somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গিয়াস কামাল চৌধুরীর শব্দহীন একটি সাক্ষাৎকার

২৯ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

:: রাশেদুল হাসান ::

সকালে ঘুম থেকে উঠে টিভিস্ক্রীনে চোখ বুলানো ইদানিং একটা অভ্যাস হয়ে দাড়িয়েছে। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। শুক্রবার বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের মাঝে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অন্তত ৮ জন মারা যায়। বিরোধী দলের দাবী একটাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পূণর্বহাল করে নিবার্চন, কিন্তু সরকারীদলের অনঢ় অবস্থান দেশের মানুষকে আর কত কষ্ট সহ্য করতে হবে কে জানে। বিরোধী দলীয় নেতার সংলাপের জন্য সময় বেধে দেয়াসহ হরতাল, জ্বালাও পোড়ও নিয়ে সাধারণ মানুষের মত অনেকটা অস্বস্থিতে দিন যাচ্ছিল। মানুষের চোখ সবসময় টিভি স্ক্রীনের দিকে। কোথায় কোন মূহুর্তে কি ঘটে করো জানা নাই। এমন উৎসুখ চোখ আজও (শনিবার) সকালে টিভিস্ক্রীনে, সদ্য সংবাদে একটি লাইন পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। সংবাদে লেখা ‘ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি গিয়াস কামাল চৌধুরী ভোর ৫ টায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাইহে রাজিউন)। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধসহ দেশের সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং সাংবাদিকদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট একজন লড়াকু সৈনিক আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
যে মানুষটি ভয়েস অব আমেরিকার সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে সমধিক পরিচিত এক ব্যক্তিত্ব। যিনি বিভিন্ন সময়ে একাধিক মেয়াদে ডিইউজে, বিএফইউজে ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। যিনি বাংলাদেশের একজন কূটনীতিক হিসাবে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর একনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে পাকিস্তান আমলে গণতান্ত্রিক ও স্বায়ত্তশাসন অন্দোলনে অংশ নিয়ে বহুবার কারাবরণ করেন। সেই মানুষটি আজ আর আমাদের মাঝে নেই।
আমার সাথে তাঁর তেমন কোন পরিচয় নেই। বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট, সংবাদ বিশ্লেষক হিসেবে তিনি আরো আগ থেকেই আমার মনে স্থান করে নিয়েছেন। সাহিত্য ও সাংবাদিকতার সাথে জড়িত থাকার কারণে অনেকের লেখাই পাঠোপলদ্ধির সুযোগ হয়েছিলো। গিয়াস কামাল চৌধুরীর লেখনির ভাষা কেন জানি বারবার কাছে টানে। বলে রাখা দরকার গিয়াস কামাল চৌধুরীর সাথে আমার একবারই দেখা হয়েছিলো। আর এটাই যে শেষ দেখা হবে জানা ছিলো না।
২০০৯ সালের কথা, দৈনিক ফেনীর সময় এর ঈদ বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ হবে। কোন ক্রোড়পত্র নয় কয়েকশ পৃষ্ঠার ম্যাগাজিন প্রকাশিত হবে। শুরু থেকেই আমাকে এসব বিষয়গুলো দেখতে হতো। সাহিত্য বিষয়ক লেখা সংগ্রহ ও সম্পাদনাটা আমার কাঁধে কখন যে এসে পড়লো টেরই পাইনি। ঈদ সংখ্যা বের হবে, লেখা চাই। লেখা-লেখির সাথে জড়িত থাকায় সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসাইনকে অভয় দিলাম লেখার কোন সমস্যা হবে না। ভাবলাম ফোন করে দিলে শয়ে শয়ে লেখা এসে জমা হয়ে যাবে। কিন্তু না সম্পাদক মহোদয় আমাকে জানালেন আমরা কেবল আমাদের ফেনীর লেখকদের নিয়েই ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করবো। যথারীতি আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিবারই আমাকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে ফেনীর লেখকদের লেখা সংগ্রহের জন্য। বলে রাখা দরকার লেখক তালিকায় সবসময়ই আমাদের প্রিয় গিয়াস কামাল চৌধুরীর অবস্থান শীর্ষে থাকলেও আমরা ব্যস্ততার করণে তাঁকে পাইনি। তবে ২০১২ সালে তাঁকে আর মিস করতে চাইনি। সম্পাদক আমাকে জানালেন এবার গিয়াস কামাল চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার নিতে হবে। বয়স হয়েছে কখন আবার মারা যান। আমরা গিয়াস কামাল চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিতে ঢাকায় যাই। উনার বাসার ঠিকানা সংগ্রহ করতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বিশিষ্ট সাংবাদিক, কবি ও কলামিস্ট এরশাদ মজুমদার উনার স্ত্রীর ফোন নাম্বারটা আমাদের দিলেন। এবং আমাদের এ তথ্যটা দিলেন যে উনি অসুস্থ, কথা ও দেখা করতে পারবে কিনা জানিনা। তবে তিনি বললেন ভাবীকে আমার কথা বলো, তবে হয়তো দেখা করতে পারবে। যথারিতি ভাবীর নাম্বারে ফোন দিয়ে এরশাদ মজুমদারের কথা বলে দেখা করার সুযোগটা নিয়ে নিলাম। এক বুক আশা নিয়ে সহকর্মী নুরুল্লাহ কায়সারকে নিয়ে রমজানের প্রথম সাপ্তাহের কোন এক সন্ধ্যায় উনার বাসায় উঠলাম। ভাবী আমাদের জানালেন, উনি অনেকদিন ধরে অসুস্থ কথা বলতে পারেননা। তিনি আমাদের আরও জানালেন ২০১১ সাল থেকে তিনি দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, যা তাঁর স্মৃতিশক্তি ও স্বাভাবিক জীবনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ডাক্তার উনাকে একা থাকতে বলেছেন। আমরা কাউকে উনার সাথে দেখা করতে দেই না কিন্তু‘ এরশাদ ভাই বলাতে আর না করলাম না। আমরা ড্রইং রুমে বসলাম। কিছুক্ষণপর ভাবী এবং কাজের মেয়ে গিয়াস কামাল চৌধুরীর দু’ বাহু ধরে আমাদের সামনে এনে বসালেন। পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। মুখ নেড়ে কি যে বলছেন কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না। ভাবী আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমরা ফেনী থেকে উনার সাথে দেখা করতে এসেছি এ কথাও বললেন। তিনি আমাকে বুকের মধ্যে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরলেন। কি যে বলতে কি যেন বলতে চাচ্ছেন তিনি। আমি লক্ষ করলাম তার দু’ চোখ বেয়ে পানি বেরিয়ে আসছে। ভাবী বললেন ফেনী ও ফেনীর মানুষের প্রতি রয়েছে তাঁর অঘাধ ভালোবাসা। ফেনীর মানুষের সাথে দেখা হলেই তার চোখ দিয়ে পানি পড়ে। ইতমধ্যে আমাদের চোখও অশ্রুসজল হয়ে পড়লো। আমরা সাংবাদিক, উনার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছি এসব ভাবী উনাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন। যে মানুষটির কাছ থেকে সাক্ষাৎকার নেয়ার আশায় এখানে এসেছি সে মানুষটির এমন অবস্থার কথা চিন্তা করতেই খারাপ লাগলো। আমরা শব্দহীন একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে বাড়ী ফিরলাম।
সকাল থেকে এ নস্টালজিয়ায়ই ভুগছিলাম। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলনা আমাদের প্রিয় গিয়াস কামাল চৌধুরী আজ থেকে আমাদের মাঝে নেই। সে দিনের সে বোবা কান্নার কথা বারবারই মনে পড়ে যায়। চোখ ভিজে আসে অশ্রু বন্যায়। তিনি আর ফিরে আসবেন না, পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা সমস্যায় তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সাহসী অংশগ্রহণ চোখে পড়বে না। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাসে তিনি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে বেঁচে থাকবেন।
আমাদের প্রিয় গিয়াস কামাল চৌধুরী ফেনী জেলার সদর উপজেলার শর্শদিতে ১৯৩৯ সালের ২১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরীর সাংবাদিকতা শুরু হয় ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে, ইত্তেফাক গ্রুপ থেকে প্রকাশিত ‘ঢাকা টাইমস’ পত্রিকার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে তিনি ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকার আইন প্রদায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় যোগদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণসহ জাতীয় গণতান্ত্রিক ও পেশাজীবীদের অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
লেখক: ফেনী প্রতিনিধি, দৈনিক বর্তমান; সহ-সম্পাদক, দৈনিক ফেনীর সময়।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×