somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনন্ত যাত্রা (ছোট গল্প)

২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




এই চা গরম...................চা গরম।
চমকে পিছনে ফিরে তাকালাম। দশ-বার বছরের এক ছেলে বিশাল ফ্লাক্সে করে ‘চা’ বিক্রি করছে। ফ্লাক্সের সাথে অনেকগুলো প্লাস্টিকের চা’র কাপ বাধা।
চা খাবেন স্যার।
না।
ছেলেটি অন্য যাত্রীদের দিকে এগিয়ে গেল। আমি রেলিঙের দিকে ঝুঁকে আবার পানির দিকে তাকালাম। বুড়িগঙ্গার কালচে পড়া পানি কেটে কেটে লঞ্চটা ছুটে চলছে। কচুরীপানাগুলো দ্রুত পিছনে সরে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও পানিতে ছড়িয়ে পড়া ‘তেলের বৃত্ত’ দুলতে দুলতে যাচ্ছে। সূর্যের আলো পড়ে জায়গাটা ঝিকমিক করছে। নদীর তীর ঘেঁষে পীচঢালা পথ। পথের পাশে বিল্ডিং এর সারি। একতলা, দো-তলা, কোনটা আকাশ ছোঁয়া। মাঝে মাঝে বড় বড় পাইপ দিয়ে কালো ‘থিকথিকে’ পানি বুড়িগঙ্গায় এসে পড়ছে। সর্বংসহা মা’র মতো বুড়িগঙ্গা সমস্ত ক্লেদ নিজের বুকে শুষে নিচ্ছে।
দেখতে দেখতে লঞ্চটা ঢাকা শহরকে পিছনে ফেলে বড় নদীতে এসে পড়লো। পানির বুক থেকে এখন ভেসে আসছে তাজা বাতাস। এই বাতাসে এক ধরনের দামাল ভাব আছে। মন ফুরফুরে করে দেয়।
আমার মনটা চনমনিয়ে উঠলো। অন্যান্য যাত্রীদের চোখে-মুখেও চঞ্চলতার ছাপ! দোতলার কেবিনে বসা যাত্রীরা ফিটফাট ভদ্রগোছের। কেহ গম্ভীর মুখে চোখের সামনে ধরে আছে দৈনিক পত্রিকা। কেহ পাশের জনের সাথে জুড়ে দিয়েছে- রাজনৈতিক আলাপ। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা আমার মতো ডেকে দাঁড়িয়ে নদীর দৃশ্য দেখছে।
পাশে মহিলা কেবিন। তরুণী, মাঝ বয়েসী, বৃদ্ধা, সদ্য বিবাহিত, বোরখাওয়ালী সবাই পাশাপাশি বসে আছে। মাঝ বয়েসী দু’ একজন মহিলা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছেন। মাঝে মাঝে ছোট ছোট বাচ্চারা কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছে। রেলিং ধরে পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া লঞ্চ দেখছে। পিছনে পিছনে মা’রা ছুটে আসছেন। ওদের হাত ধরে কেবিনে ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
দরজার সামনে চানাচুর-বাদাম ওয়ালাদের জটলা। ঘুরে-ফিরে ওরা মহিলা কেবিনের সামনে এসে হাঁক দিচ্ছে,
চানাচুর! ঝাল চানাচুর!
বিক্রিও করছে দেদারছে। চানাচুরওয়ালা মহাব্যস্ত! সে দ্রুত হাতে চানাচুর বানাচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের সামনের ডেকে চলে এলাম। হু-হু করে বাতাস বইছে। মন মাতানো মিষ্টি বাতাস। বাতাসের তোড়ে রোদের তেজ গায়ে লাগছে না। নদীর উপর দিয়ে গাংচিল রাজকীয় ভঙ্গিতে উড়ছে। চোখ ভরে ওদের দেখছি।
দেখ, দেখ, পাখিগুলো কি সুন্দরভাবে উড়ছে!
নারীকণ্ঠের শব্দে পিছনে ফিরে তাকালাম।
কটকটে হলুদ শাড়িপরা একজন সুন্দরী মহিলা পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোককে পাখিগুলো দেখাচ্ছেন। ভদ্রলোক হয়তো তার হাজব্যান্ড। পাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছেন। মহিলার হাতে ক্যামেরা। তিনি মনোযোগ দিয়ে উড়ন্ত পাখিগুলোর স্ন্যাপ নেয়ার চেষ্টা করছেন। মাতাল হাওয়া তার শাড়ি এলোমেলো করে দিচ্ছে। ভদ্রলোক বেশ লম্বা-চওড়া। তিনি ভ্রু কুচকে উন্নাসিক ভঙ্গিকে আশেপাশের দৃশ্য দেখছেন।
মহিলার সাথে একবার চোখাচুখি হল। সাথে সাথে চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। আহল্লাদী ভঙ্গিতে স্বামীর গা ঘেষে দাঁড়ালেন।
সোনিয়ার কথা মনে হল। লঞ্চে উঠার পর সেই যে মহিলা কেবিনে যেয়ে বসেছে, একটি বারের জন্যও বাইরে আসেনি। বেচারী একা একা নিশ্চয়ই নিঃসঙ্গতায় ভুগছে। দ্রুত পা চালিয়ে মহিলা কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ভিতরে অনেক মহিলার মাঝে সে চুপ করে বসে আছে। বাইরে বের হলে সে চুপচাপ থাকে। আগ বাড়িয়ে কারও সাথে কথা বলতে পারে না। জানালার ফাঁক দিয়ে চোখের ইশারায় ওকে ডাকলাম। ও বেরিয়ে এল।
বললাম, একা একা বসে আছো। ভাল লাগছে?
কি করবো?
নদীর দৃশ্য দেখো।
বলে দূর আকাশে তাকালাম। এক ঝাঁক ধবধবে সাদা বক নীল আকাশে উড়ে যাচ্ছে।
দেখ দেখ কি চমৎকার না!
ও উজ্জ্বল-নিষ্পাপ চোখ তুলে তাকাল। কিছু বললো না।
দূরে ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে শান্ত একটি গ্রাম! পানির দিকে তাকালে মনে হচ্ছে- কি দ্রুত লঞ্চটা ছুটছে। আর দূরে গাছপালার দিকে তাকালে মনে হচ্ছে- লঞ্চটা থেমে আছে।
ধীর গতির জন্য লঞ্চে আমি সাধারণত উঠি না। মনে হয়- সময় থমকে আছে। মনে গাছাড়া ভাব চলে আসে। গতির যুগে এই গতিহীনতা ভাল লাগে না। সোনিয়ার পীড়াপীড়িতে আজ লঞ্চে করে বিক্রমপুরে যাচ্ছি।
বিক্রমপুরের মুক্ত পরিবেশে ও বড় হয়েছে। বাসে উঠলে ওর মাথা ঘুরায়। বমি বমি আসে। লঞ্চে আরাম-বোধ করে। প্রফুল্ল থাকে। কিন্তু ও আজ এমন গম্ভীর হয়ে আছে কেন? কোমল স্বরে বললাম, সোনিয়া কিছু খাবে!
ও ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, নাহ।
কিছু খাও, ভাল লাগবে।
কমলা কিনে ওকে দিলাম। ও কমলা হাতে নিয়ে দূরে তাকিয়ে রইল। খেল না। মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠলো। চুপ করে ওর পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম!
সোনিয়া, তোমার মন খারাপ?
ও কোন উত্তর দিল না। দূরে পালতোলা একটা নৌকার দিকে তাকিয়ে রইল। একসময় শান্ত কণ্ঠে বলল, তুমি প্রকৃতি পছন্দ করো!
আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম, হ্যাঁ করি!
ও ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পরে বলল, আমরা যদি ঢাকায় আর না ফিরি!
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন?
ও ম্লান হেসে বলল, নাহ, এমনি বললাম!
মনে মনে তোলপাড় শুরু হল। আমাদের বিয়ে হয়েছে মাত্র এক বছর। এই এক বছরে ওকে নানাভাবে দেখেছি। ও যখন অনবরত কথা বলে, মনে হয় জনম জনম ধরে ওকে চিনি। কিন্তু যখন গম্ভীর হয়ে থাকে, এই বিশাল পানি রাশির মতোই ওকে দুর্ভেদ্য মনে হয়।
যেদিন প্রথম ও আমাদের ফ্যামিলিতে আসে, সেদিন থেকে ছোট বড় সবাইকে আপন করে নিয়েছে। আমিও ওকে কোন কিছু দিতে কৃপণতা করিনি। যখন যা কিছু চেয়েছে, তা-ই এনে দিয়েছে। আমাদের দাম্পত্য জীবনও মধুর। ওর সারা চোখে মুখে সুখী সুখী ছাপ! মানুষ দুঃখ কষ্টের ছাপ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে, সুখেরটা করে না। কিন্তু এই মুহূর্তে ওকে ভীষণ দুখী মনে হচ্ছে। কোমল গলায় বললাম, সোনিয়া, আমাদের ফ্যামিলিতে তোমার কোন সমস্যা হচ্ছে?
ও তাড়াহুড়ো করে বলল, না তো!
তাহলে এমন গম্ভীর হয়ে আছো কেন? মেয়েরা বাপের বাড়ী যাওয়ার সময় কত হাসিখুশী থাকে? আর তুমি?
ও ফিক করে হেসে ফেলল।
কি করবো! লোকজনের সামনে তোমার সাথে হেসে হেসে গল্প করবো?
করলে সমস্যা কি? আমি তো তোমার অপরিচিত কেউ না!
দেখ, বিবাহিত মেয়েরা স্বামীর সাথে বাইরে বের হলে- প্রেমিক-প্রেমিকার মত গুজুর গুজুর করে না।
কে বলছে করে না। একটু আগেও একজন মহিলাকে দেখলামÑস্বামীর সাথে--------
চুপ করো তো! শুনতে ইচ্ছা করছে না!
পানির দিকে চোখ ফেরালাম। ঢেউ বাড়ছে। লঞ্চটা একটু একটু দুলছে। বাতাসের ঝাপটায় সোনিয়ার নতুন শাড়ির গন্ধ ভেসে আসছে। আকাশী রঙের শাড়িতে ওকে এক টুকরো নীল আকাশ মনে হচ্ছে।
ও আমার দিকে ফিরে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল, জানো, ঢাকায় থাকতে থাকতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। চলো আমরা বিক্রমপুরে থেকে যাই!!
তা হয়, কিভাবে? আমার চাকরি ঢাকায়।
বিক্রমপুরে ট্রান্সফার হও।
তাতে লাভ!
ও প্রায় ঝংকারের সুরে বলল, লাভ-লোকসান বুঝি না! ঢাকায় কি আছে? ধুলো-বাড়ি, খুপড়ির মতো রুম! এখানে মানুষ থাকে?
