ব্লগ অথবা ম্যাগাজিন বা বন্ধুদের আড্ডায় প্রায়ই শুনি আজকালকার মহিলারা হিন্দি সিরিয়ালে চরম আসক্ত মানে ম্যানিয়াটিক বা নেশাগ্রস্ত। আসক্তি মানে হচ্ছে কোন জিনিসের প্রতি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক বেশী অনুরাগ, একই জিনিস নিয়ে বারবার ভাবা, এবং নির্দিষ্ট সেই জিনিসের প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগের কারনে প্রয়োজনীয় কাজ কে হেলা করার মানসিকতা সৃষ্টি। এবং সেটার ফলাফল অবশ্যই নেগেটিভ।
ইদানিং শুনছি বা দেখছি চোখের সামনে অনেক কে যে এই হিন্দি সোপ অপেরাগুলোর কারনে মহিলারা কোনরকমে দৌড় দিয়ে সংসারের কাজ করে বসে যাচ্ছে টিভির সামনে, এমনকি অনেক শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত মহিলারা যাঁরা কিনা একসময় অবসরে হাতে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প বা বঙ্কিমের উপন্যাস তাঁরা এখন হাতে নেন শুধু টিভির রিমোট, আর তাঁদের প্রিয় চ্যানেল স্টার প্লাস, স্টার জলসা,লাইফ ওকে বা জিটিভি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা সবাই এককথায় বলে দেই যে হিন্দি সিরিয়াল খারাপ। কেনো বলি সেটাও আমরা জানি, তারপরো সংক্ষেপে বলি একটু।
কেনো এই হিন্দি সিরিয়াল খারাপ?
হিন্দি সিরিয়ালগুলোর বিষয়বস্তু ঘুরে ফিরে একই শাশুড়ী বউ দ্বন্দ্ব, ননদ ভাবী ঝগড়া, পরকীয়া, কয়েকটা বিয়ে, কোটি কোটি টাকার গল্প, লক্ষ টাকার শাড়ী, গহনা ভাবখানা এমন যেনো ভারতের সব ব্যক্তি কম করে কয়েক কোটি টাকার মালিক! এককথায় ঘুরেফিরে একই টপিক সব চ্যানেলের সব সিরিয়ালে ঘুরে আসে যা থেকে শেখার কিছু নেই কারন গল্পগুলো আপাদমস্তক অবাস্তবতায় ঘেরা, সস্তা কাহিনী। এবং সিরিয়ালম্যানিয়ায় যে আসক্ত হবে তার চিন্তার জগত অবশ্যই অবাস্তবতায় আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থেকে যায়।
আর সিরিয়াল নির্মাতারাও এমন চকচকে লেবাস দিয়ে সিরিয়ালগুলো বানায় যে মেয়েরা সহজেই আকৃষ্ট হয়, আর মাত্র দুই তিনটা পর্ব দেখেই টোপ গিলে ফেলে মানে ম্যানিয়ায় আক্রান্ত হয়।
এখন কথা হচ্ছে যে আমরা তো শুধু বলেই চলেছি সিরিয়াল খারাপ বা চ্যানেল বন্ধ করো বা এই করো বা সেই করো, আবার এটাও সাথে সাথে বলা হচ্ছে যে মহিলারা চ্যানেল বন্ধ করলে ঝাড়ুযুদ্ধ শুরু করবে!!
কিন্তু কার্যকর কোন প্রতিকার নিয়ে কি ভাবা যায় না?
এই নিয়ে আমার কিছু মতামত দিবো, আপনারা অবশ্যই আমার মতের পিঠে পালটা মত বা পক্ষে বিপক্ষে যেকোন রায় দিতে পারেন।
আমার মতে শুধু চেঁচিয়েও কোন লাভ নেই। সিরিয়াল নামের খারাপ খেলনাটি ভেঙ্গেও কোন লাভ নেই ( মানে চ্যানেল বন্ধ) বরং পরিস্হিতিটা এমন হওয়া উচিত যিনি এই সিরিয়াল দেখছেন তিনি নিজেই এটার আর দেখবেন না!
