somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সৃষ্টি, চেতনা ও আত্মার চিরন্তন যাত্রা – চতুর্থ স্তর

২১ শে নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



তৃতীয় স্তরের জ্ঞান-অনুসন্ধান যখন আত্মাকে ক্লান্ত করে না বরং আরও গভীরে ঠেলে দেয়, তখন সে প্রবেশ করে চতুর্থ স্তরের মহাজাগতিক দ্বারে। এটি এমন এক স্তর যেখানে সত্য আর মায়া/ধোঁকা, আলো আর অন্ধকার, বাস্তব আর প্রতিফলিত বাস্তবতার প্রতিচ্ছবির পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। এখান আত্মা আর পথ খোঁজে না। পথ নিজেই আত্মার সামনে উন্মুক্ত হয়।
যেমন সকালের রোদ প্রথমে ফাঁকা মাঠে পড়ে, তারপর ধীরে ধীরে ছায়াগুলো সরিয়ে দেয়, তেমনি এই স্তর আত্মার সকল ছায়াকে সরিয়ে দেয়। এ স্তরে পরম বাস্তবতাকে উপলব্ধির সাথে সাথে সকল বিভ্রমের অবসান ঘটে।
এ স্তরে আত্মা সত্যকে দেখে সম্পূর্ণভাবে। তার কাছে সম্পূর্ণ ভাবে প্রতীয়মান হয় সৃষ্টি কোথা থেকে উতপত্তি লাভ করেছে, জীবন কী, মৃত্যু কী, সময়ের প্রকৃতি কী, অস্তিত্বের নিয়ম কী, কারণ-ফলাফল চক্র কীভাবে কাজ করে। এ সকল জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে এই স্তরে অগমণ হেতু তার গভীর উপলব্ধি থেকে। চতুর্থ স্তর “জ্ঞান”শুধু নয় এটি “প্রজ্ঞা”-র স্তর।

ধর্ম–দর্শনে এর ব্যাখ্যা

হিন্দু যোগ - হিন্দু দর্শনে আত্মার বিবর্তনের প্রথম স্তরকে “তামসিক” স্তর বলে। এটা অন্ধকার, অজ্ঞতা, বিভ্রান্তির স্তর। জীব আত্মা তখনো মায়ার পর্দায় ঢাকা। নিজের স্বরূপ সম্পর্কে অচেতন। আর দ্বিতীয় স্তরটিকে “রাজসিক” স্তর বলে। এ স্তরে মানুষের ভেতরের শক্তি, মানসিক চাহিদা ও চিন্তার জন্ম হয়। আধ্যাত্মিকতার প্রথম ধাপ শুরু হয়। তৃতীয় স্তরে এসে কুন্ডলিনী শক্তির প্রথম জাগরণ হয়।মানসিক ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটে। তারপর চতুর্থ স্তরে হলো “ব্রহ্ম” উপলব্ধি। যেখানে আত্মা ও ব্রহ্ম একাকার। তখন উপলব্ধি আসে “অহং ব্রহ্মাস্মি” — আমি ব্রহ্ম।
বৌদ্ধ ধ্যান – বৌদ্ধধর্মে প্রথম স্তরে আত্মার অবস্থাকে বলা হয় “অবিদ্যা” অবস্থা —যেখানে মানুষ বাস্তবতার প্রকৃত স্বরূপ দেখতে পায় না। চক্রাকারে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। দ্বিতীয় স্তরে এসে এটি ‘স্মৃতি ও সচেতনতা’ জন্মানোর আদি ধাপে উন্নীত হয়। অবিদ্যা এখনো প্রবল, তবে জ্ঞানতৃষ্ণার জন্ম হয়। তৃতীয় স্তরে মনের ক্ষমতার বৃদ্ধির ফলে অন্তর্দৃষ্টির সূচনা হয়। বুদ্ধ বলেছেনঃ মনই সব কিছুর উৎস। ধ্যানের মাধ্যমে অন্তর্দৃষ্টি তৈরি হয়। তবে চতুর্থ স্তরে উপনীত হওয়া হলো নির্বাণ লাভের প্রাথমিক স্তর। আত্মা সম্পূর্ণরূপে কুসংস্কারমুক্ত হয়।
সুফি তরিকায় চেতনার প্রথম স্তরকে নাফসে আম্মারা বলা হয় । এটা আত্মার অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিপক্ক অবস্থা। সেখানে প্রবৃত্তি দ্বারা সে নিয়ন্ত্রিত। দ্বিতীয় স্তরকে বলে নফসে লাওয়ামা। এখানে আত্মা ভুল - সঠিকের বিচার করতে শুরু করে। তৃতীয় স্তরে আত্মার উপলব্ধির সঞ্চার হয়। শুরু হয় জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা। চতুর্থ স্তরে এসে মানুষ “হক্কুল ইয়াকিন” অনুভব করে। সে সত্যকে চোখে নয়, হৃদয় দিয়ে দেখে।
খ্রিস্টীয় মিস্টিসিজম –আত্মার প্রথম স্তরকে “spiritual infancy” বা আত্মার শৈশব অবস্থা বলে। এখানে মানুষ পাপ বা ভুলের অন্ধকারে আবদ্ধ থাকে। সত্যের আলো তখনো তার কাছে পৌঁছেনি। দ্বিতীয় স্তর হলো spiritual awakening–এর প্রথম পর্যায়। মানুষ বুঝতে পারে যে তার থেকেও উচ্চ কোন শক্তি বিদ্যমান। তৃতীয় স্তরে মনের গভীর উপলব্ধির প্রস্ফূরণ ঘটে। চতুর্থ স্তরে শুরু হয় Mystic vision. ইশ্বরের আলো হৃদয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তাওবাদের দাও এর সরাসরি উপলব্ধি ঘটে। প্রকৃতি আর স্রষ্টা অবিচ্ছেদ্য । একই নিয়মে একীভূত।
সব ধর্মেই চতুর্থ স্তর পরম সত্তার উপলব্ধি অনুভব করে।

আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পরিপূর্ণতা — হৃদয় ও যুক্তির মিলন
এ স্তরে জ্ঞান আর বুদ্ধির লড়াই শেষ। আত্মা এমন ভারসাম্য অর্জন করে যা, না আবেগপ্রবণ, না কঠোর যুক্তিবাদী। বরং মাপা, শান্ত, গভীর। এই স্তরে এসে মানুষ আধ্যাত্মিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাদের মন স্ফটিকের মতো স্বচ্ছতা ধারণ করে।
এ স্তরে মানুষ শুধু জ্ঞানের অধিকারী হয় না, জ্ঞানকে মানুষ প্রয়োগ করতে শেখে। সে অন্যকে সাহায্য করা, সত্য বলা, অহং ত্যাগ করা,ধৈর্য ধারণ করা, অনিশ্চয়তার মধ্যে শান্ত থাকার গুণগুলো ধারণ করে। এগুলো আর শিক্ষার পর্যায়ে থাকে না, স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়। এ স্তরে মানুষ বুঝে জ্ঞানই আলো। আলোর অধিকারী হওয়ার মানে হলো আলো অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া। নিঃস্বার্থ ভালবাসার স্ফূরণ পরিলক্ষিত হয়।

সৃষ্টির প্রকৃতির উপলব্ধি — নিজের অবস্থানের জ্ঞান
এ স্তরে এসে মানুষ উপলব্ধি করে সৃষ্টি আছে, সৃষ্টি চলে কোন একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মে, কেউই একা নয়,সব কিছুই সংযুক্ত, পরস্পর নির্ভরশীল। সব প্রাণের অস্তিত্ব মূল্যবান। এই উপলব্ধি মানুষকে গভীর ভাবে নম্র করে তোলে । সে “আমি” কেন্দ্রিক ভাবনা থেকে সরে এসে হয়ে ওঠে বিশ্বজনীন।

আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞার শুদ্ধতা — আবেগের উত্তরণ
এ স্তরের মানুষের আবেগ থাকে, কিন্তু আবেগ তাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। তার ভয় নেই, ক্ষোভ নেই, অহং নেই, লোভ নেই। এই স্তরে সে যেন একজন নিখাদ মানুষে পরিণত হতে থাকে।
অনেক ক্ষেত্রে সে পূর্বজন্ম মনে করতে পারে। কারণ-ফলাফল চক্রের প্রকৃতি বোঝে। মৃত্যুকে ভয় পায় না। জন্ম-মৃত্যুর ঘূর্ণি তার সামনে স্পষ্টরূপে পরতীয়মান হয়। এদের জীবন দীর্ঘ হয়
মানসিক শান্তির কারণে, শারীরিক সংবেদনশীলতার কারণে এদের জীবন দীর্ঘ হয়।

ধর্ম মতে এ অবস্থার ব্যাখ্যা
হিন্দু জ্ঞানযোগ অনুসারে এ অবস্থা হলো জ্ঞানকে শুদ্ধ করা, দ্বৈত-অদ্বৈত ভেদ মুছে ফেলা।
বুদ্ধধর্ম বলে আরহত অবস্থা। আত্মিক শান্তি, মুক্ত মন, লৌকিক আবেগের ক্ষয় ঘটা।
সুফিবাদে একে ফানা অবস্থায় উপনীত হওয়া বলে, যেখানে আত্মা নিজেকে হারিয়ে পরমের সাথে মিলিত হয়।
খ্রিস্টীয় মিস্টিক অনুসারে এ অবস্থা হলো union with God যেখানে ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন ঘটা। love, compassion, truth এর সাক্ষাত পাওয়া যায়।
তাওবাদ — sage অবস্থা। মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে একীভূত হওয়ার অবস্থা হলো চতির্থ স্তর ।
সব দর্শনেই চতুর্থ স্তর “অহং থেকে নিস্তারের স্তর”।

আত্মার দায়িত্ব — সৃষ্টির নিয়ম পালন করা
এ স্তরে মানুষ বুঝতে পারে “আত্মা শক্তির দায়িত্ব আছে।” তার সত্য, তার আলো। আলো মানে জ্ঞান। সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষায় একে ব্যবহার করতে হবে। এ স্তরে আত্মা তার ব্যক্তিগত লাভ লোকসান নিয়ে চিন্তা করে না। সে কাজ করে সৃষ্টির বৃহত্তর কল্যাণে।
অন্ধ বিশ্বাসের মৃত্যু
এ স্তরে অন্ধ বিশ্বাস ভেঙে যায়। মানুষ আর ধর্মীয় ভীতি, পুরাণ, কুসংস্কার, অন্ধ আচার—
কোনো কিছুর কাছে মাথা নত করে না। সে জানে—
• সত্য পরীক্ষা করা যায়
• সত্য যুক্তিতে টিকে থাকে
• সত্য অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়
এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতায় বলেছিলেন,
‘সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,
সে কখনো করে না বঞ্চনা।

উপসংহার — আলোর দিকে উত্তরণ
তৃতীয় স্তর জ্ঞানের দ্বার খুলে দেয়। চতুর্থ স্তর সেই জ্ঞানকে বাস্তবায়ন করে। এ স্তরে আত্মা পরিপক্ব, মুক্ত, উন্নত, ধীর, স্থির শান্ত, আলোকিত। চতুর্থ স্তর আত্মার কাছে সেই বার্তা পৌঁছে দেয় যে এখন তুমি সামনে এগোও, পঞ্চম স্তরের সৃষ্টিশীল জীবনে।
ক্রমশঃ
সৃষ্টি, চেতনা ও আত্মার চিরন্তন যাত্রা -তৃতীয় স্তর
দ্বিতীয় স্তর
প্রথম স্তর
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৫২
৭টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিচার চাই? না ভাই, আমরা "উল্লাস" চাই

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৩৭





দীপু চন্দ্র দাস একটি পোশাক শিল্প কারখানায় চাকরি করতো। সম্প্রতি দীপু দাস তার যোগ্যতা বলে সুপার ভাইজার পদে প্রমোশন পেয়েছিলো।

জানা যায়, সুপারভাইজার পজিশনটির জন্য আরও তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×