মেয়েটি চোখের সামনে এমন তরতর করে যুবতী হয়ে উঠছে তা লাল মিয়ার কখনও দৃষ্টিগোচর হয়নি। আজও হয়ত হতো না যদি মেয়েটি ভেজা কাপড়ে তার সামনে না আসত। বৃষ্টিতে ভিজে সালোয়ারটি শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে,ফলে শরীরের স্ফীত অংশগুলো স্পষ্ট প্রতীয়মান। মেয়েটি ঘরের সামনে থাকা টিনের চাল থেকে সংগ্রহীত বৃষ্টির পানি দিয়ে উপুর হয়ে পা ধুচ্ছে আর লাল মিয়া জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে তার শরীরের স্ফীত অংশগুলোর দিকে। ভেজা শরীরে ঘরে ঢুকে লাল মিয়াকে দেখে মেয়েটি কিছুটা ইতস্তত বোধ করে আর বুকের ওড়নাটা ঠিক করতে করতে জিঙ্গেস করে, " কহন আইছেন খালু?"
লাল মিয়ার ঘোর কাটে,টিনের চালের উপর ঝুপ-ঝাপ বৃষ্টির শব্দের কারনে সে নাজমার কথা ঠিকমত শুনতে পায় না,নাজমাও উত্তরের অপেক্ষা না করে ঘরে ঢুকে যায়।
লাল মিয়া অত্র এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। বয়স ৫০-৫৫ বছর হবে। চুলে আর গোঁফে সবসময়ই কলপ করে বলে সত্যিকারের বয়সের চেয়েও আরও দশ বছর কম মনে হয়,গত পনের বছর যাবৎ সে এই এলাকার মেম্বার। এবার সুযোগ ছিল চেয়ারম্যান হওয়ার, বর্তমান চেয়ারম্যান হঠাৎ করে মারা যাওয়ায় গত দেড় বছর যাবৎ কোন নির্বাচন ছাড়াই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছে তার পাশের ওয়ার্ডের আজিজল মেম্বার, অথচ এই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার দৌড়ে সবার সামনে ছিল লাল মিয়া,কিন্তু কোন লেখাপড়া না থাকায় শেষ পর্যন্ত সে নিজেই পিছিয়ে যায়। সব জায়গায় টিপ-সই দিতে তার শরম করে। আর চেয়ারম্যান হইলে টিপ-সই দেয়ার ঝামেলা বেশি,তার চেয়ে মেম্বার হয়ে থাকাই ভাল। আর তাছাড়া আজিজল মেম্বার তার কথা ছাড়া একচুলও নড়ে না,তাই লাল মিয়াই পরোক্ষভাবে চেয়ারম্যন।
নাজমাদের বাসায় লাল মিয়া প্রায়ই আসে। নাজমার মায়ের সাথে জমিজমার বিষয়ে নানা রকম আলাপ-আলোচনা করে,পাশে বসে পানের খিলি বানিয়ে দেয়,সুখ-দুঃখের কথা কয়। নাজমার মা লিলু বেগম লাল মিয়াকে দুলাভাই বলে ডাকে,লাল মিয়ার বউ লিলু বেগমের কেমন যেন দূর সম্পর্কের বোন হয়। সেই সূত্রেই লাল মিয়ার সাথে লিলুর একটু বেশি ঘনিষ্ঠতা। নাজমাদের অভাবের সংসারে লাল মিয়া নানা রকম সাহায্য সহযোগীতা করে। এইতো গত বছর লাল মিয়ার কাছ থেকে টাকা নিয়ে লিলু তার স্বামীকে বাজারে দইয়ের ব্যবসা দিয়ে দেয়। সেই টাকাই কোন সুদ ছাড়া কিস্তিতে কিস্তিতে শোধ করে লিলু। তারই সুবাধে লাল মিয়া এখন একটু বেশি বেশি আসে নাজমাদের বাসায়। মাঝখানে কয়েক বছর সে নাজমাদের বাসায় খুব একটা আসতো না। তার আগে সে প্রায় নিয়মিতই আসত নাজমাদের বাসায়। নাজমা তখন ছোট,ক্লাস ত্রি বা ফোরে পড়ে। নাজমার বাবা দিনরাত বাজারে বসে বসে জুয়া খেলত। তখন লাল মিয়া নাজমাদের বাসায় এসে ঘন্টার পর ঘন্টা লিলুর সাথে গল্প করত। তখন পাড়া-পড়শীরা লিলু আর লাল মিয়াকে নিয়ে নানারকম মুখরোচক কথা রটায়, কিন্তু লাল মিয়ার ভয়ে কেউ মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পেত না। একসময় লাল মিয়ার কানে এ ব্যাপারটা আসে যে, লোকজন বলাবলি করছে লাল মিয়া আর লিলুর মইধ্য ইটিস-পিটিস আছে নইলে একটা বেগানা পুরুষ একটা মহিলার লগে ঘরের মইধ্য বইসা কিসের এত ফুসুর -ফাসুর করে। এ ব্যাপারটা শোনার পর লাল মিয়া নাজমাদের বাসায় যাওয়া মোটামুটি বন্ধ করে দেয়।
