সোহেল বিনীতভাবে বলল, স্যার আজ আমাকে তিনটায় ছুটি দিতে হবে। ঢাকা যাব।
ম্যানেজার মাথা কাত করে সায় দিলেন এবং বললেন, হাতের কাজ শেষ করে যেয়েন।
সোহেল ম্যানেজার চেম্বার থেকে বের হয়ে এলো। তার মনটা আনন্দে ফুরফুর করছে। যাক অনুমতি মিলেছে। বৃহস্পতিবার একটু আগেভাগে না গেলে হয়? কোথায় ঢাকা, কোথায় বিয়ানীবাজার। ছ’মাস হলো তার বিয়ানীবাজার পোষ্টিং হয়েছে। সে চাকরি করে ন্যাশনাল ব্যাংকে।
সোহেল তার ডেস্কে এসে কাজে মনোযোগ দিল। কোনো কাজ ফেলে রেখে যাওয়া যাবে না। নানাজন নানা কথা বলবে। অবশ্য এইদিনটাতে কেমনে কেমনে সবকাজ আগেভাগে শেষ হয়ে যায়। হয়তো মনটা আনন্দে থাকে বলে। বাড়ি যাবার আনন্দ! সামনে দু’দিন বন্ধ। যতই যাবার সময় ঘনিয়ে আসে তার শরীর ঝিম ঝিম করতে থাকে। উত্তেজনায় সে ঠিকমতো চেয়ারে বসতে পারে না। তার এই হাবভাব হয়তো বাইরেও প্রকাশ পায়। তার কোন কোন কলিগ কমেন্ট করে বসেন।
কি সোহেল সাহেব আজ বাড়ি যাচ্ছেন?
জি।
বোঝা যাচ্ছে। যান তো তেজি বাঘ হয়ে। আসেন তো ভেড়া হয়ে।
কলিগরা মুচকি মুচকি হাসে। সোহেল কোন উত্তর দেয় না। উত্তর দিলে হয়তো আরও মুখরোচক কিছু বলবে। বেশিরভাগ স্থানীয় অফিসার। বাড়ি যাবার আনন্দ এবং উত্তেজনা -এরা কি বুঝবে!
সোহেল টানা তিন ঘন্টা কাজ করল। তারপর লাঞ্চে গেল। লাঞ্চ শেষে সে যাবার জন্য প্রস্তত হতে শুরু করল।
বেলা দু’টা বাজতেই সেকেন্ড অফিসার তাকে ডাকলেন।
সোহেল সাহেব কিছু ফরেন রেমিটেন্স এসেছে। পে-অর্ডার লিখতে হবে।
সোহেল আমতা আমতা করে বলল, স্যার এখন লিখব। তিনটায় গাড়ি।
বেশিক্ষন লাগবে না। দ্রুত লিখে ফেলুন। পে-অর্ডার তো আপনিই করেন।
সোহেল আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত কাজে নেমে পড়ল। আধা ঘন্টার মধ্যে প্রায় পঞ্চাশটার মতো পে-অর্ডার লিখে ফেলল। কাজগুলো সেকেন্ড অফিসারের কাছে জমা দিতেই ম্যানেজার চেম্বারে ডাক পড়ল। ম্যানেজারের সামনে একজন হোমরা চোমরা ভদ্রলোক বসে আছেন। সে ঢুকতেই ম্যানেজার সাহেব বললেন, ওনার একটা একাউন্ট খুলে দিন তো। আপনার গাড়ি ক’টায়?
স্যার তিনটায়।
বেশিক্ষন লাগবে না। একাউন্টটা খুলেই আপনি চলে যান।
ভদ্রলোকের একাউন্ট খুলতে খুলতেই আরেকজন ক্লায়েন্ট চলে এলো। সোহেল তার একাউন্টও খুলে দিল।
সবকাজ শেষ করে সে যখন ব্যাংক থেকে বের হলো-তখন ঘড়িতে প্রায় পৌঁনে তিনটা। তাড়াহুড়ো করে সে একটা সিএনজি নিল। নিরিবিলি রাস্তা। কিন্তু আজ কি কারণে যেন জ্যাম লেগে গেল।
সে যখন বাস কাউন্টারে পৌঁছল লোকজন জানাল, এইমাত্র ঢাকার বাসটা ছেড়ে গেল। আপনি সিএনজি নিয়ে যান। গেলেই ধরতে পারবেন।
সোহেল লাফ দিয়ে আবার সিএনজিতে উঠল।
ভাই ঢাকার রোডে যান। তাড়াতাড়ি!
