তোতা মিয়া সকাল থেকে উঠানে বসে আছে। তার হাতে লম্বা একটা পাটকাঠি। সে তার থালা থেকে উঠানে মুড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছে। দুটো কাক ঘুরে ফিরে সেই মুড়ি খুটিয়ে খুটিয়ে খাচ্ছে। সে পাটকাঠি নাড়িয়ে মুখে বলছে- হুস... হুস...।
কাক দুটো দুরে সরে যায়। কিছুক্ষন পর আবার এসে বসে। তোতা মিয়া বিমল আনন্দে হেসে উঠে। সে মনে মনে ভাবল, কাক পক্ষী হিসেবে খারাপ না। যা পায় তাই সোনামুখ করে খায়।
সে একটা একটা করে মুড়ি ছুড়ে দেয়। কাকদুটো কাড়াকাড়ি করে খেয়ে ফেলে।
আহারে! কাকদুটো বোধহয় ক্ষুধার্ত।
সে থালার সবগুলো মুড়ি উঠানে ছুড়ে দেয়।
খা, তাড়তাড়ি খা।
কাকদুটো ঝাপিয়ে পড়ে গবগব করে খেতে থাকে।
তোতা মিয়া আশেপাশে ভয়ে ভয়ে তাকায়। খালেকের মা এলো কিনা। সে দেখলে হৈ-চৈ শুরু করবে। খনখনে গলায় বলবে, আপনে কাউয়ারে মুড়ি খাওয়াইতাছেন? এমুন মানুষ সাত জন্মেও দেখি নাই। নিজেই খাইতে পায় না!
তাকে চুপ থাকতে হবে। কিছু বলা যাবে না। খালেকের মা তিনবেলা ভাত দিয়ে যায়। তাকে রাগালে কপালে খাওয়া জুটবে না।
কাকদুটো মুড়ি খেয়ে গাছের ডালে বসে আছে। এখনো পুরোপুরি চলে যায়নি। কৃতজ্ঞতাবোধ আছে।
তোতা একদৃষ্টিতে কাকদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে। কি মিচমিচে কালো পক্ষী! একজন আরেকজনের ঠোটে ঠোকাঠুকি করছে। এরা কী স্বামী-স্ত্রী? কোনটা মেয়ে কাক? সে অনেকক্ষন তাকিয়ে থেকেও ধরতে পারে না। কোনো মেয়ে কাক যদি ধবধবে সাদা হতো, কাক সমাজে তার অবস্থান কি হতো? ঠোকরায়ে তাড়িয়ে দিতো? নাকি আলাদা খাতির করত? তার দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত, তার কন্ঠে কা কা শোনার জন্য তার আশেপাশে ঘুরঘুর করত? মানুষের ক্ষেত্রে যেমন হয়। কোনো মেয়েছেলে একটু ফর্সা হলে সব জায়গায় তার খাতির। দেওয়ান গাজীর মতো পয়সাওয়ালা লোকের ছেলেরা পর্যন্ত ইজ্জত করে।
সেবার ‘হালখাতার’ দিন দেওয়ান গাজী পুরো গ্রামের লোকজনকে দাওয়াত করে খাওয়াল। তার মতো কামলারা মাঠে লাইন ধরে বসে গেছে। সে মরিয়মকে নিয়ে মাঠে বসতেই দেওয়ান গাজীর ছেলে রমজান গাজীর চোখ পড়ল মরিয়মের ওপর। সে টকটকে একটা লাল শাড়ি পড়ে এসেছে। দুধে আলতো গায়ের রঙ আর সেই শাড়িতে তাকে আগুনের গোলার মতো লাগছিল।
রমজান গাজী বলল, তোতা বিবিরে নিয়া আইছস? তোরা ঘরে গিয়ে বস। তুই আমার আপনার লোক।