যাইহোক,সে অনেক আগের কথা। এখন লোকজন এসব ভুলে গেছে। লাল মিয়া নাজমাদের বাসায় এখন আসে শুধু কিস্তির টাকা নিতে অথবা কিস্তির টাকার ব্যানারে লিলুর সাথে দেখা করতে।
লাল মিয়া এসেছে প্রায় দেড় ঘন্টা হয়ে গেছে। এখনো বৃষ্টি খুব একটা কমেনি। সে যখন আসে তখন পুরাই খরা,হঠাৎ করেই মুষলধারে বৃষ্টি,শ্রাবন মাসের বৃষ্টির এই এক সমস্যা এই বৃষ্টি তো এই রোদ। বৃষ্টিতে লাল মিয়া আটকে পরে নাজমাদের বাসায়। যেই বৃষ্টি তাতে ছাতাতেও কিছু হবে না। লাল মিয়া নাজমাদের ঘরের বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে। এমন সময় নাজমার মা লিলু বেগম বাদাম আর চাল ভাজা নিয়ে আসে।
"খান দুলাভাই,অর আব্বায় কহন আইয়ে ঠিক নাই,আইলে টেকা পাঠায়া দিমু নে"
লাল মিয়া নড়েচরে বসে,টাকার ব্যাপারে তার মনে হয় খুব একটা আগ্রহ নাই। সে লিলুকে বলে "মাইয়াতো
ভালোই বড় হইছে দেখতাছি"
" জ্বে,আমনেগো দোয়ায় আরকি"
" তা,পড়া-লেহা করে কোন ক্লাসে?
" আল্লায় চাইলে সামনে মেট্রিক দিবো "
" ও, পড়ালেহা করে ঠিকঠাক মতন না হারাদিন ঘুইরা বেড়ায়?"
"পড়ে আরকি নিজে যা পারে,টেকা-পয়সার অভাবেতো আর প্রাইভেট পড়াইতে পারি না,কি আর করা; যা হয় হইবো,বিয়ার আগ পইযন্ত পড়ুক"
লাল মিয়া আবার নড়েচরে বসে,গলা খাকারি দিয়ে বলে," টেকা-পইসার চিন্তা করো ক্যান! টেকা-পইসার লাইগা পোলাপানের পড়ালেহা বন্ধ থাকবো নাকি! সে গলার স্বর নরম করে টেনে টেনে বলতে থাকে,"আর একটা কথা হইলো তোমার আফায় কয়দিন হইলো ঢাকা গেছে তার বড় পোলার বাসায় এইডাতো মনে হয় জানোই,বড় পোলার বউ আবার পোয়াতি, অহন ডেলিভারি হওনের আগেতো আর আইতে পারবো না,তাও মনে করো দুই-আড়াই মাসের মত লাগবো আইতে,বাড়িটা সারাদিন নিরিবিলি থাহে; তাই কইছিলাম নাজমা যদি আমার বাসায় যাইয়া পরীক্ষার আগে কয়টা দিন থাহে তাইলে অর পড়া-লেহার লাইগা খুব ভাল হইতো আর তাছাড়া স্কুলও আমার বাসা থেইকা কাছে হয়,আর প্রাইভেট মাস্টার নিয়া টেনশনের কিছু নাই ঐটা আমি ঠিক কইরা দিমুনে,আমার পরিচিত ভালা মাস্টার আছে; অহন দেহ চিন্তা কইরা কেমন হয়"
নাজমার মা কিছুই বলে না,চুপ করে ভাবতে থাকে। লাল মিয়া তার দিকে আড়চোখে তাকায় তার মতিগতি বোঝার জন্য। লিলু কিছু বলছে না দেখে লাল মিয়াই আবার বলতে শুরু করে " আরে এতো চিন্তার কী আছে,তোমার মাইয়াতো আমার মাইয়ার মতই,অয় তো আর আজীবনের লাইগা যাইতাছে না, বাড়িটা নিরিবিলি থাকে আবার স্কুলটাও কাছে তাছাড়া তোমার বাসায়তো কারেন্টও নাই, হারিকেন-কুপি এইসব দিয়া আর কতক্ষন পড়া যায়। যা কইছি অর ভালোর লাইগাই কইছি"