আর মানুষ থাকছে না?
থাকুক, আমি আর সবার মতো না।
একটু হেসে বললাম, তুমি কি রকম?
‘আমি আমার মতো!’ বলে ও রাগী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল।
ওকে চটাতে ইচ্ছা করছে না। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। আকাশের দিকে তাকালাম। খণ্ড খণ্ড মেঘ ভেসে যাচ্ছে। ঝড় আসতে পারে। নদীতেও ঢেউ বাড়ছে।
ডেকের লোকজন রেলিং ধরে বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। উস্ক-খুস্ক এক যুবক আড়চোখে সোনিয়ার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। আমার চোখে চোখ পড়তে সে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। পাশে তিন চারজন ছেলে কি নিয়ে যেন গল্প করছে। একজন উচ্চস্বরে হা-হা করে হেসে উঠলো।
সোনিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে ওদেরকে এক পলক দেখল। তারপর নির্লিপ্তভাবে চোখ সরিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল।
শাড়ি পরাতে ওকে আজ পরিপূর্ণ একজন নারীর মতো লাগছে। সেলোয়ার কামিজে ওকে নাইন-টেন পড়–য়া একটি মেয়ের মতো লাগে। তখন আচরণও করে বাচ্চা মেয়ের মতো!
আমার বিশ্বাস সদ্য বিবাহিত মেয়েরা সুখে থাকলে শাড়ি পরে বাপের বাড়ি যায়। আর অশান্তিতে থাকলে যায় সেলোয়ার কামিজ পরে। বাবা-মাকে মনে করিয়ে দেওয়া- তাদের চিরচঞ্চল আদুরে মেয়েটি আবার ফিরে এসেছে। অবশ্য এখন সোনিয়ার কথা-বার্তা শুনে বোঝা যাচ্ছে না সে সুখে আছে, না দুঃখে আছে। তবে ঢাকার পরিবেশ যে তার সহ্য হচ্ছে না- তা স্পষ্ট।
পাশের ছেলেগুলো কি নিয়ে যেন উচু গলায় হাসছে। সোনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণের প্রাণান্তকর চেষ্টা! সোনিয়া ফিরেও তাকাচ্ছে না। একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি- সোনিয়া যখন পাশে থাকে, ওর দিকে কেউ ভদ্রভাবে তাকালে ভিতরে ভিতরে গর্ব অনুভব করি। কিন্তু কেউ দৃষ্টি কটুভাবে সোনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলে রাগে গা জ্বলতে থাকে।
সোনিয়া হঠাৎ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু হয়তো বুঝলো!
সে দ্রুত বলল, আমি কেবিনে যাচ্ছি। তুমি স্টাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? কেবিনে যাও!
বলেই সে হনহন করে কেবিনে ঢুকে গেল।
আমিও ধীর পায়ে কেবিনে এসে বসলাম। যাত্রীদের মাঝে রাজনৈতিক আলাপ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
একজন লোক দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলছেÑবি.এন.পি এসেই দেশটারে খাইল। জামাত-শিবিরের সাথে জোট গঠন করেছে। শালারা সব রাজাকার!
পত্রিকা হাতে আরেক ভদ্রলোক বললেন, আওয়ামী লীগই বা দেশটারে কি দিয়েছে? দেখেছি না তাদের আমলে!! বাপদাদার জমিদারী স্টাইলে দেশ শাসন করে গেছে!
পাশ থেকে আরেকজন লোক খনখনে গলায় বলে উঠলো,
“অ্যা! বিএনপি যে ধোয়া তুলসী পাতা। সব বেনিয়া জাত! টাকা ছাড়া তারা কিছু বুঝে? ভাঙ্গা সুটকেস নিয়ে জিয়া মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে। তার ছেলে এখন কোটি কোটি টাকার মালিক!
তার সাথে সুর মিলিয়ে আরেকজন বলল,
হের কথা আর কি কমু ভাই এই যে গাবতলীর বাস-ট্রাক থেকে ট্রাফিকপুলিশ যে পরিমাণ চাঁদা তুলে, তার একটা অংশও তার হাতে চলে যায়। দেশটারে লুইট্যা পুইট্যা খাইতাছে!
আরে আপনি চুপ করেন মিয়া, আপনি কি জানেন? কোটি টাকা খরচ কইরা শেখ হাসিনা যে টুঙ্গিপাড়ায় মাজার দিল, হেইডা কার টাকায় দিল?
একজন টুপি পরা কালো দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, যে যাই বলেন, বিএনপি বলেন, আর আওয়ামী লীগই বলেন, সবাই এক! যতদিন দেশে ইসলামী বিপ্লব না হবে, ততদিন দেশে শান্তি নাই।
আলোচনা চলতেই লাগল! সবাই নিজের নিজের মতামত দিয়ে যাচ্ছে। শুনতে ভাল লাগছে না। মাথা টিপ টিপ করছে। নিঃশব্দে সীট ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
হু হু বাতাস! ঝলমলে সূর্য উদাও হয়ে মেঘ ভর করেছে। মেঘের ছায়া পদ্মার উত্তাল পানিতে এসে পড়েছে। পানির রঙও যেন বদলে গেছে। ঘন কালো রহস্যময় মনে হচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে ডেকের পিছনের দিকে চলে এলাম! চোঙ্গা দিয়ে হু হু করে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। এখানে শব্দ বেশ তীক্ষè! কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। এরই পাশে কয়েকজন যাত্রী কার্ড খেলতে বসে গেছে। গামছা বিছিয়ে গোল হয়ে বসে তারা কার্ড খেলছে। পাশে এক মুচি ছোকরা দ্রুত হাতে জুতা পালিশ করছে। ডেকের একেবারে পিছনে এক লোক আয়েশ করে বসে করুণ সুরে বাঁশী বাজাচ্ছে। লঞ্চের একটানা ট্যা----- ট্যা----- শব্দ ছাপিয়ে সেই সুর ভেসে আসছে। তন্ময় হয়ে কিছুক্ষণ সেই সুর শুনলাম। এক ডিমওয়ালাকে ঘিরে ছোট খাটো জটলা। সবাই সিদ্ধ ডিম কিনছে। জার্নিতে বের হলে- অনেকের ডিম খাওয়া বেড়ে যায়। আমি খেতে পারি না। বমি বমি ভাব আসে।
ডিমওয়ালাকে পাশ কাটিয়ে ডেকের পিছন দিক দিয়ে নিচে নেমে এলাম। ইঞ্জিনের বিকট শব্দে পুরো নিচতলাটা গম গম করছে। ইঞ্জিনরুমে উঁকি দিলাম। টিম টিম করে একটি বাল্ব জ্বলছে। বিশাল বিশাল দুটো ইঞ্জিন। রুম থেকে গরম হাওয়া বের হচ্ছে। এক লোক টুল পেতে ইঞ্জিনের পাশে বসে আছে। তার সারা শরীর দরদর করে ঘামছে।
এখানে যাত্রীদের আনাগোনা কম। দু’একজন টয়লেটে যাওয়া আসা করছে। পাশে একটি মহিলা কেবিন। দরিদ্র শ্রেণীর মহিলারা এখানকার যাত্রী। তারা একজন আরেকজনের সাথে চিৎকার করে কথা বলছে। নইলে শুনতে পাচ্ছে না।
হঠাৎ লঞ্চটা প্রবলবেগে দুলতে শুরু করল।
নিচতলার জানালা দিয়ে নদীর দিকে তাকালাম! বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। বিশাল বিশাল ঢেউ লঞ্চের গায়ে আছড়ে পড়ছে। একটু আগেও পদ্মায় এত ঢেউ ছিল না। জানালার কাছে পানি ছুঁই ছুঁই করছে। আমরা যেন পানির মধ্যে ডুবে ডুবে এগুচ্ছি। সাবমেরিনের মতো। যতদূর চোখ যায়, ঘন কালো পানি আর পানি। হঠাৎ বিশাল এক ঢেউ এসে বসার বেঞ্চগুলো ভিজিয়ে দিল। যাত্রীরা পটাপট জানালাগুলো বন্ধ করে দিল।
মনটা খঁচ খঁচ করছে। হঠাৎ আবহাওয়া এত খারাপ হয়ে উঠল! সাথে সাথে পদ্মাও অশান্ত হয়ে উঠছে।
দ্রুত উপরে উঠে এলাম। সোনিয়ার কাছে যাওয়া দরকার। বেচারী একা বসে আছে। অজানা আশঙ্কায় আমার বুকটা টিপ টিপ করছে।
মহিলা কেবিনের সামনে আসতেই সোনিয়া বেরিয়ে এল। ওর চোখে-মুখে আতঙ্ক।
দেখেছো, আকাশ কি অন্ধকার হয়ে এসেছে! প্রচণ্ড ঝড় আসবে!
আশ্বাসের সুরে বললাম, নাও আসতে পারে। বৃষ্টি হবে হয়তো। বৃষ্টি হলে আকাশ এমনি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আমার কথায় ভরসা পেল বলে মনে হল না। অন্যান্য যাত্রীরাও কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেছে। সবাই আকাশের অবস্থা দেখছে। হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাস শুরু হল। ডাঙ্গায় থাকলে এ সময় প্রচণ্ড ধুলা-বালি খেতে হতো। এখানে তার ঝামেলা নেই। যতদূর চোখ যায় চারদিকে কেবল পান আর পানি। কোন তীর দেখা যাচ্ছে না। নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় লাগছে! ডাঙ্গায় যত বড় ঝড়ই হোক, নিজেকে এত অসহায় লাগেনি। ডাঙ্গার প্রাণী বলে কি আমরা জলে অসহায়?
হাতঘড়ি দেখলাম। বেলা তিনটা। দেখতে দেখতে দিনে-দুপুরে পদ্মার বুকে নেমে এল রাতের অন্ধকার! সাথে সাথে বাতাসের একটানা শো-শো গর্জন। ঢেউয়ের আঘাতে লঞ্চখানা একখণ্ড সোলার মতো দুলছে। গতিও কমে গেছে। ঢিমে-তেতালাভাবে এগুচ্ছে।
নিচ তলার যাত্রীরা আতঙ্কে উপরে উঠে আসছে। সবাই এসে জড়ো হচ্ছে- সারেং এর রুমে।
সারেং এর রুম থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে বলল, আপনারা যার যার সীটে যান। ভয় পাবেন না! সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে লঞ্চ আরও বেশী করে দুলবে।
যাত্রীরা তবুও সরছে না। বাতাসের বেগ ক্রমশ বাড়ছে। ঘন কালো মেঘে পুরো আকাশটা ছেয়ে গেছে। একটু আগেও ছিল ফর্সা ফকফকে!
