টেলিভিশন সমালোচনা লেখা ঠিক আমার কাজ নয়। কারন ময়রা কখনো মিষ্টি খায় না, মিষ্টি নিয়ে সমালোচনাও করে না। কিন্তু অনুরোধে ঢেঁকি গিললে কাষ্ঠকেও রসালো মনে হয়। সকল চ্যানেলের প্রতিশ্র“তি থাকে ঈদের বিশেষ আয়োজনের। ইটিভি ও দেশ টিভিরও তেমন প্রতিশ্র“তি ছিলো বৈকি। ইটিভি দেশের সবচেয়ে পুরোনো চ্যানেলগুলির একটি আর দেশটিভি সর্বকনিষ্ঠ। তবে এই বিষয়টি চ্যানেলগুলির মালিকদের মধ্যেই আছে এখন কারন টিভি চ্যানেলের কর্মীরা খেলোয়াড়দের মতো অহরহ দলবদল করেন বলে কোন চ্যানেলই আর নবীন বলে দাবী করতে পারেন না। প্রথমেই বলি খবর বিষয়ে। খবর পাঠিকারা ঈদ বলেই হয়তো সাধারন দিনের চেয়ে সাজগোজ ও শাড়ীতে একটু উচ্চমাত্রায় ছিলেন। ব্যতিক্রম ছিলেন দেশ টিভিতে নাতাশা। ইটিভির পাঠিকারাও স্বাভাবিক ছিলেন। ঈদ মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব এবং এটি ধর্মীয় আচরনের অংশ। বছরের পর বছর দেশের বৃহত্তম ঈদের জামাত শোলাকিয়ায় হয়। এটা কি লিড নিউজ হতে পারে কিনা সেটা বিবেচনা করা দরকার। শুধূ তাই নয়, একদল লোক একদিন আগেই ঈদ উদযাপন করেন। এটাও কি কোন খবর হবার মতো গুরুত্ত্ব রাখ্?ে কিছু লোক কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং দেশের আইন কানুন না মেনে, অবৈজ্ঞানিক কাজ করছেন। ফতোয়াবাজদের মতো এদেরও শাস্তি হওয়া উচিত। সেটি নিয়ে কোন কথা না বলে বরং এদের টিভি ক্যামেরার সামনে মজা করে নিয়ে আসার কোন কারন নেই। একজনতো বলতে থাকলেন সৌদি আরবে যখন ঈদ হয় তখন আমাদেরও ঈদ করতে হবে এটাই ধর্মের নিয়ম। তাকে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিলো কোরবানীর ঈদও তারা একই নিয়মে করেন কিনা এবং ইফতার করেন কখন? নামাজ পড়েন কখন? কারন সৌদি আরবে যখন মাগরিব পড়া হয় আমরা তখন এশা পড়ি। ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে থাকে সংবাদ আর সেখানে লাশ এর ছবি ও দুমড়ানো যানবাহনের ছবি দেখালে আনন্দ মাটি হতে বাধ্য। সেটিও হয়েছে। মজার বিষয় হলো আন্তর্জাতিক সংবাদ বাদ দিলে যে কোন ঈদের সংবাদে বছরের পর বছর একই জিনিষ দেখাচ্ছে চ্যানেলগুলি। যেমন এর পরই ক্যামেরা নিয়ে তারা দৌড় দেন বিভিন্ন পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলিতে। সংবাদ কম থাকলে সংবাদের আয়তন কমানো যেতে পারে, সেটা না করে চ্যানেলগুলি যেন তেন প্রকারে সংবাদের সাইজ ঠিক রাখে। আমার মনে হয় ঈদের সময় সংবাদ নিয়ে চ্যানেলগুলির মনোযোগী হওয়া উচিত।
