মামুন হুট করে একটা চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে ঢুকল। বেশ আভিজাত রেষ্টুরেন্ট। সাথে তানিয়া এবং রনি। তানিয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে মামুনের দিকে তাকাল। মামুন মৃদু হেসে বলল, কোন সমস্যা নাই। আজ আমরা ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করব।
তারা ভেতরে ঢুকে একটা ছোট টেবিল দখল করে বসল। তানিয়ার ঘোর এখনো কাটেনি। মামুনের যে আয় এখানে ঢোকার প্রশ্নই আসে না। সে অবাক চোখে আশেপাশে তাকাচ্ছে। চারদিকে আলোআধারি পরিবেশ। জোড়ায় জোড়ায় ধনী ঘরের প্রেমিক প্রেমিকা এবং নবদম্পতিরা বসে আছে।
তানিয়া বিস্মিত স্বরে বলল, তুমি বোনাস পেয়েছ?
না।
তাহলে হঠাৎ এখানে?
আসা যায় না?
তানিয়া স্থির দৃষ্টিতে মামুনের দিকে তাকাল।
মামুন রহস্যময় ভঙ্গিতে একটু হাসল। তারপর বলল, চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।
চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছ মানে? বুঝলাম না।
অনেকদিনই তো চাকরি করলাম। কিছুই তো করতে পারলাম না।
তুমি আমার সাথে রসিকতা করছ!
রসিকতা করব কেন? এই দেখ রিজাইন লেটার।
তানিয়া রিজাইন লেটারটা দেখল। তার হাতপা ঠান্ডা হয়ে এলো। সে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে মামুনের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন তাকে চিনতে পারছে না। মামুন মনোযোগ দিয়ে খাবারের মেন্যু দেখছে। রনির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, রনি বাবু তুমি কি খাবে? আজ আমরা পেট ভরে খাব।
রনি বাবার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল। মামুন মেন্যু দেখে নিজেই অর্ডার দিল। তানিয়ার আশায় বসে থাকা বোকামী। সে থম হয়ে আছে।
কিছুক্ষনের মধ্যে দু’জন ওয়েটার ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে এলো। সবগুলো খাবার সাজিয়ে রাখতেই টেবিলটা ভরে গেল।
মামুন তানিয়ার দিকে থাকিয়ে বলল, শুরু করা যাক।
তানিয়া উদ্বিগ্নস্বরে বলল, তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝছি না।
বোঝার দরকার নাই। আগে খাও। চাকরিটা ছেড়ে দেয়ায় প্রভিডেন্ট ফান্ডের কিছু টাকা পেলাম। ব্যস...
বলেই মামুন খাওয়া শুরু করল।
তুমি কি আরেকটা চাকরি নিয়েছ?
চাকরি মনে হয় গাছের বড়ই। ঝাঁকুনি দিলাম। অমনি ঝুর ঝুর করে পড়ল।
তানিয়া স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে- সে সত্য বলছে না মিথ্যা বলছে।
মামুন চোখ মুখ করুন করতে গিয়ে মৃদু হেসে ফেলল।
তানিয়া কাটা কাটা গলায় বলল, তুমি খুব রহস্যময় মানুষ না রহস্য করে বেড়াবে। আসল ঘটনা কি খুলে বল। মামুন একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। চাকরি ছাড়ার কথা বলে তানিয়াকে যতটা ভড়কে দেবে ভেবেছিল, ততটা পারেনি। হুট করে চাইনিজে ঢোকার কারনে হয়তো পারেনি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে কেউ চাইনিজে ঢোকে না। পার্কের গাছতলায় বসে থাকে।
সে শান্তস্বরে বলল, আসল ঘটনা আর কি? তোমার অনুমানই ঠিক। আমি আরেকটা চাকরি নিয়েছি। ফাইন্যান্স কোম্পানি।
তানিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সে খাবারের দিকে তাকিয়ে বলল, দুজনের খাবার অর্ডার দিয়েছ না দশজনের। পুরো চাইনিজ তো খালি করে ফেলেছ!