সিএনজিওয়ালা দ্রুত সিএনজি ছুটাল। কিছুক্ষনের মধ্যে ঢাকাগামী বাসটা দেখা গেল। এসি বাস। রাজকীয় ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে যাচ্ছে। কিন্তু সিএনজিওয়ালা কিছুতেই ওটাকে ধরতে পারছে না।
সোহেল অস্থিরকন্ঠে বলল, ভাই আরেকটু দ্রুত চালান!
সিএনজিওয়ালা বলল, ভাই ফুল ইসপিরিড দিছি। এরচেয়ে বেশি ইসপিরিড তোলা সম্ভব না।
যতই সময় যাচ্ছে বাস এবং সিএনজির মধ্যকার দূরত্ব বাড়ছে। সোহেল সীটে বসে উসখুস করছে। ইস আরেকটু তাড়তাড়ি যদি যেতে পারত! সে একদৃষ্টিতে বাসের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন তার চোখের আড়াল হলে বাসটা হারিয়ে যাবে।
একসময় সিএনজিওয়ালা বলল, ভাই এইটা আর ধরা সম্ভব না। খালি রাস্তা পাইয়া বিমানের মতো ছুটাইছে।
সোহেল অসহায়ভাবে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। তারপর একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ফিরে চলেন।
সে আবার বাসকাউন্টারে এলো। কাউন্টার থেকে জানাল- পরের বাস রাত বারটায়। তবে নতুন করে টিকিট কাটতে হবে। টিকিটের দাম কম রাখার জন্য সে কিছুক্ষণ ঝুলাঝুলি করল। কোনো লাভ হলো না। কি আর করা! রাত বারটার টিকিট নিয়ে সে ধীর পায়ে বাসার দিকে চলল। ব্যাংকের সামনে দিয়ে যেতেই একবার ভাবল-আবার অফিসে যাবে! পরক্ষনেই মনে হলো কি দরকার। হাসাহাসি করবে।
সে সরাসরি বাসায় এলো। পুরো ঘর ফাঁকা। দূ’রুমে তারা চারজন থাকে। আজ কেউ ফিরবে না। সবাই বাড়ি যাবে। জামা-কাপড় না ছেড়েই সে সটান বিছানায় শুয়ে পড়ল। ফ্যানটা শো শো শব্দ করে ঘুরছে। ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। চারদিক অন্ধকার। মোবাইলটা বাজছে। হ্যালো বলতেই তানিয়ার উদ্বিগ্নস্বর শোনা গেল।
কি ব্যাপার, কতক্ষন ধরে কল করছি! কতদুর এসেছ?
আসি নাই। বাসায় বসে আছি।
বাসায় বসে আছ মানে?
গাড়ি মিস করেছি।
ইয়া আল্লাহ! এখন কি হবে!
তানিয়ার কন্ঠে প্রচন্ড হতাশা। সে প্রায় কাদো কাদো স্বরে বলল, বাসার সবাই আশা করে আছে তুমি আজ আসবে। একটু আগে বের হবে না!
সে চুপ করে রইল। সোহেল কিছুক্ষন ‘হ্যালো’ ‘হ্যালো’ করে বলল, তুমি ফোন রেখে দিয়েছ?
না, বলো।
মন খারাপ করছ কেন?
তানিয়া বিষন্ন কন্ঠে বলল, মন খারাপ করিনি। বলো
একটা সুখবর আছে। রাত বারটার গাড়িতে আসছি।
সে প্রায় চিৎকার করে বলল, সত্যি!
হ্যা। তুমি আশা করে আছ আসবো। আমি না এসে পারি?
সোহেল হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় আরাম করে বসল। ঘরে জমাট নিস্তব্ধতা। ব্যাগ গুছিয়ে ফিরে আসার মধ্যে কোথায় যেন বিষন্নতা লুকিয়ে আছে! নিজের ঘর নিজের কাছে কাছেই অপরিচিত লাগছে। মনে হচ্ছে-ঘরের দেয়াল, আসবাবপত্র তার ফিরে আসাকে স¦াভাবিকভাবে নিচ্ছে না। বারটা পর্যন্ত সে কিভাবে সময় কাটাবে?
