=প্রথম জুম'আ ও স্বদেশীর ভিড়ে=
গত দিনের ভ্রমণ-ক্লান্তি আর খোঁজা-খুঁজির শ্রান্তি লাঘবে ভোরের ঘুমটি ভাঙ্গলো যখন, তখন চোখ মেলতেই দেখি জ্ঞান-পিপাসুদের সাজানো বাগান। কত আর হবে সকাল নয় কি সাড়ে নয়টা, বসেছিলাম কিছুক্ষণ, দেখেছিলাম জ্ঞানের আকাংখা, সৌন্দর্য, শৃংখলা। দিনটি ছিল শুক্রবার, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদে এটাই আমার জীবনের প্রথম জুম্'আ, আত্মার রঙ যেন আমি দু'চোখেই দেখতে পাচ্ছি। অযু করে পবিত্রতা অর্জন করে ধীর পদে চললাম মসজিদের পানে, পথ তো নয় যেন জনতার ঢল। মসজিদের ভেতরকার অবস্থা উপছে পড়া, অবশেষে যেন সারিগুলো খুঁজলে দু'টো পা রাখার জায়গাও পাওয়া যাবে না। শুক্রবারে ছাদ খুলে দেয়া হয়, এছাড়া মদীনা যেহেতু মক্কার উত্তরে অবস্থিত তাই মদীনার কিব্লা দক্ষিণে, মসজিদের বাইরের দক্ষিণাংশ মানে ইমামের সম্মুখের অংশ বাদ দিয়ে পূর্বাংশ, পশ্চিমাংশ ও উত্তরাংশেও মুসল্লীদের বৃদ্ধি অনুযায়ী বিস্তৃতি ঘটতে থাকে এইদিনে। প্রায় এগারটার মধ্যে পেঁৗছেও প্রথমদিকে স্থান পেলাম না; বর্তমান প্রথম ছাতার সামনের অংশে জায়গা পেলাম। অনুভব করলাম মহান আল্লাহ্ তা'আলার ইবাদাতে মানুষের মনের প্রতিযোগী মনোভাব; কল্যাণ লাভের প্রতিযোগিতা। জুম্'আ শেষে আবারো প্রচণ্ড জনস্রোতে যেন অনেকটা ভাসতে ভাসতেই পেঁৗছে গেলাম বাসায়, যেখানে মেহমান হলাম মদীনার।
অবাক হলাম জ্ঞানপিপাসুদের ভীড় দেখে, আরো আনন্দ ছড়ালো মন-প্রাণজুড়ে মধুর ব্যবহার, যেন সবাই আমাকে কতকাল থেকে চেনে-জানে; অথচ আজই প্রথম সাক্ষাৎ। তেমনি সাক্ষাৎ ঘটলো মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন ছাত্রের সাথে। মাদ্রাসা শিক্ষা বা দ্বীনী শিক্ষার সৌভাগ্য আমার জীবনে আসেনি, ছোট বেলায় মক্তবে কিছুদিন কুরআন পড়েছিলাম বটে তাও যৌবনের প্রারম্ভেই যেন খেয়ে-দেয়ে হজম। তবে মাঝে মাঝে ইচ্ছে জাগতো, 'যদি মাদ্রাসায় পড়তে পারতাম', কিন্তু পরিবার-পরিজন ছিল সাধারণ শিক্ষার পক্ষপাতী, সেসব বুঝে-শুনে আমার ইচ্ছেগুলো মনের সিন্দুকেই বন্দী হয়ে ছিল, ভাব প্রকাশের মুক্তিও মেলেনি তাদের নসীবে। আমাদের গ্রামাঞ্চলে মাদ্রাসার ছাত্রদের যে দৈন্যদশা দেখতাম তাতে ওদেরকে আমার মাঝে মাঝে করুণার পাত্র মনে হতো।
