somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

5. তলা'আল বাদরু 'আলাইনা (আমাদের মাঝে পূর্ণ চাঁদের উদয়)

১৪ ই জুন, ২০০৬ রাত ৮:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পূর্বাংশ পড়ুন- Click This Link

=জান্নাতের বাগান এবং পথ দর্শনে=
---------------------------

ফজরের পর আজ আর বাসায় ফিরিনি, জান্নাতের বাগানসমূহের একটি, যেটি অবস্থিত মসজিদুন্-নববীর অভ্যন্তরে, সেখানে যাওয়ার এবং বসার সুযোগ পেলাম। মসজিদ খোলা থাকে অথচ জান্নাতের সেই বাগানটিতে ভিড় থাকে না এমনটি কখনো দেখা যায় না। সূর্যোদয়ের পর সালাত আদায় করলাম এবং তিলাওয়াত করলাম পবিত্র কুরআন থেকে। প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরের অনেক পাশেই বসে ছিলাম, যেন আন্তরিক পরশ অনুভব করছিলাম। এখানকার দায়িত্বে নিয়োজিত আলেমগণকে দেখলাম যিয়ারতকারী অনেককেই সংশোধন করে দিচ্ছেন অর্থাৎ, দো'আ কিংবা কিছু চাওয়া অথবা চাওয়ার জন্য মুসলমানেরা হাত তুলবে শুধুমাত্র আল্লাহ্ রাব্বুল 'আলামীনের কাছেই; কোন পীর, ওস্তাদ এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছেও না (এ বিষয়েও বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রাখি পরবর্তীতে ইনশাআল্লাহ্)।

বেরুলাম তখন সকাল দশ কি সাড়ে দশ হবে। আজ ঐতিহাসিক কিছু স্থানে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে, সে অনুযায়ী মসজিদ থেকে বের হয়েই ভাবলাম একা যাব না কি কোন দলের সাথে ভিড়ে যাব, উল্লেখ্য যে, এই প্রথম সফরে আমার কোন সহযোগী (গাইড) ছিল না, সীরাত পড়ে পরিচিতির যেটুকু সঞ্চয় করেছিলাম, তাই সম্বল আর মদীনায় এসে যাদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম, তাদের কাছ থেকে মৌখিক কিছু পরামর্শ। অবশেষে একটা মাইক্রোতেই উঠে বসলাম, যেখানে আরো প্রায় ছয়/সাত জন যাত্রী ছিলেন। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম উহুদ পাহাড়, আজ কাছাকাছি যাচ্ছি। মনটাতে খুবই উত্তালতা অনুভব করলাম, ঠিক যখন গাড়ী থেকে নামতে গিয়ে উহুদের মাটির প্রথম স্পর্শ পাই, যেন অনেকটা শিউরে উঠলাম।

এ তো সেই প্রান্তর, যেখানে আমার প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহত হয়েছিলেন, যেখানে হামযা রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর বুক চিরে কলিজা বের করে চিবিয়ে খেতে চেষ্টা করেছিল এবং গিলতে না পেরে ফেলে দেয় হিন্দা, এ তো সেই পাহাড় যার মধ্য থেকে আনাস ইবনে নযর রাদিয়াল্লাহু 'আনহু জান্নাতের সুঘ্রাণ পেয়ে শাহাদাতের মাধ্যমে তা অর্জন করে নেন। গাড়ী যেখানটায় থামলো, স্থানটা ঐতিহাসিক মানচিত্রানুযায়ী ঐ জায়গাটা হওয়ারই সম্ভাবনা রাখে বেশী, যেখানে হানযালা রাদিয়াল্লাহু 'আনহু শাহাদাত বরণ করেন, যাকে ফিরিশ্তারা গোসল করিয়েছিলেন। কত মর্মান্তিক ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই উহুদ পাহাড়। দেখলাম সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা (শহীদদের নেতা) আমীর হামযাসহ উহুদের যুদ্ধে নিহত প্রায় সত্তরজন আসহাবের কবর। এখানেও একই ব্যবস্থা, দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ ও বিভ্রান্তদের জন্য এখানেও উপদেশের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যাতে করে কেউ কবরবাসীদের কাছে নয়; একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহ্রই কাছে হাত পাতে কোন কিছুর আশায়। এত সব ব্যবস্থার মাঝেও দেখা যায় দু'একটা বেদুঈন বালককে, যারা-কি পড়ে কিভাবে কবর যিয়ারত করতে হবে এই নূন্যতম জ্ঞানটুকু রাখে না-এমন যিয়ারতকারীদেরকে মক্তবের হুজুরের মত করে কিছু দোআ পড়িয়ে দু'পাঁচ রিয়াল আদায় করে থাকে।

