| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হুমায়রা হারুন
মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব শুধু প্রযুক্তিতে নয়, বরং মননের বিনিময়ে। ব্লগে যোগাযোগের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠত্বেরই প্রকাশ ঘটে। আপনি যখন লেখেন, মন্তব্য করেন, কিংবা অন্যের ভাবনা পড়েন — আপনি তখন মানব প্রজাতির মননে অংশ গ্রহন করেন।

সৃষ্টি, চেতনা ও আত্মার চিরন্তন যাত্রা -তৃতীয় স্তর
বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন — জ্ঞানের সূর্যোদয় এবং আত্মার উন্মেষ
দ্বিতীয় স্তরের আত্মা যখন অনুধাবন করতে পারে যে “বিশ্বাস” আর “ভয়” যথেষ্ট নয়, তখন জন্ম নেয় প্রশ্ন, যুক্তি, অনুসন্ধানের। এই স্তর মানুষের চেতনার প্রকৃত স্বরূপ জাগরণের সময়। এ স্তরে অনুভূতিকে অন্ধভাবে আত্মা গ্রহণ করতে চায় না। বরং সে ব্যাখ্যা চায়ঘটনার পিছনে কারণ চায়। এ থেকেই শুরু হয় বুদ্ধিবৃত্তিক অধ্যায়ের সূচনা। আত্মা যেন আলোর দিকে এগিয়ে যায়। আকাশ তখনো ফ্যাকাশে, তবে সোনালি রঙের প্রথম রেখাগুলো দিগন্তে উঁকি দিচ্ছে।
এই স্তরেই মানুষ শেখে— 'আমি ভাবতে পারি। আমি প্রশ্ন করতে পারি। আমি জানতে পারি।' এই বক্তব্যই বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার জন্ম দেয়। এ স্তরে মানুষের বুদ্ধিবোধ পরিপক্ব হতে শুরু করে। সে চিন্তা করে, পর্যবেক্ষণ করে, তুলনা করে, সিদ্ধান্ত নেয়। সে বুঝতে পারে, অন্ধ বিশ্বাস তাকে পথ দেখাতে পারবে না। সত্য জানতে হলে তাকে জানতে হবে দুটো বিষয় –কেন, কিভাবে ?এখানে যুক্তি প্রথমবারের শক্ত, দৃঢ়, সংহত হয়।
ধর্ম ও দর্শনে তৃতীয় স্তরের ব্যাখ্যাঃ
উপনিষদীয় জ্ঞানঃ উপনিষদে বলা হয়েছে— “জ্ঞানই মুক্তির পথ।” এ পর্যায়ে মানুষ “জিজ্ঞাসা” থেকে “জ্ঞান” অর্জনের পথে পা বাড়ায়।
বৌদ্ধ দর্শনে আছে সম্যক-দৃষ্টির ধারণা। এটি বোধির পথে প্রথম পদক্ষেপ। ধর্ম, কুসংস্কার নয়, জ্ঞান ও বুদ্ধিবাদ এ স্তরে প্রভাব বিস্তার করে।
খ্রিস্টধর্মে বলে, “বুদ্ধি” বা “ঈশ্বরীয় যুক্তি” ব্রহ্মাণ্ডের কাঠামোর ভিত্তি।
সব দর্শনে সৃষ্টি, চেতনা ও আত্মার চিরন্তন যাত্রার তৃতীয় স্তরে এসে বুদ্ধির দ্বারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
আধ্যাত্মিক শক্তির সূক্ষ্ম স্পন্দন — জ্ঞানের গভীরতাঃ
