বিঃদ্রঃ আলোচনাকে ব্যাপক অর্থে ধরতে হবে। কেননা, আল্লাহ্র ধারণা কোন গণ্ডী দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না।
হাদিস দিয়ে শুরু করছি –
হুযুরে পাক (দঃ) এর বাণী – আমি আল্লাহ্কে তোমাদের অপেক্ষা বেশী জানি আর আল্লাহকে জানা ও চিনা মনের কাজ। কারণ আল্লাহ্ বলেন, “কিন্তু তিনি তোমাদের মনের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের পাকড়াও করিবেন।”
বুখারী শরীফ
তুমি কি সে লোককে দেখনি, যে পালনকর্তার ব্যাপারে বাদানুবাদ করেছিল ইব্রাহীমের সাথে এ কারণে যে, আল্লাহ সে ব্যাক্তিকে রাজ্য দান করেছিলেন? ইব্রাহীম যখন বললেন, আমার পালনকর্তা হলেন তিনি, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। সে বলল, আমি জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটিয়ে থাকি। ইব্রাহীম বললেন, নিশ্চয়ই তিনি সুর্যকে উদিত করেন পূর্ব দিক থেকে এবার তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত কর। তখন সে কাফের হতভম্ব হয়ে গেল। আর আল্লাহ সীমালংঘণকারী সম্প্রদায়কে সরল পথ প্রদর্শন করেন না।
আল-কুরআন(২-২৫৮)
যারা কিছু জানে না, তারা বলে, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে কেন কথা বলেন না? অথবা আমাদের কাছে কোন নিদর্শন কেন আসে না? এমনি ভাবে তাদের পূর্বে যারা ছিল তারাও তাদেরই অনুরূপ কথা বলেছে। তাদের অন্তর একই রকম। নিশ্চয় আমি উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করেছি তাদের জন্যে যারা প্রত্যয়শীল।
আল-কুরআন(২-১১৮)
সবকিছুর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল কালিমা তাইয়্যিবা –
“ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”
লা = নাই, অস্তিত্বহীন, যা অবস্থান করে না, সত্ত্বাহীন।
ইলাহ = মাবুদ, ঈশ্বর, বস্তু (ব্যাপক অর্থে)।
ইল্লাল্লাহু = আল্লাহ্ ছাড়া (মুলত ইলাহ এবং আল্লাহ্ শব্দের অর্থ একই হলেও এই কালিমাতে সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে)।
মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ = মুহাম্মাদ (দঃ) আল্লাহ্র রাসুল।
মূলত “ইলাহ” বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা করব।
ইলাহ শব্দটির অর্থ যদি বস্তু ধরি তবে এখানে সারাদিন ধরে আলোচনা করা যাবে। অনেকের ধর্ম অনুভূতিতে আঘাত লাগবে। তথাপিও আলোচনার স্বার্থে আমাকে ক্ষমা করবেন।
পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় যা কিছু Exist করে তাই বস্তু। তা যদি নিউট্রনের চেয়েও ক্ষুদ্র হয় তবুও তা বস্তু। এক কোষী অ্যামিবাও বস্তু।আবার বৃহৎ ক্ষেত্রে এই পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র ,তারা,তারকারাজি,গ্যালাক্সি, মহাবিশ্ব, ব্ল্যাকহোল সবকিছুই বস্তু এবং বস্তুবিজ্ঞানের অন্তর্গত। প্রতিনিয়ত আমাদের এসব বস্তুর উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়, আমরা চাইলেও থাকতে হয়, এমনকি না চাইলেও। আমরা এসব বস্তুর সাথে যুক্ত/ নির্ভরশীল। তা আমরা আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণ করলেও নির্ভর করতে হয় (এটা আরেক আলোচনার বিষয়)। জীবনে চলতে ফিরতে কিভাবে বস্তুর উপর নির্ভরশীল হতে হয় তা ছোট বাচ্চারও জানা। মোটকথা বস্তু জগতে আমাদের বসবাস, এর উপরেই আমাদের জীবন যাপন, ভোগ-উপভোগ, আনন্দ -বেদনা সব কিছু। প্রতিনিয়ত বস্তুর রূপান্তর সত্যিই বিস্ময়কর !