হবে না কেন, আমাদের পিতা-মাতা এবং সমাজই এর জন্য দায়ী, তাদের যে সন্তানটির মধ্যে তারা জ্ঞানের প্রখরতা দেখে, যাকে সুস্থ-বুদ্ধিমান মনে হয়, তাকেই তারা খেয়ে না খেয়ে সাধারণ শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত করতে চায়, অবস্থাভেদে কখনো কখনো দেখা যায় গ্রামের চাষাভূসা পিতার পরিচয় দিতেও তখন উচ্চশিক্ষিত সন্তান লজ্জাবোধ করে, হায় শিক্ষা! হায় প্রায়চিত্তভোগী পিতা-মাতা!! পক্ষান্তরে যে ছেলেটি তার দেখতে হাবাগোবা, পক্ষাঘাতগ্রস্ত তাকেই সে আল্লাহ্র রাস্তায় দান করতে তৎপর হয়ে উঠে, ভর্তি করিয়ে দেয় মাদ্রাসায়, বেচারা দ্বীন শিখে এসে বাবা-মায়ের সেবায় নিয়োজিত হয় আর নিয়োজিত হয় সেই সমাজকে আল্লাহ্র দ্বীন শিক্ষা দিতে, যে সমাজ তাকে এর বিনিময়ে একমুঠো চাল দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে। এহেন সমাজের পিতা-মাতা যদি মৃতু্যপথে ক'ফোঁটা জল চেয়ে চেয়ে না পেয়ে তৃষ্ণার্ত বুকে পৃথিবী ত্যাগ করে, তো এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই; পাওনা কখনো কখনো শুরু হয়ে যায় গন্তব্যে পেঁৗছানোর পূর্ব থেকেই। তো এইসব কারণে-অকারণে বিতশ্রদ্ধ ছিলাম আমি মাদ্রাসা ছাত্রদের প্রতি।
আমায় চমৎকৃত করলেন তিনি, তার কথার সৌন্দর্য-মাধুর্য, তার পোষাক-পরিচ্ছদ, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা সবকিছুতেই আমি এমনকিছু দেখতে পেয়েছিলাম যা কিনা সাধারণ শিক্ষাজীবনে আর কোথাও আমার নযর কাড়েনি, যদিও আমার অপছন্দের তালিকায় মাদ্রাসার ছাত্ররা তখনো অনেকাংশ জুড়ে। আমি বাধ্য হলাম যেন, তার সাথে পরবর্তী সাক্ষাতের প্রস্তাব দিতে এবং তার বিদ্যাপীঠ মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দেখার আগ্রহ প্রকাশ করতে। তিনি সানন্দে রাযী হলেন, ঠিক হলো পরদিন মানে শনিবার বিকেলে।
দুপুরের পাঠ চুকে আসর পড়ে বেশ ঘুরোঘুরি করলাম মদীনার বাঙ্গালী মার্কেটে। এখানেও অন্যান্য প্রতিটি শহরের মতই অবস্থা, বাংলাদেশীরা তাদের পারস্পরিক সাক্ষাৎ ও যোগাযোগ রক্ষার্থে একটা নির্দিষ্ট এলাকা বেছে নেয় যেন, কিংবা গতানুগতিকভাবেই যেন গড়ে উঠে শহরের প্রাণকেন্দ্রের কোন এলাকাজুড়ে বাংলাদেশীদের বাজার বা পাড়া, যাকে এখানে সবাই বলে 'বাঙ্গালী মার্কেট'। অবশ্য শহরভেদে নামেও কিছু ভিন্নতা দেখা যায় যেমন, ইয়নাবোতে বাংলাদেশীদের একত্র হওয়ার এলাকাটিকে বলে 'নিমতলা', রিয়াদে দেখেছি 'বাত্হা' ও 'হারাহ্', মক্কায় 'মিসফালাহ্' ইত্যাদি ইত্যাদি, কখনো স্থানের সঠিক নামে কখনো ছদ্মনামে পরিচিত। মদীনার বাংলা মার্কেটের আরেক নাম হচ্ছে 'বাংলাগলি' যদিও এ স্থানের সঠিক নাম হচ্ছে 'বাব আল-মাজেদী'। বাংলাদেশীদের দোকান ও হোটেলগুলো একটা সরু গলিজাতীয় রাস্তার দু'পাশে বিধায় এই নাম সম্ভবতঃ।
