পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমানের একমাত্র মেয়ে ঐশি রহমান জন্মেছেন সোনার চামচ মুখে নিয়েই। ছোট্টবেলা থেকেই বাবা-মা দুজনই তার সব আবদার পূরণ করেছেন। তারপরও এমন আদুরে মেয়ে হয়ে কী করে তার আপন বাবা-মাকে হত্যা বা হত্যার পরিকল্পনা করতে পারে সে নিয়ে বিস্ময় কাটছে না কারোরই। অনুসন্ধান করে জানা যায়, বেপরোয়া জীবন-যাপন আর ইয়াবার নেশায় মত্ত হয়ে ও-লেভেল পড়ুয়া ১৭ বছরের ঐশিই শেষ পর্যন্ত বনে যান বাবা-মায়ের হন্তারক। এ যেন দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পোষার মতো, যে কিনা পরিচর্যাকারীকেই দংশন করল সুযোগ বুঝে।
বাবা-মায়ের কাছে যখন যা চেয়েছেন পেয়েছেন সহজেই। আর এই অতি আদরই কাল হয়ে দাঁড়াল মাহফুজুর-রত্না দম্পতির। অতি মাত্রায় আদরের কারণে পারিবারিক অনুশাসনে কিছুটা ঠিল হওয়ায় ধনীর দুলালী ঐশি জড়িয়ে পড়েন নানা অসামাজিক কাজে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা আর অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ার সুবাদে অল্প দিনেই ঐশি জড়িয়ে পরে ইয়াবা চক্রের সাথে। শুরু হয় পারিবারিক দূরত্ব।
ঐশির মামা মো. রায়হান ঐশির ইয়াবা সেবনের ব্যাপারটি স্বীকার করে পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, “ঐশী ইয়াবা সেবন করত, এটা আমরা শুনেছি। সে প্রায়ই রাতে দেরি করে বাসায় ফিরত। আর ঐশির অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল। ঐশির এসব উচ্ছ্বৃঙ্খলতা নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে ঝামেলা চলছিল। ঐশির সাথে আমাদের কথা হতো অনেক কম। ঐশি বন্ধু-বান্ধব নিয়ে থাকতে পছন্দ করতো।”
প্রতিদিন নেশার টাকা জোগার করা, ডিজে পার্টিতে যাওয়াসহ কথিত বন্ধুদের সাথে ডেট করতে গিয়ে প্রতিদিনই টাকার জন্য ধর্না দেন ঐশি। মাহফুজুর-রত্না মারা যাওয়ার শেষ কয়েকদিন আগে ঐশি অধিক পরিমানে টাকার জন্য চাপ দেয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইংরেজি মাধ্যমের বিশেষ ঐ স্কুলটিতে চলে রমরমা ইয়াবার ব্যবসা। আর প্রতিপিস ইয়াবার দাম ৪০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা। যারা একদম নতুন তারা একটা দুইটা দিয়ে শুরু করেন আর পুরাতনরা অগনিত ইয়াবা সেবন করেন। সর্বশেষ ভবনটির ম্যানেজার আমজাদ আলী ৪ আগস্ট ভাড়া সংগ্রহ করতে গেলে মাহফুজ তাকে বলেন, “আমাদের একটু পারিবারিক সমস্যা চলছে। আমি অফিসে থাকা অবস্থায় ঐশি-ওহিকে বাসার বাইরে যেতে দিওনা।” ধারণা করা হচ্ছে আদরের মেয়ে ঐশিকে নিয়ন্ত্রণে আনতেই বাবা এমন নির্দেশ দেন।
বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড শাহীন জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে ঐশী তার ছোট ভাই ও গৃহকর্মীকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় ওই বাড়ির ম্যানেজার আমজাদ হোসেন পিতা-মাতার অনুমতি ছাড়া তাদের বাইরে যেতে বাধা দেন। একইসাথে মাহফুজুর রহমানের স্ত্রী স্বপ্না রহমানের মোবাইল ফোনে কল করেন তিনি। তখন ওই মোবাইল ফোন থেকে বলা হয়, 'আমি রাজশাহী আছি। ওদের যেতে দাও।' গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, মায়ের মোবোইল ফোন তখন ঐশীর কাছেই ছিল। মায়ের ফোন বাজতে থাকলে সে কৌশলে গেট থেকে সরে গিয়ে আমজাদের কল রিসিভ করে। মায়ের কণ্ঠ নকল করে মেয়েদের বাইরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
