অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে নাবিলার রাত আটটা বেজে গেল। সে চাকরি করে বাংলালিংকের কাস্টমার সেন্টারে। তিন বছর আগে সে যখন বাংলালিংকের হেড অফিসে ভাইবা দিতে গেল, একজন অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি মনে কর এই কাজের জন্য তুমি উপযুক্ত?
নাবিলা স্মার্টলি বলল, ইয়েজ স্যার।
কেন মনে কর উপযুক্ত?
নাবিলা একটু হেসে বলল, স্যার আমি সহজে বোর হই না, গুছিয়ে কথা বলতে পারি এবং যেকোন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারি। আমার বিশ্বাস এ কাজের জন্য এই তিনটি জিনিস খুবই দরকার।
তুমি সিউর এই তিনটি জিনিস তোমার আছে?
জি স্যার।
ধর, হঠাৎ এক কাস্টমার তোমাকে প্রেম নিবেদন করল, তুমি কি করবে?
আমি খুব ভদ্রভাবে তাকে বলবো, ঠিক আছে-আমি তোমার সাথে প্রেম করব। তার আগে জানতে হবে- তোমার কি যোগ্যতা আছে? সে যদি বলে সে মাষ্টার্স পাশ, হ্যান্ডসাম বেতনে চাকরি করে, ভালো গান গাইতে পারে বা গিটার বাজাতে জানে। আমি তার স্টাটাস বুঝে তখন একেক শর্ত দেব। যেমন ছেলেটি যদি মিডল ক্লাশের হয়, আমি ভদ্রভাবে জানতে চাইব-তোমার নিজস্ব ফ্ল্যাট এবং প্রাইভেট কার আছে? এ দুটো জিনিস ছাড়া আমি কোন ছেলের সাথে অ্যাফেয়ার্সই করবো না।
অফিসার হাসিমুখে বললেন, ধর ঐ ছেলে এক বছরের মাথায় একটা প্রাইভেট কার নিয়ে তোমার সামনে হাজির হয় এবং বলে তার এখন নিজস্ব ফ্ল্যাট এবং প্রাইভেট কার আছে। তখন তুমি কি করবে?
নাবিলা মৃদু হেসে বলল, আমি তখন ছেলেটার আউটলুক, পার্সোনালিটি, গেট-আপ, মুখের ভাষা সবকিছু লক্ষ্য করব। যদি ডিসেন্ট হয়, সেক্ষেত্রে নমনীয় হবো। যদি রাফ এন্ড টাফ হয়, বিনীতভাবে জানতে চাইব-তোমার ফ্ল্যাট বাড়ি কোন এলাকায়? ধানম-ি এবং গুলশান ছাড়া কোথাও আমি থাকতেই পারি না।
তার চাকরি হয়ে গেল। তবে তাৎক্ষনিকভাবে গুছিয়ে উত্তর দিতে পারার কারনেই যে হয়েছে, তা না। তারা হয়তো অন্যকিছুও দেখেছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেয়ার সময় বসের কথায় তা বোঝা গেল।
তিনি হাসি হাসি মুখে বললেন, তুমি স¥ার্ট, সুন্দরী এবং বাঙ্গালী মেয়েদের তুলনায় বেশ লম্বা। তোমাকে রিক্রুট করার সময় এ বিষয়গুলোও বিবেচনা করা হয়েছে। কনগ্রাচুলেশন ফর এন্ট্রি আওয়ার বাংলালিংক ফ্যামিলি।
কলিংবেল টিপতেই মা দরজা খুলে দিলেন এবং নিরবে তাকিয়ে থাকলেন। মার এই নিরব চাহনীর অর্থ সে জানে।
মাকে পাশ কাটিয়ে সে দ্রুত নিজের রুমে ঢুকে গেল।
খাওয়া দাওয়া শেষে রাত দশটায় সে ল্যাপটপে ফেসবুক নিয়ে বসল। মা তার রুমে এলেন। তার হাতে কাগজের স্তুপ। নাবিলা না তাকিয়েই বুঝল- এগুলো কিসের কাগজ। তার ভ্রু-কুঁচকে গেল।
মা বায়োডাটা দেখিও না। এখন বায়োডাটা দেখব না।
কেন দেখবে না?