গলা ডুবিয়ে খাও।
একদিন গলা ডুবিয়ে খেলে আর উঠতে হবে না। ডুবে যেতে হবে।
তানিয়া ছোট্ট একটা কাপে স্যুপ ঢেলে রনিকে দিল। রনি গরম স্যুপে ফু দিতে শুরু করল। তানিয়া স্যুপ নাড়তে নাড়তে বলল, তুমি অভিনয়ও পার না।
কি রকম?
কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়ে মিটমিট করে হাসে না। সে থাকে বিষন্ন। সত্যিকারের বিষন্ন।
হয়তো।
এখানে সেলারী কেমন?
আগের চেয়ে ভালো।
ওহ! এজন্য সাহেবের হাত খুলে গেল।
সারাজীবনই তো হিসেব করে চললাম। দেখি হিসাব ছাড়া কিছুদিন চলে।
তারা বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে গেল। মামুন ক্লান্ত দেহে সোফায় বসল। তার হাঁসফাঁস লাগছে। এর আগে ভরপেট সে চাইনিজে খায়নি। সাধারন একটা বীমা কোম্পানীতে চাকরি করে গলা ডুবিয়ে চাইনিজে খাওয়া যায় না। যাক এখন এই অবস্থা কাটবে। ভালো বেতন। শুনেছে ওরা দু’বছর বছর পরপর প্রমোশনও দেয়। সে একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলল। হঠাৎ ঘরটা স্যাতস্যাতে ও ঘিঞ্জি মনে হচ্ছে। চাইনিজের ঝলমলের আলো থেকে ফেরার কারনে হয়তো এরকম লাগছে। আর্শ্চয এরকম একটা ঘরে তারা তিনবছর কাটিয়ে দিল!
দুই
দেখতে দেখতে মামুনের জীবনে দ্রুত কিছু পরিবর্তন এলো। সে আগের বাসা ছেড়ে দিল। নতুন ফ্ল্যাট বাড়িতে উঠে এলো। টাইলস করা ফ্লোর। সাথে এটার্চ বারান্দ্রা। জানালা খুলে দিলে হু হ করে বাতাস আসে। তানিয়া দ্রুত ঘর সাজিয়ে ফেলল। ঘর সাজাতে গিয়ে বারবার তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। আসবাবপত্রের কী অবস্থা! নতুন রঙ করা চকচকে রুমগুলোর সাথে কিছুতেই মানাচ্ছে না। মামুন সিলিং পরিস্কার করছিল।
তানিয়া বলল, এই তুমি কালই খাট চেঞ্জ করবে। ফ্ল্যাটে ঢোকার সময় কী যে লজ্জ্বা লাগছিল!
লজ্জ¦া লাগছিল কেন?
অনেক ভাড়াটিয়া বারান্দ্রা থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমাদের দেখছিল।
তাতে কি?
বুঝছ না? ওরা আমাদের আসবাবপত্র দেখে আমাদের স্টাটাস বোঝার চেষ্টা করছিল।
মামুন কিছু বলল না। পরদিনই অটোবির একটা খাট নিয়ে এলো। উৎসাহের সাথে সেই খাট পাতা হলো। এরপর প্রতিমাসেই বেতন পেলে নতুন নতুন জিনিস কেনা শুরু হলো। আগের টিভি বদলে এলসিডি টিভি, নতুন একটা ফ্রীজ। গরমের দিনে তারা হাঁসফাঁস করে। আনা হল এসি। এক বছরের মাথায় দেখা গেল তাদের ঘরে আধুনিক সুযোগ সুবিধার এমন কিছু নাই, তাদের নাই।
একদিন তানিয়ার মামা-মামী তানিয়ার বাসায় বেড়াতে এলেন। তানিয়াকে দেখে মামী হবাক।
একি! এত মোটা হয়েছ কেন?
