হাবিব সাহেব সিড়ি বেয়ে তার ফ্ল্যাটে উঠছিলেন। তার দু’হাতে পাঁচ লিটারের দুটো পানির বোতল। দোতলায় উঠতেই তার হাফ ধরে গেল। দরদর করে ঘামছেন। সিড়িতে বাড়িওয়ালার সাথে দেখা হয়ে গেল। লোকটির বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। কিন্তু দেখায় আরও বেশি। হাবিব সাহেব অপ্রসন্ন মুখে বললেন, ভাই সকাল থেকে কলে একফোটাও পানি নাই।
বাড়িওয়ালা গম্ভীর গলায় বললেন, পাবেন। একটু দেরী হবে। মোটর নষ্ট। মিস্ত্রীরিকে খবর দেয়া হয়েছে।
বলেই তিনি গোমড়ামুখে ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেলেন। ভদ্রলোক সবসময় গম্ভীর ও গোমড়ামুখে থাকেন। কেন কে জানে?
হাবিব তৃতীয়তলার পৌঁছতেই রশিদ সাহেব বের হয়ে এলেন।
সন্ন্যাসী বাবাজী কি বললেন।
হাবিব অবাক হয়ে বললেন, কার কথা বলছেন?
কার আবার? আমাদের বাড়িওয়ালা। মহান বাড়িওয়ালা!
কি আর বলবেন। পানি আসতে দেরি হবে। মোটর নষ্ট।
আজ মোটর নষ্ট। কাল পানির ট্যাংকি ফুটো। পাঁচতলা একটা বাড়িই বানিয়েছে। আপনি পানি কিনে আনলেন?
না কিনে উপায় কি?
আপনি খুব ঘেমে গেছেন। ভেতরে আসেন। কিছুক্ষণ রেষ্ট নিয়ে যান।
হাবিব সাহেব রশিদ সাহেবের ঘরে ঢুকলেন। পরিপাটি করে সাজানো ড্রইং রুম। সোফায় বসতেই রশিদ সাহেব বললেন,
ভাই আমার বড় ফ্যামিলি। সকাল থেকে বড় বড় চারটি জারের বোতল আনা হয়েছে। তাও কুলাচ্ছে না। নাহ, বাসা ছেড়ে দিতে হবে। যন্ত্রনা আর সহ্য হয় না।
রশিদ সাহেবের স্ত্রী চা-নাস্তা নিয়ে এলেন। বললেন, বাড়িওয়ালা একজন! ঢাকা শহরে একটা বাড়ি বানিয়েই কি যে ভাবে নিজেকে! থাকে সন্ন্যাসীর মতো। কথাবার্তা বলে না।
হাবিব সাহেব কিছু বললেন না। চা’র কাপে চুমুক দিলেন।
কলিংবেলের শব্দ হচ্ছে। রশিদ সাহেবের স্ত্রী দরজা খুললেন। মিসেস ফাহমিদা দাড়িয়ে আছেন। দোতলার বাসিন্দা।
কি ব্যাপার ভাবি?
মিসেস ফাহমিদা বললেন, আপনাদের কাছে এক্সটা বালতি হবে?
এক্সটা বালতি নেই। একটা আছে আমরাই পানি ভরে রেখেছি।
ওহ। সকাল থেকে কি যে অবস্থা! গোসল করতে গিয়েছি, পানি নেই। মিঠুর আব্বু এখনো ঘুমে। উঠেই যদি দেখে পানি নেই...
রশিদ সাহেবের স্ত্রী বললেন আমরা তো সেই আলাপই করছি। আসেন, ভেতরে আসেন।
মিসেস ফাহমিদা ভেতরে ঢুকলেন। তার ফর্সামুখ ঘামে চিকচিক করছে। হয়তো গোসল সারতে পারেননি। রশিদ সাহেব তাকে দেখে একটা তেলতেলে হাসি দিলেন।
কি খবর ভাবি! পানি হান্টিংয়ে বের হয়েছেন?