সোনিয়া পাশে দাঁড়িয়ে শক্ত করে আমাকে ধরে আছে। মহিলা কেবিনে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। পুরুষরা তাদের নিজ নিজ স্ত্রী লোকদের খোঁজখবর নিচ্ছে। লঞ্চের দুলুনীতে ঠিকমতো হাঁটা যাচ্ছে না। রেলিং ধরে ধরে হাঁটতে হচ্ছে। মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা ভয়ে বিলাপ করছে।
আমরা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কেবিনে ঢুকতে ভয় করছে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক মোবাইল করার চেষ্টা করছে। হয়তো নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না। তার মোবাইল করা দেখে আমারও মোবাইলের কথা মনে পড়লো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলাম, নেটওয়ার্ক শূন্য। তার মানে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন!
যাত্রীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। সারেং -এর রুমের কাছে ভীড় ক্রমশ বাড়ছে। হলুদ শাড়ি পরা সেই মহিলা স্বামীর হাত ধরে সারেং -এর রুমের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে এখন ক্যামেরা নেই। মুখ থেকে ঝলমলে হাসিও উদাও হয়ে গেছে। তিনি কাঁদো কাঁদো গলায় বলছেনÑ
লঞ্চটা তীরের দিকে নিয়ে গেলেই তো পারে।
স্বামী ভদ্রলোক তার কথার প্রতিধ্বনি করে সারেং এর রুমে উঁকি দিয়ে উঁচু গলায় বললেন, হ্যালো, সারেং সাহেব, আপনি লঞ্চটা তীরের দিকে নিয়ে যান! লঞ্চে মেয়ে-ছেলে আছে। ওরা ভয় পাচ্ছে!
জটলার মধ্যে গুঞ্জন উঠলো। অনেকে তার কথায় সায় দিল।
‘হ্যাঁ তীরের দিকে নিয়ে যান। তীরের দিকে।’
সারেং লোকটি হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
সরাসরি তীরের দিকে লঞ্চ ঘোরানো যাইবো না। ঢেউয়ের বাড়ি খাইয়া উল্টাইয়া যাইবো। আমি কোনাকুনি ভাবে যাচ্ছি।
সারেং এর কথায় কেহ ভরসা পেল না। আশেপাশে কোন তীরও দেখা যাচ্ছে না। একজন যাত্রী বিজ্ঞের মতো বলল, তীরের দিকে চালিয়ে কি হবে? তীরের দিকে ঢেউ বেশী।
মোটামতো একজন যাত্রী বলল, এতোবড় একটা লঞ্চ। সেই পরিমাণ বয়াও নেই।
সবাই তার কথায় সায় দিল।
আরে শালারা কি যাত্রীদের জীবন নিয়া ভাবে! শালারা এসেছে- ব্যবসা করতে!
দেখতে দেখতে কবরের মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এল পদ্মার বুকে। ভয়াল গর্জনে ঝড়ো হাওয়া বইছে। এখনও বৃষ্টি নামেনি। হঠাৎ আকাশটা এফোড়-ওফোড় করে দিয়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। উজ্জ্বল আলোর ঝলকানিতে মানুষের মুখগুলো কি অসহায় দেখাচ্ছে!
সোনিয়ার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। দমকা বাতাস ওর শাড়ি এলোমেলো করে দিচ্ছে। বারবার বুক থেকে শাড়ির আঁচল খসে পড়ছে। একহাতে শক্ত করে আমাকে ধরে, অন্য হাতে শাড়ি সামলাচ্ছে। বেচারী শখ করে আজ শাড়ি পরেছে। শাড়ি পরে ও স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারে না। তাই জার্নিতে বের হলে ও সাধারণত শাড়ি পরে না।
ডেকে দাড়ানো তরুণ ছেলেগুলোর গল্প-গুজব বন্ধ হয়ে গেছে। ওরাও বারান্দায় এসে এক একটা থাম ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মুখগুলো থমথম করছে। আমরা ওদের খুব কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছি। ওরা এখন সোনিয়ার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।
দেখতে দেখতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। ডেকে দাঁড়ানো যাত্রীরা বারান্দায় এসে জড়ো হচ্ছে। বারান্দাটা মানুষে গিজ গিজ করছে। নিচের যাত্রীরা উপরে আসায় ভীড় আরও বেড়ে গেছে। গায়ের সাথে গা লেগে যাচ্ছে। উৎকট ঘামের গন্ধ নাকে এসে লাগছে- সে দিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই।
একজন যাত্রী মিনমিনে গলায় বলল, যারা নিচ থেকে এসেছেন, তারা নিচে চলে যান।
আরেকজন মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, আপনি চলে যান! আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
পাশ থেকে একজন শান্ত সুরে বলল,
ভাই এখন ঝগড়া কইরেন না। আল্লাহ আল্লাহ করেন। বলেই সে শব্দ করে কাঁদো কাঁদো গলায় পড়া শুরু করলোÑ
‘লা ইলাহা ইল্লাললাহু মুহাম্মাদুর রাসুরুল্লাহ।’
‘লা ইলাহা ইল্লাললাহু মুহাম্মাদুর রাসুরুল্লাহ’।
কেবিনের যাত্রীরা শক্ত করে জানালা ধরে- ‘আল্লাহ-আল্লাহ’ করছে।
একজন সুদর্শন ভদ্রলোক কেবিনের ছাদে বাঁধা ‘বয়া’ খোলার চেষ্টা করছেন। এতে সবার মাঝে আতঙ্ক আরও ছড়িয়ে পড়ল। তাদের চোখেমুখে দিশেহারা ভাব। ভয়ার্ত চোখে তারা নদীর দিকে তাকাচ্ছে।
বিশাল পদ্মায় লঞ্চটা একটুকরা খড়কুটার মতো ভাসছে। মানুষের সমান উঁচু এক একটা ঢেউ ছুটে আসছে। লঞ্চটা যখন ঢেউয়ের উপরে উঠছে, আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে, পর মুহূর্তে এত নিচে নেমে যাচ্ছে- মনে হচ্ছে এই জন্মে লঞ্চটা আর উঠবে না। চারদিক দিয়ে ঘনকালো পানি ঘিরে ফেলেছে। নিচে নামার সময় বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ছোটকালে মেলাতে নাগর দোলায় চড়ার সময় এরকম অনুভূতি হয়েছিল।
সোনিয়ার পিঠে হাত দিয়ে ওকে জাপটে ধরে আছি। স্বাভাবিক অবস্থায় লোকজনের সামনে এভাবে জড়িয়ে ধরার কথা কল্পনাও করতে পারতাম না। কেউ আমাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। আমরাও কারও দিকে তাকাচ্ছি না। হয়তো ভুল বললাম। সবাই সবার দিকে তাকাচ্ছি। কিন্তু কেউ কাউকে দেখছি না। সবার চোখে শূন্য দৃষ্টি।
ঝড়ের গর্জন ছাপিয়ে একজন মহিলার তীক্ষè কণ্ঠ শোনা গেল,
বাবুকে ধর, বাবুকে ধরো।
মহিলা কেবিন থেকে ভীতিকর চিৎকার ভেসে আসছে। সবাই একসাথে চেঁচামেচি করছে। কারও কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। কাছে দাঁড়ানো একজন নারীর কণ্ঠ শোনা গেল- আল্লাহ, এখন কি হবে! আল্লাহ রহম করো।
বিশাল এক ঢেউ এগিয়ে আসছে! এই ধাক্কা সামলাতে পারবে তো? লঞ্চটা ঢেউয়ের চূড়ায় উঠল। পর মুহূর্তে পানির নিচে নেমে গেল। সাথে সাথে নারী-পুরুষের আর্ত-চিৎকার।
‘আল্লাহ বাঁচাও!! আল্লাহ বাঁচাও!!’
এক মহিলা গ্রাম্যসুরে জোর গলায় বিলাপ করছে।
হায় আল্লাহ! অহন কি হইবো! কপালে এমুন ভাবে মউত লেহা ছিল!
কে যেন চাপা উত্তেজিত গলায় ধমক দিল, চুপ করেন। আল্লাহ আল্লাহ করেন।
মহিলার চিৎকার আরও বেড়ে গেল।
অন্ধকার এতো ঘন হয়ে এসেছে- একজন আরেকজনের মুখ ভাল করে দেখতে পাচ্ছি না।
কে যেন কান্নার সুরে বলল, সারেং কি করে। সে কোথাও সিগনাল পাঠাতে পারে না।
কেবিনের ভেতর টিম টিম করে আলো জ্বলছে। জানালা দিয়ে দেখলাম, সেই সুদর্শন ভদ্রলোক ‘বয়া’ নামিয়ে ফেলছে। তার মুখে কিছুটা নির্লিপ্ত ভাব। যেন লঞ্চ ডুবলে এক্ষুণি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তার ‘বয়ার’ আশেপাশে আরও তিন-চারজন যাত্রী এসে দাঁড়িয়েছে। দুলুনীতে তারা কেবিনের মাঝখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। একজন আরেকজনের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
বয়া দেখে বুকটা ধুক ধুক করছে। লঞ্চটা দি ডুবে যায় কি করবো আমি? সোনিয়াকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম। ওর ধ্বধবে সাদা চোখে তাকিয়ে বললাম, ভয় পেও না।
নিজের কাছে নিজের কণ্ঠস্বর কেমন কাঁপা কাঁপা শোনাল।
পানির মৃত্যুকে কঠিন মৃত্যু মনে হয়।
ভেসে থাকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা! কিন্তু ক্রমেই নিচে তলিয়ে যাওয়া!!
হুট করে ছোট কালের একটা ঘটনা মনে পড়ল।
একবার রুমে ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে যায়। ইঁদুর ধরার কল দিয়ে একটা জ্যান্ত ইঁদুর ধরে বালতির পানিতে ছেড়ে দেই। ইঁদুরটা বার বার উঠে আসার জন্য ছটফট করছিল। একটা কাঠি দিয়ে সেটাকে বালতির তলায় চেপে ধরি। ইঁদুরটা মুখ হা করতে করতে নিস্তেজ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর ভেসে উঠে!
হায় আল্লাহ কি করেছি আমি!! সৃষ্টিকর্তা কি এখন তার প্রতিশোধ নিবে!!