পাশের রুমের রিয়াজ ভাই থাকলে এত একঘেয়ে লাগত না। তাকে নিয়ে সংগীতের আসরে যাওয়া যেত। বাজারের শেষ মাথায় সংগীতের আসর বসে। তার কন্ঠ অপূর্ব। অন্যান্য বাউলদের সাথে যখন গলা ছেড়ে গান ধরেন, মনে হয় তিনি ব্যাংকার না, জাত গায়ক।
সোহেল প্রায়ই বলে- রিয়াজ ভাই আপনি ভুল করে ব্যাংকে চলে এসেছেন। আপনার পথ ছিল বাউল সাধনা।
রিয়াজ ভাই রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসেন। কিছু বলেন না। তিনি সদ্য বাবা হয়েছেন। মাঝে মাঝে নিজে থেকেই বলেন- নাহ চাকরিবাকরি আর ভালো লাগছে না। বাবুটা একটু বড় হোক। দেখবে একদিন হুট করে চাকরি ছেড়ে পথে নেমে গেছি। সাথে বউ-ছেলে। সবার হাতে থাকবে একতারা। পড়নে গেরুয়া রঙের কাপড়। পারফেক্ট বাউল পরিবার! হা...হা...হা...
সোহেল ঘড়ি দেখল। মাত্র আটটা। নাহ সময় আর যাচ্ছে না! নিজের উপরই রাগ লাগছে। অফিস থেকে যদি আরেকটু আগে বের হতো! বৃহস্পতিবার এলে মনটা এমন তরল অবস্থায় থাকে, কোনো কাজ দিলে আর না করতে পারে না।
রাতে তানিয়া আরও কয়েকবার ফোন দিল।
‘এই শুনছ-সাড়ে এগারটার মধ্যে কাউন্টারে চলে আসবে। খেয়ে উঠবে কেমন! পথের হাবিজাবি জিনিস খাবে না’।
‘এই কতদূর এসেছ? বাস ছেড়েছে? ঘুমিয়ে পড়ো না। বাসে ঘুমানো ঠিক না। ঢাকায় পৌঁছেই আমাকে কল দিবে’।
সোহেল ঢাকা পৌঁছল শেষ রাতে। তখনো ফজরের আজান দেয়নি। এই সময়ে রাস্তায় বের হওয়া নিরাপদ না। সে ওয়েটিংরুমে বসে রইল। সে একা না। আরও অনেকে বসে আছে। তার পাশে ভারি চশমা পড়া একছেলে। স্বল্প আলোতেও সে একটা বই এমনভাবে পড়ছে, মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ পর সে পরীক্ষার হলে ঢুকবে। তার সাথের মেয়েটি ঘুমঘুম চোখে বার বার ঘড়ি দেখছে। তার মুখে রাজ্যের বিরক্তি। ওপাশের চেয়ারে একজন মধ্যবয়স্ক লোক চাদর গাঁয়ে ঝিমাচ্ছে। তার সাথের মহিলা কি যেন চিবুচ্ছে। হয়তো পান। এত ভোরে এমন মজা করে কেউ পান চিবুতে পারে! পাশে তাদের কিশোরী কন্যা একনাগাড়ে আইফোন টিপছে। মুহূর্তের জন্য চোখ সড়াচ্ছে না। সবাই ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায়।
সে যখন বাড়িতে পৌঁছল তখন মুসল্লিরা মসজিদ থেকে বের হচ্ছে। কলিং বেল টিপতেই মা দরজা খুলে দিলেন। তিনি তসবি হাতে জায়নামায থেকে উঠে এসেছেন। তার মুখ হাসিতে ভরে উঠল।
এসেছিস! গাড়ি নাকি ফেল করেছিস?
হ্যা।
সোহেল পা ছুয়ে মাকে সেলাম করল।
আমি চিন্তায় বাঁচি না। রাত করে আসা...