বুঝছিনা কি করব? দু’বেলা ডায়েটিং করছি। তারপরও ফ্যাট হচ্ছি।
মামা হাসিমুখে বললেন, বড়লোকের বউ। এখন মোটা না হলে মানায়।
মামা, আমাদের বলেন বড়লোক। এই ফ্ল্যাটে আমাদের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ। সবার ঘরে ওয়াশিং মেশিন আছে। একবছর হয়ে গেল, আমরা একটা ওয়াশিং মেশিন কিনতে পারলাম না।
মামী বলললেন, ওয়াশিং মেশিন কি দরকার? নিজের কাপড় নিজে ধুলেই তো শরীর ফিট থাকে।
পারি না মামী। পানি ধরলেই ঠান্ডা লেগে যায়। সেদিন ওর একটা প্যান্ট ধুলাম। হাঁচতে হাঁচতে জান বের হবার দশা।
মামী কিছু বললেন না। নতুন সংসার শুরু করলে মেয়েরা যেমন উৎসাহের সাথে তার ঘরসংসার দেখায়, তানিয়াও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার ঘরের নতুন আসবাবপত্র দেখাচ্ছিল।
মামী এই বক্স খাটটা দেখেন। রনির জন্য কিনেছি। অরিজিন্যাল জাহাজের খাট। খুব পোক্ত।
বাহ চমৎকার!
দাম পড়েছে একটু বেশি। পঁচিশ হাজার নিয়েছে। তারপরও ভালো একটা জিনিস পেলাম।
মামী বললেন, রনি কোথায়? ওকে তো দেখছি না।
পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে হয়তো গেমস খেলছে। দিনরাত গেমসের নেশা।
তানিয়া আইপি নম্বরে ফোন দিয়ে রনিকে আসতে বলল। রনিকে দেখে মামী আৎকে উঠলেন।
একি! রনির এই কী অবস্থা! ও তো হাঁটতেই পারছে না।
বাস্তবিকই রনি এতটা মোটা হয়েছে- তাকে হাঁটতে হচ্ছে পা ফাঁক করে। অথচ তিনবছর আগে সে ছিল হালকা পাতলা। তানিয়া একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। রনিকে নিয়ে সে চিন্তায় আছে। জন্মের সময় সে ছিল আন্ডারওয়েট। তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে কত ছোটাছুটি। ডাক্তাররা পুষ্টিকর খাবারের পরামর্শ দিলেন। এখন ফ্রীজ ভরতি পুষ্টিকর খাবার, সে খায় না। অথচ দিন দিন ফুটবলের মতো গোল হচ্ছে। সে নিজেও কম খায়, কিন্তু মুটিয়ে যাচ্ছে। একজন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। প্রতিদিন যাই যাই করে যাওয়া হয় না। মামুন এলে আজই যাবে। মামা-মামী বিকেল পর্যন্ত থাকলেন। এই সময়ের মধ্যে মামী আপনজনের মতো একটার পর একটা উপদেশ দিলেন।
‘তানিয়া কড়াইতে এত মাংস! তোমরা মোটে তিনজন মানুষ। এত মাংস খাও কেন? বেশি মাংস খাও বলেই শরীরে চর্বি জমছে। প্রেসারকুকারেও দেখি মাংস! ফার্মের মুরগী বাদ দিতে পার না’।
‘ইশ্ বাথরুমে এত নোংরা কাপড়-চোপড়। কাজের মহিলার আশায় বসে থাকলে চলে। কাপড় পঁচে সব ত্যানা ত্যানা হবে’।
‘ওমা এত ওষুধ কে খায়! ঘুমের ওষুধও আছে দেখছি। ওষুধ খাওয়া ছাড়। বেশি ওষুধ খেলে সারা জীবন ওষুধে ওষুধে কাটবে!’