হঠাৎ প্রচণ্ড ভয় অক্টোপাশের মতো চেপে ধরল। বুকের ধুকধুকানী বাড়ছে।
‘আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করো। লা ইলাহা ইল্লাললাহু মুহাম্মাদুর রাসুরুল্লাহ।’
মনে মনে লজ্জা লাগলো। এখন বিপদের সময় আল্লাহকে ডাকছি।
বাতাসের গর্জনের সাথে নিচতলা থেকে জিকিরের রোল ভেসে আসছেঃ
‘লা ইলাহা ইল্লাললাহ। লা ইলাহা ইল্লাললাহ।’
এই ধ্বনি বুকে বল সৃষ্টি করছে।
সোনিয়া আলতো হাতে আমার মুখ তার দিকে ফেরাল। আমি চমকে ওর দিকে তাকালাম। তারপর অপরাধীর মতো ফ্যাকাশে হাসি হাসলাম। সান্ত্বনা টাইপ কিছু কথাবার্তা ওকে বলা দরকার। ভাবছি কি বলবো। ও গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। শান্ত স্বরে বলল, তুমি ভয় পাচ্ছো?
মনে মনে হোঁচট খেলাম। চোখ দেখে কি ও কিছু বুঝে ফেলেছে? স্ত্রীরা নাকি স্বামীদের চোখের ভাষা দ্রুত বুঝে ফেলে!
তাড়াহুড়ো করে বললাম, ভয় পাওয়ার কি আছে! মরতে হয় দু’জনে একসাথে মরবো।
নিজের কাছেই কথাগুলো সিনেমার ডায়লগ ডায়লগ মনে হল। ও রহস্যময় ভঙ্গিতে একটু হাসলো। হঠাৎ ওকে প্রচণ্ড ম্যাচিউর মনে হচ্ছে। নিজেকে মনে হচ্ছে- ছেলে মানুষ!
ডুবে গেলে কি করবো আমি? আমি তো নিজেই সাঁতার জানি না। ভেসে থাকবো কিভাবে? সোনিয়াকে ভাসিয়ে রাখবো কিভাবে?
হঠাৎ টাইটানিকের দৃশ্য মনে পড়ল। নিজের জীবন দিয়ে প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আমিও কি পারবো?
নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় মনে হচ্ছে! হাত-পা ছোড়াছুড়ি করলেই কি আর ভেসে থাকা যায়? তখন সোনিয়া যদি আমাকে ধরে ভেসে থাকতে চায়, কি করবো আমি!?
ছিঃ কি সব অলুক্ষণে কথাবার্তা ভাবছি! হয়তো এ সবের কিছুই ঘটবে না। একটু পরে ঝড় থেমে যাবে। ঢেউ শান্ত হয়ে আসবে। লঞ্চখানা ঘাটে যেয়ে নোঙ্গর করবে। সোনিয়া ডাঙ্গায় নেমে- সবুজ ঘাসে পা ফেলে উচ্ছ্বল হয়ে উঠবে।
দেখ, দেখ, সাদা বক বসে আছে। তোমাদের ঢাকায় আছে- এসব?
ও যখন উচ্ছ্বল হয়, ওকে বাচ্চা মেয়ের মতো লাগে। কোলে বসিয়ে আদর করতে ইচ্ছা করে। আর এখন কি গম্ভীর শক্ত হয়ে আছে!
নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরতেই ও বলল, তোমাকে নিয়েই আমার ভয়! তুমি সাঁতার জানো না। আমাকে নিয়ে চিন্তা করি না। আমি ভেসে থাকতে পারবো। ছোটকালে খুব ভাল সাঁতার শিখেছি।
ম্লান হেসে বললাম, এই স্রোতে সাঁতার জানা, নাজানা সমান।
ও চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। অন্যান্য মহিলা যাত্রীদের মত চিৎকার-চেঁচামেচি কিছুই করছে না। আমার অসহায় অবস্থা দেখে কি ও এত ধীর-স্থির-আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠেছে? এই পরিস্থিতিতে ওর তো দিশেহারা হয়ে যাবার কথা! অনেক সামান্য ব্যাপারে ওকে দিশেহারা হয়ে যেতে দেখেছি। এই মুহূর্তে ওকে প্রচণ্ড শক্তিশালী এক মানবী বলে মনে হচ্ছে। এ যেন আমার চেনা-জানা সেই মিষ্টি বউটি নয়।
ওর ধীর-স্থির রূপ দেখে আমার মধ্যেও কোথা থেকে যেন এক শক্তি এসে ভর করলো।
মরলে মরবো! মরতে তো একদিন হবেই!
শান্তভাবে বললাম, লঞ্চটা যদি ডুবে যায়, আমরা কেউ কারো হাত ছাড়বো না।
ও গভীরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল।
হঠাৎ প্রচণ্ড এক ঝড়ের ঝাপটা আমাদের পা ভিজিয়ে দিল। লঞ্চটা প্রবল বেগে দুলে উঠলো। মনে হল- এই বুঝি তলিয়ে গেল! আর উঠবে না।
আমরা কিছুক্ষণ ঢেউয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো। এক সময় আমাদের লাশ ফুলে ফেঁপে ভেসে উঠবে। ভাসতে ভাসতে কোন তীরে যেয়ে আটকাবে। স্থানীয় লোকজন দেখতে ছুটে আসবে। আসবে- ডিসি, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ। মর্গে নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে কাটা ছেড়া করবে। দুর্ঘটনা স্থানের আশেপাশে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী হেলিকপ্টার নিয়ে ছুটে আসবেন। মুখ করুণ করে সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দিবেন। টিভি চ্যানেলের লোকজন এবং সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে থাকবে। এত লাশ দেখলে জনতার মাথা ঠিক থাকবে না! কিছু লাশ চিরতরে গায়েব হয়ে যাবে। বিবৃতি দেয়া হবে- ‘প্রবল স্রোতে লাশ ভেসে গেছে।’
প্রিয়জনেরা তাদের ‘প্রিয় মুখগুলো’ জীবনে আর দেখতে পাবে না!
ছিঃ আমি আবার অলুক্ষণে চিন্তা করছি! মন দুর্বল হয়ে পড়েছে বলেই কি এসব চিন্তা আসছে?
একটি বাচ্চা মেয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। আম্মা--------আম্মা----------।
বারান্দায় আমরা ঠাসাঠাসি করে করে দাঁড়িয়ে আছি।
কে যেন চিৎকার করে বলল, কেহ আযান দেন ভাই, আযান দিলে ঝড় কমে।
কেবিন থেকে জিকিরের শব্দ আসছে। ঝড়ের গর্জন, ঢেউয়ের তাণ্ডব, বাচ্চাদের চিৎকার, নারীদের বিলাপ, বজ্রপাতের গরগর শব্দ- সব মিলিয়ে এক রক্ত হীম করা পরিবেশ!!
‘আল্লাহ হু আকবর, আল্লাহ হু আকবর’- জোরে জোরে কে যেন আযান দিচ্ছে।
সোনিয়া নিচু স্বরে ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করছে। আমি চুপ করে আছি দেখে ভর্ৎসনার সুরে বলল, একটু আল্লাহকে ডাকো না!
আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহ, তুমি আমাদের রক্ষা করো! তুমি ছাড়া এই বিপদ থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।’

দুই

পড়ন্ত বিকাল। মিষ্টি রোদ উঠেছে। পদ্মার শান্ত বুক চিরে আমাদের লঞ্চখানা রাজহংসীর মতো এগিয়ে চলছে। ছোকরা টাইপের এক ছেলে পানি দিয়ে ঘষে ঘষে বমি পরিষ্কার করছে। বারান্দায় প্রচুর বাদাম ছড়িয়ে আছে। বাদামওয়ালার বাদামের ঝুলি হয়তো উল্টিয়ে গেছে। তাকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না।
কেবিনের যাত্রীরা সীটে যেয়ে বসেছে। তারা স্তব্ধ হয়ে আছে। জিকির থেমে গেছে। বারান্দায় দাঁড়ানো একজন ভদ্রলোক ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলছেন,
বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম। আল্লাহর অশেষ রহমত।
সোনিয়া আমার পাশে শান্তভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে মুখে ক্লান্তি। কোমল স্বরে বললাম, কেবিনে যেয়ে বসো, ভাল লাগবে।
ও ক্লান্ত স্বরে বলল, যাচ্ছি। ঐ দেখ তীর দেখা যাচ্ছে!
দূরে অস্পষ্ট গাছের সারি। মনটা খুশীতে নেচে উঠল। মনে হচ্ছে- যুগযুগ ধরে মাটির সংস্পর্শে নেই। এখন মাটির কাছে ফিরে যাচ্ছি। কেবিন থেকে আরও যাত্রীরা ছুটে আসছে তীর দেখতে। সবার মাঝে চঞ্চলতা!
সোনিয়া শাড়ি ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ও মহিলা কেবিনে ছুটে গেল।
ক্লান্তিতে পা ভেঙ্গে আসছে। ধীর পায়ে কেবিনে এসে বসলাম।
এক লোক রসিয়ে রসিয়ে এক গ্রাম্য মাতব্বরের কাহিনী বলা শুরু করেছে। বোকা কিসিমের মাতব্বর। শুনে সবাই হা হা হেসে উঠছে। এরি মধ্যে এক ছোকড়া চা নিয়ে এসেছে- বিক্রি করতে। এতো ঝড় ঝাপটার মধ্যে সে কিভাবে চা’র ফ্লাক্স বাঁচিয়ে রেখেছে তা এক রহস্য। সবাই চা দিতে বলছে। ছোকরা কাপের পর কাপ চা দিয়ে যাচ্ছে।
সোনিয়া আবার বারান্দায় এসে দ্রুত হাত নেড়ে ডাকছে। উঠে এলাম।
‘দেখ দেখ ঘাট। আমরা এখানে নামবো না?’
একটু হেসে বললাম, হ্যাঁ এখানেই নামবো। বাপের বাড়ির ঘাটের কথা ঠিকই মনে আছে।
ও ফিক করে হেসে দিল। চাপা খুশীতে ওর চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করছে। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে আসলে বোধ হয় সবার এ রকম হয়।
আশেপাশে কোলাহল বাড়ছে। যাত্রীরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এক লোক চাপা উত্তেজিত গলায় বলল, এই ব্যাগ আমার। আপনার ওখানে চলে গেছে।
যে যার মালামাল সামলাচ্ছে। চারদিকে ব্যস্ততা। কে বলবে একটু আগে আমরা সবাই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছিলাম!
সামনে ঘাট। আর দু’তিন মাইল গেলেই আমরা ঘাটে পৌঁছে যাব। ঘাটের দোকানপাট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
সোনিয়া আলতো করে আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিক তাকাতেই ও মিষ্টি হেসে চোখ সরিয়ে নিল।
পিছনের দিকে তাকালাম। বিশাল পদ্মা। বিকালের নরম রোদে ঝলমল করছে! তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হল সে ব্যঙ্গ সুরে হাসছেÑ
‘তোমরা মানুষেরা যতই শক্তিশালী হও, তোমাদের সভ্যতা যতই ঝলমল করুক, তোমরা এখনো প্রকৃতির সন্তান। আমাকে অবহেলা করা মানে একদিন কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে ফিরে আসা!!’