নাজমার মা রাজি হয়। রাজি না হওয়ার কিছু নাই, ও তো আর সারাজীবনের জন্য যাচ্ছে না। তাছাড়া লাল মিয়া একজন মানী ব্যাক্তী,সে তাদেরকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগীতা করে। তার প্রস্তাবেতো আর মুখের উপর না বলে দেয়া যায় না, গিয়ে কিছুদিন থাকুক,যদি ভালো না লাগে তাহলে চলে আসবে। এসব ভেবে নাজমার মা রাজি হয়। সে বলে, "আইচ্ছা দুলাভাই, নাজমার লগে কতা কইয়া কাইল-পরশু পাঠায়া দিমুনে"
পরেরদিন নাজমা বইপত্র,প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে লাল মিয়ার বাসায় যায়। নাজমার খুব একটা খারাপ লাগে না সেখানে। এতো বড় ঘর,রঙিন টিভি আবার রান্না-বান্নারও ঝামেলা নাই। ঢাকা যাওয়ার সময় লাল মিয়ার বউ এক মহিলাকে ঠিক করে দিয়ে গেছে ঘর-দোর পরিস্কার আর রান্না-বান্না করার জন্য। তাই নাজমার কাজ হলো সারাদিন পড়াশোনা করা আর টিভি দেখা। এরমধ্য লাল মিয়া নাজমার জন্য অংক আর ইংরেজীর প্রাইভেট মাস্টার ঠিক করে দেয়। নাজমা প্রতিদিন বিকেলবেলা প্রাইভেট পড়তে যায়। লাল মিয়া বাহিরে সারাদিন নানা কাজে ব্যস্ত থাক,এই গ্রামের সকল আচার-বিচারে লাল মিয়াই মূখ্য ব্যাক্তি। সে যেই সিদ্ধান্ত দিবে সেটাই চুড়ান্ত। তার মুখের উপর কথা বলার সাহস কারো নাই। প্রতিদিন রাত আটটা-নয়টার দিকে লাল মিয়া বাসায় ফেরে। হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে। নাজমার খোজ-খবর নেয়। মাঝে মাঝে নাজমাকে চা বানাতে বলে, চা খেতে খেতে নাজমার সাথে নানা বিষয় নিয়ে গল্প করে। প্রথমদিকে গল্প করতে নাজমার ভালোই লাগতো,কিন্তু ইদানিং খুব একটা ভালো লাগেনা। কথা বলার সময় লাল মিয়া তার দিকে কেমন করে যেন তাকায়। লাল মিয়া তার বুকের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। তারপরও এ ব্যাপারটাকে নাজমা খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। সে ভাবে এটা হয়ত তার বয়সের কারনে মনের মধ্য সৃষ্টি হওয়া একধরনের বিভ্রান্তি। লাল মিয়াকে সে খালু বলে ডাকে,বাবার মত সম্মান করে। তার সম্পর্কে এসব ভাবতে গিয়ে নাজমা নিজেই নিজের কাছে লজ্জা পায়।
এরমধ্য একদিন লাল মিয়া একটু রাত করে বাসায় ফেরে। নাজমা দরজার খিল না দিয়েই ঘুমিয়ে পরে। লাল মিয়া ঘরে ঢুকে, নাজমার রুমের কাছে গিয়ে দেখে লাইট জ্বালিয়ে রেখেই নাজমা অগোছালোভাবে শুয়ে আছে। তার বালিশের কাছে একটা বই খোলা পরে আছে। সম্ভবত পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পরেছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে নাজমার স্তন দুটি উঠানামা করছে। লাল মিয়া দরজায় দাড়িয়ে থেকে এ দৃশ্য দেখছে। সে নাজমার খাটের কাছে গিয়ে দাড়ায়,নাজমার পাশে বসে। সে নাজমার গালে হাত রাখে, নাজমা টের পায় না, হাত আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামতে থাকে; হঠাৎ করেই নাজমা জেগে উঠে। লাল মিয়া ক্ষুধার্ত বাঘের মত নাজমার উপর ঝাপিয়ে পরে। তারপর শুধু "খালু" বলে নাজমার একটা আর্তচিৎকার শোনা যায়। ঠিক সে সময় দূরে কোথাও শেয়ালের চিৎকার শোনা যায়,শেয়ালের চিৎকারের সাথে নাজমার চিৎকার মিশে একাকার হয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:১৭