু বকর (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে বললাম, আপনি যদি ইচ্ছা করেন তাহলে হাফসা (রাঃ) কে আপনার বিবাহাধীনে নিতে পারেন। তিনি চুপ রইলেন এবং কোন উত্তর দিলেন না। তার চুপ থাকাটা আমার নিকট অত্যন্ত ভারী মনে হলো, ওসমানের চেয়েও ভারি মনে হলো। এ ভাবে কয়েক দিন চলে গেলো। অতঃপর রাসূল (সাঃ)হাফসা (রাঃ) কে বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন, তখন আমি রাসূল (সাঃ)-এর সাথে হাফসা (রাঃ)-এর বিবাহ দিয়ে দিলাম। এরপর আবু বকর (রাঃ) আমার সাথে সাক্ষাৎ করে বললেন, তুমি আমার নিকট হাফসা (রাঃ)-এর কথা আলোচনা করেছিলে কিন্তু আমি চুপ ছিলাম। হতে পারে আমার এ চুপ থাকার দ্বারা তোমার মনোঃকষ্ট হয়েছে। আমি বললাম, হ্যাঁ কষ্ট হয়েছিল। তিনি বললেন, আমি জানতাম যে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরূপ চিন্তা করছেন। এটা ছিল তাঁর একটি গুপ্ত রহস্য যা আমি প্রকাশ করতে চাচ্ছিলাম না। রাসূল (সাঃ) যদি হাফসা (রাঃ)-এর কথা আলোচনা না করতেন তা হলে আমি অবশ্যই তা কবুল করে নিতাম।

হযরত আনাস (রাঃ) ছেলেদের সাথে খেলা করছিলেন। এমন সময় রাসূল (সাঃ) তাশরীফ আনলেন এবং আমাদেরকে সালাম করলেন। অতঃপর একটি প্রয়োজনীয় কথা বলে আমাকে পাঠালেন। আমার কাজ সেরে আসতে একটু দেরী হলো। কাজ শেষ করে আমি যখন ঘরে গেলাম তখন মা জিজ্ঞাসা করলেন, এতক্ষণ কোথায় কাটালে? আমি বললাম, রাসূল (সাঃ) এক প্রয়োজনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বললেন কি প্রয়োজন ছিল? আমি বললাম, গোপন কথা। মা বললেন, সাবধান, রাসূল (সাঃ)-এর গোন কথা ঘুর্ণাক্ষরেও কাউকে বলবে না।

বন্ধুত্ব মূলতঃ তখনই ফলপ্রসূ ও স্থায়ী হতে পারে যখন কেউ সামাজিক চরিত্রে নমনীয়তা এবং অসাধারণ ধৈর্য্য ও সহনশীলতা সৃষ্টি করবে আর বন্ধু সম্পর্কে উদারতা, ক্ষমা ও মার্জনা, দানশীলতা এবং একে অন্যের আবেগের প্রতি লক্ষ্য ও মনোযোগ দেবে। রাসূল (সাঃ) এর কয়েকটি ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়, তিনি কত উন্নত প্রশস্ত অন্তর, ধৈর্য্য সহ্য ও উদারতার সাথে মানুষের স্বাভাবিক প্রয়োজন ও দুর্বলতার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন যখন আমি নামাযের জন্য আসি তখন মন চায় যে, নামাযকে দীর্ঘ করি। যখন কোন শিশুর কান্না শোনা যায় তখন নামায সংক্ষেপ করে দিই কেননা আমার নিকট অত্যন্ত কষ্টকর যে আমি নামাযকে দীর্ঘ করে শিশুর মাকে কষ্টে নিপতিত করছি।
হযরত মালেক বিন হুয়াইবিস বলেন যে, আমরা কয়েকজন সমবয়স্ক যুবক দীনী জ্ঞানার্জনের জন্য রাসূল (সাঃ)-এর মজলিসে উপস্থিত হলাম। ২০ দিন পর্যন্ত হুজুরের দরবারে ছিলাম। রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত দয়ালু ও নম্র ছিলেন। যখন ২০ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল তকন তিনি বুঝতে পারলেন যে,আমরা বাড়ী ফিরে যেতে আগ্রহী। তখন তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা তোমাদের ঘরে কাকে রেখে এসেছো? আমরা বাড়ীর অবস্থা জানালে তিনি বললেন, যাও তোমাদের স্ত্রী-বাচ্চাদের নিকট ফিলে যাও? আর তোমরা যা শিখেছ তা তাদেরকে শিখাও। তাদেরকে ভাল কাজ করার উপদেশ দাও। অমুক নামায অমুক সময় পড়, নামাযের সময় হলে তোমাদের একজনে আযান দেবে এবং তোমাদের ইলম ও চরিত্রে যে উন্নত সে নামায পড়াবে।