ফাহমিদা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, পানি কোথায় যে হান্টিং করব। পুরো বাড়ি কারবালা হয়ে গেছে। বাড়িওয়ালার হুশ নেই। আমাদের বেসিনের কলটা নষ্ট। এক সপ্তাহ ধরে বলছি। উনি কানেই নেন না।
রশিদ সাহেব তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, আরে সন্ন্যাসী বাবাজি কি কানে নেবে? আপনারা নিজেই লাগিয়ে নেন। তারপর ভাড়া থেকে কেটে রাখবেন।
তাই করতে হবে।
রশিদ সাহেব বললেন, আরে ঢাকা শহরে স্যাটেল হব কে জানত? এসব জায়গা পানির দরে বিক্রি হয়েছে। এককাঠা এক লাখ। তখন কত সেধেছে! রাখি নাই।
মিসেস ফাহমিদা বললেন, আমার আব্বা যখন ঢাকায় আসেন, এসব জায়গা ছিল ক্ষেতের মতো। তিনি ইচ্ছে করলে বিশ-ত্রিশ কাঠা জমি কিনে ফেলতে পারতেন। কিন্তু কিনেননি। ব্যবসায়ী মানুষ। জমি কিনলেই টাকা আটকে যাবে। তখন জায়গা রাখলে আজ আমরা বাদশা মতো থাকতাম। সন্ন্যাসীর বাসায় ভাড়া থাকতে হতো না।
হাবিব সাহেব উসখুস করছেন। বসে বসে এসব আলাপ শুনলে তার চলবে না। দোকানে যেতে হবে। চা শেষ করেই তিনি উঠে দাড়ালেন।
রশিদ সাহেব বললেন, মাঝে মাঝে আসবেন। আলাপ আলোচনা করব। আমরা ভাড়াটিয়া ভাড়াটিয় যদি মিলমিস না থাকে তাহলে কি বাড়িওয়ালার সাথে হবে? তারা রাজা, আমরা প্রজা। আমাদের যন্ত্রনা তারা কি বুঝবে?
হাবিব সাহেব তার ঘরে ঢুকলেন। তার স্ত্রী জেসমিন বলল, দু’বোতল পানি আনতে এতক্ষন লাগল?
রশিদ সাহেবের ওখানে কিছুক্ষন বসলাম। বাড়িওয়ালার ওপর দেখি সবাই ক্ষ্যাপা। দেখি ফ্যানটা ছাড়।
তিনি ফ্যানের নিচে বসলেন। ফুলস্প্রীডে ফ্যান চলছে। তবুও ঘামছেন। জেসমিন নাস্তা নিয়ে এল। নাস্তা খেতে খেতেই তিনি শুনলেন মিশুর টিচার কিছুদিন ধরে আসছে না। তিনি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কেন?
জেসমিন বলল, হয়তো বেতনের জন্য। দু’মাসের বেতন বাকী পড়েছে।
তিনি কিছু বললেন না। কিছুদিন ধরে তার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। কাপড়ের দু’টো গাইড খারাপ পড়েছে। বেশ কিছু টাকা বাকিতে আটকা পড়েছে। তিনি মনে মনে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে বললেন, একসময় আমিও টিউশনী করতাম। ছ’মাস বেতন পাইনি, তাও পড়ানো বাদ দেইনি।
টিচাররা কি আর আগের মতো আছে। সামনে মিশুর এসএসসি পরীক্ষা। এই সময়ে যদি টিচার না আসে!
হাবিব সাহেব বললেন, চলো বাসাটা ছেড়ে দেই। সস্তায় কোনো বাসায় উঠে যাই।
জেসমিন চুপ করে রইল। তার মন সায় দিচ্ছে না। ভালো জায়গায় থাকার পর সস্তা জায়গায় থাকা যায়? মনের উপর চাপ পড়বে না? তাছাড়া মেয়ে বড় হচ্ছে। তার ধারনা-সস্তা এলাকায় বেকার রোমিওদের আনাগোনা বেশি।
সে বলল, অন্য এলাকায় মন টিকবে? এখানে ওর স্কুল।
অভ্যস্ত হলে টিকবে।
আর কিছুদিন দেখ। তোমার অবস্থা ফিরে কিনা!
