somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডাকেনা, করিনা, দেখিনা, বলেনা, বকেনা, পিটায়না, মারেনা, যাইনা, খাইনা, পাইনা। যত বড় হচ্ছি এই "না' এর লিস্ট বাড়ছে 'না'?

১১ ই মে, ২০১৬ দুপুর ১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ছোট বেলায় সবার আগে শুরু আদর্শ লিপি দিয়ে। অ আ ক খ। সিলেট চক। মুছতে মুছতে হাতের তালু সাদা করে ফেলতাম। আর সেই আওয়াজ। চক আর সিলেটের একটা আনকমন আওয়াজ।
এক হিন্দু টিচার ছিল আমার। প্রতিদিন সকাল ৮ টায় আসতেন, তখন স্কুলে ভর্তি হইনি। অনেক অনেক আদর করতেন আমায়। আমায় হাঁতে ধরে ধরে লেখা শিখিয়েছেন, পড়া শিখিয়েছেন। আমার হাঁতে খড়ি উনার কাছেই। শুধু যে আদর করতেন তাইই না, মারতেন, স্কেইল দিয়ে। কাঠের স্কেইল। হলুদ রঙের। টিচার টিচার বলেই ডাকতাম। উনার বিয়ের সময় উনার নব্য স্বামীর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কথা এখনও অস্পষ্ট মনে আছে। তারপর মনে পড়ে একজন বিরাট লম্বা চওড়া টিচারের কথা। উনি ভীষণ রাগি ছিলেন। পরাতেন ভালো। কিন্তিউ পড়া না পারলেই বেদম মার। একবার উনার মার বেতের বাড়ী খেয়ে আমার জোড় এসে পড়েছিল। মা পড়ে তাকে মানা-ই করে দেন। আরেকটু বড় যখন হই আমি আর আমার বড় আপু এক সাথে পড়া শুরু করি। টিচার আসার তাইমে একটা আতংকে ভুগতাম। টিচার আসবে বিকেল ৫ টায়। ওই ৫ টা কখন বাজবে। ডোরবেল কখন বাজাবে। ওই আতংকে। মাঝে মাঝে দেরি হতো টিচার আশায়। ৫ টা। ৫ টা ৫। ৫ টা ১০। আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ করতাম যেন টিচার না আসে। সেই আতংক আধা ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতো। তারপর খুশি কে দেখে। দুই ভাই-বোন পারলে নাচতাম।
এমন টিচার পেয়েছিলাম যে কি না হাঁতে সুত্র লিখে নিয়ে আসতো। তারপর সেটা দেখে দেখে অংক করাতো। এমইন টিচার পেয়েছিলাম আমাদের কাউকে কোনদিন একটা ধমকও দেননি। পড়া না পারলেও না। শান্ত ভাবে বোঝাতেন আর চোখ গরম করতেন। আবার এমনও ছিল, পিটাতে পিটাতে চেয়ার থেকে নামিয়ে ফেলতেন। ব্যাং বানিয়ে রাখতেন।
টিচার স্মৃতিতে আরেকটা পিরিয়ড ঢোকানো যায়। আমার বেশিরভাগ টিচারই ছিলেন মাস্টার্স পাশ। তখন শুনতাম এম এ পাশ। সেই টিচারদের চাকরির জন্য হন্নে হয়ে ঘোড়া ফেরা করা, চাকরি পেয়ে টিউশনি ছেড়ে দেয়া- এই সব অবুঝ কথাবার্তা একটা ফাইভ সিক্সে পড়া স্টুডেন্টের জন্য। আমার মনে আছে স্যার তাদের ব্যক্তিগত কথাও আমাদের সাথে শেয়ার করতেন। কবে কবে তার ইন্টার্ভিউ। কত কষ্ট করছেন একটা চাকরির জন্য। এসব। অনেকের চেহারা কণ্ঠ কিছু কিছু স্মৃতি স্পষ্ট মনে আছে আমার। এমনই কয়েকজন টিচারের বিদায় দিতে হয়েছে মন খারাপ নিয়ে, ইভেন কেঁদেও। দু বছর পড়িয়েছেন। চাকরি হয়েছে ভালো জায়গায় আলহামদুলিল্লাহ্‌। মিষ্টি নিয়ে আসতেন আমাদের বাসায়। স্যার যখন যাওয়ার সময় দরজায় দাড়িয়ে জুতা পড়তে পড়তে বলতেন “আসি। তোমরা সবাই ভালো থেকো। মনোযোগ দিয়ে পড়ো। যে টিচার দিয়ে গেছি তাকে আমার মত মেনে চলো।” অনেক মন খারাপ হতো। ক্লাস ফাইভে মুসলিম স্কুলে যখন চান্স পাই, যে স্যার অনেক ওভারটাইম পরিয়ে আমাকে সফল করেছেন, তার যখন চাকরি হয়ে যায়, চলে যায়। আমি ো আমার বড় বোন কেঁদেছিলাম। লিখতে গিয়ে তেমন অনুভুত হল যেন।
হুম। টিচার তখন চলে গেলে আরেকজন টিচার ঠিকই দিয়ে যেতেন।
যেমনটা আমি করতাম বা আমার বন্ধু করত। এক সময় যেমন আমি স্টুডেন্ট ছিলাম আমার স্যার ছিল। আমি বড় হয়ে তেমন ভাবেই টিউশনি শুরু করি। মর্মে মর্মে বুঝি। আমিও বাসায় দেখে যেতাম কি কি পরাব স্টুডেন্টকে আজ বাসায় গিয়ে। পড়া না পারলে কানমলা। বেতের বাড়ি। আমি যেমন খেয়েছি ছোট সময় এবার তোরাও খা। ব্যাং বানিয়ে রাখতাম। উবুত করে। ওরা যখন ওভাবে ব্যাং হয়ে থাকতো আর মাঝে মাঝে পড়ে যেতো আবার ঠিক হতো। দেখে আমার ছোটবেলার কথাও মনে পড়ে যেতো। আমিও একসময় এমন ব্যাং হয়ে থাকতাম।
বিকেলে বাড়ির সামনের রাস্তায় খেলে বাসায় আসতে মাগরিবের আজানের পরে হলেই মায়ের মাইর, এখনও ভুলিনি। পিটিয়ে পায়ের গীরা যে ফুলিয়ে ফেলত। আজ বাদে কালই শাকরাইন। মা আমি আর বড় আপু মিলে আমার নাটাইয়ে মাঞ্জা দিয়েছিলাম। মনে আছে। বিরাট বড় বারান্দা ছিল আমাদের। গলিটা অন্ধকার ছিল। গলির শেষ মাথায় আমাদের বাসা। বাসার পাশেই পঞ্চায়েত কবরস্থান। সে কী ভয়। মিল্কভিটা দুধ কিনবতে পাঠাতো মা। কিন্তু কিনে আসার সময় গলির মুখে দাড়িয়ে থাকতাম। কখন কেউ আসবে। কেউ আসলেই তার পেছন পেছন হাঁটতাম। যেইনা বাড়ির গেটের সামনে আসতাম এক দৌরে তিনতলা।
দিনের সময় এক চোখে মার্বেল খেলা, লাটিম (আমরা ছোটসময় লাড্ডু বলতাম) লাড্ডু দিয়ে আরেক লাড্ডু দুই টুকরা করার সে কী লড়াই। ইটের চাড়া, মাটির পাতিলা ভাঙ্গা চাড়া দিয়ে খেলা। সিগারেটের প্যাকেটের গোল গোল কালারফুল ছোট ছোট কাগজ সংগ্রহ করা। গুলাই বাঁশ নিয়ে এলাকা ঘুরে বেরানো পাখি শিকার করা, বড় বা ছোট চাকা ঘুরিয়ে পিছে পিছে দৌড়ানো, বড় কেউ সিগারেট খেয়ে ফেলে গেলে উঠিয়ে তার মত খাওয়ার চেষ্টা করা আর সেই কি কাশি।
এলাকার রাস্তা বন্ধ করে ক্রিকেট-ফুটবলের টুর্নামেন্ট। অনেকবার এমন হয়েছে জানালার গ্লাস ভেঙ্গে জুতা স্ট্যাম্প ব্যাট ট্যাট নিয়ে উধাও। রাস্তা বন্ধ করে খেলছি তাই রিক্সাওলা, রিক্সার যাত্রীদের সাথেও তর্ক লেগে যেতো।
সবচেয়ে মজা হতো বৃষ্টির সময়। ফুটবল। খালি পায়ে। পিচ ঢালা শক্ত রাস্তায়। পায়ের গোলকিপার। পায়ে পায়ে কত বাড়ি। ফুটবল না পেলে টেনিস সবুজ বল দিয়েই ফুটবল।
এলাকার বন্ধুদের নিয়ে চড়ুইভাতি। টুংটাং শব্দ করে আসতো ফেরিওলা। হাঁতে ইয়া বড় বাশের কি যেন। এক টাকায় দু টাকায় বিড়াল, শিয়াল, পাখি বানিয়ে দিতো। আর মজা করে খেতাম। গোলাপি রঙের হাওয়াই মিঠাই। অফ হোয়াইট ঘোড়ার ডিম। ১ টাকায় ৪ টা কমলা রঙের চকলেট। ১ টাকায় ২০ টা পয়াসা বিস্কুট।
আমার হাত খরচ ছিল দিনে দুই টাকা। তাও আব্বুর কাছে চাইতে হতো তিনবার।
টিচারের H W খাতা নিয়ে বসতাম। আর বড় আপু। মা থাকতো হাঁতে বেত নিয়ে। বেত না পেলে হাত পাখার ডাণ্ডা। অথবা ডাল ঘুঁটনিরও বাড়ি খেয়েছি অহরহ।
ছোটসময় ভাবতাম কবে বড় হব। কবে বড় হব। শুনেছি বড় হলে নাকি টিচাররা মারেন না। মা বাবা ওত শাসন করেন না। একটা বড়ভাই ভাব এসে পড়বে।
আজ বড় হয়ে খুব আফসোস করি। সেইভাবে স্যার আসার জন্য ওয়েট করতে হয়না। টিচারের হোমওয়ার্কের টেনশন হয়না। মা পিটায় না। গলির মুখে ভয় লাগে না। পাশের ঘর থেকে আলিফ লায়লার সুর আসেনা। ইত্যাদির সুর শুনে দৌরে বাসায় ঢুকিনা। শুক্রবার সকালে নিনজা টারটেলস এর তাড়া নেই। সিসিমপুরের তাড়া নেই। সনিতে থ্রি স্টুজেসের তাড়া নেই। কার্টুন নেটওয়ার্ক দেখার তাড়া নেই। বিকেলে বরফ পানি খেলার জন্য কেউ ডাকেনা। রাতে কারেন্ট চলে গেলে চোর পলান্তিস খেলতে কেউ ডাকেনা। ডাকেনা, করিনা, দেখিনা, বলেনা, বকেনা, পিটায়না, মারেনা, যাইনা, খাইনা, পাইনা। কত ‘না’। মন বুঝতে চায়না। কেন ওই দিনগুলো ফিরে পাব ‘না’?
একটা টাইম মেশিন কি হবে কারো কাছে? শুধু একটাদিন যদি ওভাবে কাঁটাতে পারতাম…
ফিরে এসে ওই টাইম মেশিনের মালিকের গোলাম বনে যেতাম। এখনও তো গোলাম হয়েই আছি। দায়িত্বগুলোর গোলাম। পিছুটানের গোলাম। একদিনের জন্যেও সেই রাজা হতে চাই, ছোটবেলায় যেমন নিজেই নিজের রাজা ছিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১৬ দুপুর ১:৫৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×