আমাদের দেশের অনেক মেয়ে ডিগ্রী বা অনার্স বা মাস্টার্স পাশ করে বিয়ের পর শুধুমাত্র গৃহিনী হয়ে আছেন। যে মেয়ের ৪/৫ বছর থেকে ২৪/২৫ বছর পর্যন্ত স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে অভ্যস্ত সে হঠাৎ করে একদিন শুধুমাত্র গৃহবধু হয়ে সারাটা দিন হয়ত বাড়িতে বসে আছে। এখণকার দিনে আগেকার মতো ১০/১২ বা ৭/৮ টা কেনো ৩/৪ টা বাচ্চাও অধিকাংশ পরিবার নিতে চায় না। সন্তানসংখ্যাও যেমন কম তেমনি ছোটখাট গেজেট থেকে শুরু করে ফ্রিজ,ওভেন বা ওয়াশিং মেশিন উচ্চবিত্ত তো বটেই মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর গৃহিনীদের কাজের ঝামেলা কমিয়ে দিয়েছে।
অবসরে টিভি সিরিয়াল গুলোর ৮০/৯০ ভাগ দর্শক গৃহবধুরা। ওয়ার্কিং উইমেনদের পক্ষে সিরিয়ালের জন্য সময় বের করা অসম্ভব প্রায়।
১। অনেক মেয়েরই স্বপ্ন থাকে শিক্ষাজীবন সেরে এই হবো বা সেই হবো কিন্তু বাস্তবে বিয়ের পর অধিকাংশ মেয়ের শ্বশুর বাড়ী থেকে মেয়েদের লেখাপড়া বা কিছু একটা কাজের সাথে যুক্ত থাকার জন্য কোন অনুপ্রেরনা দেয়া হয়না। এমনকি স্বামীরাও প্রায়ই মেয়েদের ভোগের বস্তু বা সাংসারিক কাজের ইনসট্রুমেন্ট ভাবে মাত্র।
২। ছেলেরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন যে আপনার স্ত্রীকে আপনি দিনশেষে কতটুকু সময় দেন বা সেই যতটুকু সময় দেন তা আপনার স্ত্রীকে কতটা মানসিক পরিতৃপ্তি দেয়? অধিকাংশ ছেলেই কাজের অজুহাতে শুধুমাত্র জৈবিক সংসর্গ ছাড়া স্ত্রীদের সময় দেন না। তাহলে এই মেয়েদের কেনো রুপালি পর্দার ঝিলমিল সিরিয়াল টা বেশী টানবে না?
৩। আমাদের দেশে ইউরোপ বা আমেরিকার মত ভলান্টিয়ার জব করার সুযোগ অনেক কম, যাদের কাছে টাকা মূখ্য বিষয় নয় কিনতু বাড়তি সময় কাজ করে কাটাতে চান তাদের জন্য আমাদের দেশে কোন ক্রিয়েটিভ জব নেই।
৪। অনেক মহিলাই ভালো গল্প বা কবিতা বা রম্য লিখতেন হয়ত একসময় কিন্তু এই সিরিয়ালের কল্যানে আজকের মহিলারা সবই ভূলে গেছেন।
৫।আমি মনে করি যৌথ পরিবার আবার ফিরে আসা উচিত যাতে করে একজন মেয়ে তার ছোট বাচ্চা কে নানী বা দাদীর কাছে রেখে অনায়াসে এবং নিশ্চিন্ত চাকরিতে যেতে পারেন।
দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের দেশের ম্যাক্সিমাম ছেলে চায়না বউ যেকোন আউটডোর ইভেন্টে যাক, চারদেয়ালের মাঝখানে বসে শহুরে সংসারের কাজগুলো সেরে আপনারাই বলুন আমাদের মেয়েদের কি করার থাকে যে এই সিরিয়ালগুলো গিলতে বসবে না?
আর একটা ব্যাপার ১০০ টা বা ৯০ টা মেয়ে আউটডোর কাজে যুক্ত না হোক , নাহয় টিভিই দেখুক কিন্তু সাথ নিভানা সাথিয়া বা টাপুর টুপুর বা ভালোবাসা ডটকম না দেখে বাংলা ভালো প্রোগ্রাম দেখুক এটা আমাদের সবার কামনা। কিন্তু সিরিয়াল খারাপ সিরিয়াল খারাপ বললেই কি শুধু কাজ হয়ে যাবে?