হাবিব সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। নাস্তা করে গোসল না করেই বের হয়ে গেলেন। যেভাবেই হোক দেনাদারদের কাছ থেকে পাওনা টাকাগুলো উদ্ধার করতে হবে। নইলে পথে বসতে হবে। বিকেলের দিকে হাবিব সাহেব বাসায় ফিরলেন। একপয়সাও উদ্ধার করতে পারেননি। এ মাসের মধ্যে যদি টাকা উদ্ধার করতে না পারেন, ভাড়ার টাকাও বাকি পড়বে। তিনি ঘরে ঢুকে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লেন।
জেসমিন বলল, একি ঘেমে টেমে তোমার কি অবস্থা!
পানি এসেছে?
হ্যা।
তোয়ালেটা দাও। গোসল করব।
জেসমিন তোয়ালে দিয়ে বলল, বাড়িওয়ালা আরেক কান্ড করেছে। ছাদে তালা দিয়েছে। কাউকে যেতে দিচ্ছে না।
গেলে সমস্যা কি?
বলে সবার ফø্যাটে বারান্দ্রা আছে। সেখানে কাপড় শুকাবে। ছাদে উঠলে নাকি পাশের ফ্ল্যাট থেকে অভিযোগ আসে। এসব মিথ্যা কথা। কে অভিযোগ করে?
যতই দিন যেতে লাগল বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে ভাড়াটিয়াদের অভিযোগ এবং ক্ষোভ বাড়তেই লাগল। পরিবেশটা এমন হয়ে উঠল একভাড়াটিয়া কোন অভিযোগ করলে সবাই একসাথে তার পক্ষ নেয় এবং আলাপ আলোচনা শুরু করে। হাবিব সাহেব এসবে জড়ান না। তিনি তার ব্যবসার চিন্তায় অস্থির। আর বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ করে লাভ কি? বেশি সমস্যা মনে হলে অন্য জায়গায় চলে যাও। তা না। দিনরাত অভিযোগ আর অভিযোগ। এটা কি পরাধীনতা থেকে এক ধরনের হীনমন্যতা!
সেদিন ছিল শুক্রবার। তারপরও সে মার্কেটে গিয়ে দোকান খুলল। যদি কিছু টাকা উদ্ধার হয়। কিন্তু উদ্ধার হয়নি। বেচাকেনাও হয়নি। তার শাড়ি-কাপড়ের দোকান। উপলক্ষ্য ছাড়া মানুষ আজকাল শাড়ি কেনে না। বিকেলের দিকে দোকানের দু’জন কর্মচারী তাকে ধরাধরি করে বাসায় নিয়ে এল। জেসমিন এবং মিশু উদ্বিগ্নমুখে চিৎকার করে উঠল, কি হয়েছে! কি হয়েছে!
কর্মচারীদের একজন বলল, দোকানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন।
ডাক্তারের কাছে নেয়া হয়েছে?
না। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিতেই জ্ঞান ফিরে আসে।
সন্ধ্যার দিকে হাবিব সাহেব বেশ ঘামতে শুরু করলেন। বুকেও প্রচন্ড চাপ অনুভব করছেন। মনে হচ্ছে কোনো শক্তিশালী বডিবিল্ডার তার বুকের উপর চেপে বসেছেন। তিনি পরপর কয়েক গ্ল্যাস পানি খেলেন। একবার বললেন, আমার যেন কেমন লাগছে!