এই চা গরম...................চা গরম।
চমকে পিছনে ফিরে তাকালাম। দশ-বার বছরের এক ছেলে বিশাল ফ্লাক্সে করে ‘চা’ বিক্রি করছে। ফ্লাক্সের সাথে অনেকগুলো প্লাস্টিকের চা’র কাপ বাধা।
চা খাবেন স্যার।
না।
ছেলেটি অন্য যাত্রীদের দিকে এগিয়ে গেল। আমি রেলিঙের দিকে ঝুঁকে আবার পানির দিকে তাকালাম। বুড়িগঙ্গার কালচে পড়া পানি কেটে কেটে লঞ্চটা ছুটে চলছে। কচুরীপানাগুলো দ্রুত পিছনে সরে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও পানিতে ছড়িয়ে পড়া ‘তেলের বৃত্ত’ দুলতে দুলতে যাচ্ছে। সূর্যের আলো পড়ে জায়গাটা ঝিকমিক করছে। নদীর তীর ঘেঁষে পীচঢালা পথ। পথের পাশে বিল্ডিং এর সারি। একতলা, দো-তলা, কোনটা আকাশ ছোঁয়া। মাঝে মাঝে বড় বড় পাইপ দিয়ে কালো ‘থিকথিকে’ পানি বুড়িগঙ্গায় এসে পড়ছে। সর্বংসহা মা’র মতো বুড়িগঙ্গা সমস্ত ক্লেদ নিজের বুকে শুষে নিচ্ছে।
দেখতে দেখতে লঞ্চটা ঢাকা শহরকে পিছনে ফেলে বড় নদীতে এসে পড়লো। পানির বুক থেকে এখন ভেসে আসছে তাজা বাতাস। এই বাতাসে এক ধরনের দামাল ভাব আছে। মন ফুরফুরে করে দেয়।
আমার মনটা চনমনিয়ে উঠলো। অন্যান্য যাত্রীদের চোখে-মুখেও চঞ্চলতার ছাপ! দোতলার কেবিনে বসা যাত্রীরা ফিটফাট ভদ্রগোছের। কেহ গম্ভীর মুখে চোখের সামনে ধরে আছে- দৈনিক পত্রিকা। কেহ পাশের জনের সাথে জুড়ে দিয়েছে- রাজনৈতিক আলাপ। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা আমার মতো ডেকে দাঁড়িয়ে নদীর দৃশ্য দেখছে।
পাশে মহিলা কেবিন। তরুণী, মাঝ বয়েসী, বৃদ্ধা, সদ্য বিবাহিত, বোরখাওয়ালী সবাই পাশাপাশি বসে আছে। মাঝ বয়েসী দু’ একজন মহিলা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছেন। মাঝে মাঝে ছোট ছোট বাচ্চারা কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছে। রেলিং ধরে পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া লঞ্চ দেখছে। পিছনে পিছনে মা’রা ছুটে আসছেন। ওদের হাত ধরে কেবিনে ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
দরজার সামনে চানাচুর-বাদাম ওয়ালাদের জটলা। ঘুরে-ফিরে ওরা মহিলা কেবিনের সামনে এসে হাঁক দিচ্ছে,
চানাচুর! ঝাল চানাচুর!
বিক্রিও করছে দেদারছে। চানাচুরওয়ালা মহাব্যস্ত! সে দ্রুত হাতে চানাচুর বানাচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের সামনের ডেকে চলে এলাম। হু-হু করে বাতাস বইছে। মন মাতানো মিষ্টি বাতাস। বাতাসের তোড়ে রোদের তেজ গায়ে লাগছে না। নদীর উপর দিয়ে গাংচিল রাজকীয় ভঙ্গিতে উড়ছে। চোখ ভরে ওদের দেখছি।
দেখ, দেখ, পাখিগুলো কি সুন্দরভাবে উড়ছে!
নারীকণ্ঠের শব্দে পিছনে ফিরে তাকালাম।
কটকটে হলুদ শাড়িপরা একজন সুন্দরী মহিলা পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোককে পাখিগুলো দেখাচ্ছেন। ভদ্রলোক হয়তো তার হাজব্যান্ড। পাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছেন। মহিলার হাতে ক্যামেরা। তিনি মনোযোগ দিয়ে উড়ন্ত পাখিগুলোর স্ন্যাপ নেয়ার চেষ্টা করছেন। মাতাল হাওয়া তার শাড়ি এলোমেলো করে দিচ্ছে। ভদ্রলোক বেশ লম্বা-চওড়া। তিনি ভ্রু কুচকে উন্নাসিক ভঙ্গিকে আশেপাশের দৃশ্য দেখছেন।
মহিলার সাথে একবার চোখাচুখি হল। সাথে সাথে চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। আহল্লাদী ভঙ্গিতে স্বামীর গা ঘেষে দাঁড়ালেন।
সোনিয়ার কথা মনে হল। লঞ্চে উঠার পর সেই যে মহিলা কেবিনে যেয়ে বসেছে, একটি বারের জন্যও বাইরে আসেনি। বেচারী একা একা নিশ্চয়ই নিঃসঙ্গতায় ভুগছে। দ্রুত পা চালিয়ে মহিলা কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ভিতরে অনেক মহিলার মাঝে সে চুপ করে বসে আছে। বাইরে বের হলে সে চুপচাপ থাকে। আগ বাড়িয়ে কারও সাথে কথা বলতে পারে না। জানালার ফাঁক দিয়ে চোখের ইশারায় ওকে ডাকলাম। ও বেরিয়ে এল।
বললাম, একা একা বসে আছো। ভাল লাগছে?
কি করবো?
নদীর দৃশ্য দেখো।
বলে দূর আকাশে তাকালাম। এক ঝাঁক ধবধবে সাদা বক নীল আকাশে উড়ে যাচ্ছে।
দেখ দেখ কি চমৎকার না!
ও উজ্জ্বল-নিষ্পাপ চোখ তুলে তাকাল। কিছু বললো না।
দূরে ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে শান্ত একটি গ্রাম! পানির দিকে তাকালে মনে হচ্ছে- কি দ্রুত লঞ্চটা ছুটছে। আর দূরে গাছপালার দিকে তাকালে মনে হচ্ছে- লঞ্চটা থেমে আছে।
ধীর গতির জন্য লঞ্চে আমি সাধারণত উঠি না। মনে হয়- সময় থমকে আছে। মনে গাছাড়া ভাব চলে আসে। গতির যুগে এই গতিহীনতা ভাল লাগে না। সোনিয়ার পীড়াপীড়িতে আজ লঞ্চে করে বিক্রমপুরে যাচ্ছি।
বিক্রমপুরের মুক্ত পরিবেশে ও বড় হয়েছে। বাসে উঠলে ওর মাথা ঘুরায়। বমি বমি আসে। লঞ্চে আরাম-বোধ করে। প্রফুল্ল থাকে। কিন্তু ও আজ এমন গম্ভীর হয়ে আছে কেন? কোমল স্বরে বললাম, সোনিয়া কিছু খাবে!
ও ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, নাহ।
কিছু খাও, ভাল লাগবে।
কমলা কিনে ওকে দিলাম। ও কমলা হাতে নিয়ে দূরে তাকিয়ে রইল। খেল না। মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠলো। চুপ করে ওর পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম!
সোনিয়া, তোমার মন খারাপ?
ও কোন উত্তর দিল না। দূরে পালতোলা একটা নৌকার দিকে তাকিয়ে রইল। একসময় শান্ত কণ্ঠে বলল, তুমি প্রকৃতি পছন্দ করো!
আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম, হ্যাঁ করি!
ও ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পরে বলল, আমরা যদি ঢাকায় আর না ফিরি!
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন?
ও ম্লান হেসে বলল, নাহ, এমনি বললাম!
মনে মনে তোলপাড় শুরু হল। আমাদের বিয়ে হয়েছে মাত্র এক বছর। এই এক বছরে ওকে নানাভাবে দেখেছি। ও যখন অনবরত কথা বলে, মনে হয় জনম জনম ধরে ওকে চিনি। কিন্তু যখন গম্ভীর হয়ে থাকে, এই বিশাল পানি রাশির মতোই ওকে দুর্ভেদ্য মনে হয়।
যেদিন প্রথম ও আমাদের ফ্যামিলিতে আসে, সেদিন থেকে ছোট বড় সবাইকে আপন করে নিয়েছে। আমিও ওকে কোন কিছু দিতে কৃপণতা করিনি। যখন যা কিছু চেয়েছে, তা-ই এনে দিয়েছে। আমাদের দাম্পত্য জীবনও মধুর। ওর সারা চোখে মুখে সুখী সুখী ছাপ! মানুষ দুঃখ কষ্টের ছাপ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে, সুখেরটা করে না। কিন্তু এই মুহূর্তে ওকে ভীষণ দুখী মনে হচ্ছে। কোমল গলায় বললাম, সোনিয়া, আমাদের ফ্যামিলিতে তোমার কোন সমস্যা হচ্ছে?
ও তাড়াহুড়ো করে বলল, না তো!
তাহলে এমন গম্ভীর হয়ে আছো কেন? মেয়েরা বাপের বাড়ী যাওয়ার সময় কত হাসিখুশী থাকে? আর তুমি?
ও ফিক করে হেসে ফেলল।
কি করবো! লোকজনের সামনে তোমার সাথে হেসে হেসে গল্প করবো?
করলে সমস্যা কি? আমি তো তোমার অপরিচিত কেউ না!
দেখ, বিবাহিত মেয়েরা স্বামীর সাথে বাইরে বের হলে- প্রেমিক-প্রেমিকার মত গুজুর গুজুর করে না।
কে বলছে করে না। একটু আগেও একজন মহিলাকে দেখলাম স্বামীর সাথে--------
চুপ করো তো! শুনতে ইচ্ছা করছে না!
পানির দিকে চোখ ফেরালাম। ঢেউ বাড়ছে। লঞ্চটা একটু একটু দুলছে। বাতাসের ঝাপটায় সোনিয়ার নতুন শাড়ির গন্ধ ভেসে আসছে। আকাশী রঙের শাড়িতে ওকে এক টুকরো নীল আকাশ মনে হচ্ছে।
ও আমার দিকে ফিরে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল, জানো, ঢাকায় থাকতে থাকতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। চলো আমরা বিক্রমপুরে থেকে যাই!!
তা হয়, কিভাবে? আমার চাকরি ঢাকায়।
বিক্রমপুরে ট্রান্সফার হও।
তাতে লাভ!
ও প্রায় ঝংকারের সুরে বলল, লাভ-লোকসান বুঝি না! ঢাকায় কি আছে? ধুলো-বাড়ি, খুপড়ির মতো রুম! এখানে মানুষ থাকে?