আমাদের নির্মাতারা যদি দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পারে তাহলেও অনেকেই এইসব হিন্দি সিরিয়াল দেখা বন্ধ করে দিবে হয়ত।
আর পরিবারের সকলেরই রুচিশীল অনুষ্ঠান দেখার জন্য মনোভাব থাকা উচিত। এবং পরিবারে ছোট সদস্যদেরও ভালো অনুষ্ঠান দেখার জন্য অনুপ্রেরনা দেয়া উচিত।
বাচ্চাদের ডরিমনম্যানিয়া
আমরা ছোট থাকতে মিনা বা জাংগল বুক দেখতাম, যেখানে মজার বা শিক্ষামূলক বিষয় থাকতো। কিন্তু ইদানিং বাচ্চারা এই হিন্দি ভাষায় ডাবিং করা ডরিমন ছাড়া কোন কার্টুন আর বোঝেনা ! অধিকাংশ অভিভাবকই এই ডরিমনের বিরুদ্ধে? কারন? ডরিমন কার্টুনের ফাঁকিবাজ নোবিতা বাচ্চাদের জন্য আইডল হয়ে গেছে।কি আছে ডরিমনে জানতে কয়েকটা পর্ব আমি দেখেছি। বাচ্চারা ডরিমনে নোবিতার সব পরীক্ষায় ০০ পাওয়া এবং ফাকিবাজি করাকে পজিটিভলি উপস্হাপনের জন্য ভীষন মজা পায় , আফসোস বোধ করে নিজে নোবিতার মত না হতে পারার জন্য।
আর ডরিমন বের করে একটা করে অদ্ভূত গেজেট, যা দিয়ে সব অদ্ভূত কান্ড করে নোবিতা। যেমন ৩ ঘন্টার হোমওর্য়াক ৫ মিনিটে তৈরি করা। পরীক্ষায় ফেল করে বাবা মাকে বোকা বানানো। একপর্বে দেখি নোবিতা ডরিমনের এক গেজেট এ ওর ০০ পাওয়া টেস্ট পেপার লুকিয়ে রাখে,পরে সেটা ওর মা খুজে পায় এবং এর মা মাটির নিচে আটকা পড়ে। ডরিমন যখন মাকে উদ্ধার করতে যায় তখন নোবিতা চেচিয়ে কেঁদে বলে মাকে মাটির নিচে থাকতে দাও, বাইরে আসলে আমাকে বকবে!!!
সম্পূর্ন একটা বাচ্চার মনের মাধুরী মিশানো কাহিনী বলে বাচ্চারা এটার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে।
আবারো আমার প্রশ্ন আমাদের দেশের নির্মাতারা কি করছেন?
আপনারা কি এমন কোন পজিটিভ,ক্রিয়েটিভ কার্টুন বানাতে পারেন না যা ডরিমনম্যানিয়ার জন্য চ্যালেন্জ হয়ে দাড়ায়?
ছেলেদের পর্নোম্যানিয়া
আচ্ছা মেয়েরা সিরিয়ালম্যানিয়াক, বাচ্চারা ডরিমনম্যানিয়াক, তাহলে কি ছেলেরা ম্যানিয়াশুন্য?
অনেকেই ছেলেদের পাশাপাশি পর্নো শব্দটা দেখে ঘোর বিরোধিতা করবেন এবং বলবেন যে পর্নো কি শুধু ছেলেরাই দেখে?
হয়ত শুধু ছেলেরা দেখেনা, তবে আমাদের রক্ষনশীল সমাজে একটা সিংহভাগ দর্শক ই ছেলে এটা অনায়াসে বলা যায়।
আমাদের পচে যাওয়া সমাজের অনেক নোংরামীর জন্য আমি পর্নোগ্রাফিকে দায়ী করি।
অনেক স্বামীরা বউদের পর্নো দেখতে বাধ্য করে প্রায়সময়, আজকের যুগের ছেলেদের চাহিদা পর্নোসুপারস্টারদের দেহভঙ্গিমাগুলো। এমনকি পর্নো এখন ১২/১৩ বছরের ছেলের মোবাইলে পর্যন্ত শোভা পায় । ভয় কি?
ঔ ক্লিলপস গুলো লক ও করে রাখার যদি ব্যবস্হা থাকে। এখন থেকে ২০/৩০/৪০ বছর আগে একমাত্র ম্যাগাজিন এ পড়া বা কিছু ইংলিস মুভিতে কিস সিন ছাড়া ৩এক্স এর মত অভিশাপ দেখার সুযোগই ছিলোনা। এখন প্রতিটা ছেলের কাছে মোবাইল, সবার পার্সোনাল পিসি বা ল্যাপটপ। এইরকম ছেলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল যারা পিসি বা মোবাইলে কিছু রগরগে ক্লিপস রাখেনা। কোন মেয়েই রাখেনা বা দেখেনা এই কথা আমি বলবনা, এই কথা এই চলমান সমাজে বলার সুযোগ নেই।
যে ছেলেটা বা মেয়েটা ১২/১৩ বছর বয়সে নরনারীর জৈবিক সম্পর্কের সূক্ষ সুক্ষ জিনিসগুলো নিয়ে পর্যন্ত জানছে তারা একটা সমাজের জন্য কতটা ভয়ংকর হয়ে দাড়াতে পারে?