দুপুরে আমজাদ ফ্লাটের দরজায় তালা মারা দেখতে পেয়ে স্বপ্নার মোবাইলে আবার ফোন দেয়। এ সময় ফোন ধরে ঐশি। ঐশি জানায়, মায়ের মোবাইল তার কাছে। এরপর একাধিকবার ফোন করলেও সে ফোন ধরেনি।
ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা) মনিরুল ইসলাম শনিবার রাতে সাংবাদিকদের বলেন, ঐশি একাই এই হত্যাকাণ্ডের দায় নিলেও তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রনিকে (জনি) আটক করা হয়েছে।
ঘটনার পর থেকে ঐশি সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ করেছেন পুরান ঢাকার রনির সাথে। পুরান ঢাকায় রনি ইয়াবা সাপ্লাই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত। আর ইয়াবা আসক্ত ঐশির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রনি লেখাপড়া করেনি। ও-লেভেল পড়ুয়া শিক্ষিত মেয়ের ঘন্ষ্ঠি বন্ধু কী করে এমন নিরক্ষর হয় সেটা নিয়েও রয়েছে বিশাল প্রশ্ন। পুরনো ঢাকায় বখাটে হিসেবে পরিচিত রনি। ধারণা করা হচ্ছে রনির সাথে প্রেমের সম্পর্কও আছে ঐশির।
শনিবার পর্যন্ত গোয়েন্দারা ১২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও আটক করেছে ৬ জনকে। এরা হলেন— ঐশি রহমান, গৃহকর্মী সুমী, ঐশির বান্ধবী তৃষা, ঐশির বন্ধু রনি ও অপর দু'জন (তদন্তের স্বার্থে যাদের পরিচয় গোপন করা হয়েছে)।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ একজন সিএনজি চালককে আটক করেছে। ওই সিএনজি চালকের বাসাতেই ছিল গৃহকর্মী সুমী বেগম। তবে সুমী হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কোন তথ্য দিতে পারেনি।
জিজ্ঞাসাবাদে ঐশি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে তার বেপরোয়া জীবনের গল্পও তুলে ধরেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অক্সফোর্ডে 'ও লেভেল' পড়ুয়া ঐশির আচরণে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব ছিল। বখাটে ছেলে বন্ধুদের সাথে মেলা-মেশার কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিল। মাঝে-মধ্যেই বিভিন্ন ছেলে নিয়ে বাসায় আসতো। এসব বিষয় নিয়ে পরিবারের সাথে তার বনিবনা হচ্ছিল না। এসব নিয়ে শেষ কয়েকদিন তুলকালাম ঝগড়া করে ঐশি। আর এই ঝগড়াই শেষ পর্যন্ত মায়ের ভাগ্যে ধারালো অস্ত্রের এগারোটি কোপ আর বাবার ভাগ্যে তিনটি কোপ বয়ে নিয়ে আসে।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের মধ্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মৃত আব্দুল মতিনের বড় ছেলে মো. মাহফুজুর রহমান বাবুল ১৯৮৯ সালে পুলিশের উপ-পরিদর্শক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরির শুরুতেই স্বপনা রহমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৯৫ সালে প্রথম কন্যা সন্তান ঐশী আসে ঘরে। ২০০৩ সালে ছেলে সন্তান ঐহী জন্ম লাভ করে। দুইবার জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যোগ দিয়েছিলেন এই মেধাবী অফিসার।
Click This Link