প্রথম পর্বঃ
ল্যাম্প পোষ্টের আলো তখনও জ্বলে নি, দাঁড়কাক গুলো এদিক ওদিক কা কা রবে ছোটা-ছুটি করছে। পার্কের বেঞ্চিতে দুই হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে অনেকসময় ধরে বসে আছে একটি ছেলে। দেখতে কালো রোগা হালকা পাতলা গড়নের। কিছুক্ষণ পর পার্কের এদিক সেদিক মানুষ গুলো গোল হয়ে বসে ইফতারের আয়োজন করতে লাগলো। কিন্তু ছেলেটির কোন পরিবর্তন নেই। ছেলেটির নাম মেঘ। আসলে সে জানেও না এখন ইফতারির সময় হয়েছে।
আযানের শব্দ পেয়ে হঠাৎ যেন হুশ এলো তার, পার্কের ট্যাবে গিয়ে পানি খেলো। পানি খেয়ে পার্ক থেকে বের হতে যাবে এমন সময় ইফতার করতে থাকা ৪ জন ছেলে তাকে ডাকল
এই ছেলে এদিকে আসো... নাউ ইফতার কর
এই বলে একটি কলা আর বাকি ইফতারের জিনিস কিছু কিছু করে এগিয়ে দিল। অনেকটা নিরুপায় হয়ে মেঘ সেগুলো নিয়ে একটু আড়ালে গিয়ে ইফতার সারল। তারপর একটু দূরত্ব রেখে দাড়িয়ে রইল, যখন ওই ছেলেগুলোর ইফতার করা শেষ তখন এগিয়ে এসে বলল
ভাই আপনারা যান, আমি এই জায়গাটা পরিষ্কার করে দেই
আরে না না , তুমি করবে কেন? আমাদের টা আমরাই করবো, কোন সমস্যা নাই...
ভাই, আমারে আপনারা খাবার দিলেন আর এইটুকু করতে দিবেন না !
এই বলে আর কোন সুযোগ না দিয়ে মাঘ কাজে লেগে পরল। সবার ধারণা ছিল হয়ত সে ময়লা গুলো নিয়ে এদিক সেদিক ফেলে দিবে কিন্তু সবার ধারণাকে মিথ্যা প্রমান করে রাস্তা পার হয়ে মায়লা ফেলার নির্ধারিত স্থানে গিয়ে ময়লা ফেলে আসলো। এই দেখে ছেলে গুলো কানা ঘুসা করছিল, তার পর হঠাৎ ছেলে গুলোর চোখ থেকে মেঘ উধাও হয়ে গেল, তাকে ময়লা ফেলা পর্যন্ত সবাই লক্ষ্য করেছে কিন্তু তার পরে আর কেউ দেখেনি।
মেঘ প্রায় প্রতিদিন ঘুরে বেরায় এ পার্ক থেকে সে পার্ক। চুপটি মেরে বসে থাকে, ঢাকার সবগুলো পার্কেই সে সময় কাটিয়েছে। মেঘের নির্জন পার্ক খুব পছন্দ। যেদিন কোন পার্কে বসে থাকতে বেশি ভাল লাগে পরের দিন আবার যায়। রাতে থাকতে খুব ইচ্ছা করে, কিন্তু থাকতে পারে না। রাতে ছোট একটা চাকরি করে মেঘ। ফুটপাতের কিছু দোকান পাহারা দেয়, যে লোকটি আগে পাহারা দিত সে ৩৫০০ পেত, মেঘ কে সে নিয়োগ দিয়েছে ২৫০০ টাকায়, আর সে নিজে এখন ফুটপাতে চা বিক্রি করে। কাগজে কলমে সে পাহারাদার কিন্তু পাহারা দেয় আসলে মেঘ। মেঘ সব জেনেশুনেই কাজটি করে। কারন সে জানে ঢাকা শহরে থাকতে গেলও ১০০০ তাকা লাগে, তার চেয়ে ভাল রাতে চাকরি করা। থাকার জায়গাও লাগলো না, সাথে খাবার টাকাও জোগাড় হল। তার দিনের সময়টা কাটে পার্কে ঘুমিয়ে বা বই পরে।
মেঘ তার এই উলটো অভ্যাসের একটা যুক্তিও খুজে বের করেছে। দিনের বেশির ভাগ সময় সে ঘুমিয়ে কাটায় তাই দিনের বেলায় ক্ষুধা কম লাগে, আর রাতে যখন জেগে থাকে তখন ক্ষুধা লাগলেও দোকান খোলা থাকে না। তাই খরচও কম, দিন ও ভালই চলে যাছে। অদ্ভুত যুক্তি।
মেঘ রাতে যখন পাহারা দেয়, মাঝে মাঝে একটা লোকের সাথে তার দেখা হয়। রাত যখন গভীর হয় মানুষের আনাগোনা থাকে না তখন লোকটি একটি ছোট টর্চ নিয়ে বের হয়। রাস্তায় কে যেন খোঁজে, একটু অন্ধকার দেখলে টর্চ দিয়ে দেখে। মেঘ লোকটিকে একদিন সাহস করে প্রশ্ন করেছিলো
ভাই আপনি রাতের বেলায় রাস্তায় কি খোঁজেন? আপনার কি কিছু হারাইছে?
লোকটি হেসে বলে
আরে বোকা পোলা! প্রতিদিন কি আমার জিনিস হারায় নাকি? শোন প্রতিদিন অনেক মানুষের অনেক কিছু এই রাস্তায় হারায়, কেউ খুইজা পায় কেউ পায় না, সবাই পাইয়া যাওনের পর যা থাকে তাই আমি খুজি। বুঝতে পারছস?
না বুঝি নাই !
থাক বুঝতে হইব না, এইখাবে আশেপাশে কী চা পাওন জাইব?
হ আছে, ওই সিগনালের নিচে...
তাইলে চল দুইজনে মিলা চা খাই...
না, আমি খামু না, ওস্তাদ কইছে রাতে কারো কাছ থেকে কিছু না খাইতে, আর আমি চা খাই না
আরে বোকা আমি তর কোন ক্ষতি করুম না, তুই রাতে না ঘুমাইয়া কাম কইরা খাস, আর আমি টুকাইয়া খাই, আমি তর ক্ষতি করলে আল্লাহ্ আমায় মাফ করবো না। আর ওই সিঙ্গাল থাইকা তো তর মাল ও দেখা যায়... সমস্যা নাই চল। আইজ আমি অনেক খুশি, একটা মানিব্যাগ পাইছি। পুরা ৭০০ টাকা !!!
ফিরত দিবা না?
বোকা পোলা কয় কি!! ফিরত দিমু কারে, কার মানিব্যাগ তা কি আমি জানি!! আর এইডাই তো আমার কাম, ফিরত দিলে আমার লাভ কি? আর দেখ মানিব্যাগে বেলেডের ফার আছে, মনে হয় পকেট মাইরে কাটছে, সবই নিছে, আমি পুরাডা খুইজা সেলাইয়ের ভিতর থাইকা এই ৭০০ টাকা পাইছি। আর দেখ একটা বাচ্চা মাইয়ার ছবি। এক্কেবারে পরীর নাহাল।
ওস্তাদের কথা অমান্য করে সেদিন রাতে মেঘ চা খেয়েছিল কিন্তু তাতে তার কোন ক্ষতি হয় নি বরং ভালই হয়েছে। ওই লোকটির সাথে তার একটা ভাল সম্পর্ক হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে রাতে দুই এক ঘণ্টা কথা বলার লোক তো পায়।
মেঘের আজকের এই অবস্থার জন্য মেঘ কাউকে দায়ী করে না, একদিন মেঘের সব ছিল। বাবা মা, ভাই বোন, বন্ধু বান্ধব সবাই... হঠাৎ এক দমকা হাওয়া সব দুমরে মুচরে দিল সব।
মেঘ পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান। তথাকথিত কনজারভেটিভ পরিবার বলেই হয়ত তার বাবা “আল্লাহ্ দিবে আল্লাহ্ খাওয়াবে” তত্তে বিশ্বাস করেছিলেন তাই তার ভাই বোনের সংখ্যা মোট ৭ জন। পাঁচ বোন আর দুই ভাই সাথে বাবা মা ভালই চলছিলো।
মেঘ যতই বড় হতে থাকে একটা অদ্ভুত ব্যাপার তাকে কুরে কুরে খেতে থাকে, আর সবার মত তাকে কেউ ভালবাসে না। কেউ কোনদিন তাকে ভালবেসে কাছে ডেকে নেয় নি। সেই অবহেলার কারন সে আজও খুজে বের করতে পারে নি, তবে এক প্রতিবেশি দাদীর কাছে শুনেছিল তার জন্মের পর তার মায়ের অনেক বড় একটা অসুখ হয়েছিল, সেই অসুখে পরিবারের সবাই অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।
কিন্তু এই যুক্তিতে কেন তার ভাই বোন তাকে অবহেলা করতে তার কোন কারন দার করাতে পারে না মেঘ। এখন আর এসব নিয়ে ভাবে ও না। কিন্তু এখনও মাঝে মাঝে পার্কের বেঞ্চিতে ঘুমানোর সময় পরে যাওয়ার উপক্রম হলে তার যেন মনে হয় বাবা তাকে লাথি মেরে ফেলে দিচ্ছে। ছোটবেলায় তখন ক্লাস টু তে পরে, একদিন বাবার শোবার জায়গায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো, বেশ কয়েকবার ডাকার পরও যখন ঘুম ভাঙল না তখন বাবা লাথি মেরে ফেলেদিয়েছিলেন খাট থেকে নিচে। বুকের পাশে একটা তীব্র ব্যথা নিয়ে যখন ঘুম ভাংল তখন সে ঘরের মেঝেতে পরে আছে, ততক্ষণে মেঝেতে পরায় হাতে পায়ের ব্যথাটাও অনুভুত হতে লাগলো। সেদিন রাতে সে কাঁদতে ও পারে নি, বাবা কে প্রশ্ন ও করতে পারে নি ‘বাবা আমায় ফেলে দিলে কেন !’ রাগ ও করে নি। কার উপর রাগ করবে! পরের দিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে তার কাছেই তো ২ টাকা চেয়ে নিতে হবে, না হলে যে দুপুরে বাটারবন (ভেতরে মিষ্টি ক্রিম দেওয়া রুটি) খাওয়া হবে না।
৩১-০৭-১৪
মেঘ কখনো ক্লাসে ফাস্ট হতে পারতো না কিন্তু ২ থেকে ৪ এর মধ্যেই থাকতো। বড় আপা তখন কলেজে পরেন, অবসর সময়ে পাড়ার কিছু ছেলে মেয়েকে পড়ান ঘরের বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে। ইচ্চা না থাকলেও সেখানে বসে পড়তে হতো মেঘের। সব দিনের কথা ভুলে গেলেও একটি দিনের কথা মেঘ হয়ত কোন দিনই ভুলতে পারবে না! সেদিন পড়া শেষ না করে খেতে বসেছিল বলে তার আপা এসে খাবার খাওয়া অবস্থায় ওকে কাঁচা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পিটিয়ে পিঠে হাতে দাগ করে ফেলেছিল। সেদিন আর মেঘের আর ভাত খাওয়া হয়নি।
রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে বড় ভাই আবার ঘুম থেকে তুলে মেরেছিল, ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচতে ঘরের চারদিকে দৌড়াতে থাকে মেঘ, একসময় ধরে ফেলে বড় ভাই, তার পর দুই হাতে ঘার ধরে ২/৩ হাত উচু করে ঝাঁকি মেরেছিল কয়েকটা। মা তখনও রান্না ঘরে কুপির আলোতে রুটি ভাজছিলেন আর গল্প করছিলেন লিপি বৌদির সাথে।
মেঘের খুব কষ্ট লেগেছিল সেদিন। ভাই বোন মেরেছিল বলে নয়! মা ফিরায়নি বলে! হয়তো ছেলে মেয়ে মানুষ করতে গেলে শাসন করতে হয়। কিন্তু সেটা বোঝার মত বয়স ও তো চাই!
দিন যায় মাস যায়, পঞ্চম শ্রেণী ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। সেদিন মেঘ স্কুলে যায় নি। সেদিন ছিল ২রা বৈশাখ, বড় চাচার মৃত্যু দিবস, বাড়িতে ছোট খাটো একটা আয়োজন হচ্ছে সেখানেই মিশে আছে, ভেবেছিল রেজাল্টের কথা কেউ জানতে পারবে না, একদিন পরে জানলে লাভ, বাড়ি ভরা লোকের সামনে লজ্জা পেতে হবে না! কিন্তু ছোট মানুষের ছোট চিন্তা! পাশের বাড়ির দিদিমনি এসে রেজাল্টের ঘোষণা দিলেন মেঘ নবম হয়েছে। ঠিক সাথে সাথে কঞ্চি কাটা হল, হাতে ১০ মিনিট এর মত সময় পেয়েছিল মেঘ! ওই বাঁশঝাড় থেকে কঞ্চি কাটতে যতটা সময় লাগে...
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১২:২২