তানিয়ার বিরক্তির সীমা রইল না। তবুও সে চুপচাপ শুনল। মামার কারনেই শুনল। এই মামাই তাদের অভাবের দিনগুলোতে একজন ত্রানকর্তা হিসাবে আবির্ভূত হতেন। দিনের পর দিন তারা বাজার থেকে একটা বড় মাছ কিনে
আনতে পারেনি। মামা হয়তো কোন শুক্রবার বিশাল রুই নিয়ে তাদের বাসায় হাজির।
তানিয়া মা কই। এই মাছটা ভালো করে ভাজ তো। তোর হাতের মাছ ভাজা খাওয়া মানে বেহেস্তি কোনো চিজ খাওয়া। আজ আরাম করে সবাই খাব।
আজও মামা বড় দেখে রুই মাছ নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তানিয়াদের অবস্থা দেখে আগের মতো কিছু বলেননি। মাছ দেখে তানিয়ারও ভালো লাগেনি। এতবড় মাছ কে কাটবে? মামুন বাজার থেকে মাছ কেটে আনে। সে মাছটা ডিপ ফ্রীজে ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছে।
তারা চলে যাবার কিছুক্ষন পর মামুন এলো।
তানিয়া বলল, জামাকাপড় খুলো না। চলো ডাক্তারের কাছে যাই।
কোনো সমস্যা?
সমস্যা আমাদের সবার। যে হারে মোটা হচ্ছি মানুষজন আমাদের দেখে চমকে উঠছেন।
কে চমকে উঠেছে?
ছোট মামা-মামী এসেছিলেন। তারা চমকে উঠেছেন, আবার কে?
ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছতে পৌঁছতে এশার আজান দিয়ে দিল। ওয়েটিংরুম রুগীতে গিজগিজ করছে। সবাই দেয়ালের এলসিডি টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সবাই সিনেকমপ্লেক্সে ছবি দেখতে এসেছে। কোন দেশের ক্রিকেট খেলা যেন চলছে। শব্দহীন খেলা। খেলোয়াড়দের উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে। শব্দ শোনা যাচ্ছেনা। এই টিভি অপেক্ষার যন্ত্রনা কমিয়ে দিচ্ছে। প্রায় দু‘ঘন্টা পর ডাক্তারের চেম্বারে তাদের ডাক পড়ল।
ডাক্তার রনিকে চেকআপ করে বললেন, কী সমস্যা? ওতো সম্পূর্ণ সুস্থ।
তানিয়া বলল, ও কিছুই খেতে চায় না। খাবার মুখে দিলে থু করে ফেলে দেয়।
রনির ওজন মাপা হল। পয়ত্রিশ কেজি।
ডাক্তার সাহেব বললেন, বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওর ওজন হওয়া উচিত বিশ কেজি। বাকী পনের কেজি চর্বি। এই চর্বিতেই পেট ভরা। খাবে কি? বাবু খেলাধুলা কর?
রনি মিষ্টি করে হেসে বলল, করি।
কি খেলো?
ভিডিও গেম।
এবার ডাক্তার হাসলেন।
ভিডিও গেম খেললে তো হবে না। খেলতে হবে ফুটবল, ক্রিকেট। মাঠে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।
তানিয়া নিজেরও চেকআপ করাল।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনারও একই অবস্থা। অবসিটি বা ফ্যাট। এই রোগ কেন আক্রমন করে জানেন?
ফাস্টফুড দেখলে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া। শারীরিক পরিশ্রম থেকে একহাজার হাত দুরে থাকা। কচ্ছপের মতো চলাফেরা। সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকা।
তানিয়া বলল, রাতে আমার ঘুম হয় না।
ঘুম হবে কি? ঘন্টার পর ঘন্টা টিভি সিরিয়াল দেখে মাথার কোষগুলো উত্তপ্ত করে ফেলেন।
তানিয়া সিরিয়াল বেশি দেখে না। কিন্তু ল্যাপটপে একটার পর একট ছবি দেখে। ব্যাপারটা একই বলে সে চুপ করে রইল।
তারা যখন চেম্বার থেকে বের হল, তখন রাত প্রায় দশটা। মামুন একটা সিএনজি নিল।
সিএনজিতে উঠে তানিয়া বলল, ডাক্তার যা বললেন, তাতো আমরাই জানি।
মামুন বলল, জানলেই যদি সব হতো তাহলে এই অবস্থা হয়!