পছন্দ হবে না, তাই দেখব না।
মা বিরক্ত স্বরে বললেন, পছন্দ হবে না কেন? কত হ্যান্ডসাম ছেলের ছবি এখানে!
তোমাদের হ্যান্ডসাম এবং আমার হ্যান্ডসাম এক না। আর ছবিতেই হ্যান্ডসাম। বাস্তবে তো দেখি আলুমার্কা। যতসব আগের ছবি দিয়ে বিভ্রান্ত করে!
তুই নিজেই একবার মিডিয়ায় যা-না। যাচাই বাছাই করে দেখ। তাও তো যাস না।
যাব।
কবে যাবি? সময় তো বসে থাকছে না। সেই কবে থেকে চাকরি করছিস...
নাবিলা বলল, কয়েক দিনের মধ্যেই যাব। তবে আমার চয়েজে না মিললে আমি আজীবন সিঙ্গেল থাকব। তবুও কাউকে নেব না।
আচ্ছা সে দেখা যাবে। তোর মামা একটা ম্যারেজ মিডিয়ার ঠিকানা দিয়েছিল। গিয়ে দেখতে পারিস। তোর অফিসের কাছাকাছি।
আচ্ছা মা যাব। এখন ডিস্টার্ব করো না তো।
সে ফেসবুকে মনোযোগ দিল।
দুই
ম্যারেজ মিডিয়ার সাইনবোর্ডটার দিকে নাবিলা কিছুক্ষন ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে রইল। ‘ড্রীম মিডিয়া’। সাদা মাটা একটা সাইন বোর্ড। জায়গায় জায়গায় রং উঠে গেছে। গুলশানের মতো আভিজাত এলাকায় এমন একটা ম্যারেজ মিডিয়া এখানে ব্যবসা চালাচ্ছে? সে তার বান্ধবী তানিয়ার দিকে তাকাল।
তানিয়া বলল, চল, চলে যাই। মিডিয়া ফিডিয়া কি আর ভালো হয়। শুধু শুধু আমাকে এনেছিস।
নাবিলা বলল, এসেছি যখন দেখেই যাই।
তারা ভেতরে ঢুকল এবং চমকে উঠল। জাঁকজমকভাবে সাজানো বিশাল রুম। পুরো ফ্লোর কার্পেটে ঢাকা। ক্লায়েন্ট বসার জন্য সোফা সেট আছে। সামনে গোল গোল কাঁচের টেবিল। একজন অফিসার কোট-টাই পড়ে রিসিপসন কাউন্টারে বসে আছে। পাশে একজন কোট পড়া মহিলা অফিসার।
নাবিলা বলল, এক্সকুয়িজ মি, আপনাদের এখানে পাত্রপাত্রীদের ব্যাপারে একটু জানতে এসেছি।
অফিসার বললেন, পাত্রী আপনি?
নাবিলা সরাসরি প্রশ্নে বিরক্ত হল। তবে তার অনুমান শক্তি দেখে একটু অবাক হল। কারণ তানিয়া এবং সে দুজনেই একই বয়সী। দুজনেই সেলোয়ার কামিজ পড়েছে। তানিয়া বরং অনেক সাজগোছ করে এসেছে। যদিও কিছুদিন হল তার বিয়ে হয়েছে। ওকে পাত্রী না ভেবে তাকে কেন ভাবল?
নাবিলা বলল, জি।
ভদ্রলোক বলল, কোন ধরনের পাত্র আপনার পছন্দ?
নাবিলা বলল, আপনাদের কালেকশনে কোন ধরনের পাত্র আছে?
সব ধরনের কালেকশনই আছে। নিচতলায় পাত্রদের কালেকশন। দোতালায় পাত্রীদের। তবে আমাদের এখানে পাত্রপাত্রী নির্বাচনে দুটো নিয়ম আছে।
এক. পাত্র বা পাত্রীকে নিজে আসতে হবে। নিজে এসে তার পছন্দমতো কাউকে বছাই করতে হবে।
দুই. প্রত্যেক তলায় অনেকগুলো রুম আছে। প্রথম রুমের কালেকশন পছন্দ না হলে দ্বিতীয় রুম, দ্বিতীয় রুমের পছন্দ না হলে তৃতীয় রুম- এভাবে রুমগুলো ভিজিট করতে পারবে। তবে আগের রুমে কেউ ফিরে আসতে পারবে না।
নাবিলা বলল, বেশ অদ্ভুত নিয়ম তো!