আর মানুষ থাকছে না?
থাকুক, আমি আর সবার মতো না।
একটু হেসে বললাম, তুমি কি রকম?
‘আমি আমার মতো!’ বলে ও রাগী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল।
ওকে চটাতে ইচ্ছা করছে না। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। আকাশের দিকে তাকালাম। খণ্ড খণ্ড মেঘ ভেসে যাচ্ছে। ঝড় আসতে পারে। নদীতেও ঢেউ বাড়ছে।
ডেকের লোকজন রেলিং ধরে বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। উস্ক-খুস্ক এক যুবক আড়চোখে সোনিয়ার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। আমার চোখে চোখ পড়তে সে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। পাশে তিন চারজন ছেলে কি নিয়ে যেন গল্প করছে। একজন উচ্চস্বরে হা-হা করে হেসে উঠলো।
সোনিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে ওদেরকে এক পলক দেখল। তারপর নির্লিপ্তভাবে চোখ সরিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল।
শাড়ি পরাতে ওকে আজ পরিপূর্ণ একজন নারীর মতো লাগছে। সেলোয়ার কামিজে ওকে নাইন-টেন পড়–য়া একটি মেয়ের মতো লাগে। তখন আচরণও করে বাচ্চা মেয়ের মতো!
আমার বিশ্বাস সদ্য বিবাহিত মেয়েরা সুখে থাকলে শাড়ি পরে বাপের বাড়ি যায়। আর অশান্তিতে থাকলে যায় সেলোয়ার কামিজ পরে। বাবা-মাকে মনে করিয়ে দেওয়া- তাদের চিরচঞ্চল আদুরে মেয়েটি আবার ফিরে এসেছে। অবশ্য এখন সোনিয়ার কথা-বার্তা শুনে বোঝা যাচ্ছে না সে সুখে আছে, না দুঃখে আছে। তবে ঢাকার পরিবেশ যে তার সহ্য হচ্ছে না- তা স্পষ্ট।
পাশের ছেলেগুলো কি নিয়ে যেন উচু গলায় হাসছে। সোনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণের প্রাণান্তকর চেষ্টা! সোনিয়া ফিরেও তাকাচ্ছে না। একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি- সোনিয়া যখন পাশে থাকে, ওর দিকে কেউ ভদ্রভাবে তাকালে ভিতরে ভিতরে গর্ব অনুভব করি। কিন্তু কেউ দৃষ্টি কটুভাবে সোনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলে রাগে গা জ্বলতে থাকে।
সোনিয়া হঠাৎ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু হয়তো বুঝলো!
সে দ্রুত বলল, আমি কেবিনে যাচ্ছি। তুমি স্টাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? কেবিনে যাও!
বলেই সে হনহন করে কেবিনে ঢুকে গেল।
আমিও ধীর পায়ে কেবিনে এসে বসলাম। যাত্রীদের মাঝে রাজনৈতিক আলাপ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
একজন লোক দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলছেÑবি.এন.পি এসেই দেশটারে খাইল। জামাত-শিবিরের সাথে জোট গঠন করেছে। শালারা সব রাজাকার!
পত্রিকা হাতে আরেক ভদ্রলোক বললেন, আওয়ামী লীগই বা দেশটারে কি দিয়েছে? দেখেছি না তাদের আমলে!! বাপদাদার জমিদারী স্টাইলে দেশ শাসন করে গেছে!
পাশ থেকে আরেকজন লোক খনখনে গলায় বলে উঠলো,
“অ্যা! বিএনপি যে ধোয়া তুলসী পাতা। সব বেনিয়া জাত! টাকা ছাড়া তারা কিছু বুঝে? ভাঙ্গা সুটকেস নিয়ে জিয়া মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে। তার ছেলে এখন কোটি কোটি টাকার মালিক!
তার সাথে সুর মিলিয়ে আরেকজন বলল,
হের কথা আর কি কমু ভাই এই যে গাবতলীর বাস-ট্রাক থেকে ট্রাফিকপুলিশ যে পরিমাণ চাঁদা তুলে, তার একটা অংশও তার হাতে চলে যায়। দেশটারে লুইট্যা পুইট্যা খাইতাছে!
আরে আপনি চুপ করেন মিয়া, আপনি কি জানেন? কোটি টাকা খরচ কইরা শেখ হাসিনা যে টুঙ্গিপাড়ায় মাজার দিল, হেইডা কার টাকায় দিল?
একজন টুপি পরা কালো দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, যে যাই বলেন, বিএনপি বলেন, আর আওয়ামী লীগই বলেন, সবাই এক! যতদিন দেশে ইসলামী বিপ্লব না হবে, ততদিন দেশে শান্তি নাই।
আলোচনা চলতেই লাগল! সবাই নিজের নিজের মতামত দিয়ে যাচ্ছে। শুনতে ভাল লাগছে না। মাথা টিপ টিপ করছে। নিঃশব্দে সীট ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
হু হু বাতাস! ঝলমলে সূর্য উদাও হয়ে মেঘ ভর করেছে। মেঘের ছায়া পদ্মার উত্তাল পানিতে এসে পড়েছে। পানির রঙও যেন বদলে গেছে। ঘন কালো রহস্যময় মনে হচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে ডেকের পিছনের দিকে চলে এলাম! চোঙ্গা দিয়ে হু হু করে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। এখানে শব্দ বেশ তীক্ষè! কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। এরই পাশে কয়েকজন যাত্রী কার্ড খেলতে বসে গেছে। গামছা বিছিয়ে গোল হয়ে বসে তারা কার্ড খেলছে। পাশে এক মুচি ছোকরা দ্রুত হাতে জুতা পালিশ করছে। ডেকের একেবারে পিছনে এক লোক আয়েশ করে বসে করুণ সুরে বাঁশী বাজাচ্ছে। লঞ্চের একটানা ট্যা----- ট্যা----- শব্দ ছাপিয়ে সেই সুর ভেসে আসছে। তন্ময় হয়ে কিছুক্ষণ সেই সুর শুনলাম। এক ডিমওয়ালাকে ঘিরে ছোট খাটো জটলা। সবাই সিদ্ধ ডিম কিনছে। জার্নিতে বের হলে- অনেকের ডিম খাওয়া বেড়ে যায়। আমি খেতে পারি না। বমি বমি ভাব আসে।
ডিমওয়ালাকে পাশ কাটিয়ে ডেকের পিছন দিক দিয়ে নিচে নেমে এলাম। ইঞ্জিনের বিকট শব্দে পুরো নিচতলাটা গম গম করছে। ইঞ্জিনরুমে উঁকি দিলাম। টিম টিম করে একটি বাল্ব জ্বলছে। বিশাল বিশাল দুটো ইঞ্জিন। রুম থেকে গরম হাওয়া বের হচ্ছে। এক লোক টুল পেতে ইঞ্জিনের পাশে বসে আছে। তার সারা শরীর দরদর করে ঘামছে।
এখানে যাত্রীদের আনাগোনা কম। দু’একজন টয়লেটে যাওয়া আসা করছে। পাশে একটি মহিলা কেবিন। দরিদ্র শ্রেণীর মহিলারা এখানকার যাত্রী। তারা একজন আরেকজনের সাথে চিৎকার করে কথা বলছে। নইলে শুনতে পাচ্ছে না।
হঠাৎ লঞ্চটা প্রবলবেগে দুলতে শুরু করল।
নিচতলার জানালা দিয়ে নদীর দিকে তাকালাম! বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। বিশাল বিশাল ঢেউ লঞ্চের গায়ে আছড়ে পড়ছে। একটু আগেও পদ্মায় এত ঢেউ ছিল না। জানালার কাছে পানি ছুঁই ছুঁই করছে। আমরা যেন পানির মধ্যে ডুবে ডুবে এগুচ্ছি। সাবমেরিনের মতো। যতদূর চোখ যায়, ঘন কালো পানি আর পানি। হঠাৎ বিশাল এক ঢেউ এসে বসার বেঞ্চগুলো ভিজিয়ে দিল। যাত্রীরা পটাপট জানালাগুলো বন্ধ করে দিল।
মনটা খঁচ খঁচ করছে। হঠাৎ আবহাওয়া এত খারাপ হয়ে উঠল! সাথে সাথে পদ্মাও অশান্ত হয়ে উঠছে।
দ্রুত উপরে উঠে এলাম। সোনিয়ার কাছে যাওয়া দরকার। বেচারী একা বসে আছে। অজানা আশঙ্কায় আমার বুকটা টিপ টিপ করছে।
মহিলা কেবিনের সামনে আসতেই সোনিয়া বেরিয়ে এল। ওর চোখে-মুখে আতঙ্ক।
দেখেছো, আকাশ কি অন্ধকার হয়ে এসেছে! প্রচণ্ড ঝড় আসবে!
আশ্বাসের সুরে বললাম, নাও আসতে পারে। বৃষ্টি হবে হয়তো। বৃষ্টি হলে আকাশ এমনি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আমার কথায় ভরসা পেল বলে মনে হল না। অন্যান্য যাত্রীরাও কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেছে। সবাই আকাশের অবস্থা দেখছে। হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাস শুরু হল। ডাঙ্গায় থাকলে এ সময় প্রচণ্ড ধুলা-বালি খেতে হতো। এখানে তার ঝামেলা নেই। যতদূর চোখ যায় চারদিকে কেবল পান আর পানি। কোন তীর দেখা যাচ্ছে না। নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় লাগছে! ডাঙ্গায় যত বড় ঝড়ই হোক, নিজেকে এত অসহায় লাগেনি। ডাঙ্গার প্রাণী বলে কি আমরা জলে অসহায়?
হাতঘড়ি দেখলাম। বেলা তিনটা। দেখতে দেখতে দিনে-দুপুরে পদ্মার বুকে নেমে এল রাতের অন্ধকার! সাথে সাথে বাতাসের একটানা শো-শো গর্জন। ঢেউয়ের আঘাতে লঞ্চখানা একখণ্ড সোলার মতো দুলছে। গতিও কমে গেছে। ঢিমে-তেতালাভাবে এগুচ্ছে।
নিচ তলার যাত্রীরা আতঙ্কে উপরে উঠে আসছে। সবাই এসে জড়ো হচ্ছে- সারেং এর রুমে।
সারেং এর রুম থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে বলল, আপনারা যার যার সীটে যান। ভয় পাবেন না! সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে লঞ্চ আরও বেশী করে দুলবে।
যাত্রীরা তবুও সরছে না। বাতাসের বেগ ক্রমশ বাড়ছে। ঘন কালো মেঘে পুরো আকাশটা ছেয়ে গেছে। একটু আগেও ছিল ফর্সা ফকফকে!