সিএনজি জ্যামে আটকে আছে। এত রাতেও জ্যাম। ঢাকা শহরে এখন রাতে এবং ছুটির দিনে বেশি জ্যাম হয়। এখন জ্যাম কি জন্য কে জানে? ড্রাইভাকে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল সামনে গরুর হাঁট। তাই জ্যাম।
গরুর হাঁটের কথা শুনে মামুনের মনে পড়ল এবার কোরবানীর ঈদ গ্রামে করার কথা। গতবার যাওয়া হয়নি
তিন
ঈদের তিনদিন আগে তারা গ্রামে এসে পৌঁছল। তখন সন্ধ্যা নেমেছে। সুমি উঠানের রশি থেকে জামা-কাপড় উঠাচ্ছিল। তাদেরকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠল। তারপর চিৎকার করে উঠল, বড় দাদা এসেছে। বড় দাদা এসেছে।
সে ছুটে ঘরের ভেতর ঢুকল। ততক্ষণে সবাই বের হয়ে এসেছে। মা-বাবাকে সেলাম করতেই মা কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। তার মুখে হাসি, চোখে পানি। বাবা চেঁচামেচি শুরু করলেন।
কাদের কই? কাদের... কাদের...। দরকারের সময় এরা কই যে থাকে! উঠানে কয়েকটা চেয়ার দিব! সুমি তুই হা করে দাড়িয়ে আছিস কেন? কলতলা থেকে পানি এনে দে। হাতমুখ ধুক।
মামুনের ছোট ভাই তপু দুমদাম করে কয়েকটা হাতলওয়ালা প্লাস্টিকের চেয়ার বাইরে নিয়ে এলো।
বড়দা খবর দিয়ে আসোনি কেন? খবর দিলে বাসষ্ট্যান্ডে থাকতাম...
মামুন মৃদু হাসল। হুট করে এসে সে সবাইকে চমকে দিতে চেয়েছে।
সুমি বলল, মা দেখ রনি কত বড় হয়েছে। রনি বাবু তুমি এত মোটা হয়েছ কেন?
রনিকে কোলে নিতেই সে মোচড়াতে শুরু করল। তার ঘুম ঘুমভাব কেটে গেছে। বাসে এসির ঠান্ডা হাওয়ায় এবং ঝাঁকুনিতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন আবছা আলোতে সবাইকে অবাক চোখে দেখছে।
মা বললেন, ছোটকালে মোটাই থাকে। মামুন কম মোটা ছিল! হ্যারে মামুন, তোর চোখের নিচে এমন কালি পড়েছে কেন? ঠিকমতো ঘুমাস না?
কাজের অনেক চাপ।
চাপ থাক। ঠিকমতো খাওয়া আর ঘুমাতে হবে না?
বাবা বললেন, প্রাইভেট চাকরি যে কী জিনিস আমি বুঝি। আমার বড় ভাই পয়ত্রিশ বছর একটা ওষুধ কোম্পানীতে চাকরি করল। বুঝলে মামুনের মা, শেষে জীবনটাই...
আসতে না আসতেই তুমি অলুক্ষনে কথা শুরু করলে! মোরগ জবাই দিবে না?
মামুন নিষেধ করল। কে শোনে তার কথা। রাতেই পোলাও মাংস চরান হলো। গভীররাতে সবাই গোল হয়ে খেতে বসল। পোলাউ থেকে গরম গরম ভাপ উঠছে। সবাই বেশ তৃপ্তিসহকারে খাচ্ছে। পথের ধকলে ভালোই ক্ষিধে পেয়েছে। শুধু মামুন ধীরে ধীরে খাচ্ছে। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে।
সুমি বলল, বড় দাদা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খাচ্ছে।
সবাই হেসে উঠল। মামুনও অপ্রস্তুতভঙ্গিতে হাসল। আসারপর থেকেই ক্লান্তিতে সে চোখ খোলা রাখতে পারছে না। অথচ বিয়ের প্রথম প্রথম প্রতিসপ্তাহে সে বাড়ি চলে আসত। আশ্চর্য অল্পতেই সে এখন এত ক্লান্ত হয়ে পরছে!
মা সবার পাতে এটা সেটা তুলে দিচ্ছেন।
ও কি বৌমা, তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না।
তানিয়া হাসিমুখে বলল, আমি এখন খুব কম খাই।
কেন?
ডাক্তারের নিষেধ। ডাক্তার আমাদের সবাইকে তৈলাক্ত খাবার কম খেতে বলেছে।
বাবা বললেন, গ্রামে এসেছ। এখন খেলে কিছুই হবে না। চলাফেরায় সব হজম হয়ে যাবে। ঢাকায় তো চলাফেরা কর না। হজম হবে কি? আবার খাও ফার্মের মুরগী!
খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই উঠানে এসে বসল। উঠানে পাটি বিছানো হয়েছে। আকাশ ভেঙ্গে জোসনা নেমেছে। চারদিক ফকফক করছে। একথা সেকথার পর গরুর হাঁটের কথা উঠল।
তপু বলল, ইছাপুর হাঁটে এইবার দেখার মতো একখান গরু উঠছে। দাম হাকছে দুই লাখ। দেখতে হাতির মতো।
বাবা বললেন, বুঝছি করিম মিয়ার গরু। এই হাঁটে কেউ পুছব না। কার ঠেকা পড়েছে এত টেকা দিয়ে গরু কেনার। মা বললেন, মামুন কোরবানী দিবি না?
হ্যা দেব। ভালো গরু কোথায় পাওয়া যাবে?
বাবা উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। উৎফুল্ল গলায় বললেন, জৈনসারের গরুর ব্যাপারীরা ডাকাইত। ইছাপুরা হাঁটে পানির দরে গরু বিক্রি হইতাছে। এক একটা গরুর কী সাইজ! তাগড়া মহিষের মতো!
ঠিক হলো ইছাপুরা হাঁট থেকেই গরু কেনা হবে। পরদিন বিপুল উৎসাহে একটা ষাড়গরু কেনা হলো। বিশাল ষাড়। গা থেকে তেল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। বাবা ষাড়ের একটা রশি ধরে আগেভাগে চললেন। পাশে তপু ধরে আছে আরেকটা রশি। তপু কয়েকবার বাবার হাত থেকে রশি নেয়ার চেষ্টা করল। তিনি দিলেন না। গ্রামের ভেতর দিয়ে আসার সময় গ্রামবাসী থমকে দাড়াল। কোরবানীর জন্য এত বড় গরু এই অঞ্চলে আর কেনা হয়নি। মাতব্বর শ্রেনীর কেউ কেউ জিজ্ঞেস করল, জমির শেখ, খাসা একখান জিনিস কিনছেন! কত পড়ল?
বাবা দাম বলতেই তারা বলল, জিতসেন ভাই। এই জিনিস জৈনসার হাঁট থেকে কিনলে কমছে কম এক লাখ পড়ত। শহর থেকে ছেলে এসেছে বুঝি। আপনার রাজকপাল! ছেলে বড় চাকরি করে!
বাবার বুক গর্বে ভরে উঠে। তিনি উৎসাহের সাথে হাঁটেন। ষাড়ের পেছনে পেছনে গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দলবেধে আসতে থাকে।
কোরবানীর গরু দেখে বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। ইতোমধ্যে রাজশাহী থেকে বড় মেয়ে এবং জামাই চলে এসেছে। মা গরু দেখে চিন্তায় পড়লেন। এত মাংস কাটা, রাখা!
মামুন বলল, মা কোনো চিন্তা করো না। সব গ্রামবসীর মধ্যে বিলিয়ে দেব।
ঈদের দিন দেখা গেল সত্যিই তাদের কোনো চিন্তা করতে হলো না। আশেপাশের প্রতিবেশীরা বিপুল উৎসাহ নিয়ে হাত লাগাল। কেউ মাংস কাটতে শুরু করল। কেউ বড় বড় পাতিল-কড়াই নিয়ে এলো। সুমির আনন্দ ধরে না। সে ভাবিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাবি এবার অনেকদিন থাকবে। আমরা পাশের গ্রামে মামা-মামীর বাড়িতে বেড়াতে যাব।
কিন্তু গ্রামে থাকতে তানিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছে। রাত হলে অন্ধকার অন্ধকার! কলতলায় গিয়ে গোসল করতে হয়। বাতাসের মধ্যে গুমোটভাব। এসির মতো ঠান্ডা হাওয়া কি আর পাওয়া যায়? অথচ বিয়ের পরপরই প্রথম দু’বছর সে এখানে ছিল। আশ্চর্য তখন তো এত খারাপ লাগেনি! কতদিন কলতলায় গিয়ে ভোররাতেই গোসল করে ফেলেছে। কল চেপে কত কাপড়চোপড় ধুয়েছে। শ্বশুড়-শাশুড়ির জন্য পানি তুলে দিয়েছে। একটুও ক্লান্ত হয়নি। অথচ সেদিন কলচেপে গোসল করতে গিয়ে হাঁপাচ্ছিল। সুমি দৌড়ে এলো।
ভাবী দাও আমি পানি তুলে দিচ্ছি। তুমি গোসল কর।
লাগবে না।
কেন লাগবে না? ইস্ হাতে কেমন ফোসকা পড়ে গেছে। তুমি সরো তো।
চাপকলের পানিতে গোসল করতেও তার অস্বস্তি লাগে। ঝুরঝুর করে চুল পড়ছে। না, গ্রামে আর না।
মামুনকে বলতেই সে অবাক হয়ে বলল, মাত্র একসপ্তাহ শেষ হয়েছে। ছুটি নিয়েছি দু’সপ্তাহের। বাকী সময়টা...
তানিয়া প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, অন্য কোথাও চলো। এখানে আর ভালো লাগছে না। চলো এই কদিন কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসি।
মামুন কিছুক্ষণ ভেবে রাজী হলা।
তারা কক্সবাজার গেল। সমুদ্রতীরে ছুটাছুটি, উত্তাল ঢেউয়ে ধাপাধাপি, বার্মিজ মার্কেটে ঘোরাঘুরি এবং সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে কোন ফাঁকে যে পাঁচদিন কেটে গেল! ষষ্ঠদিনে তারা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হল।
বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে রাত প্রায় এগারটা। সবার চোখে ঘুমঘুমভাব। মামুন তালা খুলতে গিয়ে থমকে দাড়াল। মনে হচ্ছে তালায় কোনো সমস্যা হয়েছে। চাবি ঘুরছে কিন্তু খুলছে না। সে কয়েকবার চাবি ঘুরিয়ে একটু জোরে টান দিল। হুট করে তালা খুলে গেল।
তারা ড্রইংরুমে ঢুকল। সুইস টিপে বাতি জ্বালাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। পুরো রুম লন্ডভন্ড। দেয়ালের এলইডি টিভিটা নাই। কম্পিউটার টেবিলটা খালি। সেখানে একটা ল্যাপ্টটপ ছিল। আর কি কি গায়েব হয়েছে কে জানে?
তারা দ্রুত বেডরুমে ঢুকল। ষ্টীল আলমারিটা খোলা। তানিয়ার মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। শাড়িগুলো ঠিকঠাক আছে কিন্তু একরত্তি স্বর্নও নাই। দশভরির মতো গয়নাগাটি ছিল। তানিয়ার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। সে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়ল।
মানুষের জীবন এমন বেঁচে থাকার প্রয়োজনে তাকে আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে হয়। যত বড় ক্ষতিই হোক, তাকে দৈনন্দিন জীবন শুরু করতে হয়। মামুনও শুরু করেছে। এবং আগের চেয়ে অফিসে বেশি সময় দিতে শুরু করেছে। প্রায়ই তার ফিরতে ফিরতে রাত হয়।
একদিন রাত প্রায় দশটা। তখনো মামুন ফেরেনি। তানিয়া চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। মোবাইলও বন্ধ। সে কয়েকবার অফিসে কল দিল। রিং হয় কেউ ধরে না। এতরাতে ধরারও কথা না। সে অস্থির হয়ে ভাবছে কি করা যায়। এমন সময় মামুন এলো। ক্লান্ত ও বিষন্ন। তানিয়া চমকে উঠল।
এত দেরী! কি হয়েছে তোমার?
কিছু না।
এমন দেখাচ্ছে কেন?
বললাম তো কিছু হয়নি।
মামুন হাতমুখ ধুয়ে ড্রইংরুমে বসতেই তানিয়া খাবার নিয়ে এলো। সে অন্যমনস্কভাবে খাবার খাচ্ছে। তানিয়া তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার উপর দিয়ে সুনামী বয়ে গেছে। কি সমস্যা আমাকে বলা যায় না?
মামুন নিরবে খাওয়া শেষ করল। তারপর সোফায় বসে বলল, অফিসে একটা ঝামেলা হয়েছে। একপার্টি এককোটি টাকা লোন নিয়ে ভেগে গেছে। তাকে খুঁজতে বের হয়েছিলাম।
মর্টগেজ আছে না?
মর্টগেজের কাগজপত্র ভূয়া। অন্যের সম্পত্তি নিজের বলে চালিয়েছে। উকিলও ধরতে পারেনি। হয়তো তাকে টাকা খাওয়ানো হয়েছে।
তোমার এত চিন্তা কেন?
লোনটা আমার হাত দিয়ে স্যাঙ্কশন হয়েছে। আমিও ফেঁসে গেছি।
তানিয়া উদ্বিগ্নস্বরে বলল, এখন কি হবে?
মামুন মাথার পেছনে দু’হাত নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, জানিনা কি হবে! পার্টিরই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
মামুন প্রতিদিন পার্টির খোঁজে বের হয়। কিন্তু কিছুতেই তার হদিস বের করতে পারে না। সারাদিন ঘুরে সে পার্কে বসে থাকে। বাদাম-চানাচুর খায়। সন্ধ্যা হলে গম্ভীরমুখে বাসায় ফিরে।
তার এই ব্যর্থতায় এক মেঘলা দুপুরে তার চাকরিটি চলে গেল।
পাঁচ বছর কেটে গেছে। এই পাঁচ বছরে মামুনের জীবনে বড় রকমের ওলটপালট হয়েছে। চাকরি চলে যাওয়ার পর নানা জায়গায় ঘুরাঘুরি করে সে একটা মার্কেটিং এ চাকরি নেয়। ফ্ল্যাট বাসা ছেড়ে একতলা একটা বাড়িতে উঠে আসে। তাদের দিন কোনোরকম চলে যায়। কিন্তু বড় রকমের যে পরিবর্তন হল- তাদের শরীর থেকে অতিরিক্ত মেদ ঝরে গেছে। ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয় না। রনির ভিডিও গেম নেই। সে এখন বন্ধুদের সাথে ছুটাছুটি করে ক্রিকেট খেলে। তানিয়া সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিজের কাজ নিজেই করে। বুয়া রাখার ক্ষমতা তাদের নেই। ছবি দেখার জন্য ল্যাপটপও নেই। তবুও শখ থেকে যায়। কোনো কোনো দিন তারা সিনেমা হলে নাইট শো দেখতে যায়। গভীর রাতে সিনেমা শেষে তারা রাস্তায় নামে। তখন হয়তো চাদ তার সর্বশক্তি দিয়ে জোসনা বিলিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার সোডিয়াম বাতি এবং জোসনার আলোতে চারদিক রহস্যময় মনে হয়। চেনা জগতকেও কেমন অচেনা মনে হয়। তারা ফুঁচকা খায়। লাল চা খায়। তারপর রিক্সায় চড়ে বসে। তীব্র বাতাসে তানিয়ার খোলা চুল উড়ে। মামুন জ্বলজ্বলে তারার দিকে তাকিয়ে ভাবে এই জীবনই বা খারাপ কী!!