এই স্তরে এসে মানুষ শুধু বিজ্ঞানী নয়, শুধু দার্শনিক নয় — সে উভয়ই। তার ভেতরে সঞ্চিত আধ্যাত্মিক শক্তির জাগরণ ঘটে। অনেকে অন্তর্দৃষ্টি,টেলিপ্যাথি অনুভব করে। ভবিষ্যৎ অনুধাবন করা, গভীর ধ্যানে মগ্ন হওয়ার মত গুণাগুন লব্ধ করে। এগুলো কোনো অলৌকিক বিষয় নয়। এ হলো চেতনা-বিকাশের স্বাভাবিক ফল।
তুলনামূলক ব্যাখ্যাঃ
হিন্দু যোগ - হিন্দু দর্শনে আত্মার বিবর্তনের প্রথম স্তরকে “তামসিক” স্তর বলে। এটা অন্ধকার, অজ্ঞতা, বিভ্রান্তির স্তর। জীব আত্মা তখনো মায়ার পর্দায় ঢাকা। নিজের স্বরূপ সম্পর্কে অচেতন। আর দ্বিতীয় স্তরটিকে “রাজসিক” স্তর বলে। এ স্তরে মানুষের ভেতরের শক্তি, মানসিক চাহিদা ও চিন্তার জন্ম হয়। আধ্যাত্মিকতার প্রথম ধাপ শুরু হয়। তৃতীয় স্তরে এসে কুন্ডলিনী শক্তির প্রথম জাগরণ হয়।মানসিক ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটে।
বৌদ্ধ ধ্যান – বৌদ্ধধর্মে প্রথম স্তরে আত্মার অবস্থাকে বলা হয় “অবিদ্যা” অবস্থা —যেখানে মানুষ বাস্তবতার প্রকৃত স্বরূপ দেখতে পায় না। চক্রাকারে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। দ্বিতীয় স্তরে এসে এটি ‘স্মৃতি ও সচেতনতা’ জন্মানোর আদি ধাপে উন্নীত হয়। অবিদ্যা এখনো প্রবল, তবে জ্ঞানতৃষ্ণার জন্ম হয়। তৃতীয় স্তরে মনের ক্ষমতার বৃদ্ধির ফলে অন্তর্দৃষ্টির সূচনা হয়। বুদ্ধ বলেছেনঃ “মনই সব কিছুর উৎস।” ধ্যানের মাধ্যমে অন্তর্দৃষ্টি তৈরি হয়।
সুফি তরিকায় চেতনার প্রথম স্তরকে নাফসে আম্মারা বলা হয় । এটা আত্মার অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিপক্ক অবস্থা। সেখানে প্রবৃত্তি দ্বারা সে নিয়ন্ত্রিত। দ্বিতীয় স্তরকে বলে নফসে লাওয়ামা। এখানে আত্মা ভুল - সঠিকের বিচার করতে শুরু করে। তৃতীয় স্তরে আত্মার উপলব্ধির সঞ্চার হয়। শুরু হয় জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা।
খ্রিস্টীয় মিস্টিসিজম- আত্মার প্রথম স্তরকে “spiritual infancy” বা আত্মার শৈশব অবস্থা বলে। এখানে মানুষ পাপ বা ভুলের অন্ধকারে আবদ্ধ থাকে। সত্যের আলো তখনো তার কাছে পৌঁছেনি। দ্বিতীয় স্তর হলো spiritual awakening–এর প্রথম পর্যায়। মানুষ বুঝতে পারে যে তার থেকেও উচ্চ কোন শক্তি বিদ্যমান। তৃতীয় স্তরে মনের গভীর উপলব্ধির প্রস্ফূরণ ঘটে।
তৃতীয় স্তরের বৈশিষ্ট্য হলো আত্মা কুসংস্কারের ভাঙন ও বিশ্বাস থেকে যুক্তির দিকে সরে আসা। এ স্তরে মানুষ তার পূর্বের অন্ধ আস্থাগুলোর বিপক্ষে প্রশ্ন করে। যেমন -
• কেন দেবতা রাগ করে?
• নিয়ম কে বানিয়েছে?
• প্রকৃতি কি সত্যিই শাস্তি দেয়?