কিছু কিছু ধর্ম চূড়ান্ত বস্তুবাদী। যেমন বস্তুর উপর এই যে আমাদের নির্ভরশীলতা এর উপর ভিত্তি করেই সনাতনীরা বিভিন্ন বস্তুর পূজা করত। প্রত্যেকটা শক্তিকে স্রষ্টার সাথে গুলিয়ে ফেলত। অজ্ঞতা এবং অবাধ্যতার কারণে সৃষ্ট শক্তিগুলোকে পূজা অর্চনা করে নিজেদের দুর্বল বিশ্বাস জাহির করত। যেমন – সাপকে দেবী মেনে নিলেও সাপের বিষের ভয়ে তাকে মেরে ফেলে নিজেদের অসহায়ত্ব মেনে নিতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। প্রকৃতপক্ষে সাপ কিন্তু ভয়ংকর নয়। তাঁর ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। কেউ কেউ বিশেষ ক্ষমতাবান ব্যাক্তিকে স্রষ্টার সাথে গুলিয়ে ফেলত। আসলে মানুষ কিছু না কিছুকে আঁকড়ে বেচে থাকতে চায়, এই দুর্বল অনুভুতির কারণে সে ভুল পথে পা বাড়িয়ে সে বস্তু/প্রানি/মানুষকে স্রষ্টা বলে পুজা/ইবাদত করত। আর এ সকল বস্তুই অনাদিকাল থেকে একই তথা স্রষ্টার বেঁধে দেয়া নিয়মে চলছে এবং চলবে(সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝা যায়)।
এখন কথা হল বস্তুর উপর এত নির্ভরশীলতা সত্বেও আল্লাহ্ কেন বস্তুবাদকে রহিত করেছেন? কারণ একটাই, আমরা/ মানুষ যা কিছুই করি না কেন তা আল্লাহ্রই সৃষ্ট বস্তু। মাটি দিয়ে তৈরি মূর্তিও বস্তু।
আমরা বস্তুর উপর নির্ভরশীল হলেও আল্লাহ্ বস্তু হতে সম্পূর্ণ মুক্ত স্বত্বা। সকল বন্ধন হতে আল্লাহ্ মুক্ত। আর এই মুক্ত স্বত্বার সাথে বস্তু যুক্ত করার নামই শিরক।
এ সম্পর্কে আলী (রাঃ)-এর একটি খুৎবা খুবই প্রণিধানযোগ্য –
"যে ব্যাক্তি আল্লাহ্তে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করে সে আল্লাহ্র একত্বে বিশ্বাস করে না।.যে ব্যাক্তি তাঁর অবস্থান নির্দেশ করে এবং তাঁকে ক্লপ্না করে,সে তাঁকে বুঝায় না।.যত কিছু আকার আকৃতিতে বুঝা যায় তাঁর সবই সৃষ্ট এবং যা কিছু অন্য কিছু দ্বারা অস্তিত্ববান তা হল ওটার কারণ, আল্লাহ্ হল সব কারনের কারণ।
যখন তিনি কিছু সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন তখন তিনি বলেন “হও” আর ওমনি তা হয়ে যায়। কিন্তু তাঁর এই “হও” বলাও স্বরের সাহায্যে নয় যা কান শুনতে পাবে। তাঁর কথা বলাও একটা সৃষ্টি কর্ম। তাঁর মত কোন কিছুর অস্তিত্ত কস্মিনকালেও ছিল না। যদি এমন কিছু থাকত তবে অবশ্যই দ্বিতীয় খোদা থাকত।
তিনি বিভিন্ন বস্তুকে একীভূত করেন,একীভূত বস্তুকে আলাদা করেন এবং দূরবর্তীকে নিকটবর্তী আর নিকটবর্তীকে দূরবর্তী করেন। তিনি কোন প্রকার সীমার মধ্যে আবদ্ধ নন এবং সংখ্যা দ্বারা গনণীয় নন,তিনি বস্তু নিরপেক্ষ। বস্তু শুধুমাত্র স্বগোত্রীয় জিনিস্কে ঘিরে থাকতে পারে এবং দেহ শুধুমাত্র নিজের সদৃশ বস্তুকে নির্দেশ করতে পারে। “মুঞ্জু” (হতে বা থেকে) শব্দ বস্তুর চিরন্তনতা মিথ্যা প্রমাণ করে, “কাদ” (সংগঠিত হওয়ার কাল) শব্দ বস্তুর অনাদিত্য প্রমাণ করে এবং “লাওয়ালা” (যদি এমন হত) শব্দ বস্তুর পূর্ণতা অস্বীকার করে।
বস্তুর মাধ্যমেই স্রষ্টা নিজেকে প্রকাশ করেন এবং বস্তুর মাধ্যমেই তিনি দৃষ্টির অন্তরালে সুরক্ষিত। স্থবিরতা ও গতি তাঁর মধ্যে সংগঠিত হয় না। যদি তাঁর মধ্যে কোন কিছুর কমতি থাকত তবে পূর্ণতারও প্রশ্ন উঠত। সেক্ষেত্রে আয়াত(নিদর্শন) তাঁর মাঝে ফুটে উঠত। এবং সৃষ্টি তাঁর আয়াত না হয়ে তিনি নিজেই একটা আয়াত হয়ে যেতেন। তাঁর নিরপেক্ষতার কুদরত দিয়ে তিনি বস্তু মোহের অতীত। কিন্তু বস্তু একে অপরের মুখাপেক্ষী। এ কথা বলা যাবে না তাঁর সীমা আছে, আদি আছে বা অন্ত আছে। তিনি কোন কিছুর নিয়ন্ত্রণাধীন নন যাতে তাঁর উত্থান পতন থাকতে পারে। কোন কিছুই তাঁর ধারক বাহক নয় যা তাঁকে বক্র বা সোজা করতে পারে।
বিলয় ঠেকাতে পারলে পৃথিবী চিরস্থায়ী হত,কিন্তু বাস্তবে আল্লাহ্ ব্যাতিত কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়, এ বিশ্ব চরাচর কোন দাম্ভিক অংশীদারের বিরুদ্ধে সৃষ্টি করেননি, বা তিনি একাকীত্ব অনুভব করে সঙ্গ পাওয়ার জন্য সৃষ্টি করেন নি।”
=আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালেব=
তাহলে বস্তু ছাড়া আমরা চলব কি করে? কিংবা বস্তু ব্যাবহারে কি শিরক হবে?
উত্তর – না। উপায় একটাই “ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ।” মোহ ত্যাগ করতে হবে।
বুঝা গেল আমরা যত ছবিই আঁকি না কেন তাতে কোন লাভ নেই। কারণ আল্লাহ্ এসবের উর্ধ্বে, আর তাঁর প্রিয় হাবীব মোস্তফা (সাঃ) ও এসবের উর্ধ্বে। তাঁদের নিয়ে এসব করা দুর্বল চিত্তের কাজ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


