সরকারের পিণ্ডি বিরোধীর ঘাড়ে
- ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
রাষ্ট্র পরিচালনায় চরম ব্যর্থ সরকার অসংলগ্ন কথাবার্তার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছে। সরকারের লোকজন কখন কোথায় কী যে বলছেন তার মাথামুণ্ড কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। নিজেদের ব্যর্থতার দায় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের মতো বিরোধী দলের কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এ নিয়ে যেসব বক্তব্য দিচ্ছে তা যৌক্তিক কি না কিংবা তা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য কি না, সেটি বিবেচনায় নেয়ার মতো কাণ্ডজ্ঞানের অভাব দেখা যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পুরাতন ভৃত্য কবিতায় লিখেছেন, ‘যা কিছু হারায় গিন্নী বলেন ক্যাষ্টা ব্যাটাই চোর।’ সরকারের নেতৃস্খানীয়রা এখন তেমনই। যা কিছু ব্যর্থতা তার সব কিছুর দায় বিরোধীদলীয় ক্যাষ্টা ব্যাটাদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে খালাস পেতে চাইছেন। নাগরিক দুর্গ সরকারের কাছে হাসিঠাট্টার ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। অপর দিকে ভারতের খায়েসমতো জাতীয় স্বার্থ তাদের কাছে বিকিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করে তোলা হয়েছে। সরকার ভারতের সাথে যা কিছু চুক্তি করছে, তার কোনো কিছুই জনগণ তো জানতে পারছেই না, এমনকি জানতে পারছেন না সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরাও। সব চুক্তিই গোপন। জনগণকে আড়ালে রেখে। আর এসব বিষয়ে জনগণ বা বিরোধী দল যাতে প্রশ্ন তুলতে না পারে, সে জন্য বিরোধী দলের ওপর নতুন নতুন নির্যাতন-কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে, যাতে তারা সে দিকেই ব্যস্ত থাকে। আর জনগণকে এমন সব সমস্যায় ফেলে দেয়া হচ্ছে যাতে তারা সেই সমস্যার দিখে মনোযোগী বেশি থাকে, সরকারের রাষ্ট্রীয় র্স্বাথবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করার সুযোগ না পায়।
এর অংশ হিসেবে নিত্যপণ্যের দাম যে বেড়েই চলেছে সে দিকে সরকার যেন দৃষ্টিহীন, তেমনি উদাসীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্খিতির অবনতির দিকেও। বিরোধী দলের নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে জনগণের দৃষ্টি কয়েক দিন রাখা হলো সে দিকে। ক’দিন যেতেই সিরাজগঞ্জে ট্রেনচাপা দিয়ে হত্যা করা হলো ছয়জনকে। তারপর হাজার হাজার লোককে আসামি করে মামলা দায়ের করা হলো। গোটা উত্তরবঙ্গের পুরুষরা এখনো দৌড়ের ওপরে। নারীর ওপর যৌন নির্যাতনের ভিডিও ছবি ইন্টারনেট মোবাইলে প্রচারের ধুমের মধ্যে নতুন উপসর্গ যোগ করা হলো নারী উত্ত্যক্ত করা তথা ইভটিজিংয়ের বিষয়টি। নারী উত্ত্যক্তকারীরা এখন এতটাই বেপরোয়া, তারা হত্যায়ও কসুর করছে না। এরা হত্যা করেছে কলেজ শিক্ষককে, হত্যা করেছে নির্যাতিত তরুণীদের মা চাঁপা রানীকে, আত্মহননে বাধ্য করেছে স্কুলছাত্রী উপজাতীয় তরুণী রূপালীকে। এসব ঘটনা লোমহর্ষক। যত অভাব-দু:খই থাক মানুষ সেসব ভুলে এসব ঘটনা তাৎক্ষণিকতার দিকে মনোযোগী হয়। সরকার স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে।
একইভাবে সরকার জনদুর্ভোগ বাড়ানোর নতুন কৌশল নিয়েছে। প্রথমে বলল, ২০ বছরের পুরনো যানবাহন রাজধানীতে চলতে দেয়া হবে না। ফলে সড়ক থেকে রাতারাতি উধাও হয়ে গেল বিপুলসংখ্যক বাস। এতে জনদুর্ভোগ চরমে উঠল। অফিসযাত্রীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়লেন। গন্তব্যে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত যানবাহনের অভাব দেখা দিলো। বাসের বদলে যে সিএনজি ট্যাক্সিতে যাবেন সেটাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। কারণ ৬০ টাকার সিএনজি ভাড়া দেড় শ’ টাকায় উঠল। লাগামহীনভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পীড়নে ন্যুব্জ মানুষ একবারেই দিশেহারা হয়ে পড়ল। সে ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই সরকার