ধর্ম বলতে আমরা খ্রিষ্টান, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা ইহুদী ধর্মকেই সাধারনত বুঝে থাকি। কিন্তু জেনে আশ্চর্য হবেন, ছোট-বড় মিলে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে কমপক্ষে ৪৩০০ ধর্মের সন্ধান পাওয়া গেছে। আরও আশ্চর্য হবেন এই জেনে যে, "নাস্তিক কিংবা ধর্মে অবিশ্বাসী" এমন লোকের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে সংখ্যার দিক থেকে এখন খ্রিষ্টান এবং ইসলামের ধর্মের ঠিক পরে অবস্থান করছে (যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৫% এরও বেশী, প্রায় ১০১ কোটি মানুষ)। এরপরে আছে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ইত্যাদি অন্যান্য ধর্ম।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে কেন এত দ্রুত গতিতে নাস্তিক কিংবা ধর্মে অবিশ্বাসীদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলেই এর মূল কারণগুলো সহজেই অনুধাবন করা যায়। যেমনঃ
- ধর্মকে ব্যবহার করে অধর্ম, নোংরা, ঘৃণিত এবং অসৎ কর্মকাণ্ড
- ধর্মীয় কুসংস্কার
- বিভিন্ন ধর্মের অযৌক্তিক এবং অবৈজ্ঞানিক কিছু কিছু ধর্মীয় বাণী এবং ব্যক্তি কিংবা দলীয় স্বার্থে এর অপব্যবহার
- ধর্মের নামে ভিন্ন ধর্মের কিংবা ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষ হত্যা, লুন্ঠন ও নির্যাতন
- ধর্মের দোহাই দিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন
- ধর্ম-যুদ্ধ
- ধর্ম-ব্যবসা
- ধর্মের দোহাই দিয়ে অমানবিকতার অপচর্চা, ইত্যাদি।
শ্রদ্ধা কিংবা বিশ্বাস ব্যাপারটি মুলত মানুষের অন্তর থেকে আসে। জোর করে কাউকে কোন কিছু বিশ্বাস করানো যায়না, কোন কিছুর প্রতি শ্রদ্ধা সৃষ্টি করানো যায়না। সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসা যত বাড়বে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসও তত বাড়বে। সৃষ্টিকে ভালভাবে না জেনে স্রষ্টাকে জানা সম্ভব নয়। স্রষ্টাকে যত বেশি জানা যাবে তাঁর প্রতি ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসও তত বাড়তে থাকবে। আর যিনি স্রষ্টাকে ভালভাবে জেনে বুঝে বিশ্বাস করেন তিনিই প্রকৃত আস্তিক।
অন্যের প্রতি, ভিন্ন বিশ্বাসীদের প্রতি, ভিন্ন ধর্মের কিংবা গোত্রের প্রতি ঘৃণা বিদ্বেষ অজ্ঞতারই নামান্তর। ভিন্ন বিশ্বাসীদের প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা সম্মান যতদিন পর্যন্ত সৃষ্টি না হবে, যতদিন পর্যন্ত ধর্মগুলো মানবিক, যুক্তিনির্ভর এবং কুসংস্কারমুক্ত না হবে, ততদিন পর্যন্ত ধর্মের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস কমতেই থাকবে এবং অপরদিকে নাস্তিক কিংবা অবিশ্বাসীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। সাধারণভাবে ধর্মভীরু, অন্ধবিশ্বাসী কিংবা বকধার্মিকদের চেয়ে নাস্তিক কিংবা অবিশ্বাসীরা অধিক জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই বিশ্বাসীদের উচিৎ অন্ধবিশ্বাসী কিংবা বকধার্মিক না হয়ে, নিজ ধর্মের পাশাপাশি অন্য ধর্মের বইসমূহও অর্থসহ ভালভাবে পড়া, ধর্ম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন করা। ধর্মের প্রতিটি বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ধর্ম হতে সকল অমানবিকতা, অযৌক্তিকতা ও কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে বিজ্ঞানভিত্তিক, যুক্তিনির্ভর, মানবিক ও কুসংস্কারমুক্ত ধর্মে দীক্ষিত হয়ে নিজে পালন করা এবং তা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে অন্যের কাছে প্রচার করা। আর সবসময় মনে রাখা উচিৎ, জ্ঞানের যেহেতু শেষ নেই, তাই বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী কিংবা ভিন্ন বিশ্বাসী সকলের জ্ঞান কিংবা বিশ্বাসকে সবসময় শ্রদ্ধা করতে হবে। “আমিই ঠিক, অন্যরা ভুল” এমন ধারণা ঝেড়ে ফেলে, অন্যের কথা শুনতে হবে, বুঝতে হবে। এরপর তার কথা অধিক যৌক্তিক হলে তা মেনে নেয়ার মানসিকতাও গড়ে তুলতে হবে। আর যদি অন্যের কথা অযৌক্তিক মনে হয় তবে বিনয়ের সাথে তার কাছে নিজের যুক্তিসমূহ তুলে ধরতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হচ্ছে মানুষের মানবিকতা, শুভ বুদ্ধিমত্তা, সুন্দর সভ্যতা, সত্য ও ঐশী জ্ঞান ইত্যাদি কারনে।
মানুষ হিসেবে জন্মে আমাদের নিজের কোন কৃতিত্ব নেই, সার্থকতা নেই। বরং বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী যাই হই না কেন, নিজেকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে প্রকৃত মানুষ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করাতেই মানুষ হিসেবে জন্মে আমাদের সার্থকতা। সত্যের আলোয় আলোকিত হয়ে অন্যকে সেই আলোয় আলোকিত করতে পারাতেই মানব জনমের সার্থকতা।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০:৪৭