এই প্রশ্নগুলি পুরোনো বিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে দেয়। এ স্তরে উপনীত হলে অনুসন্ধিৎসু মন সবকিছুর মাঝে অগ্রহ তৈরী করে। মানুষ বই পড়ে, গবেষণা করে, ইতিহাস খুঁজে দেখে, বিজ্ঞান বোঝার চেষ্টা করে। সে মনে করে, বিশ্বাসকে নয়, সত্যকে গ্রহণ করো। মানুষ প্রকৃতির নিয়ম উপলব্ধি করতে শেখে। বিজ্ঞান ও দর্শনের মিলন ঘটাতে চেষ্টা করে। মানুষ এ স্তরে বুঝতে পারে—বিশ্ব কোনো রহস্য নয়; এটি নিয়মে চলে। সে উপলব্ধি করে—মহাকর্ষ, বায়ুপ্রবাহ, ঋতু পরিবর্তন, জন্ম-মৃত্যু - সবই প্রকৃতির নিয়ম। এবং ঘটনাগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধ। এ উপলব্ধি মানুষকে “ধর্মীয় ভয়” থেকে মুক্ত করে। সব ধর্মেই তৃতীয় স্তরে “জ্ঞান-অনুসন্ধান” গুরুত্ব পায়।
• বৌদ্ধধর্মে অনুসারেঃ বুদ্ধ নিজেই কুসংস্কার ভেঙে যুক্তির পথ প্রদর্শন করেছেন। বৌদ্ধধর্ম যেমন বলে “প্রতীত্য সমুৎপাদ”—সবকিছু কারণ-ফল দ্বারা চলছে।
• হিন্দু দর্শনেঃ উপনিষদে জ্ঞানকে প্রাধান্য দেওয়া। হিন্দুধর্ম অনুসারে “কর্মফল” ধারণার আবির্ভাব হয়। এই ধারণা মতে প্রতিটি কাজের ফল আছে।
খ্রিস্টধর্ম অনুসারে ঈশ্বরের নিয়ম অনুযায়ী প্রকৃতি চলে।
সব ধর্মই স্বীকার করে— বিশ্ব নিয়মের অধীন। এ স্তরে মানুষ উপলব্ধি করে জ্ঞানই মুক্তির পথ। তার ভেতর জন্ম নেয় সত্যের তৃষ্ণা, গবেষণার আকাংখা, জ্ঞানের আলোয় এগোনোর অদম্য ইচ্ছা। এখানে থেকেই জন্ম নেয় দার্শনিক, বিজ্ঞানী, গবেষক, সাধক ও প্রজ্ঞাবান মানুষ। এ স্তর আত্মাকে নিয়ে যায় তৃতীয় স্তরের শিখর থেকে চতুর্থ স্তরের পরিপূর্ণ সত্যের পথে।
আজকের আধুনিক বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত হলেও চেতনাগতভাবে তৃতীয় স্তরের মধ্যভাগে অবস্থান করছে। এবং চতুর্থ স্তরে উন্নীত হবার পথে। আমাদের মনে প্রশ্নের সঞ্চার হয়, আমরা প্রশ্ন করি, বিজ্ঞান চর্চা করি, বিজ্ঞানের সূত্রগুলো অনুসরণ করি, আধ্যাত্মিকতার অনুসন্ধান করি । বিশ্বাসকে যাচাই করবার চেষ্টা করি।কিন্তু এখনো পুরোপুরি চতুর্থ স্তরে পৌঁছাইনি। তবে পৌঁছাতে বেশী দেরীও নেই।
এক কথায়ঃ
হিন্দু দর্শন ও উপনিষদীয় চিন্তা অনুসারেচেতনা নিজেকে প্রকাশ করে স্তর স্তরে।
উপনিষদীয় ৫টি কোষ (শরীর-চেতনার স্তর)ঃ
১. অন্নময় কোষ — শারীরিক দেহ
২. প্রাণময় কোষ — প্রাণশক্তি/শ্বাস/উদ্যম
৩.মনোময় কোষ — মানসিক জগৎ/কল্পনা/ভয়/বিশ্বাস
৪.বিজ্ঞানময় কোষ — বুদ্ধি/জ্ঞান/যুক্তি
৫.আনন্দময় কোষ — পরমানন্দ/সৃষ্টিশক্তি/ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ
বৌদ্ধ দর্শন (তিব্বতী/মহাযান/থেরবাদ)
বৌদ্ধধর্মের মূল শিক্ষা:
অবিদ্যা/ অজ্ঞতা → যা দুঃখ আনয়ন করে → চেতনার জাগরণ হলে → আত্মা নির্বাণ লাভ করে।