অফিসার নির্লিপ্তকন্ঠে বললেন, জি।
তারা প্রথম রুমে প্রবেশ করল। রুমে আসবাবপত্র তেমন কিছু নেই। পুরো দেয়াল জুড়ে ফাইল কেবিনেট। কেবিনেটগুলোর গায়ে স্টীকার লাগানো। চাকরিজীবি-এক, চাকরিজীবি-দুই ..... এভাবে দশ পর্যন্ত। ডেস্কের ওপাশে বসা পুরুষ এবং মহিলা অফিসার দু’জনেই তীক্ষèদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
অফিসার বললেন, আমাদের রুমে চাকরিজীবি এবং ব্যবসায়ী পাত্র আছে। আপনার পছন্দ?
চাকরিজীবি।
ওকে।
অফিসার বেশ কিছু ছবি এবং বায়োডাটা দেখালেন। বললেন, এই রুমের চাকরিজীবিদের বেতন বিশ থেকে চল্লিশ হাজার।
নাবিলা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ছবিগুলো দেখল। বেশিরভাগ ছেলের চেহারা সাদামাঠা। যারা একটু আকর্ষনীয় তাদের বেতন পঁচিশ হাজারের মতো। এই বেতনে আজকাল কি হয়? ঢাকা শহরে চলা সম্ভব?
নাবিলা বলল, আরেকটু বেটার কালেকশন নেই?
আমাদের কাছে নেই। দি¦তীয় রুমে গিয়ে দেখতে পারেন।
তারা দ্বিতীয় রুমে ঢুকল। ঢোকার সাথে সাথে একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটল। লিফটের মতো দুটো ষ্টীলের কপাট এসে প্রথমরুমের দরজা বন্ধ করে দিল। যেন তারা আলাদিনের গুহায় প্রবেশ করেছে।
দ্বিতীয় রুমের অফিসার বললেন, আমাদের রুমে চাকরিজীবি কালেকশন আছে যাদের বেতন চল্লিশ থেকে ষাট। নাবিলা ছবি এবং বায়োডাটাগুলো দেখল। প্রথম রুমের তুলনায় এখানকার ছেলেদের চেহারা বেশ আকর্ষনীয় এবং হ্যান্ডসাম। বেতনও ভালো। কারো কারো বেতন ষাট।
তানিয়া বলল, এখান থেকেই কাউকে চয়েজ কর না? এই ছেলেটা দেখ। দেখতে সালমান খানের মতো। র্যাংকস এ চাকরি করে। বেতন পঞ্চাশ।
নাবিলা বেশ মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখল। তারপর নাক কুঁচকে বলল, ছেলেটার চোখে বোধহয় একটু সমস্যা আছে। ডান চোখ বড়, বাম চোখ ছোট। তানিয়া ভালো করে দেখে বলল, সামান্য। ধরা যায় না।
নাবিলা বলল, খুঁজবোই যখন আরেকটু ভালো খুঁজি।
তারা তৃতীয় রুমে ঢুকল। এবং দ্বিতীয় রুমের দরজা অটো বন্ধ হয়ে গেল।
তৃতীয় রুমের অফিসার জানালেন, তাদের কাছে ভালো চাকরিজীবি কালেকশন আছে। যাদের বেতন ষাট থেকে আশি। কারও কারও ঢাকায় বাড়ি আছে।
নাবিলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তৃতীয় রুমের পাত্রদের ছবি এবং বায়োডাটাগুলো দেখল। বেশিরভাগ পাত্রের বয়স বেশি। কারো কারো মাথায় চুল নেই। কারো কারো ভুড়ি বেশ মোটা। কেউ কেউ খুব হ্যান্ডসাম, ঢাকায় বাড়ি আছে। কিন্তু ডিভোর্সী।
নাবিলা বড় করে হাই তুলতে তুলতে বলল, চল চতুর্থ রুমে যাই।
তানিয়া অসহিঞ্চু গলায় বলল, তুই নিজে কি চাস, আগে সেটা ঠিক কর।
আমি যে কি চাই নিজেও জানি না। দেখতে থাকি। হয়তো কাউকে পছন্দ হয়ে যাবে।
তারা চতূর্থ রুমে ঢুকল। এই রুমের কেবিনেটগুলোর গায়ে লেখা- বিসিএস অফিসার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রবাসী। নাবিলা ভেতরে ভেতরে একটু উত্তেজনা বোধ করল।
রুমের অফিসার বললেন, এই রুমে পুলিশ অফিসার, কাষ্টমস, আমেরিকান সিটিজেন, পেশাজীবি পাত্র আছে। আপনার পছন্দ?