ঘোষণা দিলো রাজপথে এখন থেকে যানবাহন তিন লেনে চলতে হবে। অনভ্যস্ত নাগরিকরা হিমশিম খেলো। পুলিশ ধরে ধরে জরিমানা করল। পরিস্খিতির উন্নতি তো হলোই না বরং যানজট আরো ভয়াবহ রূপ নিল। কিন্তু সেসব পদক্ষেপের কোনোটাই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা গেল না। তাহলে জনগণকে দৌড়ের ওপর রাখা যাবে কিভাবে। এবার সরকার নতুন কৌশল নিল, তা হলো বিকেল তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখা হবে। অর্থাৎ যানবাহনে গ্যাস সরবরাহ করা হবে না। এ ক্ষেত্রে যানবাহন চালাতে জনগণকে নির্ভর করতে হবে চড়া দামের ডিজেল-অকটেনের ওপর। এবার নাগরিকরা বোঝো! এতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। লাখ লাখ শ্রমঘন্টা অপচয় হচ্ছে মাত্র। মানুষের কর্মঘন্টা কেড়ে নিয়ে উৎপাদনশীলতা কমানো হয়েছে। তিন-চার ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ রাতভর গ্যাস সংগ্রহ করছে। পেট্রলের ব্যবহার খুব একটা বাড়েনি। এমন পেছনমুখী জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী পদক্ষেপের মধ্যে এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে হেলমেট সিটবেল্ট বাঁধার পদক্ষেপ। যে পুলিশ হত্যাকারীদের ধরতে পারে না, যে পুলিশ নারী লাঞ্ছনাকারীদের আটক করতে পারে না, যে পুলিশ আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে পারে না সে পুলিশ বিশাল এক অভিযান হাতে নিয়েছে।
যে নগরীতে যানবাহনের গতি ঘন্টায় গড়পড়তা তিন কিলোমিটারের বেশি নয় সেখানে সিটবেল্ট বাঁধা নিয়ে সরকারের এমন তুলকালাম। পত্রপত্রিকার রিপোর্টে দেখা গেল, পুলিশের মাথায়ই হেলমেট নেই। পুলিশের গাড়িচালকের সিটবেল্ট নেই। পুলিশ যখন নিয়ম করে দিয়েছিল, ২০ বছরের পুরনো যানবাহন নগরীতে চলতে পারবে না তখন পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছিল পুলিশই চালাচ্ছে ২০-৩০ বছরের পুরনো যানবাহন। এমন এক কৌতুকের নগরীতে সরকার পরিণত করেছে এ জনপথকে। জনগণকে ভুগিয়ে নতুন নতুন উপায়ে কষ্ট দিয়ে সরকার তাদের তাৎক্ষণিকতায় আটকে রাখতে চাইছে। যেন জনগণ কিছুতেই পুরনো কষ্ট ও প্রতিরোধে সংগঠিত হয়ে উঠতে না পারে। বিরোধী দল যাতে এসব জনদুর্ভোগের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সোচ্চার হয়ে উঠতে না পারে তার জন্য বিরোধী দলকেও রাখতে পারে দৌড়ের ওপরে। সে কারণে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে সরকার তাড়া করছে জামায়াতে ইসলামীকে, আর নানা ইস্যুতে বিএনপিকে। বেগম খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদে মহান ব্রত হাতে নিয়েছে সরকার। আবার বিরোধীদলীয় নেতার ছেলে বিদেশে চিকিৎসাধীন গুরুতর অসুস্খ আরাফাত রহমান কোকোর প্যারোল বাতিল এর মধ্যে অন্যতম। যে অ্যাটর্নি জেনারেল বড় বড় মামলায় উচ্চতর আদালতে হাজির হওয়ারই সময় হয় না, সে অ্যাটর্নি জেনারেল আরাফাত রহমানের প্যারোল বাতিলের মামলার শুনানিতে নিম্ন আদালতে হাজির হয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় বিরোধী দল নিগ্রহে সরকার কতটা মরিয়া।
এর মধ্যে আবার গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয় ঘেরাও করে শত শত র্যাব-পুলিশ।
এমনিতেই সে অফিসে ভিড়বাট্টা কম। ব্যাপকভাবে তার সমর্থকদের সেখানে সমবেত হওয়াও দু:সাধ্য ব্যাপার। সেখানে মধ্যরাতে শত শত র্যাব-পুলিশ আতঙ্কের সৃষ্টি করতে চেয়েছে, নাকি তারা বেগম খালেদা জিয়াকেই গ্রেফতার করতে চেয়েছিল এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যটি কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি বলেছেন, ওই ঘটনা বিএনপি’র সাজানো নাটক। তার অর্থ দাঁড়ায় র্যাব-পুলিশের ব্যবহৃত গাড়ির মতো অনেক গাড়ি জোগাড় করেছে বিরোধী দল। তারপর কোনোটির গায়ে র্যাব, কোনোটির গায়ে পুলিশ লিখেছে। সেখানে বহুসংখ্যক কর্মীকে র্যাব-পুলিশের পোশাক পরিয়ে একই ধরনের অস্ত্র হাতে দিয়ে গাড়িতে বসিয়েছে। কোনো কোনো কর্মীকে সাজিয়েছে গুলশান থানার ওসি বা র্যাবের কর্মকর্তা। তারপর ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে, ‘অল কোয়াইট। ফাইভ, ফোর, থ্রি, টু, ওয়ান, জিরো, অ্যাকশন।’ তারপর নাটক শুরু হয়ে গেল। এমন আজগুবি গাঁজাখুরি কথা কোনো দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলতে পারেন ভাবতেও কষ্ট হয়।
শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিশাল মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় যে চার নেতা খুন হয়েছিলেন তার সাথে যুক্ত ছিলেন জিয়াউর রহমান। এটিও কম গাঁজাখুরি কথা নয়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর সামরিক অভ্যুথান ঘটিয়েছিলেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ। এ অভ্যুথানের সাথে সাথে জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেছিলেন খালেদ। তিনি ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের পূর্বপর্যন্ত গৃহবন্দীই ছিলেন, তেমন অবস্খায় জিয়াউর রহমান কেমন করে চার নেতা হত্যায় জড়িত থাকলেন সেটা বের করা ভারি দু:সাধ্য কাজ। এসব অভিযোগ যে ভিত্তিহীন সেটা না জানার মতো নাবালক সৈয়দ আশরাফ নন। তাহলে কেনো তিনি এ ধরনের অভিযোগ উথাপন করলেন? তার উদ্দেশ্য একটাই, সেটি হলো বিএনপি’র রাজনীতিকে তাৎক্ষণিকতায় ব্যস্ত রাখা। বিএনপি’র অবিসংবাদিত নেতা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে এ ধরনের কোনো কটূক্তি করলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি’র নেতাকর্মীরা এর প্রতিবাদে সোচ্চার হবে। তারা আর দ্রব্যমূল্য আইন-শৃঙ্খলা ও দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তির বিরুদ্ধে সরব হওয়ার অবকাশ পাবে না। সরকার তার অপকর্ম চালিয়ে যাবে।
এ কৌশল ধারায় আপাতত সর্বশেষ পালকটি যুক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে। জেলহত্যা দিবসের আলোচনা সভায় তিনি বলেছেন, বিরোধী দল নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। বিদ্যুৎ সঙ্কট নিরসনে চরমভাবে ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘গভীর রাতে যখন বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয় না তখনো লোডশেডিং কেন হয় বুঝে নেবেন। ষড়যন্ত্রের এটা একটি মাত্র উদাহরণ।’ এ ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা আমরা আগেও শুনেছি। রূপগঞ্জের চৌদ্দগ্রামে আর্মি হাউজিং নিয়ে যখন একসাথে ফুঁসে উঠেছিল গোটা এলাকার মানুষ তখনো সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, বিরোধী দল এলাকার জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছে। যাক, এ থেকে তবু একটা বিষয় বেরিয়ে এলো, বিরোধী দল একসাথে চৌদ্দগ্রামের সব মানুষকে উসকে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। আমরা ভেবেছিলাম বিরোধী দল বুঝি নি:শক্তি হয়ে পড়েছে। কিন্তু সরকার প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিলো, বিরোধী দল নি:শক্তি তো হয়ইনি বরং একযোগে বিপুলসংখ্যক মানুষকে জাগিয়ে তোলার বলে অধিকতর বলীয়ান হয়েছে। সরকার দিতে পারে না বিদ্যুৎ, তাই নতুন সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ভাড়ার বিদ্যুতের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের ব্যবস্খা হয়েছে। অথচ মধ্যরাতের লোডশেডিংয়ের জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করছেন। এ রকম আজগুবি কথা যে বলা যায় ভাবতে কষ্ট হয়। সরকার সম্ভবত ধরে নিয়েছে, তারা যত আজগুবি কথাই বলুক না কেন, জনগণ তা বিশ্বাস করবে। কিন্তু আমরা বলছি, দেশে সে পরিস্খিতি নেই। দশ কোটি মানুষ এখন শিক্ষিত। তাদের ধোঁকা দেয়া এখন অত সহজ নয়। আর সরকারের এ কথা সত্য হলে পরিস্খিতি এই দাঁড়ায়, বিরোধী দল একযোগে গ্রামকে গ্রাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিংবা এখন নিয়ন্ত্রণ করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে সব ক্ষেত্রে। তা হলে সরকারকে তো সতর্ক হতেই হয়।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]
[সূত্রঃ নয়া দিগন্ত, ০৬/১১/১০]
Click This Link