কোন ব্যাপার না। আরও মানুষ আসছে না।
সে ব্যাগ থেকে আপেল-কমলা বের করতে করতে বলল, তানিয়া ঘুমে।
বউমা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল। এইমাত্র বোধহয় শুয়েছে।
সোহেল হাত-মুখ ধুয়ে তার ঘরে ঢুকল। পুরো ঘরে হালকা মিষ্টি একটা ঘ্রান। ফেøার, আসবাবপত্রগুলো চকচক করছে। তার আসার দিন তানিয়া এগুলো ধুয়ে মুছে ঝকঝকে করে ফেলে। তানিয়া ঘুমে অচেতন। ফর্সা হাতটা মশারির বাইরে বের হয়ে আছে। মুখে রাত জাগরনের ক্লান্তি। তবুও সমস্ত মুখে একটা মিষ্টি ভঙ্গি লেগে আছে। সে কয়েক মূহুর্ত তানিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। ঘুমন্ত সৌন্দর্য! এই সৌন্দর্যের কথা তানিয়া কখনো জানতেও পারবে না। সে সাবধানে তার হাতটা মশারির ভেতর ঢুকিয়ে নিঃশব্দে তার পাশে শুয়ে পড়ল।
তার যখন ঘুম ভাঙ্গল, তখন বেলা প্রায় দশটা। জানালা গলে সূর্যের আলো বিছানায় এসে পড়েছে। সে উঠে বসতেই তানিয়া প্রায় ছুটে এলো।
তুমি এসে আমাকে জাগাওনি কেন? আশ্চর্য!
সোহেল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নাস্তার টেবিলে বসল। নাস্তা খেতে খেতেই পত্রিকাটা টেনে নিল। একজায়গায় তার চোখ আটকে গেল। সে খাওয়া রেখে এক নিঃশ্বাসে খবরটা পড়ল। তারপর স্থির চোখে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল।
তানিয়া কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল, কি হলো?
সোহেল পত্রিকাটা এগিয়ে দিল।
এই নিউজটা পড়।
তানিয়া এক পলক তাকাল। ‘বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ। আটজন নিহত, বারজন আহত’।
তানিয়া ঠোট বাকিয়ে বলল, দূর্ঘটনার নিউজ আমি পড়ি না। তাও আবার সকালবেলা! নাস্তার টেবিলে!
সোহেল ছোট্ট করে বলল, এই বাসেই আমার আশার কথা ছিল।
তানিয়া স্তব্ধ হয়ে গেল! একবার সোহেলের দিকে, একবার দূর্ঘটনার ছবির দিকে তাকাল। তার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল!সোহেল বিনীতভাবে বলল, স্যার আজ আমাকে তিনটায় ছুটি দিতে হবে। ঢাকা যাব।
ম্যানেজার মাথা কাত করে সায় দিলেন এবং বললেন, হাতের কাজ শেষ করে যেয়েন।
সোহেল ম্যানেজার চেম্বার থেকে বের হয়ে এলো। তার মনটা আনন্দে ফুরফুর করছে। যাক অনুমতি মিলেছে। বৃহস্পতিবার একটু আগেভাগে না গেলে হয়? কোথায় ঢাকা, কোথায় বিয়ানীবাজার। ছ’মাস হলো তার বিয়ানীবাজার পোষ্টিং হয়েছে। সে চাকরি করে ন্যাশনাল ব্যাংকে।
সোহেল তার ডেস্কে এসে কাজে মনোযোগ দিল। কোনো কাজ ফেলে রেখে যাওয়া যাবে না। নানাজন নানা কথা বলবে। অবশ্য এইদিনটাতে কেমনে কেমনে সবকাজ আগেভাগে শেষ হয়ে যায়। হয়তো মনটা আনন্দে থাকে বলে। বাড়ি যাবার আনন্দ! সামনে দু’দিন বন্ধ। যতই যাবার সময় ঘনিয়ে আসে তার শরীর ঝিম ঝিম করতে থাকে। উত্তেজনায় সে ঠিকমতো চেয়ারে বসতে পারে না। তার এই হাবভাব হয়তো বাইরেও প্রকাশ পায়। তার কোন কোন কলিগ কমেন্ট করে বসেন।
কি সোহেল সাহেব আজ বাড়ি যাচ্ছেন?
জি।
বোঝা যাচ্ছে। যান তো তেজি বাঘ হয়ে। আসেন তো ভেড়া হয়ে।
কলিগরা মুচকি মুচকি হাসে। সোহেল কোন উত্তর দেয় না। উত্তর দিলে হয়তো আরও মুখরোচক কিছু বলবে। বেশিরভাগ স্থানীয় অফিসার। বাড়ি যাবার আনন্দ এবং উত্তেজনা -এরা কি বুঝবে!
