somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফেরার গল্প

২৭ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ১১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এখানে একটা সত্যিকারের পুকুর ছিলো। আর কেউ না মনে রাখলেও আমি সেটা মনে রেখেছি। সেই পুকুর পাড়ে কত শত উদাসী দুপুর যে কাটিয়েছি ভাবলেই এই খড়খড়ে রোদের দুপুরটাও বেশ মায়াময় হয়ে ওঠে। আমি অনেকদিন পরে এই রাস্তায় ফিরছি। ঐ যে ওখানে একটা বিষণ্ণ আতাগাছ দেখছেন, ওটার পাশের গলিটা দিয়ে পঞ্চাশ গজ মত গেলেই আমার বাড়ী। কিংবা বলতে পারেন আমার বাড়ী ছিলো। এখন কেউ আছে কি না, সেটা জানা নেই।

একবিন্দুও বাড়িয়ে বলছিনা, আমি আসলেই ফিরে এসেছি। যদিও চেনা রাস্তাটা আর আগের মতো চেনা নেই। কালাম মামার চা সিগারেটের দোকানটা যেখানে ছিলো, সেখানে একটা কিম্ভুত আকৃতির হাইরাইজ দেখছি। কে জানে, কালাম মামাই এটার মালিক কি না।

এই যে লাল ইটের নোনাধরা বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, এখানে থাকতো রচনা'রা। তবে এই বাড়িটা এরকম ভাঙ্গাচোরা ছিলোনা তখন। এই পাড়ার সবচে' আধুনিক বাড়িটার এমন হতশ্রী দশা দেখে বুক হু হু করে উঠছে। একসময় রচনার সাথে একটু কথা বলতে পারলে তাদের বাসার লনে খানিকক্ষণ খেলাধুলা করতে পারলে পাড়ার কিশোরদের কাছে নিজেকে অনেক বড় লাগতো। কামরুল কিংবা নওশাদের সাথে যদি রচনা বেশী সময় কথা বলতো, তাহলে কিশোর বুকে চিনচিনে ব্যাথা হ'তো। সেই দিনগুলোও কতদুরে ফেলে এসেছি...

একদিন রচনার বিয়েও হয়ে গিয়েছিলো তার বাবার মতই এক ব্যবসায়ীর সাথে। তরুন আমি, কামরুল, নওশাদের জন্য সেদিনটা ছিলো অনেক কষ্টের। গাড়ি চেপে বরের বাড়িতে রচনা চলে যাবার পর আমরা তিন বন্ধু মিলে সারারাত একসাথে হেঁটেছিলাম। কেউ কোনো কথা বলিনি, শুধু একের পর এক সিগারেট পুড়েছিলো আমাদের হাতে।
কামরুলরা এই পাড়া ছেড়েছিলো তার কিছুদিন পরেই। আর কোনো খোঁজ পাইনি ওদের। নওশাদ এখানেই ছিলো। ঐ যে বাঁ পাশে টিনের চাল ওয়ালা ঘরগুলো উঠেছে, ওটা ছিলো নওশাদদের উঠোন। একটা বিশাল আমগাছ ছিলো উঠানে। নওশাদের মা এই আমগাছের আম দিয়েই প্রতি বছর আমসত্ত্ব বানাতেন। আমরা ছিলাম তার রাক্ষস কুল।

সময় অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলো, সাথে নওশাদটাও অনেক যাযাবর হয়ে গিয়েছিলো। আমি চাকরী পাবার অল্প কিছুদিন আগে নওশাদ একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করলো। কোন মেয়ে নাকি ওকে প্রত্যাখান করেছে তাই। সেই যাত্রা বেঁচে ওঠার পর, নওশাদের মা ওকে ধরে বিয়ে করিয়ে দিলো। কেয়া ভাবী দারুণ একজন মানুষ ছিলেন। নওশাদকে একটানে যাযাবর থেকে গৃহস্থ বানিয়ে ফেলেছিলেন। সব পাগলামি ঝেড়ে ফেলে নওশাদ নিজের ব্যবসা শুরু করলো, আর বছর না ঘুরতেই মিষ্টি একটা ছেলের বাবাও হয়ে গেলো।