সোনিয়া পাশে দাঁড়িয়ে শক্ত করে আমাকে ধরে আছে। মহিলা কেবিনে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। পুরুষরা তাদের নিজ নিজ স্ত্রী লোকদের খোঁজখবর নিচ্ছে। লঞ্চের দুলুনীতে ঠিকমতো হাঁটা যাচ্ছে না। রেলিং ধরে ধরে হাঁটতে হচ্ছে। মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা ভয়ে বিলাপ করছে।
আমরা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কেবিনে ঢুকতে ভয় করছে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক মোবাইল করার চেষ্টা করছে। হয়তো নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না। তার মোবাইল করা দেখে আমারও মোবাইলের কথা মনে পড়লো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলাম, নেটওয়ার্ক শূন্য। তার মানে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন!
যাত্রীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। সারেং -এর রুমের কাছে ভীড় ক্রমশ বাড়ছে। হলুদ শাড়ি পরা সেই মহিলা স্বামীর হাত ধরে সারেং -এর রুমের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে এখন ক্যামেরা নেই। মুখ থেকে ঝলমলে হাসিও উদাও হয়ে গেছে। তিনি কাঁদো কাঁদো গলায় বলছেনÑ
লঞ্চটা তীরের দিকে নিয়ে গেলেই তো পারে।
স্বামী ভদ্রলোক তার কথার প্রতিধ্বনি করে সারেং এর রুমে উঁকি দিয়ে উঁচু গলায় বললেন, হ্যালো, সারেং সাহেব, আপনি লঞ্চটা তীরের দিকে নিয়ে যান! লঞ্চে মেয়ে-ছেলে আছে। ওরা ভয় পাচ্ছে!
জটলার মধ্যে গুঞ্জন উঠলো। অনেকে তার কথায় সায় দিল।
‘হ্যাঁ তীরের দিকে নিয়ে যান। তীরের দিকে।’
সারেং লোকটি হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
সরাসরি তীরের দিকে লঞ্চ ঘোরানো যাইবো না। ঢেউয়ের বাড়ি খাইয়া উল্টাইয়া যাইবো। আমি কোনাকুনি ভাবে যাচ্ছি।
সারেং এর কথায় কেহ ভরসা পেল না। আশেপাশে কোন তীরও দেখা যাচ্ছে না। একজন যাত্রী বিজ্ঞের মতো বলল, তীরের দিকে চালিয়ে কি হবে? তীরের দিকে ঢেউ বেশী।
মোটামতো একজন যাত্রী বলল, এতোবড় একটা লঞ্চ। সেই পরিমাণ বয়াও নেই।
সবাই তার কথায় সায় দিল।
আরে শালারা কি যাত্রীদের জীবন নিয়া ভাবে! শালারা এসেছে- ব্যবসা করতে!
দেখতে দেখতে কবরের মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এল পদ্মার বুকে। ভয়াল গর্জনে ঝড়ো হাওয়া বইছে। এখনও বৃষ্টি নামেনি। হঠাৎ আকাশটা এফোড়-ওফোড় করে দিয়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। উজ্জ্বল আলোর ঝলকানিতে মানুষের মুখগুলো কি অসহায় দেখাচ্ছে!
সোনিয়ার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। দমকা বাতাস ওর শাড়ি এলোমেলো করে দিচ্ছে। বারবার বুক থেকে শাড়ির আঁচল খসে পড়ছে। একহাতে শক্ত করে আমাকে ধরে, অন্য হাতে শাড়ি সামলাচ্ছে। বেচারী শখ করে আজ শাড়ি পরেছে। শাড়ি পরে ও স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারে না। তাই জার্নিতে বের হলে ও সাধারণত শাড়ি পরে না।
ডেকে দাড়ানো তরুণ ছেলেগুলোর গল্প-গুজব বন্ধ হয়ে গেছে। ওরাও বারান্দায় এসে এক একটা থাম ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মুখগুলো থমথম করছে। আমরা ওদের খুব কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছি। ওরা এখন সোনিয়ার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।
দেখতে দেখতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। ডেকে দাঁড়ানো যাত্রীরা বারান্দায় এসে জড়ো হচ্ছে। বারান্দাটা মানুষে গিজ গিজ করছে। নিচের যাত্রীরা উপরে আসায় ভীড় আরও বেড়ে গেছে। গায়ের সাথে গা লেগে যাচ্ছে। উৎকট ঘামের গন্ধ নাকে এসে লাগছে- সে দিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই।
একজন যাত্রী মিনমিনে গলায় বলল, যারা নিচ থেকে এসেছেন, তারা নিচে চলে যান।
আরেকজন মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, আপনি চলে যান! আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
পাশ থেকে একজন শান্ত সুরে বলল,
ভাই এখন ঝগড়া কইরেন না। আল্লাহ আল্লাহ করেন। বলেই সে শব্দ করে কাঁদো কাঁদো গলায় পড়া শুরু করলোÑ
‘লা ইলাহা ইল্লাললাহু মুহাম্মাদুর রাসুরুল্লাহ।’
‘লা ইলাহা ইল্লাললাহু মুহাম্মাদুর রাসুরুল্লাহ’।
কেবিনের যাত্রীরা শক্ত করে জানালা ধরে- ‘আল্লাহ-আল্লাহ’ করছে।
একজন সুদর্শন ভদ্রলোক কেবিনের ছাদে বাঁধা ‘বয়া’ খোলার চেষ্টা করছেন। এতে সবার মাঝে আতঙ্ক আরও ছড়িয়ে পড়ল। তাদের চোখেমুখে দিশেহারা ভাব। ভয়ার্ত চোখে তারা নদীর দিকে তাকাচ্ছে।
বিশাল পদ্মায় লঞ্চটা একটুকরা খড়কুটার মতো ভাসছে। মানুষের সমান উঁচু এক একটা ঢেউ ছুটে আসছে। লঞ্চটা যখন ঢেউয়ের উপরে উঠছে, আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে, পর মুহূর্তে এত নিচে নেমে যাচ্ছে- মনে হচ্ছে এই জন্মে লঞ্চটা আর উঠবে না। চারদিক দিয়ে ঘনকালো পানি ঘিরে ফেলেছে। নিচে নামার সময় বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ছোটকালে মেলাতে নাগর দোলায় চড়ার সময় এরকম অনুভূতি হয়েছিল।
সোনিয়ার পিঠে হাত দিয়ে ওকে জাপটে ধরে আছি। স্বাভাবিক অবস্থায় লোকজনের সামনে এভাবে জড়িয়ে ধরার কথা কল্পনাও করতে পারতাম না। কেউ আমাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। আমরাও কারও দিকে তাকাচ্ছি না। হয়তো ভুল বললাম। সবাই সবার দিকে তাকাচ্ছি। কিন্তু কেউ কাউকে দেখছি না। সবার চোখে শূন্য দৃষ্টি।
ঝড়ের গর্জন ছাপিয়ে একজন মহিলার তীক্ষè কণ্ঠ শোনা গেল,
বাবুকে ধর, বাবুকে ধরো।
মহিলা কেবিন থেকে ভীতিকর চিৎকার ভেসে আসছে। সবাই একসাথে চেঁচামেচি করছে। কারও কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। কাছে দাঁড়ানো একজন নারীর কণ্ঠ শোনা গেল- আল্লাহ, এখন কি হবে! আল্লাহ রহম করো।
বিশাল এক ঢেউ এগিয়ে আসছে! এই ধাক্কা সামলাতে পারবে তো? লঞ্চটা ঢেউয়ের চূড়ায় উঠল। পর মুহূর্তে পানির নিচে নেমে গেল। সাথে সাথে নারী-পুরুষের আর্ত-চিৎকার-
‘আল্লাহ বাঁচাও!! আল্লাহ বাঁচাও!!’
এক মহিলা গ্রাম্যসুরে জোর গলায় বিলাপ করছে-
হায় আল্লাহ! অহন কি হইবো! কপালে এমুন ভাবে মউত লেহা ছিল!
কে যেন চাপা উত্তেজিত গলায় ধমক দিল, চুপ করেন। আল্লাহ আল্লাহ করেন।
মহিলার চিৎকার আরও বেড়ে গেল।
অন্ধকার এতো ঘন হয়ে এসেছে- একজন আরেকজনের মুখ ভাল করে দেখতে পাচ্ছি না।
কে যেন কান্নার সুরে বলল, সারেং কি করে। সে কোথাও সিগনাল পাঠাতে পারে না।
কেবিনের ভেতর টিম টিম করে আলো জ্বলছে। জানালা দিয়ে দেখলাম, সেই সুদর্শন ভদ্রলোক ‘বয়া’ নামিয়ে ফেলছে। তার মুখে কিছুটা নির্লিপ্ত ভাব। যেন লঞ্চ ডুবলে এক্ষুণি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তার ‘বয়ার’ আশেপাশে আরও তিন-চারজন যাত্রী এসে দাঁড়িয়েছে। দুলুনীতে তারা কেবিনের মাঝখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। একজন আরেকজনের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
বয়া দেখে বুকটা ধুক ধুক করছে। লঞ্চটা দি ডুবে যায় কি করবো আমি? সোনিয়াকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম। ওর ধ্বধবে সাদা চোখে তাকিয়ে বললাম, ভয় পেও না।
নিজের কাছে নিজের কণ্ঠস্বর কেমন কাঁপা কাঁপা শোনাল।
পানির মৃত্যুকে কঠিন মৃত্যু মনে হয়।
ভেসে থাকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা! কিন্তু ক্রমেই নিচে তলিয়ে যাওয়া!!
হুট করে ছোট কালের একটা ঘটনা মনে পড়ল।
একবার রুমে ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে যায়। ইঁদুর ধরার কল দিয়ে একটা জ্যান্ত ইঁদুর ধরে বালতির পানিতে ছেড়ে দেই। ইঁদুরটা বার বার উঠে আসার জন্য ছটফট করছিল। একটা কাঠি দিয়ে সেটাকে বালতির তলায় চেপে ধরি। ইঁদুরটা মুখ হা করতে করতে নিস্তেজ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর ভেসে উঠে!
হায় আল্লাহ কি করেছি আমি!! সৃষ্টিকর্তা কি এখন তার প্রতিশোধ নিবে!!
হঠাৎ প্রচণ্ড ভয় অক্টোপাশের মতো চেপে ধরল। বুকের ধুকধুকানী বাড়ছে।
‘আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করো। লা ইলাহা ইল্লাললাহু মুহাম্মাদুর রাসুরুল্লাহ।’
মনে মনে লজ্জা লাগলো। এখন বিপদের সময় আল্লাহকে ডাকছি।
বাতাসের গর্জনের সাথে নিচতলা থেকে জিকিরের রোল ভেসে আসছেঃ
‘লা ইলাহা ইল্লাললাহ। লা ইলাহা ইল্লাললাহ।’
এই ধ্বনি বুকে বল সৃষ্টি করছে।
সোনিয়া আলতো হাতে আমার মুখ তার দিকে ফেরাল। আমি চমকে ওর দিকে তাকালাম। তারপর অপরাধীর মতো ফ্যাকাশে হাসি হাসলাম। সান্ত্বনা টাইপ কিছু কথাবার্তা ওকে বলা দরকার। ভাবছি কি বলবো। ও গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। শান্ত স্বরে বলল, তুমি ভয় পাচ্ছো?
