লাশ ,
পত্রের শুরুতে তোমাকে কী বলে সম্বোধন করবো তা ঠিক করতে বেশ ভাবতেই হচ্ছে। তুমি লাশ হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে হলেও তোমার একটা নাম থাকতো , একটা পরিচয় থাকতো।
আমি তখন , প্রিয়, সম্মানীত , মহাশয়, জনাব, হুজুর এমন অসংখ্য পছন্দের শাব্দিক অলংকার সামনে এনে তোমাকে সম্বোধন করতাম। এখন তা বড়ই মুশকিল।
তোমাকে প্রিয় লাশ বললে মানবিক বা অল্পমানবিক মানুষেরা আমাকে ঘিরে ধরে নানা উচ্ছিষ্ট শব্দ প্রয়োগে মন্দ বলবে। হয়তো তোমাকে প্রিয় বলায় কেউ কেউ আমাকে খুনীও ভাবতে পারে । তাই তোমাকে আর কোন পদ-মর্যাদা বা অমর্যাদার টানা-পোড়েনে না রেখে , তোমার পড়নের কাপড় যেভাবে খুলে নিয়ে একটি কাপড় দিয়েই তোমাকে সমাহীত করে কিংবা লুকিয়ে রাখে আমিও সব বিশেষণ বিসর্জন দিয়ে তোমাকে শুধুই লাশ বললাম।
আশা করি পৃথিবীর অনেক আশা -নিরাশার হিসেব থেকে মুক্ত হয়ে এক প্রকার ভালোই অছো ।
পরসমাচার এই যে ,
প্রাণ প্রাচুর্যহীন তোমার নানা খবর প্রতিদিন কোন না কোন ভাবে পেয়েই যাই । এর কারন বুঝতে আজ কাল খুব একটা বেগ পেতে হয় না মোটেও ।
পত্রিকার পাতায় চকচকে ; অহ! না , অনেকটা ফেকাসে । কারন তোমাদের ছবি একটু ঝাপসা অথবা ব্লার না করে দিলে উচ্চ আদালতের মান মর্যাদা থাকে না। অথবা বলতে পারো এখনো যাদের প্রাণ দেহে আছে তেমন লাশের সামাজিক মর্যাদাও কিছুটা ক্ষুন্ন হয়। তবুও খবর পেয়েই যাই ।
আজ এমকগঞ্জে ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার , গতকাল মারা যাওয়া ওমকপুরের ৩০ জনের দেহের সুরত হাল এখনো শেষ হয় নি । হয়তো ঠিক আমি বা আমার আশ পাশের কেউ আজ রাতেই চাঁদের জোৎসানায় প্রাণহীন লাশ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এত বিচলিত হওয়ার কিছুই নেই ; সকালের নাশতার রুটি সামনে আসার আগেই অথবা কারো কারো ফজরের ডাকে এগিয়ে যাওয়া সমাজের স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে বা সংবাদে ঠিকই খবর পেয়ে যাবো । সংখ্যা কিছুটা বেশি হলে হিসাবটা সহজ, বেওয়ারীশ হতে সময় লাগবে খুবই অল্প। শুধু যার কাছে তোমার প্রাণের মূল্য ছিলো , তোমার প্রাণ যেই জীবনের বন্ধনে ছিলো সেই শুধু দির্ঘ পথে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ক্লান্ত হবে হয়তো ।
খবর খুব দ্রুত পাই বা একটু দেরিতে তোমার লাশ হওয়া যেন থামবার না । শুধু তুমি জানলে না , অনুধাবন করলে না তোমার প্রাণহীনতা কারো কারো জন্যে কত্ত মজার খেলা । তোমাকে পরিচয়হীন আর প্রাণহীন বানিয়ে কেউ কেউ কী সীমাহীন পরিচয়ের মালিক হয়ে গেছে তাও তুমি ঠিকঠাক জানলে না ।
প্রিয় লাশ , তুমি শুনলে হয়তো হাসবে আফসোস ও করতে পারো ! সন্তান, বাবা -মা , আদরের চাচা-জাতিজা , খুব আদরের পরম আত্মীয় কিংবা পার্কে প্রেমের মোহে ঘুরে বেড়ানো ভালোবাসার -প্রনয়ের প্রেমিক -প্রেমিকা সবাই একে একে অপরের প্রাণ কেড়ে নিয়ে একে অপরকে লাশ বানানোর কী বিভৎস সুন্দর খেলায় যে মেতেছে, তুমি ভাবতেও পারবে না ।
ধ্যাত ছাই ! আমি আবার এসব কী বলি ? তুমি ভাবতে পারলেতো লাশ হতে না । লাশদের ভাবনা থাকতে নেই ।
তবে একটি কথা তুমাকে না বল্লেই না , জানো – যাদের প্রাণ আছে তারাও কম লাশ নয়। সত্যকে সত্য , মিথ্যাকে মিথ্যা , ভালো কে ভালো অথবা মন্দকে মন্দ বলার বা ভাবার কোন চৈতন্যই নেই কোন প্রাণ সমেত লাশের।
তোমাকে পিটিয়ে পশুত্বের সকল পরিচয় প্রকাশ করে যারা তোমাকে লাশ করে! ঠিক পরের মুহুর্তেই তারা হয়তো মৃত গো মাংসের রাজভোগ করবে রাষ্ট্র বা সমাজের রাজ সভায়। শুধু তুমি দেখে যেতে পারলে না ।
তোমাকে লাশ করার অনুমতি পত্র যে সব বাবুরা তুলে দেয় নানা অধিদপ্তর বা দপ্তর থেকে সেই বাবুদের আজ কত্তো নাম-জশ খ্যাতি ! তুমি একবার একটু দেখে যেতে পারলে বুঝতে - তোমার প্রানহীন লাশের উপরে কত্তো বড়-বড় দালান কোটা , সড়ক -মহাসড়ক আর প্রাচুর্যের উৎসব হয়।
আত্মার গত হওয়া প্রাণ , আমার বা আমাদের অস্তিত্বের শেষ পরিণতি লাশ,
পত্রে অনেক কথা বলার ইচ্ছা ছিলো , তোমার যাপন করা জীবনের আরাধনা করারও কম ইচ্ছা ছিলো না । কিন্ত পারলাম না । তোমার লাশের সাথে প্রাণ জুড়ে দিলে যদি আবার সমাজে দ্রোহ দানা বাধে ! যদি লাগামহীন লোভের সব রঙিন সুসজ্জিত বাতি নিভে যায় ! তবে আমারো রাজদন্ড হতে দেরী নেই । তাই আজ বেশি করে তোমার সাথে কথা বলা হলো না । আমায় ক্ষমা করো।
বিদায়ের এই বেলায় প্রাণ বহনকারী অসংখ্য লাশের জন্য তোমার দোয়া, প্রার্থনা এবং আর্শিবাদ কামনা করি। যেন যাপিত জীবনে লাশের গন্ধ নয় প্রাণের উল্লাস হয় ।
আরো অফুরান প্রাণ সঞ্চার করতে ভালো থাকো লাশ !
ইতি
তোমার অতি নিকটের জীবিত লাশ
০৯.০৮.২০২২