তোতার মন খুশিতে ভরে উঠে। শত শত মানুষের চোখের সামনে দিয়ে সে গাজীর ঘরে গিয়ে বসে। মরিয়ম মাটির দিকে তাকিয়ে তার পেছনে পেছনে আসে। বাইরে বের হলে সে সবসময় মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তখন তার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় সে সবার চোখের চাহনী দেখতে পাচ্ছে। এজন্য সে হয়তো মনে মনে হাসে। সেই হাসি তার মুখ দিয়ে নয়, সারা শরীর দিয়ে বের হয়। তোতা তখন তাকে চিনতে পারে না। তার গায়ে গা লেগে থাকলেও মনে হয় এই মরিয়মকে সে চেনে না।
সেইদিন তোতা রমজান গাজীর খাতির করার রহস্য বুঝে নাই। এখন বুঝে। মরিয়ম যদি কয়লার মতো কুচকুচে কালো হতো, রমজান গাজী ফিরে তাকাত? মানুষ বড়ই রূপভক্ত প্রানী।
তোতা মিয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। তার উঠানের সামনের রাস্তা দিয়ে আজগর যাচ্ছিল। সে হাক দেয়, তোতা ক্ষেতে যাবি।
সে উদাস চোখে তাকায়। ভাবলেশহীন মুখে না সূচক মাথা নাড়ে। আজগর হনহন করে চলে যায়। তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে ভাবে-এতো খেটে ফায়দা কি? একবেলা খেটে যদি তিনদিন খাওয়া যায়, কি দরকার তিনদিন খাটা।
জীবনে সে কম খেটেছে! লোহার মতো পেটানো তার শরীর। সূর্য উঠার আগেই ক্ষেতে চলে যেত। সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা খাটত। মাজু মাতব্বর প্রায়ই বলতেন, তোতা থাকলে আমার ক্ষেতে আর কামলার দরকার নাই। ও একাই একশ।
এত খেটে ফায়দা কি হয়েছে? খাটুনির আগেও সে যেমন ছিল, খাটুনির পরও সে একই আছে। একলা মানুষ! একলা মানুষের জন্য এতো খাটা কি দরকার! সে খাটাখাটুনি ছেড়ে দিয়েছে।
বেলা বাড়ছে। বসে থাকতে থাকতে তার ঝিমুনির মতো আসে। হঠাৎ চেচামেচিতে তার ঝিমুনীভাব কেটে যায়। বিশাল আকৃতির একটা দাতাল শুকর গোত গোত করতে করতে তার প্রায় শরীর ঘেষে চলে গেল। হিন্দু পাড়ার লোকজন লাঠি সড়কি হাতে শুকরটাকে ধাওয়া করছে। সে লাফিয়ে উঠে। তার বুকটা এখনো কাঁপছে। অনেকদিন আগে তার বুক এরকম কেঁপে উঠেছিল।
দিনটা ছিল মেঘলা। ক্ষেত থেকে সন্ধ্যায় ফিরে দেখে ঘরদুয়ার সব খোলা। সে উঁচু গলায় ডাকতে শুরু করল, মরিয়ম, মরিয়ম , ওহ মরিয়ম, ওহ মনার মা।
কোনো সাড়া নেই। অন্যান্য দিন ক্ষেত থেকে ঘরে ফিরলে মরিয়ম দৌড়ে আসে। কলতলায় গিয়ে পানি চেপে দেয়।
ভর সন্ধ্যায় গেল কই এরা! ঘরদুয়ার খোলা রেখে...