মনে মনে হোঁচট খেলাম। চোখ দেখে কি ও কিছু বুঝে ফেলেছে? স্ত্রীরা নাকি স্বামীদের চোখের ভাষা দ্রুত বুঝে ফেলে!
তাড়াহুড়ো করে বললাম, ভয় পাওয়ার কি আছে! মরতে হয় দু’জনে একসাথে মরবো।
নিজের কাছেই কথাগুলো সিনেমার ডায়লগ ডায়লগ মনে হল। ও রহস্যময় ভঙ্গিতে একটু হাসলো। হঠাৎ ওকে প্রচণ্ড ম্যাচিউর মনে হচ্ছে। নিজেকে মনে হচ্ছে- ছেলে মানুষ!
ডুবে গেলে কি করবো আমি? আমি তো নিজেই সাঁতার জানি না। ভেসে থাকবো কিভাবে? সোনিয়াকে ভাসিয়ে রাখবো কিভাবে?
হঠাৎ টাইটানিকের দৃশ্য মনে পড়ল। নিজের জীবন দিয়ে প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আমিও কি পারবো?
নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় মনে হচ্ছে! হাত-পা ছোড়াছুড়ি করলেই কি আর ভেসে থাকা যায়? তখন সোনিয়া যদি আমাকে ধরে ভেসে থাকতে চায়, কি করবো আমি!?
ছিঃ কি সব অলুক্ষণে কথাবার্তা ভাবছি! হয়তো এ সবের কিছুই ঘটবে না। একটু পরে ঝড় থেমে যাবে। ঢেউ শান্ত হয়ে আসবে। লঞ্চখানা ঘাটে যেয়ে নোঙ্গর করবে। সোনিয়া ডাঙ্গায় নেমে- সবুজ ঘাসে পা ফেলে উচ্ছ্বল হয়ে উঠবে।
দেখ, দেখ, সাদা বক বসে আছে। তোমাদের ঢাকায় আছে- এসব?
ও যখন উচ্ছ্বল হয়, ওকে বাচ্চা মেয়ের মতো লাগে। কোলে বসিয়ে আদর করতে ইচ্ছা করে। আর এখন কি গম্ভীর শক্ত হয়ে আছে!
নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরতেই ও বলল, তোমাকে নিয়েই আমার ভয়! তুমি সাঁতার জানো না। আমাকে নিয়ে চিন্তা করি না। আমি ভেসে থাকতে পারবো। ছোটকালে খুব ভাল সাঁতার শিখেছি।
ম্লান হেসে বললাম, এই স্রোতে সাঁতার জানা, নাজানা সমান।
ও চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। অন্যান্য মহিলা যাত্রীদের মত চিৎকার-চেঁচামেচি কিছুই করছে না। আমার অসহায় অবস্থা দেখে কি ও এত ধীর-স্থির-আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠেছে? এই পরিস্থিতিতে ওর তো দিশেহারা হয়ে যাবার কথা! অনেক সামান্য ব্যাপারে ওকে দিশেহারা হয়ে যেতে দেখেছি। এই মুহূর্তে ওকে প্রচণ্ড শক্তিশালী এক মানবী বলে মনে হচ্ছে। এ যেন আমার চেনা-জানা সেই মিষ্টি বউটি নয়।
ওর ধীর-স্থির রূপ দেখে আমার মধ্যেও কোথা থেকে যেন এক শক্তি এসে ভর করলো।
মরলে মরবো! মরতে তো একদিন হবেই!
শান্তভাবে বললাম, লঞ্চটা যদি ডুবে যায়, আমরা কেউ কারো হাত ছাড়বো না।
ও গভীরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল।
হঠাৎ প্রচণ্ড এক ঝড়ের ঝাপটা আমাদের পা ভিজিয়ে দিল। লঞ্চটা প্রবল বেগে দুলে উঠলো। মনে হল- এই বুঝি তলিয়ে গেল! আর উঠবে না।
আমরা কিছুক্ষণ ঢেউয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো। এক সময় আমাদের লাশ ফুলে ফেঁপে ভেসে উঠবে। ভাসতে ভাসতে কোন তীরে যেয়ে আটকাবে। স্থানীয় লোকজন দেখতে ছুটে আসবে। আসবে- ডিসি, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ। মর্গে নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে কাটা ছেড়া করবে। দুর্ঘটনা স্থানের আশেপাশে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী হেলিকপ্টার নিয়ে ছুটে আসবেন। মুখ করুণ করে সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দিবেন। টিভি চ্যানেলের লোকজন এবং সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে থাকবে। এত লাশ দেখলে জনতার মাথা ঠিক থাকবে না! কিছু লাশ চিরতরে গায়েব হয়ে যাবে। বিবৃতি দেয়া হবে- ‘প্রবল স্রোতে লাশ ভেসে গেছে।’
প্রিয়জনেরা তাদের ‘প্রিয় মুখগুলো’ জীবনে আর দেখতে পাবে না!
ছিঃ আমি আবার অলুক্ষণে চিন্তা করছি! মন দুর্বল হয়ে পড়েছে বলেই কি এসব চিন্তা আসছে?
একটি বাচ্চা মেয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। আম্মা--------আম্মা----------।
বারান্দায় আমরা ঠাসাঠাসি করে করে দাঁড়িয়ে আছি।
কে যেন চিৎকার করে বলল, কেহ আযান দেন ভাই, আযান দিলে ঝড় কমে।
কেবিন থেকে জিকিরের শব্দ আসছে। ঝড়ের গর্জন, ঢেউয়ের তাণ্ডব, বাচ্চাদের চিৎকার, নারীদের বিলাপ, বজ্রপাতের গরগর শব্দ- সব মিলিয়ে এক রক্ত হীম করা পরিবেশ!!
‘আল্লাহ হু আকবর, আল্লাহ হু আকবর’ জোরে জোরে কে যেন আযান দিচ্ছে।
সোনিয়া নিচু স্বরে ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করছে। আমি চুপ করে আছি দেখে ভর্ৎসনার সুরে বলল, একটু আল্লাহকে ডাকো না!
আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহ, তুমি আমাদের রক্ষা করো! তুমি ছাড়া এই বিপদ থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।’

দুই

পড়ন্ত বিকাল। মিষ্টি রোদ উঠেছে। পদ্মার শান্ত বুক চিরে আমাদের লঞ্চখানা রাজহংসীর মতো এগিয়ে চলছে। ছোকরা টাইপের এক ছেলে পানি দিয়ে ঘষে ঘষে বমি পরিষ্কার করছে। বারান্দায় প্রচুর বাদাম ছড়িয়ে আছে। বাদামওয়ালার বাদামের ঝুলি হয়তো উল্টিয়ে গেছে। তাকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না।
কেবিনের যাত্রীরা সীটে যেয়ে বসেছে। তারা স্তব্ধ হয়ে আছে। জিকির থেমে গেছে। বারান্দায় দাঁড়ানো একজন ভদ্রলোক ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলছেন,
বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম। আল্লাহর অশেষ রহমত।
সোনিয়া আমার পাশে শান্তভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে মুখে ক্লান্তি। কোমল স্বরে বললাম, কেবিনে যেয়ে বসো, ভাল লাগবে।
ও ক্লান্ত স্বরে বলল, যাচ্ছি। ঐ দেখ তীর দেখা যাচ্ছে!
দূরে অস্পষ্ট গাছের সারি। মনটা খুশীতে নেচে উঠল। মনে হচ্ছে- যুগযুগ ধরে মাটির সংস্পর্শে নেই। এখন মাটির কাছে ফিরে যাচ্ছি। কেবিন থেকে আরও যাত্রীরা ছুটে আসছে তীর দেখতে। সবার মাঝে চঞ্চলতা!
সোনিয়া শাড়ি ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ও মহিলা কেবিনে ছুটে গেল।
ক্লান্তিতে পা ভেঙ্গে আসছে। ধীর পায়ে কেবিনে এসে বসলাম।
এক লোক রসিয়ে রসিয়ে এক গ্রাম্য মাতব্বরের কাহিনী বলা শুরু করেছে। বোকা কিসিমের মাতব্বর। শুনে সবাই হা হা হেসে উঠছে। এরি মধ্যে এক ছোকড়া চা নিয়ে এসেছে- বিক্রি করতে। এতো ঝড় ঝাপটার মধ্যে সে কিভাবে চা’র ফ্লাক্স বাঁচিয়ে রেখেছে তা এক রহস্য। সবাই চা দিতে বলছে। ছোকরা কাপের পর কাপ চা দিয়ে যাচ্ছে।
সোনিয়া আবার বারান্দায় এসে দ্রুত হাত নেড়ে ডাকছে। উঠে এলাম।
‘দেখ দেখ ঘাট। আমরা এখানে নামবো না?’
একটু হেসে বললাম, হ্যাঁ এখানেই নামবো। বাপের বাড়ির ঘাটের কথা ঠিকই মনে আছে।
ও ফিক করে হেসে দিল। চাপা খুশীতে ওর চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করছে। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে আসলে বোধ হয় সবার এ রকম হয়।
আশেপাশে কোলাহল বাড়ছে। যাত্রীরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এক লোক চাপা উত্তেজিত গলায় বলল, এই ব্যাগ আমার। আপনার ওখানে চলে গেছে।
যে যার মালামাল সামলাচ্ছে। চারদিকে ব্যস্ততা। কে বলবে একটু আগে আমরা সবাই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছিলাম!
সামনে ঘাট। আর দু’তিন মাইল গেলেই আমরা ঘাটে পৌঁছে যাব। ঘাটের দোকানপাট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
সোনিয়া আলতো করে আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিক তাকাতেই ও মিষ্টি হেসে চোখ সরিয়ে নিল।
পিছনের দিকে তাকালাম। বিশাল পদ্মা। বিকালের নরম রোদে ঝলমল করছে! তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হল সে ব্যঙ্গ সুরে হাসছেÑ
‘তোমরা মানুষেরা যতই শক্তিশালী হও, তোমাদের সভ্যতা যতই ঝলমল করুক, তোমরা এখনো প্রকৃতির সন্তান। আমাকে অবহেলা করা মানে একদিন কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে ফিরে আসা!!’
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:১৬
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×