আহ! আমার ফিরে আসার গল্প বলতে গিয়ে দেখি বিশাল কাহিনী ফেঁদে বসলাম। যাক্‌, আমিও মোটামুটি দু'-তিন বছর চাকরী করে মা-বাবার চাপে পড়ে লোপাকে বিয়ে করে ফেলি। নিজের স্ত্রী বলে বলছি না, লোপার মত মেয়েকে পাওয়া আমার সাত জনমের ভাগ্য ছিলো। অন্যের বাবা-মা কে কেউ এভাবে আপন করে নিতে পারে, আমার জানা ছিলোনা। আর আমার বাবা-মা? তারাও লোপাকে পেয়ে যেনো নিজের হারানো মেয়েকে খুঁজে পেলো। বলতে বোধহয় ভুলে গেছিলাম, আমার একটা বড় বোন ছিলো। আমার জন্মের পরপরই, মাত্র তিন দিনের জ্বরে ভুগে মারা যায়। যা হোক, লোপার কথা বলছিলাম।

লোপার সাথে আমার বিয়ের মাত্র সপ্তা দুই আগে পরিচয়। মুরুব্বীদের প্রাক বিবাহ কথা বার্তা শেষ হবার পরেই আমি মেয়েটাকে দেখি। দুই সপ্তাহে একটা মানুষকে আর কতটুকু চেনা যায়? সবকিছু ঠিকঠাক বুঝে ওঠার আগেই দেখি সাজগোজ করা একটা শ্যামলা মেয়ে আমার ঘরে বসে আছে। নিতান্ত ছাপোষা আমি আরো বেশী গৃহী হয়ে গেলাম। এরপরের সাতটা বছর কিভাবে চলে গেলো বুঝতেই পারিনি। লোপার সাথে কখনো কথা কাটাকাটি, মন কষাকষি হয়নি সেটা বলবোনা। কিন্তু প্রতিবারই কিভাবে কিভাবে জানি সব কিছু মিটে যেতো।

এই সাত বছরে লোপা আর আমার একটা মেয়ে হয়েছিলো। দুজন মিলে অনেক আলোচনা-ঝগড়াঝাটি করে নাম রেখেছিলাম শ্যামা। মেয়েটার মায়াময় মুখের কথা ভাবতেই চোখে পানি চলে আসলো। আমার শ্যামা যদি বেঁচে থাকে, কেমন দেখতে হয়েছে? কি করছে? কিছুই জানিনা। আর জানবোও বা কিভাবে? কতদিন পর ফিরছি এই রাস্তায়, আমার বাড়ীর রাস্তায়।

এইযে, সুশীল কাকুর সেলুন পার হচ্ছি। আরে! এখানেতো সেলুনই নেই এখন। একসময় বাবার হাত ধরে আসতাম চুল কাটাতে, বড় হয়ে ওঠার পর একা একাই। আবার শ্যামার প্রথম চুল কাটানোর জন্য সুশীল কাকুকেই ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভয় পেতাম, এত নরম চামড়া, যদি কেটে ছড়ে যায়? সুশীল কাকু থাকতেন আরেকটু সামনে গিয়ে ডানের বাড়িটায়। বাবার সাথে উনার ছিলো বন্ধুর মত সম্পর্ক, পুজো পার্বণে উনাদের বাসায় কত নাড়ু সন্দেশ খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।

আমাদের বিয়ের চার বছরের মাথায় বাবা মারা গেলেন হঠাৎ করেই। মা ও শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। সাজানো পৃথিবী অনেকটাই এলোমেলো হয়ে পড়লো। এর ভেতরেই বাবার মৃত্যুর পাঁচ মাসের মাথায় মা ও চলে গেলেন বাবার সান্নিধ্যে। নিজের নাতনীর মুখ দেখে যেতে পেরেছিলেন এটাই স্বান্তনা। আমি মনে হয় একটু বদলেও গিয়েছিলাম তখন। অনেক দিনের ছায়া মাথার উপর থেকে সরে যাওয়ায় অনেকটা অবিন্যস্ত। তবুও সামলে নিচ্ছিলাম নিজেকে আস্তে আস্তে।

এইতো বিষণ্ণ আতা গাছটার কাছে চলে এসেছি। এবার বাঁয়ে মোড়, তিনটা বাড়ী পার হ'লেই আমার বাড়ী। আহা কতদিন আমার মেয়েটাকে দেখিনা, লোপাকেও। মেয়েটা মনেহয় অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। এতদিন পর আমাকে দেখে কি চিনতে পারবে? যে হারে মুখ ভর্তি সাদা সাদা দাঁড়ি-গোঁফ হয়েছে! লোপার চুলেও মনেহয় পাক ধরেছে। কিন্তু আমি ঠিকই চিনতে পারবো ওদেরকে। নিশ্চই চিনতে পারবো আমার হৃদপিণ্ডের ধুক ধুক শব্দগুলোকে।