এ ক্ষেত্রে চেতনাবিকাশের ধাপঃ
১ স্তর. কুসংস্কার এবং অজ্ঞতা (অবিদ্যা)
২ স্তর. ভ্রান্ত ধারণা
৩ স্তর. জ্ঞান ও দৃষ্টির শুদ্ধি
অর্থাৎ, ১–২ স্তর = অবিদ্যা, কুসংস্কার, উপাসনার প্রাথমিক যুগ।
৩য় স্তর = জ্ঞান/সম্যক দৃষ্টি
সুফিবাদ
সুফিবাদে মূল লক্ষ্য হলো নফসকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা।
নফসের উন্নতির ৭টি স্তরঃ
১. নফস আম্মারা — প্রবৃত্তিনির্ভর, অজ্ঞতা
২. নফস লাওয়ামা — আত্মসমালোচনা
৩. নফস মুলহামা — জ্ঞান, অনুপ্রেরণা
৪. নফস মুতমাইন্না — প্রশান্তি
৫. নফস রাজিয়া — সন্তুষ্টি
৬. নফস মারজিয়া — আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন
৭. নফস কামিলা — পূর্ণতা, ঐক্য
সুতরাং এ আলোচনার সাথে মিল রেখে নিম্নোক্ত ভাবে ভাগ করা যায়ঃ
১ম - ২য় স্তর: প্রবৃত্তি/অজ্ঞতা
৩য় স্তর: আত্মার জাগরণ
খ্রিষ্টীয় মিস্টিসিজম
তিনটি ধাপে আত্মার উত্তোরণ ঘটে। যেমনঃ
1. Purification — পাপ পরিশোধ
2. Illumination — অন্তর্জ্ঞান
3. Union — ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন
অর্থাৎ আত্মা ইন্ডিভিজুয়াল সোল থেকে Holy Spirit-এ রূপান্তর - শেষে God-consciousness-এ পরিণতি লাভ করা
খ্রিষ্টীয় mystic দের মতে “When the soul sees no separation, creation flows through it.”
গ্রীক দর্শন (প্লেটো/প্লটিনাস/অ্যারিস্টটল)
প্লেটোর দর্শন অনুসারে আত্মার তিনটি ধরণের সমাহার। যেমনঃ
1. Appetitive — প্রবৃত্তি
2. Spirited — আবেগ
3. Rational — বুদ্ধি
পরবর্তীতে Neoplatonism-এ ধারণা করা হয়
1. Soul
2. Intellect
3. The One
যা তুলনা করলে বলা যায়ঃ
১–২ স্তর = প্রবৃত্তি/আবেগ
৩ স্তর = বুদ্ধি
আধুনিক বিজ্ঞান (নিউরোসায়েন্স,কসমোলজি ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব) চেতনাকে ব্যাখ্যা করে তিনটি স্তরে। যেমনঃ
1. Primitive brain (Reptilian)
2. Emotional brain (Limbic)
3. Rational brain (Neocortex)
তার সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন তত্ত্ব:
* Integrated information theory
* Quantum consciousness
* Unified field theory
যা তুলনা করলে দাঁড়ায়ঃ
১–২ স্তর = বেঁচে থাকার অনুভূতি/ভয়/প্রবৃত্তি
৩ স্তর = যুক্তির সন্ধান
নিউ এজ/মেটাফিজিক্স -এর মতে মহাবিশ্ব "কম্পন" বা vibration দিয়ে তৈরি।
ডাইমেনশন 3D–7D অনুযায়ী চেতনাস্তরঃ
3D: ভৌতিক জগত
4D: বিশ্বাস/এনার্জেটিক সংবেদন
5D: জ্ঞান-প্রজ্ঞা
6D: আধ্যাত্মিক সৃষ্টিশক্তি
7D: উৎস অর্থাৎ চেতনার মূল উৎস(Source consciousness)
ক্রমশঃ
সৃষ্টি, চেতনা ও আত্মার চিরন্তন যাত্রা -দ্বিতীয় স্তর
©somewhere in net ltd.