এখন বৈচিত্র নয় বরং অনুষ্ঠানের পরিমান চ্যানেলগুলির কাছে বিনোদন বলে বিবেচ্য হচ্ছে। তাই তারা পাঁচ দিন ব্যাপি, ছয় দিন ব্যাপি, সাত দিন ব্যাপি বলে তাদের প্রমোশনাল চালাতে থাকেন।অথচ এই সাতদিনে তারা তাদের অনেক নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার করেন। সকল চ্যানেলের প্রধানতম বিনোদন বস্তু হলো নাটক এবং চ্যানেলগুলি তাদের ঈদের অনুষ্ঠানের কোন আগাম প্ল্যানিং করে বলে মনে হয় না। তাই ঈদের সময় তারা যেসব নাটক দেখায় দু একটি বাদে তাদের সবকটির বিষয়, পাত্র পাত্রী এবং লোকেশন সবই বাকি ৩৬০ দিনের মতোই থাকে। অনুষ্ঠানের দর্শকশ্রেনীও তাদের বিবেচ্য। সববয়সের জন্য ঈদ নাকি ঈদ টিন এজারদের অথবা বুড়োদের, শিশুদের নাকি মহিলাদের? শিশুদের জন্য সকল আয়োজন গতানুগতিক। দেশ টিভিতে ইচ্ছাপুরন করার জন্য মিলার গানের সাথে এক শিশু নাচবে বলে তাকে মিলার বাসায় নিয়ে যাওয়া হলো। ঈদের ইচ্ছা এর চেয়ে বড় কোন কিছু হলে বোধহয় ভালো লাগতো। নামে নামে টক্কর নামে একটি অনুষ্ঠান ভালো লাগলো। ভালো লাগার কারন অনুষ্ঠানে দুইজন আনিসুল হক ও উপস্থাপিকা সাবেরী আলম। পরিমিতিবোধ, উপস্থাপনার একটি গুন। সাবেরী সেটি সকলকে বুঝিয়ে দিলেন। তবে এন্ড টাইটেলে অতিথি বানানটি ভুল দেখে কষ্ট পেলাম কারন দুটি চ্যানেলেই এমন অসংখ্য বানান ভুল দেখেছি এই কদিন এবং সারা বছর সেটি দেখি। দুটি চ্যানেলই গভীর রাতে ফোন করে গান শোনার লাইভ বা জীবন্ত অনুষ্ঠান প্রচার করে। একটির নাম ফোনো লাইভ, আরেকটি কলের গান। দুটি অনুষ্ঠানেই উপস্থাপিকাদের পোষাক ও মেকআপ তাদের সৌন্দর্যকে মাটি করেছে। লাইভ অনুষ্ঠানে শব্দ একটি গুরুত্ত্বপুর্ণ বিষয়। ব্যান্ড ও গায়কভেদে এর তারতম্য দেখা গেছে। জেমস বা এলআরবি এলে শব্দ ভালো। এর কারন সম্ভবত ব্যান্ডগুলির নিজস্ব সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার। ঈদের দিন সকালে মম আর সজল একটি ফোন আড্ডা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে। প্রথম বিরতির আগে পর্যন্ত ফোন ও এসএমস এর নম্বর বা ই মেল এর ঠিকানা লেখা কোন অ্যাস্টন দেখা যাচ্ছিল না । টিভি স্ক্রিন এর তিন কোনে তিনাট গ্রাফিকস বিরক্তির কারনে পরিনত হয়। স্ক্রিন এর কোনে এই ধরনের গ্রাফিক্স মূলত এমটিভির আবিষ্কার। পরে ভারতীয় চ্যানেলগুলি লোগো ও গ্রাফিক্স নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে থাকে আর আমরা যথারীতি দাদাস্য অনুকরনং তপঃ। মম ও সজলের উপস্থাপনা সপ্রতিভ ছিল । মডেল ও অভিনেতাদের সমন্বয়ে মুশফিক কল্লোল পরিচালিত একটি গানের লিপসিং ভিডিও প্রচারিত হয়েছে যার অংশগ্রহনকারীরা ছিলেন স্মার্ট ও সুদর্শন কিন্তু নাচ গান ছিল ভারতীয় আইটেম সং এর সস্তা অনুকরন। ঈদের দিন সকালে উইনিং মোমেন্টস নামে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিজয়ের দিনগুলি নিয়ে অনুষ্ঠানটি ছিল উপভোগ্য। কুদ্দুস বয়াতীকে দিয়ে রমজানেরই রোজার শেষে গানটি বেসুরে গাওয়ানো ঠিক কিনা জানি না। তবে এটি যদি রবীন্দ্রসংগীত হতো তবে দেশ টিভি কোনদিন একাজটি করতো না। এই গানটি সুরহীন বাউলা ভাব নিয়ে গাওয়ার জন্য