সেবার, শ্যামার তিন বছরের জন্মদিন সামনে চলে এসেছে। আমি আর লোপা ঠিক করলাম মেয়েটাকে সাগর পাহাড় এগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। লোপা আর শ্যামা'র সে কি উচ্ছাস। মহা উৎসাহে শ্যামাকে নিয়ে লোপা বেড়ানোর প্রস্তুতি নিতে থাকলো, আর আমি ব্যাস্ত থাকলাম ছুটির আগে শেষ মূহুর্তের কাজ গুলো নিয়ে। রওনা দেবার আগের দিন দুপুরে, অফিস থেকে বেরোবো বেরোবো করছি, এমন সময় আমার ফোনটা বেজে উঠেছিলো। জরুরী কোনো একটা খবর ছিলো, যেটা এখন আর মনে নেই, শুনে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম অফিস থেকে।

এইতো আমার বাড়ীতে পৌছে গিয়েছি।
কিন্তু... এরকম ময়লা জমে আছে কেন গেটের সামনে? ঘরের দরজা জানালাগুলো একটাও আস্ত নেই কেন? লোপা শ্যামা ওরা কি আমার উপর রাগ করেছে গত আঠারো বছর ধরে যোগাযোগ নেই বলে?

আহ! সব কথা মনে পড়ায় এত এত কষ্ট লাগে কেনো। সারাবছরই তো ভুলে থাকি, মেয়েটার জন্মদিন কাছিয়ে আসলেই মনে পড়ে কেন সব কিছু...

আমার শ্যামা... আমার লোপা... বাসায় ফিরছিলো টুকিটাকি কিছু জিনিস কিনে। পথে ওদের রিকশাটাকে ধাক্কা দিয়েছিলো একটা কার। মেয়ে কোলে লোপা ছিটকে পড়েছিলো রাস্তায়, আর একটা বাস চলে গিয়েছিলো ওদের কোমল শরীর দু'টোকে পিষে দিয়ে।

সারা বছর পথে পথে ঘুরি আমি। সেই বাসটা আর কারটাকে খুঁজি। অন্য কিছু মনে থাকে না। শুধু শ্যামার জন্মদিনের আগে আগে মনে পড়ে ওদের সাগর আর পাহাড়ে নিয়ে যাবো বলেছিলাম। ফিরে আসি এই রাস্তায়...
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=হিংসা যে পুষো মনে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮


হাদী হাদী করে সবাই- ভালোবাসে হাদীরে,
হিংসায় পুড়ো - কোন গাধা গাধিরে,
জ্বলে পুড়ে ছাই হও, বল হাদী কেডা রে,
হাদী ছিল যোদ্ধা, সাহসী বেডা রে।

কত কও বদনাম, হাদী নাকি জঙ্গি,
ভেংচিয়ে রাগ মুখে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণমাধ্যম আক্রমণ: হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন নূরুল কবীর ও নাহিদ ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:০৫


জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রক্তস্নাত পথ পেরিয়ে আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সাম্প্রতিক মব ভায়োলেন্স এবং গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ সেই স্বপ্নকে এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নিউ এজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

রিকশাওয়ালাদের দেশে রাজনীতি

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৪৯

রিকশাওয়ালাদের দেশে রাজনীতি

সবাই যখন ওসমান হাদিকে নিয়ে রিকশাওয়ালাদের মহাকাব্য শেয়ার করছে, তখন ভাবলাম—আমার অভিজ্ঞতাটাও দলিল হিসেবে রেখে যাই। ভবিষ্যতে কেউ যদি জানতে চায়, এই দেশটা কীভাবে চলে—তখন কাজে লাগবে।

রিকশায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপিকেই নির্ধারণ করতে হবে তারা কোন পথে হাটবে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:০৫




অতি সাম্প্রতিক সময়ে তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিএনপির অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে ইদানীং আওয়ামীসুরের অনুরণন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি এখন জামাতের মধ্যে ৭১ এর অপকর্ম খুঁজে পাচ্ছে! বিএনপি যখন জোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী বিপ্লবীর মৃত্যু নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭



শরিফ ওসমান হাদি। তার হাদির অবশ্য মৃত্যুভয় ছিল না। তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, আলোচনা ও সাক্ষাৎকারে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি অনেকবার তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলেছেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও ভারতবিরোধী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×