সোহেল টানা তিন ঘন্টা কাজ করল। তারপর লাঞ্চে গেল। লাঞ্চ শেষে সে যাবার জন্য প্রস্তত হতে শুরু করল।
বেলা দু’টা বাজতেই সেকেন্ড অফিসার তাকে ডাকলেন।
সোহেল সাহেব কিছু ফরেন রেমিটেন্স এসেছে। পে-অর্ডার লিখতে হবে।
সোহেল আমতা আমতা করে বলল, স্যার এখন লিখব। তিনটায় গাড়ি।
বেশিক্ষন লাগবে না। দ্রুত লিখে ফেলুন। পে-অর্ডার তো আপনিই করেন।
সোহেল আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত কাজে নেমে পড়ল। আধা ঘন্টার মধ্যে প্রায় পঞ্চাশটার মতো পে-অর্ডার লিখে ফেলল। কাজগুলো সেকেন্ড অফিসারের কাছে জমা দিতেই ম্যানেজার চেম্বারে ডাক পড়ল। ম্যানেজারের সামনে একজন হোমরা চোমরা ভদ্রলোক বসে আছেন। সে ঢুকতেই ম্যানেজার সাহেব বললেন, ওনার একটা একাউন্ট খুলে দিন তো। আপনার গাড়ি ক’টায়?
স্যার তিনটায়।
বেশিক্ষন লাগবে না। একাউন্টটা খুলেই আপনি চলে যান।
ভদ্রলোকের একাউন্ট খুলতে খুলতেই আরেকজন ক্লায়েন্ট চলে এলো। সোহেল তার একাউন্টও খুলে দিল।
সবকাজ শেষ করে সে যখন ব্যাংক থেকে বের হলো-তখন ঘড়িতে প্রায় পৌঁনে তিনটা। তাড়াহুড়ো করে সে একটা সিএনজি নিল। নিরিবিলি রাস্তা। কিন্তু আজ কি কারণে যেন জ্যাম লেগে গেল।
সে যখন বাস কাউন্টারে পৌঁছল লোকজন জানাল, এইমাত্র ঢাকার বাসটা ছেড়ে গেল। আপনি সিএনজি নিয়ে যান। গেলেই ধরতে পারবেন।
সোহেল লাফ দিয়ে আবার সিএনজিতে উঠল।
ভাই ঢাকার রোডে যান। তাড়াতাড়ি!
সিএনজিওয়ালা দ্রুত সিএনজি ছুটাল। কিছুক্ষনের মধ্যে ঢাকাগামী বাসটা দেখা গেল। এসি বাস। রাজকীয় ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে যাচ্ছে। কিন্তু সিএনজিওয়ালা কিছুতেই ওটাকে ধরতে পারছে না।
সোহেল অস্থিরকন্ঠে বলল, ভাই আরেকটু দ্রুত চালান!
সিএনজিওয়ালা বলল, ভাই ফুল ইসপিরিড দিছি। এরচেয়ে বেশি ইসপিরিড তোলা সম্ভব না।
যতই সময় যাচ্ছে বাস এবং সিএনজির মধ্যকার দূরত্ব বাড়ছে। সোহেল সীটে বসে উসখুস করছে। ইস আরেকটু তাড়তাড়ি যদি যেতে পারত! সে একদৃষ্টিতে বাসের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন তার চোখের আড়াল হলে বাসটা হারিয়ে যাবে।
একসময় সিএনজিওয়ালা বলল, ভাই এইটা আর ধরা সম্ভব না। খালি রাস্তা পাইয়া বিমানের মতো ছুটাইছে।
সোহেল অসহায়ভাবে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। তারপর একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ফিরে চলেন।
সে আবার বাসকাউন্টারে এলো। কাউন্টার থেকে জানাল- পরের বাস রাত বারটায়। তবে নতুন করে টিকিট কাটতে হবে। টিকিটের দাম কম রাখার জন্য সে কিছুক্ষণ ঝুলাঝুলি করল। কোনো লাভ হলো না। কি আর করা! রাত বারটার টিকিট নিয়ে সে ধীর পায়ে বাসার দিকে চলল। ব্যাংকের সামনে দিয়ে যেতেই একবার ভাবল-আবার অফিসে যাবে! পরক্ষনেই মনে হলো কি দরকার। হাসাহাসি করবে।
সে সরাসরি বাসায় এলো। পুরো ঘর ফাঁকা। দূ’রুমে তারা চারজন থাকে। আজ কেউ ফিরবে না। সবাই বাড়ি যাবে। জামা-কাপড় না ছেড়েই সে সটান বিছানায় শুয়ে পড়ল। ফ্যানটা শো শো শব্দ করে ঘুরছে। ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। চারদিক অন্ধকার। মোবাইলটা বাজছে। হ্যালো বলতেই তানিয়ার উদ্বিগ্নস্বর শোনা গেল।
কি ব্যাপার, কতক্ষন ধরে কল করছি! কতদুর এসেছ?