(বুখারী মুসলিম)

হযরত মুআবিয়া বিন সুলামী (রাঃ) নিজের এক ঘটনা বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূল (সাঃ)-এর সাথে নামায পড়ছিলাম, এর মধ্যে এক ব্যক্তির হাচিঁ আসলে নামাযরত অবস্থায়ই আমার মুখ থেকে “ইয়ারহামুকাল্লাহ” বের হয়ে গেল, লোকেরা আমার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। আমি বললাম, আল্লাহ তোমাদেরকে শান্তিতে রাখুক। তোমরা আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন? অতঃপর আমি যখন দেখতে পেলাম যে, তারা আমাকে চুপ থাকতে বলছে তখন আমি চুপ হয়ে গেলাম। রাসূল (সাঃ) যকন নামায থেকে অবসর হলেন আমার মাতা-পিতা রাসূল (সাঃ)-এর উপর কোরবান হোক! আমি রাসূল (সাঃ) এর চেয়ে উত্তম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দাতা পূর্বেও দেখিনি এবং পরেও না। তিনি আমাকে ধমক দেননি, মারেন নি এবং ভাল-মন্দ কিছুই বলেন নি। শুধু এতটুকু বলেছেন যে, নামাযে কথা-বার্তা বলা ঠিক নয়। নামায হল আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করার, মহত্ত্ব বর্ণনা করার এবং কোরআন পাঠ করার জন্য।

(মুসলিম)

২০. দোআর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেবে। নিজে ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য দোআ করবে এবং তাদের নিকট দোআর আবেদন করবে। দোআ বন্ধুদের সামনে করবে এবং তাদের অনুপস্থিতেও। অনুপস্থিতিতে বন্ধুদের নাম নিয়েও দোআ করবে।

হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, “আমি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট ওমরা করার জন্য অনুমতি চাইলাম”, তিনি অনুমতি দেয়ার সময় বললেন, “হে ওমর দোআ করার সময় আমাদের কথাও মনে রেখ”। হযরত ওমর (রাঃ) বলেন “আমার নিকট এ কথা এত আনন্দদায়ক বোধ হয়েছে যে এর পরিবর্তে আমাকে সারা দুনিয়া দিয়ে দিলেও এত খুশী হতাম না”।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন যে, কোন মুসলমান যখন তার মুসলমান ভাইয়ের জন্য গায়েবানা দোআ করে তখন আল্লাহ তা’আলা তার দোআ কবুল করে নেন আর দোআকারীর মাথার উপর একজন ফেরেশতা নিযুক্ত করে দেন, সে ব্যক্তি যখন তার ভাইয়ের জন্য নেক দোআ করে তখন ফেরেশতা আমীন বলেন আর বলেন, তুমি তোমার ভাইয়ের জন্য যা চেয়েছ তোমার জন্যও ঐসব কিছু বরাদ্দ আছে।

(সহীহ মুসলিম)

নিজের দোআসমূহে আল্লাহর নিকট অকপটে এ আবেদন করতে থাকবে যে, আয় আল্লাহ! আমাদের অন্তরকে হিংসা বিদ্বেষ এবং পঙ্কিলতার ময়লা থেকে ধুয়ে দিন! আমাদের চক্ষুকে অকৃত্রিম ভালবাসা দ্বারা জুড়ে দিন! আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে একতা ও বন্ধুত্বের দ্বারা সুন্দর করে দিন।

পবিত্র কোরআন বুঝে বুঝে পড়বে এবং কোরআনে বর্ণিত এ দোয়ারও গুরুত্ব প্রদান করবে।

আরবি

“আয় আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এবং আমাদের পূর্বে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ক্ষমা করুন। আমাদের অন্তর থেকে মুমিনদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে দিন। হে আমাদের প্রতিপালক আপনি নিশ্চয়ই দয়াবান ও দয়ালু।

(সূরায়ে হাশর-১০)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১৬ সকাল ১০:০১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো - ছবি ব্লগ

লিখেছেন শোভন শামস, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৯

"পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো", কিংবা "পোস্টকার্ড রো" বা "সেভেন সিস্টারস" নামে পরিচিত, বাড়িগুলো। এটা সান ফ্রান্সিসকোর আলামো স্কোয়ার, স্টেইনার স্ট্রিটে অবস্থিত রঙিন ভিক্টোরিয়ান বাড়ির একটি সারি। বহু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×