তার প্রমান আজকের পাড়ায় পাড়ায় গজানো হাজার হাজার ইভটিজার, যার প্রমান ইন্টারনেটের ওয়েবসাইটে পাওয়া বাচ্চা ছেলেমেয়েদের স্কুলের বাথরুমে করা নানা কুকর্মের চিত্র।
টাইটেল টা ছেলেদের নিয়ে দিয়েছি কারন এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সমাজে হিংস্র কান্ড গুলো ৯৯ ভাগ ছেলেরাই ঘটিয়ে আসছে।
১২ বছর বয়সে যে ছেলে ৩ এক্স দেখে ফেলেছে সেই ছেলের কাছে আমরা কি আশা করতে পারি?
আমি বলবনা এক্স মুভি দেখেই শুধু আজ কে রেপ বা ইভটিজিং হচ্ছে। তবে আমি এক্স মুভি তৈরি, বিক্রয়, সংরক্ষন কে ঘৃনা করি মনেপ্রানে, এর মাঝে কোন পজিটিভ বিষয় খুজে পাইনা।
অনেক ছেলেকে রাস্তায় বলতে শুনি হায় ক্যআ মাল হ্যআয়!!!
আজা সেক্সি!!!
যাতা যেখানে সেখানে বলার বিকৃত মানসিকতা কি আমরা তাহলে পর্নো মুভি দেখেই পেলাম?
অনেকের কাছে এক্স মুভি না দেখা মানে গাঁইয়া, সেকেলে, আনস্মার্টনেস!!!
অনেক দম্পতি বাসায় এক্স মুভির সিডি রাখেন, কেউ কেউ রাখেন বাসার যেখানে, সেখানে!
একবার কি ভেবে দেখবেন যে এই মুভির ম্যাক্সিমাম অগ্রহনযোগ্য ভঙ্গিমাগুলো না দেখলে আপনার কি খুবই ক্ষতি হতো?
কয়বার আপনার বাচ্চা লুকিয়ে সিডিটা দেখলো?
আপনার ১২/১৩/১৪ বছরের ছেলে বা মেয়ে স্কুলে গিয়ে যদি নেটের যে লিংক এ গিয়ে আপনি দেখে মজা পাচ্ছেন সেরকম করে আপনার কেমন লাগবে?
যিনি হিন্দি সিরিয়ালে ব্যস্ত তার কাছে প্রশ্ন, আপনি কি কখনো বাংলা কোন প্রোগ্রাম দেখেন?
না দেখলে আপনার এটা ভেবে কি একটুও লজ্জা লাগেনা যে আপনার ভাষায় তৈরি কিছুই দেখেন না আপনি?
আর এই গরীব দেশের টাকায় হিন্দি সিরিয়াল কে প্রমোট করছেন?
বাচ্চারা তো বাচ্চাই। আপনিই যখন অলীক কাহীনির সিরিয়াল দেখা কন্ট্রোল করতে পারেন না, আপনার বাচ্চা কেনো পারবে?
একদিন বাচ্চা আপনাকে নোবিতার মত ০০ পেয়ে দেখাবে।
আর দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়ার জন্য পারস্পরিক বোঝাপাড়া আর ভালোবাসা, আস্হা টা খুব জরুরী, সেটাই যদি না থাকে তাহলে অখাদ্য পর্নো আপনার জীবনে সুখ এনে দিতে পারবেনা।
আপনি যদি আজ থেকে শুধরাতে পারেন আজকের বাংলাদেশের পথভ্রষ্ট বাচ্চারা এবং কিশোর কিশোরীরাও কোনদিন ভুল পথে যাবেনা, এইটা আমার আশা। এইটা আমার বিশ্বাস।
একটা বিষয় কখনোই ভূলে গেলে চলবেনা যে বাচ্চারা আমাদের দেখেই শিখে বা শিখবে। আমাদের মাঝে যদি একটা বিশাল শূন্যতা থেকে যায় সেটা আমাদের ছেলেমেয়েদের উপরই প্রভাব ফেলবে, আর আমাদের আচরনই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের নিরাপত্তা বা অনিরাপত্তা নির্ধারন করে।