আসি নাই। বাসায় বসে আছি।
বাসায় বসে আছ মানে?
গাড়ি মিস করেছি।
ইয়া আল্লাহ! এখন কি হবে!
তানিয়ার কন্ঠে প্রচন্ড হতাশা। সে প্রায় কাদো কাদো স্বরে বলল, বাসার সবাই আশা করে আছে তুমি আজ আসবে। একটু আগে বের হবে না!
সে চুপ করে রইল। সোহেল কিছুক্ষন ‘হ্যালো’ ‘হ্যালো’ করে বলল, তুমি ফোন রেখে দিয়েছ?
না, বলো।
মন খারাপ করছ কেন?
তানিয়া বিষন্ন কন্ঠে বলল, মন খারাপ করিনি। বলো
একটা সুখবর আছে। রাত বারটার গাড়িতে আসছি।
সে প্রায় চিৎকার করে বলল, সত্যি!
হ্যা। তুমি আশা করে আছ আসবো। আমি না এসে পারি?
সোহেল হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় আরাম করে বসল। ঘরে জমাট নিস্তব্ধতা। ব্যাগ গুছিয়ে ফিরে আসার মধ্যে কোথায় যেন বিষন্নতা লুকিয়ে আছে! নিজের ঘর নিজের কাছে কাছেই অপরিচিত লাগছে। মনে হচ্ছে-ঘরের দেয়াল, আসবাবপত্র তার ফিরে আসাকে স¦াভাবিকভাবে নিচ্ছে না। বারটা পর্যন্ত সে কিভাবে সময় কাটাবে?
পাশের রুমের রিয়াজ ভাই থাকলে এত একঘেয়ে লাগত না। তাকে নিয়ে সংগীতের আসরে যাওয়া যেত। বাজারের শেষ মাথায় সংগীতের আসর বসে। তার কন্ঠ অপূর্ব। অন্যান্য বাউলদের সাথে যখন গলা ছেড়ে গান ধরেন, মনে হয় তিনি ব্যাংকার না, জাত গায়ক।
সোহেল প্রায়ই বলে- রিয়াজ ভাই আপনি ভুল করে ব্যাংকে চলে এসেছেন। আপনার পথ ছিল বাউল সাধনা।
রিয়াজ ভাই রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসেন। কিছু বলেন না। তিনি সদ্য বাবা হয়েছেন। মাঝে মাঝে নিজে থেকেই বলেন- নাহ চাকরিবাকরি আর ভালো লাগছে না। বাবুটা একটু বড় হোক। দেখবে একদিন হুট করে চাকরি ছেড়ে পথে নেমে গেছি। সাথে বউ-ছেলে। সবার হাতে থাকবে একতারা। পড়নে গেরুয়া রঙের কাপড়। পারফেক্ট বাউল পরিবার! হা...হা...হা...