নাবিলা বলল, আগে ছবি এবং বায়োডাটাগুলো দেখি। তারপর জানাই।
তারা ছবি এবং বায়োডাটা নিয়ে সোফায় বসল।
তানিয়া বলল, দেখ কী সুন্দর সুন্দর পুলিশের ছবি!
যত সুন্দরই হোক পুলিশ বাদ।
খারাপ কি? ক্ষমতা আছে। রাঙামাটি বান্দরবান দূর্গম অঞ্চলে ভ্রমনে গেলি। থানার লোকজন জিপ নিয়ে হাজির। ফ্রীজে মাছ নাই, তোর সাহেবকে বাজারে পাঠালি। ব্যাগভর্তি করে মাছ নিয়ে ফিরে এলো। সে হয়তো ভুল করে মানিব্যাগও নিয়ে যায়নি।
নাবিলা তীক্ষèদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, রসিকতা করছিস? কর। বড়লোক ব্যবসায়ী বর পেয়েছিস তো! মজার মজার কথা আসছে।
তুই কর। তোরও তো সুযোগ আছে। এখানে অনেক কাস্টমস অফিসার আছে। একজনকে বেছে নে। সারাজীবন টাকার উপর থাকতে পারবি।
ঘুষের টাকার আমার দরকার নাই।
ক্ষমতা চাস না। টাকাও চাস না। তাহলে চাস কি?
নাবিলা জবাব দিল না। থমথমে মুখে বায়োডাটাগুলো দেখতে লাগল। বিসিএস অফিসারদের বেশিরভাগ ঢাকার বাইরে পোষ্টিং। ঢাকার বাইরে যাবার প্রশ্নই আসে না। প্রবাসী পাত্রও তার পছন্দ না। আমেরিকা, কানাডা, অস্টেলিয়ার সিটিজেন হলেই সোনার পাত্র না।
নাবিলা বলল, এই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের প্রসার কেমন? দেখতে তো ইয়াং মনে হচ্ছে।
অফিসার বললেন, সবাই সদ্য পাশ করা। তবে ভবিষ্যতে প্রসার হবে।
ভবিষ্যত হবে! তার দরকার বর্তমানে। সে বলল, বর্তমানে প্রসার আছে এমন কোন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার নাই?
আমাদের রুমে নাই। অন্যরুমে দেখতে পারেন।
তারা পঞ্চম রুমে ঢুকল। এই রুমে তারা জমজমাট প্রসারওয়ালা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পাত্র খুঁজে পেল । কিন্তু সবার বয়স চল্লিশের উপর। কারো কারো মাথায় চকচকে টাক।
তানিয়ার মুখে ভয়াবহ বিরক্তি। ওর বিরক্তিভাব লক্ষ্য করে নাবিলা বলল, নাহ এখানে আসাই ভূল হয়েছে। ওয়েল ব্যালেন্স কাউকে পেলাম না।
তারা ষষ্ঠ রুমে ঢুকল। এবং বিস্মিত হল। এই রুমে কোনো চেয়ার টেবিল নেই। আসবাবপত্র নেই। কোনো কেবিনেট নেই। কোনো অফিসারও নেই। ফাঁকা একটা রুম এবং বের হবার একটা দরজা। সিলিং এ ঝুলছে একটা স্লাাইড যেখানে লাল রঙের একটা লেখা ধীরে ধীরে যাচ্ছে- ‘দুঃখিত আপনাকে সন্তুষ্ট করার মতো কোন পাত্র আমাদের হাতে নেই। থ্যাংক ইউ ফর ভিজিটিং আওয়ার ড্রীম মিডিয়া।’