কবি নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন বলে মনে হয় না। তারকা সংবাদ নামে অপি করীমের উপস্থাপিত অনুষ্ঠানটি ভালো হয়েছে। যা কিছু প্রথম অনুষ্ঠানটি বিজরী ভালো উপস্থাপনা করেছেন। হ্যালো জোকস অনুষ্ঠানটিতে প্রিয় আহসান হাবীব এর গম্ভীর উপস্থিতি দেখে মনে হয়েছে তিনি কোন কারনে আমার মতো অনুরোধে ঢেঁকি গিলেছেন। তবে তিনি অসাধারন একজন গল্প বলিয়ে। তার বলা জোকস বাদ দিলে অনুষ্ঠানটি ছিল সাধারন মানের। দেশ টিভির অধিকাংশ অনুষ্ঠানের সেট ছিল ভাল্ ো। আধা রিকশা দেয়া এই অনুষ্ঠানের সেটটি সেই ভালো লাগা মানের ছিল না।
আসি নাটকে। সম্পত্তি নাটকটি ছিল একটি সিরিয়াস নাটক। ভালো লেগেছে। হুমায়ুন আহমেদ এর নাটক থাকতেই হবে ঈদে। দেশ টিভিতে সেটি একটু বেশী মাত্রায় ছিল। ছেলে দেখা নাটকটি সাধারন মানের। তিনি একুশে টিভিতে আরেকটি নাটক দিয়েছেন যার নাম কনে দেখা। নাম দেখে মনে হয়েছে শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন নিজেকে অতি মাত্রায় নিংড়ে নিচ্ছেন। নীতুর ঘরে ফেরা নাটকটি ছিল মজার এবং এতে দৈত্য জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অসাধারন। নাট্যমঙ্গেেলর কথা শুনে পূন্যবান নাটকে নায়িকাদের নিয়ে কিছু সংলাপ ছিল যেটি পরে একটি ডিসক্লেইমার দিয়ে হালাল করার চেষ্টা হয়েছে। তবে এধরনের নাটক যেখানে পরিচালক ও প্র্রযোজক, মদ্যপ ও নারীলিপ্সু, নায়িকা চরিত্রহীন,পুরো ইউনিট অসদাচরন করছে সেটি দেখালে সাধারন মানুষ বিশ্বাস করে মিডিয়াতে এমনটাই হয়। যতোই মাসুদ রানার মতো বলা হোক না কেন ঘটনা কাল্পনিক। বাজান গেলাম সংলাপটি শুনে সবাই মজা পেয়েছে। হুমায়ুন আহমেদের সব নাটকে পাত্র পাত্রী ছিলেন প্রায় একই। ফলে মনে হয়েছে একই নাটক দেখছি। হেলিকপ্টার নাটকটিতে জাহিদ হাসান এর অভিনয় ছাড়া আর কোনো বিশেষত্ত্ব ছিল না। মনিকার প্রস্তাব নামে একটি নাটক দেখলাম যেটি একদমই ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালায় থাকতে পারে বলে মনে হয়নি। তৃতীয় পক্ষের ও একই অবস্থা। রংমিস্তিরি বলে একটি নিয়মিত নাট্যধারা আসছে যার প্রথম পর্বটি দেখলাম। ভালো লেগেছে কারন নাটকটিতে পান্ডিত্য ছিল না, ছিল সরল ভাবে গল্প বলে যাওয়ার চেষ্টা। লারা লোটাস, ইনামুল হক সহ সকলেই নাটকটিতে স্বাভাবিক সুন্দর ছিলেন।
রুনা লায়লার পুরোনো গান কেবল সেট লাইট দিয়ে আর কত? সব চ্যানেলে এই গানগুলির নানা রকম ভিডিও বহুবার দেখানো হয়ে গেছে। রুনা লায়লার জন্য চ্যানেলগুলির বিশেষভাবে বিনিয়োগ করে নতুন গান তৈরী করা উচিত। দুরপাঠ নামের শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানে শিক্ষার বিষয় মেহেদী লাগানো। শেখাতে এসেছেন, যারা মেহেদী বাজারজাত করেন, তারা। কোন একদিন ডাল এ বাগাড় দেয়া শেখাতে কাওরান বাজারের