সোহেল ঘড়ি দেখল। মাত্র আটটা। নাহ সময় আর যাচ্ছে না! নিজের উপরই রাগ লাগছে। অফিস থেকে যদি আরেকটু আগে বের হতো! বৃহস্পতিবার এলে মনটা এমন তরল অবস্থায় থাকে, কোনো কাজ দিলে আর না করতে পারে না।
রাতে তানিয়া আরও কয়েকবার ফোন দিল।
‘এই শুনছ-সাড়ে এগারটার মধ্যে কাউন্টারে চলে আসবে। খেয়ে উঠবে কেমন! পথের হাবিজাবি জিনিস খাবে না’।
‘এই কতদূর এসেছ? বাস ছেড়েছে? ঘুমিয়ে পড়ো না। বাসে ঘুমানো ঠিক না। ঢাকায় পৌঁছেই আমাকে কল দিবে’।
সোহেল ঢাকা পৌঁছল শেষ রাতে। তখনো ফজরের আজান দেয়নি। এই সময়ে রাস্তায় বের হওয়া নিরাপদ না। সে ওয়েটিংরুমে বসে রইল। সে একা না। আরও অনেকে বসে আছে। তার পাশে ভারি চশমা পড়া একছেলে। স্বল্প আলোতেও সে একটা বই এমনভাবে পড়ছে, মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ পর সে পরীক্ষার হলে ঢুকবে। তার সাথের মেয়েটি ঘুমঘুম চোখে বার বার ঘড়ি দেখছে। তার মুখে রাজ্যের বিরক্তি। ওপাশের চেয়ারে একজন মধ্যবয়স্ক লোক চাদর গাঁয়ে ঝিমাচ্ছে। তার সাথের মহিলা কি যেন চিবুচ্ছে। হয়তো পান। এত ভোরে এমন মজা করে কেউ পান চিবুতে পারে! পাশে তাদের কিশোরী কন্যা একনাগাড়ে আইফোন টিপছে। মুহূর্তের জন্য চোখ সড়াচ্ছে না। সবাই ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায়।
সে যখন বাড়িতে পৌঁছল তখন মুসল্লিরা মসজিদ থেকে বের হচ্ছে। কলিং বেল টিপতেই মা দরজা খুলে দিলেন। তিনি তসবি হাতে জায়নামায থেকে উঠে এসেছেন। তার মুখ হাসিতে ভরে উঠল।
এসেছিস! গাড়ি নাকি ফেল করেছিস?
হ্যা।
সোহেল পা ছুয়ে মাকে সেলাম করল।
আমি চিন্তায় বাঁচি না। রাত করে আসা...
কোন ব্যাপার না। আরও মানুষ আসছে না।
সে ব্যাগ থেকে আপেল-কমলা বের করতে করতে বলল, তানিয়া ঘুমে।
বউমা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল। এইমাত্র বোধহয় শুয়েছে।
সোহেল হাত-মুখ ধুয়ে তার ঘরে ঢুকল। পুরো ঘরে হালকা মিষ্টি একটা ঘ্রান। ফেøার, আসবাবপত্রগুলো চকচক করছে। তার আসার দিন তানিয়া এগুলো ধুয়ে মুছে ঝকঝকে করে ফেলে। তানিয়া ঘুমে অচেতন। ফর্সা হাতটা মশারির বাইরে বের হয়ে আছে। মুখে রাত জাগরনের ক্লান্তি। তবুও সমস্ত মুখে একটা মিষ্টি ভঙ্গি লেগে আছে। সে কয়েক মূহুর্ত তানিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। ঘুমন্ত সৌন্দর্য! এই সৌন্দর্যের কথা তানিয়া কখনো জানতেও পারবে না। সে সাবধানে তার হাতটা মশারির ভেতর ঢুকিয়ে নিঃশব্দে তার পাশে শুয়ে পড়ল।
তার যখন ঘুম ভাঙ্গল, তখন বেলা প্রায় দশটা। জানালা গলে সূর্যের আলো বিছানায় এসে পড়েছে। সে উঠে বসতেই তানিয়া প্রায় ছুটে এলো।
তুমি এসে আমাকে জাগাওনি কেন? আশ্চর্য!
সোহেল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নাস্তার টেবিলে বসল। নাস্তা খেতে খেতেই পত্রিকাটা টেনে নিল। একজায়গায় তার চোখ আটকে গেল। সে খাওয়া রেখে এক নিঃশ্বাসে খবরটা পড়ল। তারপর স্থির চোখে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল।
তানিয়া কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল, কি হলো?
সোহেল পত্রিকাটা এগিয়ে দিল।
এই নিউজটা পড়।
তানিয়া এক পলক তাকাল। ‘বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ। আটজন নিহত, বারজন আহত’।
তানিয়া ঠোট বাকিয়ে বলল, দূর্ঘটনার নিউজ আমি পড়ি না। তাও আবার সকালবেলা! নাস্তার টেবিলে!
সোহেল ছোট্ট করে বলল, এই বাসেই আমার আশার কথা ছিল।
তানিয়া স্তব্ধ হয়ে গেল! একবার সোহেলের দিকে, একবার দূর্ঘটনার ছবির দিকে তাকাল। তার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল!