আব্বা সিগারেট আসক্ত। মামাও, ইন্ডিয়ান পাতার বিড়ি। এছাড়া বংশের মুরব্বী টাইপের অনেকেই ধুমপায়ী। বড় ভাইও মাঝে মধ্যে দু’টা-একটা ‘টান’ দেন। বুঝি না, খালি ধোঁয়া আর ধোঁয়া। এতে না পেট ভরে, না স্বাদ লাগে। তাহলে কেন তারা এটি নিয়মিত সেবন করেন? এমন সহজাত প্রশ্ন ও এডভেঞ্চারের নেশা নিয়েই, শৈশবে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একদিন ‘সিগারেটের স্বাদ আবিষ্কার’ অভিযানে নেমে পড়ি। রাতে রেল লাইনের ধারে কিম্বা পাড়া-মহল্লার কোনো চিপা-চাপায় কয়েকজন মিলে সিগারেট টেনে তারপর চকোলেট ও কলা খেয়ে কলার বাকল দিয়ে হাত-মুখ মুছতাম। যাতে গন্ধ শুঁকে কেউ টের না পায়। ধুত্তুরি! কীসের কী? স্বাদের লেশমাত্র নেই। তবুও ‘দৃঢ় মনোবাল’ নিয়ে বা অন্তরে আশা জাগিয়ে রেখে কখনো-সখনো লুকিয়ে সিগারেট ফুঁকতাম। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত ধুমপানের রহস্য ধরা দিলোই না!
তারপর একদিন ভাবলাম, চায়ের ব্যাপারটা একটু পরীক্ষা করা যাক। ওটাতো অন্তত ধরা-ছোয়া যায়, বেশি খেলে একটু পেট ভরে। আমাদের বাড়িতে ইট-সিমেন্ট লাগানোর সময় রাজমিস্ত্রীদের ডেলি দু’চারবার চা দেয়া হতো। তখন মুস্তাক ভাইকে (খালাতো) নিয়ে দীর্ঘ দু’মাস চা পান করেছি। কিন্তু এতেও শেষ পর্যন্ত কোনো রকম স্বাদ আবিষ্কার করতে পারিনি।
আমাদের সিলটি (সিলেটি) এক ক্লাসমেট হেবজু ভাই (হিফজুর রহমান) প্রায় প্রতিদিনই দু’চার টাকা কাপপ্রতি চা খেতো। দেখে আমার খুব ঘেন্না হতো। ছাগল কোথাকার! চা পয়সা দিনে কিনে খাওয়ার কী আছে?
দীর্ঘদিন পর, কীভাবে কীভাবে যেন একটু একটু চা… খেতে শুরু করি। এরপর কী আর করা। একসময় নেশা ধরে গেল। কাপপ্রতি চিনি তিন চামচ, দুধ দুই চামচ। দৈনিক দুইটা, তিনটা, চারটা। পারদ তখন শুধু উপরেই ওঠে, নিচে নামে না। পেটে কিছু থাকুক বা না থাকুক, জিহ্বায় কিছু পড়–ক কি না পড়–ক, এক কাপ চা হলে আর কিছু লাগে না।
হ্যাঁ, এভাবেই চলতে লাগল বছরের পর বছর। মাঝে মধ্যে কেবল চায়ের জায়গা কফি দখল করে। অতঃপর একদিন টের পাই, নেশাটা অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। মাগার কিচ্ছু করার নেই। এটা ছাড়া বাঁচা সম্ভব না। তবে চেষ্টা করলে সামান্য কমানো যায়। তাও সাময়িক। এরই মধ্যে লেখালেখিতে হাতে খড়ি। আর একজন ধর্মপরায়ণ লেখক-সাহিত্যিক চা ছেড়ে তো মদ-গাঁজা ধরতে পারেন না তাই না? সুতরাং লেখকের একান্ত মুহূর্তে, একাকিত্বে, নিরব নিভৃত সময়ে টেবিলের উপর খাতা-কলম বাদে চা ছাড়া আর আছে কী?
এক বড় ভাই সেদিন বললেন, চিনিতে ১৮০টি রোগ হয়, দুধচা খুবই ক্ষতিকর, ইত্যাদি ইত্যাদি। হ্যাঁ, সেটা এখন আমিও টের পাই। কেননা, শৈশবে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মহাদেব পট্টির ‘চিটাগাং বেকারি এন্ড সুইটমিটে’ প্রায় প্রতিদিন সকালেই খালিপেটে চলে যেতাম এক পোয়া জিলেপি খেতে। তখন সেটাই আমার নেশা। জগতের ১২আনা স্বাদ যেন চিনিতেই। একটা সময় হালির পর হালি কলা, বড় বড় কাঁঠাল এক বসাতেই শেষ করতাম। এছাড়া ঝাঁল ও তেলেভাজা হাবিজাবির নেশা তো আছেই।
নাহ! যত কথাই বলেন, যত রোগই হোক, চা’টা অন্তত ‘ইহজীবনে’ ছাড়া যাচ্ছে না। তবে অনেক কষ্ট করে দুধ-চিনি কমাতে পারি। সারাদিন ঘরে-বাইরে দৌড়ে, হতাশ হৃদয়ে ক্লান্ত শরীরে, অবসাদক্লিষ্ট হয়ে যখন রুমে ফিরি, তখন এক কাপ চায়ে জিরিয়ে জিরিয়ে ক’টি সুখটান… আমাকে যেন নতুন জীবন দান করে, নতুন ভাবনার শক্তি যোগায়। আহা কি শান্তি!
তবুও ভাবি, একাকী, নিভৃতে, ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, ‘চায়ের কাপে সুখটান’, আসলে কি চা পান, না বিষপান?
জাকির মাহদিন : গবেষক, কলামিস্ট