সে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। ঘর খাঁ খাঁ করছে। কেউ নেই। তার বুকটা কেঁপে উঠল।
এরপর দশ বছর কেটে গেছে। এই দশ বছরে এমন কোন জায়গা নেই, সে মরিয়মকে খুঁজে নাই।
কেউ এসে যদি বলত- তোর মরিয়মকে পলাশপুর গ্রামে দেখলাম। সে নাওয়া খাওয়া ভূলে পলাশপুরে ছুটে যায়। কিন্তু গিয়ে দেখে মরিয়মের নামগন্ধ নাই।
আবার কেউ এসে হয়তো বলল, তোতা তোর ভাগ্যটাই খারাপ। মরিয়ম রমজান গাজীর সাথে ঘর করছে। একটা মেয়েও হয়েছে। তারা আছে ঢাকার আগারগাঁও বস্তিতে। সে তাড়াহুড়ো করে ঢাকায় ছুটে। আগারগাঁও বস্তি তন্ন তন্ন করে খুঁজে। সবাই আছে। মরিয়ম নাই। সে যেন হাওয়ায় মিশে গেছে।
গ্রামের মূরব্বীরা কেউ কেউ শান্ত¡না দিয়ে বলেন, মরিয়মের খোঁজ নিয়ে আর কি করবা? তার কথা ভূলে যাও।
মিয়াভাই এইডা কুনো কথা কইলেন? সাথে আমার পোলা আছে না।
পোলা থাকলে বউ যায় কেমনে? তুমি জোয়ান মর্দ লোক। বউরে পিটাইতা?
মিয়াভাই আল্লাহর কসম! হের গায়ে আমি কুনোদিন ফুলের টোকাও দেইনি।
ভাত কাপড়ে কষ্ট দিতা?
আমরা তিনবেলা খাইয়া পইড়া ভালোই ছিলাম।
শুধু মোটা চালের ভাত- কাপড় দিলেই হয় না। সৌখিন জিনিসপত্র কিন্না দিতে হয়। মেয়ে ছেলের মন। কিসে মজে বুঝতে হইব।
তোতা মিয়া চুপ করে থাকে। আগুনের মতো রূপসী মেয়েছেলের মন বোঝা বড়ই শক্ত! কখন কি যে পছন্দ করে তার ঠিক ঠিকানা নাই। চলে যাবার কিছুদিন আগেও একটা সিল্কের শাড়ির জন্য সেকি অভিমান!
কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলেছে, তুমার সব ভালোবাসা মুখেই। কতদিন ধইরা একটা রাজশাহী সিল্ক আনতে বলতাছি। আমার একটা কথা যদি শুনতা!
আনমু। আনমু। এই মাসে হাত একদম খালি। দেখি সামনের মাসে।
দেখতে দেখতে তো তিন মাস পার হইয়া গেল।
তোতা মিয়া জবাব দেয় না। মনার জন্মের পর সে টাকা পয়সা হিসাব করে চলে। জীবন থাকতে সে মনাকে ক্ষেতের কাজে লাগাবে না, স্কুলে দিবে। মরিয়ম এইসব নিয়ে ভাবে? সাজগোছ করতে পারলেই সে খুশি। সে সবসময় এমনভাবে সেজেগুজে থাকে বাহির থেকে ফিরলে মনে হয়, তার ঘরে কোনো এনজিওর মেয়ে এসেছে। প্রশ্ন-ট্রশ্ন করবে। পার্থক্য তাদের হাতে থাকে কাগজ-কলম, মুখ থাকে গম্ভীর। মরিয়মের মুখে থাকে পান। কথায় কথায় ফিকফিক করে হাসে। তোতার কাছে এই দৃশ্য বড়ই মধুর লাগে!
তোতার বুক চিড়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসে। কতদিনকার কথা অথচ মনে হয় এই তো সেদিন।
প্রথম প্রথম পাড়াপ্রতিবেশী এসে প্রায়ই বলতো, তোতা আরেকটা বিয়া কর। একজন গেছে তাতে কি? কতজনে বউ থাকতেই দু’তিনটা বিয়া করে। তুমি কেমন মর্দ? একজন গেছে তার শোক এখনো ভুলতে পারছ না।
এসব উপদেশ শুনলে তার রাগ লাগে। ইচ্ছে করে বলে- আপনের ইচ্ছা হইলে দশটা করেন। আমি করুম না। কিন্তু সে চুপ থাকে। এরকম কিছু বললে হয়তো বলবে- ‘খালি চ্যাটাৎ চ্যাটাৎ কথা। এজন্যই বউ গেছে গা।’ সে শুধু হাসে। অন্যের অজ্ঞতা দেখলে মানুষ যে ভঙ্গিতে হাসে, সেই ভঙ্গিতে হাসে। পাড়াপ্রতিবেশীদের এসব অনুরোধও একসময় কমে আসে।
গত কয়েক বছর ধরে তার সঙ্গী হয়েছে একটা কুকুরছানা।
এক সন্ধ্যেবেলা সে উঠানে বসে আছে। কাই কাই করতে করতে কুকুরছানাটা ছুটে এল। ওর সাড়া গায়ে গরম মাড়। কেউ হয়তো ছুড়ে মেরেছে। সে কুকুরছানার পিঠ থেকে মাড় পরিষ্কার করতে করতে বলল, কিরে কে তোর এই অবস্থা করেছে? কার হাড়িতে মুখ দিয়েছিলি?
কুকুরছানাটা হয়তো তার কথা বুঝতে পারল। সে দু’বার কুই কুই করে থেমে গেল। কি বলতে চাইল কে জানে? ধা করে তার ছেলের কথা মনে পড়ল। মনা তখন কথা বলতে পারে না। মরিয়ম তেল ডলে রোদে বসিয়ে রেখেছে। ওর সামনে দিয়ে তাদের পালা হাঁস বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছিল। মনা খপ করে একটা বাচ্চা ধরে বসে। মা হাঁসটা তেড়ে এসে ওর হাতে ঠোকর বসিয়ে দেয়। মনা অসহায়ভাবে কাঁদতে থাকে। কুকুরছানাটাও অসহায়ভাবে কাঁদছে। সে কুকুরছানাটার প্রতি প্রচন্ড মমতা অনুভব করে। কলের ঠান্ডা পানি দিয়ে ওর পিঠ ধুয়ে দিল।
এরপর থেকে কুকুরছানাটা তার পিছু ছাড়ে না। সে যেখানে যায় কুকুরছানাটা তার পিছু পিছু যায়। সে যা খায় খায় ওকে দিয়ে খায়। একটা রুটি থাকলেও অর্ধেক দিয়ে খায়। অনেক সময় সে কাজে যায় শুধু নিজের খাওয়ার জন্য না, ওর খাওয়ার জন্য। দেখতে দেখতে কুকুর ছানাটাও বেশ বড় হয়ে উঠল।
একবার খুব ভোরে কাঁশতে কাঁশতে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে অভ্যাসবশত ডাকল, মনার মা, মনার মা।
খোলা জানালা দিয়ে কুকুরছানাটা লাফ দিয়ে ভেতরে ঢুকল। তার পাশে বসে গা শুকতে লাগল এবং ক্ষনে ক্ষনে তার মুখের দিকে তাকাল। যেন বলতে চাচ্ছে-তোমার খারাপ লাগছে?
সেই থেকে তোতা মিয়া কুকুরছানাকে মনা বলে ডাকতে শুরু করল।
কিছুদিন যাবত তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। রাত হলে বেশ কাশি হয়। তেমনভাবে কাজও করতে পারে না। ক্ষেতে কাজ করতে গেলে কয়েকবার বিশ্রাম নিতে হয়। ওকে বারবার বিশ্রাম নিতে দেখে মাজু মাতব্বর একদিন বললেন, তোতা তুই তো বুড়ো হয়ে গেছিসরে। গাল-মুখ ভেঙ্গে গেছে। তোরে আর ক্ষেতের কাজে রাখা যাইব না। বয়স কত হইল?
জি হুজুর পয়তাল্লিশ।
টাকাপয়সা কিছু জমাইছস?
জ্বেনা। জমায় কি হইব? খাওনের লোক নাই।
নিজের জন্য জমাবি। যার কেউ নাই, তার টাকাই তো আশ্রয়।
তোতা এসব নিয়ে ভাবে না। একা মানুষ এত ভেবে কি হবে? একা থাকতে তার খারাপও লাগে না। শুধু রাত হলে অস্থির অস্থির লাগে। কোনো কোনো রাতে একেবারেই ঘুম হয় না। দীর্ঘরাত একা জেগে থাকা বড়ই কষ্ট! তখন সে দরজা খুলে বারান্দ্রায় আসে। চাঁদের আলোতে উঠান ফকফক করছে। কুকুরছানাটা গুটিশুটি মেরে বারান্দ্রার পাটিতে ঘুমায়। সে ওর পাশে গিয়ে বসে।
মনা ঘুমাস? ও মনা...
মনার কোনো সাড়া নেই। সে আঙ্গুল দিয়ে ওর পেটে খোঁচা দেয়। সে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে। অদ্ভুত চোখে তাকায়। তারপর পা দুটো সামনে বাড়িয়ে একটা বুকডন দেয়।
মনা দেখছস কত্ত বড় চাঁন উঠছে। চাঁন্দের আলোতে বাইরে থাকন ঠিক না। পরীতে ধরে।
মনা চুই চুই শব্দ করে। যেন তার কথা বুঝতে পারছে।
বুঝছস প্রথম প্রথম উঠানে পাটি বিছায় আমরাও বইসা থাকতাম। তখন মরিয়মরে পরীতে ধরত। তখন বুঝি নাই। যেই মানুষ একটার বেশি কথা কয় না, সেই মানুষ হড়বড় কইরা কথা বলে। আর কী সব আজব কথা! শুনবি?
এ্যই চান্দের আলোর দিকে অনেকক্ষন তাকায় থাক।
ক্যান?
থাকই না। তখন তুমার চউখও চান্দের মতো হইব।
দূর পাগলী।
মরিয়ম খিল খিল করে হাসে। হাসি আর থামতেই চায় না।
আমার চউখের দিকে তাকায় দেখ।
তোতা মরিয়মের চোখের দিকে তাকায়। সত্যি সত্যি তার চোখ চাঁদের মতো জল্বজ্বল করছে।
এখনো পূর্ণ চাঁদ উঠলে সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় মরিয়মের চোখ। চাঁদ দেখেই রাত পার করে দেয়ার চেষ্টা করে।
আজকাল তার ঘুমই হয় না। শুইতে গেলে কাশির তোড় বাড়ে। সাথে কাঁপুনি দিয়ে জ¦র।
আজও বোধহয় ঘুম হবে না। সে অনেকক্ষন কাশল। কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে আসে। যক্ষ্মা হয়েছে কিনা কে জানে? বুকে গ্যার গ্যার শব্দ হচ্ছে। শেষ রাতের দিকে তার তন্দ্রার মতো হল। কিন্তু ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন দেখে সে ধড়ফড় করে উঠে বসল।
মোটা কালো এক লোক মরিয়মকে লাকড়ি দিয়ে সমানে পেটাচ্ছে। মনা ধরতে যাচ্ছে। লোকটি তাকে ছুড়ে মারল। মনা চিৎকার করে উঠল।
তার বুক হাপড়ের মতো উঠা নামা করছে। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। সে মুখ হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার মনে হচ্ছে মনা এখনো কাঁদছে। একটু স্বাভাবিক হতেই বুঝল-কুকুরছানাটা বারান্দ্রায় বসে অদ্ভুত গলায় আওয়াজ করছে। মনে হচ্ছে কোন মেয়ে মানুষ কাঁদছে।
সে চেঁচিয়ে বলে-চুপ কর মনা।
মনা কিছুক্ষন থেমে আবার আওয়াজ শুরু করে। ভয়ে তার গা ছমছম করে। সে বিছানা থেকে উঠে বসে। বাকী রাতটা বোধ হয় বসেই কাটাতে হবে।
মনা আবার বিলাপ করছে। এট অলুক্ষনের চিহ্ন কিনা কে জানে! নাকি ওর আজ পেট ভরেনি? সে আওয়াজের ধরন বোঝার চেষ্টা করছে। নাহ, এটা ক্ষিধে লাগার আওয়াজ না। তখন ‘তুই’ ‘তুই’ জাতীয় শব্দ করে। দীর্ঘদিন একসাথে থাকার কারনে সে গলার আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারে। আজকেরটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এর মানে কি?
এর দু’দিন পর তোতামিয়া প্রবল জ্বরে পড়ল। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে জ্বর। সাথে কাশি। প্রতিবেশী খালেকের মা প্রতিদিনের মতো খাবার দিয়ে গেছে। সে খাবার মুখে দিতেই বমি করে ফেলে দিয়েছে। কাশতে কাশতে ভোর রাতের দিকে তার শরীর নিস্তেজ হয়ে এলো।
দুই
ভোর থেকেই মনা বেশ উচ্চস্বরে ঘেউ ঘেউ করছে। এমন স্বরে সে কখনো ঘেউ ঘেউ করেনি। প্রতিবেশীরা ছুটে এলো। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। তোতা মিয়া দরজা খুলছে না। তারা দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকল। তোতা মিয়ার মুখে মাছি ভনভন করছে। অনেক আগেই প্রানবায়ু তার দেহ ছেড়ে চলে গেছে। মনা ছুটে এলো। তার নাক শুকল। তারপর ধীরে ধীরে হেঁটে ঘরের কোনায় গিয়ে বসে রইল। ওর চোখের দৃষ্টিতে দিশেহারাভাব। জিহ্বা বের করে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে।
যথাসময়ে লাশের জানাজা পড়ানো হল। তারপর ‘কলেমা শাহাদাত’ পড়তে পড়তে খাটিয়া নিয়ে সবাই গোরস্থানের দিকে চলল।
কেউ লক্ষ করল না সবার পেছনে পেছনে মনাও আসছে। লাশ কবরে নামানো হল। শেষ মাটির টুকরো কবরে চাপা দিয়ে গ্রামবাসী বলাবলি করতে লাগল-আহ হা বড় ঠান্ডা মানুষ ছিল! বউয়ের শোকে আর বিয়ে করল না। একা থেকে জীবনটা পার করে দিল। তারপর যে যার বাড়ি ফিরে গেল।
কেউ মনার দিকে ফিরেও তাকাল না। মনা একটা গাছের নিচে চুপ করে দাড়িয়ে ছিল। গ্রামবাসী চলে যেতে সে কবরে কাছে এসে দাড়াল। একদৃষ্টিতে কবরের দিকে তাকিয়ে রইল। কবরকে ঘিরে কয়েকটা পাক খেল। তারপর কবরের সামনে চুপ করে বসে রইল। ধীরে ধীরে কবরের বুকে রাত নেমে এলো। সে নড়ল না। মূর্তির বসে রইল।
এক সপ্তাহ পার হয়েছে। গ্রামবাসী হতভম্ব হয়ে দেখল, মনা কবরখানা থেকে নড়ে না। আশেপাশে ঘুরঘুর করে। আবার কবরের পাশে এসে বসে থাকে। যেন সে কবর পাহাড়া দিচ্ছে। কোন পাখি যদি কবরের ওপরে এসে বসে, সে বিকট শব্দে ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করে। পাখি ভয়ে উড়ে চলে যায়। সে গম্ভীরভঙ্গিতে কবরে চক্কর দেয়।
এভাবে অনেকদিন কেটে গেল। একদিন গ্রামবাসী দেখল, কবরের পাশে মনা মরে পড়ে আছে। অনেকে অনেক কথা বলল। কেউ বলল, মনিবের শোকে মরে গেছে। কেউ বলল, না খেয়ে মরে গেছে। কেউ বলল, সাপে কেটেছে। তুচ্ছ একটা প্রাণীর মৃত্যু রহস্য নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামাল না।
গল্পটি ’নবজীবন’ গল্পগ্রন্থ থেকে নেয়া