জেসমিন চিন্তায় অস্থির। কি করবে বুঝতে পারছে না। পাশের ভাড়াটিয়াকে ডাকল। তারা বললেন, ঠিক হয়ে যাবে। যে গরম পড়েছে। মাথায় আইসব্যাগ দেন। শরীরের তাপ কমে আসবে।
তার চিন্তা কমল না। রশিদ সাহেবকে খবর দেয়া হল। তিনি এসে বললেন, টেনশন থেকে শরীর ঘামে। ভাই কোনো ব্যাপারে টেনশন করেন না। হয়তো প্রেসার বেড়েছে। একজন ডাক্তার ডেকে প্রেশারটা একটু মাপান।
জেসমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাবী উনাকে এক গ্ল্যাস তেঁতুলের শরবত করে দেন। খেলে আরাম পাবেন। আমি এখন যাই। সন্ধ্যায় আবার আমার ছোট শ্যালকের বৌভাত। না গেলে মাইন্ড করবে।
রশিদ সাহেব চলে গেলেন। রাত বাড়তেই হাবিব সাহেব অজ্ঞানের মতো পড়ে রইলেন। জেসমিন দিশেহারা হয়ে উঠল। একবার তেতুলের শরবত খাওয়াল। একবার মাথায় পানি দিল। মিশু দৌড়ে বাড়িওয়ালার কাছে গেল। বাড়িওয়ালা ছুটে এলেন। একটা সিএনজিতে করে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন।
ইমাজেন্সি বিভাগের ডাক্তাররা চেকআপ এবং ইসিজি করে বললেন, হার্টএটাক হয়েছে। মাইল্ড এটাক। কয়েকদিন ক্লোজ সুপারভিশনে রাখতে হবে। ভালো হয় হাসপাতালে ভর্তি করে দিলে।
বাড়িওয়ালা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। সারারাত তার পাশে বসে রইলেন। জেসমিন বারবার বলল, ভাইজান আপনি চলে যান। আর কত কষ্ট করবেন! আমি আর মিশু তো আছিই।
পরেরদিন দিন ডাক্তাররা তার এনজিওগ্রাম করে জানালেন, তার হৃৎপিন্ডের রক্তনালিতে দুটি ব্লগ ধরা পড়েছে। রিং পড়াতে হবে। তাহলেই তিনি পুরোপুরি বিপদমুক্ত হবেন।
জেসমিনের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। বাড়িওয়ালা শান্ত¡নার স্বরে বললেন, ভয় পাবেন না। রিং পড়ানো মেজর কোনো অপারেশন না। আজকাল অহরহ পড়ানো হচ্ছে।
জেসমিন তবুও চুপ করে রইল। একসময় বিষন্ন কন্ঠে বলল, রিং পড়ানোর মতো অবস্থা আমাদের নাই। ওর ব্যবসা ভয়াবহ মন্দা যাচ্ছে।
বাড়িওয়ালা বললেন, হতাশ হবেন না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন। দেখি কি করা যায়।
তিনি তার হার্টে রিং পড়ানোর ব্যবস্থা করলেন। সমস্ত খরচপাতি দিলেন এবং বললেন, যতদিন সুস্থ না হয় এবং দোকানে না য়ায়, ততদিন ভাড়ার টাকা বা অপারেশনের টাকা নিয়ে ভাববেন না।
তিনমাস পরের কথা। হাবিব সাহেব পুরোপুরি সুস্থ। তিনি সিড়ি দিয়ে নিচে নামছিলেন। বাড়িওয়ালা ধীরে ধীরে উপরে উঠছিলেন। তারমুখ আগের মতোই গম্ভীর। হাবিব সাহেব সালাম দিতেই উনি ওয়ালাইকুমসালাম বলে ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেলেন। হাবিবের সাহেবের কাছে আজ তাকে একজন গোমড়ামুখো সন্ন্যাসী মনে হল না। মনে হল শ্বেতশুভ্র এজন ফেরেস্তা গম্ভীরমুখে ধীরে ধীরে উপরে উঠে যাচ্ছেন।