ডাল বিক্রেতা চলে আসবেন দুরপাঠে, অপেক্ষায় থাকলাম। গাজী শুভ্রর মিউজিক ভিডিওর অনুষ্ঠানটি ভালো ছিল। এবার বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান ছিল দেশ টিভিতে যার প্রথম এপিসোড প্রচারিত হয়েছে। বলা হয়েছে এগুলো নিয়মিত আসবে। তাই যদি হয়, তবে এদের ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠান বলে অভিহিত না করাই ভালো। দেশ টিভির সকল অনুষ্ঠানের আবহ সংগীত ছিল ভালো। তাদের কোন বাদ্য বাজনা কানকে বিব্রত করে নাই।
ইটিভি সম্পর্কে বলা বড়ই কঠিন। একটি নাটক নীলাঞ্জনা। তিন দিনে ভাগ করে দেখলাম। একটি ফ্যাশন শো। ফ্যাশন অ্যান্ড টিউন। তিন দিনে ভাগ করে দেখলাম। একটি রাজনীতিবিদদের নিয়ে টক শো। তিন দিনে ভাগ করে দেখলাম। জেলখানায় ঈদ, সাংসদদের সংসার, ভালো আইডিয়া। কিন্তু যখন উপস্থাপক বললেন, “আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রিত”, বুঝলাম, ভাষা কেবল নাটকে নয়, অন্যত্রও বিপন্ন। তোমার জন্য মরতে পারি নামের একটি সেলেব্রিটি গেম শো দেখলাম। সেটটি এফডিসির পুরোনো তলোয়ার মার্কা ছবির মতো। অংশগ্রহনকারী সাধারন দর্শকরা যদি ভালো না হয় তবে এই অনুষ্ঠানটির ভবিষ্যত সংগীন। নাচ নাচ নামে একটি হিন্দি প্রভাবিত নাচের অনুষ্ঠান দেখলাম। আবারো বলি দাদাস্য অনুকরনং তপঃ। এই অনুকরনের আরেক নমুনা মজ্জাই মজা নামে আরেকটি অনুষ্ঠান। বাংলা ভাষায় মজ্জা মানে হাড়ের মধ্যে থাকা নরম মজাদার রক্তউৎপাদক বস্তুবিশেষ। হিন্দি গানের কাছ থেকে নাম ধার করতে গিয়ে মজার মজ্জা বের করে দিয়েছেন পরিকল্পনাকারী। ইটিভির সকল অনুষ্ঠান এর পরিকল্পনা বা ভাবনাকারী একই ব্যক্তি। এটাও বেশ মজ্জাদার। ফোনো লাইভ কনসার্টগুলি ছিলো ভালো। কনে দেখা নামে নাটকটিতে হুমায়ুন আহমেদ তার প্রিয় বস্তু কোয়ান্টাম ফিজিক্স এর প্যারালাল ইউনিভার্স বিষয়টি নিয়ে সংলাপ দিয়েছেন। আমার মনে হলো, চ্যানেল আই, এটিএন এর হুমায়ুন আহমেদ সম্ভবত প্যারালাল বিশ্বের হুমায়ুন আহমেদ। একেক চ্যানেলে একেক জন আলাদা হুমায়ুন আহমেদ লিখেছেন নাটক। চয়নিকা চৌধুরীর এস এম এস নামের নাটকটি তার নির্মান এ যতœ এবং অভিনেতা অভিনেত্রীদের কারনে ভালো লেগেছে। ইটিভির সবচেয়ে ভালো অনুষ্ঠান ছিলো দুপুর আর সন্ধ্যার নিয়মিত দুটি অনুষ্ঠান একুশের দুপুর আর একুশের সন্ধ্যা। এর কারন অনুষ্ঠানের টিমওয়ার্ক এবং উপস্থাপকদের সপ্রতিভ, দৃষ্টিনন্দন উপস্থিতি। তাদের সেলেব্রিটি সিলেকশন ও ছিলো ভালো।
দুটি চ্যানেলেই সিনেমাগুলি ছিল বারবার দেখা বাংলা ছবি। এবার বলি আসল কথা, উপরের সকল ঘটনা, লেখক, পাত্র পাত্রী, অনুষ্ঠান ও সমালোচনা, সবই কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে তার কোন সম্পর্ক নাই। কোয়ান্টাম ফিজিক্সে প্যারালাল ইউনিভার্স বলে একটা কথা আছে...........