হারিয়ে গিয়েছিলাম ইতিহাসের অন্তরালে, যদিও জনারণ্যের মাঝেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ত্যক্ত-বিরক্ত মাইক্রো-ড্রাইভার গায়ে হাত রেখে বললো ঃ 'ইয়াল্লা সাদীক, নাহ্না মা-স্যী' ওহে বন্ধু, আমরা যাচ্ছি (তুমিও চলো)। মন না চাইলেও চলে আসতে হলো। পরবর্তী স্থান ছিল মসজিদে কি্ববলাতাঈন, মুসলমানদের পূর্ববর্তী কেবলা ছিল মসজিদুল আকসার দিকে, তারপর আল্লাহ্ তা'আলা তাকে পরিবর্তন করে মসজিদুল হারামের(মক্কার) দিকে করে দেন। দু'টো মিনার স্থাপন করা হয়েছে এ মসজিদে, মিনার দু'টিই যেন বলে দিচ্ছে মসজিদের পরিচয়। ভেতরে সুন্দরভাবে মুসল্লীদের জন্য সংক্ষিপ্তভাবে লেখা আছে আল্লাহ্র আয়াতসহ কিছু পরিচয়-ইতিহাস। দু'রাকাআত সালাত আদায় করে আবার চড়লাম পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। পথে পথে দেখে নিচ্ছিলাম মদীনার বিভিন্ন রাস্তা-বাড়িঘর গুলো। আবেগী মনের অলিন্দে তখন ইতিহাসের পাতাগুলো হালকা বাতাসে খেলা করছিল যেন।

যাত্রীদের মধ্য থেকে একজনের কণ্ঠস্বরে ফিরে তাকালাম, একজন সুদানী ভদ্রলোক চালকের কাছে জানতে চাইলেন 'সানিয়াতুল ওদা'আ' এখানে কোথায়? আমরা তখন মসজিদ কুবার কাছাকাছি। চালক হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলেন। মনের চোখে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম, আনসার যুবক খেজুর গাছে উঠে রাসূলের মদীনায় আগমন দেখতে চেষ্টা করছে, হঠাৎ কাফেলা চলে এলো দৃষ্টি-সীমায়, বেজে উঠলো দফ্, শিশুদের আভ্যর্থনা সঙ্গীত- 'তলা'আল বাদরু 'আলাইনা...', মনের অজান্তেই দু'চোখ ভিজে উঠলো। আলোচিত প্রতিটি স্থানকেই জীবনে প্রথম দেখার অনুভূতিটাই আলাদা। ভাবনার জগত সাঁতরে সাঁতরেই যেন চলছিলাম প্রতি পদে পদে। সালাত আদায় করে নিলাম আবেগে-আনন্দে। খানিক ঘুরে-ফিরে দেখলাম মসজিদের চারপাশ, কারুকাজ। মাইক্রোবাসটি যখন আমাদের নিয়ে আবার ফিরে এলো মসজিদুন্ নববীর কাছে, তখন যোহরের সময় ছুঁই ছুঁই করছিল, অযু বানিয়ে প্রতি সালাতে হাজার সালাতের আকাংখা নিয়ে ঢুকে পড়লাম মসজিদের অভ্যন্তরে, মহান প্রতিপালকের আহ্বানে সাড়া দিতে, তাঁকে সিজ্দা করতে।

দুপুরের কিছু সময় বিশ্রামে কাটালাম, চেষ্টা করলাম কিছু ঘুমিয়ে নিতে কারণ, বিকেলের প্রোগ্রাম ছিল মদীনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি দেখার। কিন্তু ভাবনারা ঘুমকে দু'চোখের আশপাশেও আসতে দিল না। মদীনা! আমার মনের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে প্রশান্তি ছড়িয়ে দিয়েছে, ছড়িয়েছে আনন্দ অঢেল, এ ক'দিনেই পৃথিবীতে আমার দেখা এবং অনুভব করা সবচেয়ে শান্তিময় স্থান বলে মনে হতে লাগলো। এখন ভাবতেই কষ্টে হৃদয়টা মুচড়ে উঠছে যে, এই শান্তির শহর ছেড়ে চলে যাবো আর মাত্র একটি দিনের পরেই। কিন্তু কি করেই বা থাকবো এখানে, ওদিকে তো কত কি ফেলে এসেছি, তার উপর এখানে হঠাৎ করেই তো স্থায়ী কোন কাজের ব্যবস্থা করা এতই সহজ নয়। আমার মিষ্টভাষী মেজবানকে বলবো বলবো করেও সরাসরি বলতে পারছি না, ইঙ্গিতে অনেক বুঝিয়েছি যে, মদীনা আমার হৃদয় কেড়েছে। এভাবে সাত-পাঁচ-তিন-এক ভাবতে ভাবতে ভাবনারা কখন যে শূন্যে এসে ঠেকেছে টেরই পাইনি, ক্লান্ত মন তখন স্বপ্নের দেশে, স্মৃতির অজান্তে নিরব, নিথর ঘুমে তলিয়ে গেছে রৌদ্র-ভ্রমণ-ক্লান্ত দেহটিও।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০০৬ রাত ১০:৫৮
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয় দিবসের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ ও ঘৃণা জানিয়ে । সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান ২০২৫, ১৬ই ডিসেম্বর।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:১৯




দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রানের এক সাগর রক্তের বিনিময়। দুই লক্ষাধিক মা বোনের সম্ভ্রম হারানো। লক্ষ শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত‍্যু। এক কোটি মানুষের বাস্তুহারা জিবন। লক্ষ কোটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×