বিকেলের মিঠে রোদ-ছায়ায় ঘুরে ফিরে দেখলাম বাংলাদেশীদের ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকান-হোটেল আর মাগরিব এশা আদায় করলাম হারামে। মজার ব্যাপার লক্ষ্য করলাম যে, আমরা স্বদেশে জনসংখ্যায় অনেক বেশী বলে জড়াজড়ি করে, প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে-ঠুলে চলতে হয় আমাদের, প্রবাসেও আমরা যেন অভ্যেসের লালন করে যাচ্ছি, তাই প্রতিটি বাংলামার্কেটেই থাকে শ্বাসরুদ্ধ করা ভিড়। মনে পড়ে, রিয়াদের 'বাত্হা'য় যতদিন গিয়েছি, ইন করা ইস্তিরি শার্ট কখন যে ধাক্কাধাক্কিতে অনেকটা গেঞ্জির রূপ ধারণ করেছে টেরই পাইনি, ওখানে গেলে পায়ে হাঁটতে হয় না, স্রোতের টানেই ভাসতে ভাসতে চলতে থাকবেন জনসমুদ্রে, শুধু গন্তব্য এলে কষ্ট করে ঠেলা-ধাক্কার বৈঠা হাতে নিয়ে কিনারে পেঁৗছতে হবে মাত্র। এমনটি দেখতে পাওয়া যায় শুধু এখানকার ছুটির দিন ও তার আগের দিনটিতেই; তবে প্রবাসের একঘেয়েমিতে সপ্তাহে এমন একটি দিন একেবারেই মন্দ না অনেকের জন্য, যদিও আমি তেমন পছন্দ করি না। গ্রামাঞ্চল থেকে শাক-শব্জি বিক্রি করতে আসা বাংলাদেশী ভাইদেরকে দেখতে আমার খুব ভাল লাগে, তখন মনে হয় না যে প্রবাসে আছি, যেন বাংলাদেশের কোন হাটে এসেছি।
উল্লেখ্য করা প্রয়োজন যে, একই দেশের প্রবাসী হলেও আমি যে শহর থেকে এসেছি, (পূর্বে উল্লেখ করেছি- উমলেজ) সেই পাঁচ বর্গকিলোমিটারের বিচ্ছিন্ন বাড়ী-ঘর নিয়ে গড়ে উঠা ক্ষুদ্র শহরে এত বেশী বাংলাদেশী ছিল না যে পাড়া গড়ে উঠবে, সেখানে এমন ধরনের কোন পাড়াও নেই। স্বল্প সংখ্যক বলে সবাই সবাইকে চিনতাম, ভাল-মন্দ আদান-প্রদান হতো নিজেদের মধ্যে যেমনটি হয়ে থাকে আমাদের গ্রামাঞ্চলে। শহুরে জীবনে তো পাশের ফ্লাটের প্রতিবেশীকেই চেনা হয় না বছর বছর থেকে, নগর জীবনের এ এক অভিশাপ, সমাজ ও সামাজিক ঐক্য এখানে যেন গৌণ ঠেকে। প্রবাসেও তেমনি দেখেছি, ছোট আর বড় শহরগুলোর প্রবাসী বাংলাদেশীদের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যেও যেন গ্রাম ও শহরের ব্যবধান বিদ্যমান। তাই একই দেশের প্রবাসী হয়েও মদীনায় এসে কিছু নতুনত্ব পেলাম, পেলাম ভিন্নতা, একটু অচেনা অচেনা নগুরে ভাব স্বদেশীদের ভিড়ে। এভাবেই রাতের বুকে হারিয়ে গেল সেদিনের সময়গুলো।
(চলবে)
পরাংশ পড়ুন-
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০০৭ সকাল ১০:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




