বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর বিশিষ্ট মোফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কোন প্রকার অভিযোগপত্র দাখিল ছাড়াই শুধু তদন্তে অগ্রগতি হচ্ছে সরকার পক্ষের আইনজীবীর এহেন বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আদালত বলেছেন, কোন অভিযোগপত্র (চার্জশীট) ছাড়া বিচারের আগেই ৬ মাস ধরে আটক রাখছি। এই অবস্থায় আর কতদিন। অনির্দিষ্টকালের জন্য আমরা তাকে আটক রাখতে পারি না। এরূপ কড়া মন্তব্য করে আদালত তদন্ত কর্মকর্তার কেস ডায়েরি (সিডি) তলব করেছেন। কোন অভিযোগ না থাকার কথা আদালত সরকার পক্ষের কৌঁসুলির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও মাওলানা সাঈদীকে জামিন দেননি। বরং আগামী ১৫ মার্চ তারিখে পুনরায় আদালতে হাজির করার জন্য কারা মহাপরিদর্শকের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মাওলানা সাঈদীর কৌঁসুলি এডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের কোন অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধী বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা হলো শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাচার।
গত ২৯ ডিসেম্বর সর্বশেষ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তদন্ত শেষ করে ফর্মাল চার্জশীট প্রদানের আদেশ দেন। বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গতকাল এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সরকার পক্ষের কৌঁসুলি চীফ প্রসিকিউটর ও অন্যান্য প্রসিকিউটরদেরকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। মাওলানা সাইদীকে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকায় পুরানা হাইকোর্ট ভবনস্থ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নেয়া হয়। ১০টা ৩৭ মিনিটে তাকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। বিচারপতি নিজামুল হক, এ কে এম জহির ও ফজলে কবিরের সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল এজলাসে বসেন বেলা পৌনে ১১টায়। শুরুতেই সরকার পক্ষের কৌঁসুলি প্রসিকিউটর এস হায়দার আলী মাওলানা সাঈদীকে আরো আটক রাখার আবেদনের পক্ষে যুক্তিতর্ক পেশ করেন। তিনি বলেন, পূর্ব নির্ধারিত ১৫ ফেব্রুয়ারিই আমরা তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেছি। তদন্তে অগ্রগতি হচ্ছে। আরো তদন্তের জন্য আরো সময়ের প্রয়োজন। এজন্য মাওলানা সাঈদীকে আটক রাখার সময় বর্ধিত করার আবেদন জানান তিনি। এ পর্যায়ে আদালত হায়দার আলীকে জিজ্ঞেস করেন যে, আপনাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছিল তদন্ত শেষ করে ১৫ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত চার্জশীট দাখিল করার জন্য। এখন আপনারা বলছেন, অগ্রগতি হয়েছে, হচ্ছে। একথা আগের প্রতিবেদনেও বলেছেন। আজও বলছেন, আগামীতেও হয়তো তাই বলবেন। তিনি তদন্ত কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে পারেন এমন কথা বলে ৬টি জিডির কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেই জিডিরই বা তদন্তের অগ্রগতি কোথায়? প্রসিকিউটর এসব প্রশ্নের কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় আদালত বলেন, অগ্রগতি আমরা দেখছি এতটুকু যে আগের রায়ের প্রতিবেদন ছিল ৩ পৃষ্ঠা এবং কয়েকটি প্যারা, এবার দেখছি ১ পৃষ্ঠা একটি মাত্র প্যারা। কোন অভিযোগ আপনারা আনতে পারেননি। এ অবস্থায় বিচারের আগে মাওলানা সাঈদীকে ৬ মাস ধরে আটক রেখেছি। আর কতদিন লাগবে? এভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য কাউকে আটক রাখা যায় না। আরো আটক রাখার পক্ষে আপনারা কোন গ্রহণযোগ্য যুক্তিও দেখাতে পারছেন না। বিচারে স্বচ্ছতা আনতে হলে আমাদেরকে আইন অনুসারে আগাতে হবে। তদন্ত সংস্থা ক'টি সিজার লিস্ট করেছে তা কি বলতে পারবেন? এ পর্যায়ে হায়দার আলী বলেন, তদন্ত সংস্থা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে। প্রায় ২০ মিনিট এভাবে হায়দার আলীর বক্তব্য ও আদালতের জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। তবে আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেন পূর্ণাঙ্গ চার্জশিট দাখিল না করা এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখার আবেদনে।
সরকার পক্ষের যুক্তিতর্কের পর বেলা ১১টা ৫ মিনিটে মাওলানা সাঈদীর পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট তাজুল ইসলাম যুক্তিতর্ক পেশ শুরু করেন। তিনি বলেন, প্রতিপক্ষ মাওলানা সাঈদীকে আটক রাখার পক্ষে কোন যুক্তিই দেখাতে পারেনি। ফর্মাল চার্জশীট দাখিল করার কথা থাকলেও তারা তা না করে টিকটিকি দেখিয়ে কুমিরের বাচ্চা দেখানোর গল্প শুনাচ্ছেন। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি অগ্রগতি রিপোর্টের কপি দাবি করলে আদালত তা দেয়ার নির্দেশ দেয়।
এডভোকেট তাজুল ইসলাম ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত যুগোস্লাভিয়া, রুয়ান্ডাসহ বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নজীর উপস্থাপন করে বলেন, অসংখ্য মানুষকে আটক করার পর তাদের জামিন দেয়ার নজীর আছে। এই আদালত সেই পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে। আদালত এ সময় রায়ের ফটোকপি চাইলে তাজুল তা সরবরাহ করলে আদালত বলেন, আপনি এরূপ যত কাগজপত্র পাবেন আমাদেরকে কপি সরবরাহ করবেন। এটা তো প্রযুক্তির কল্যাণ। আমরা যেকোন শর্তে জামিন নিতে রাজি আছি। মাওলানা সাঈদী যুদ্ধাপরাধী না হলেও তাকে যুদ্ধাপরাধী বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা হবে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যা। এছাড়াও তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত। তার শরীরে দুটি রিং লাগানো আছে। তিনি ৩৫ বছর ধরে ডায়াবেটিস রোগেও আক্রান্ত।
এ পর্যায়ে প্রসিকিউটর হায়দার আলী আবারো দাঁড়িয়ে বলেন, আসামী পক্ষ ইন্টারনেট থেকে যে কাগজ আদালতে দিয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়াও অগ্রগতি রিপোর্টের কপি অফিস দিতে ভুল করেছে। জবাবে আদালত বলেন, আমরা অনুমোদন দিয়েছি বলেই প্রতিপক্ষ ইন্টারনেটে প্রাপ্ত কাগজপত্র আমাদেরকে সরবরাহ করেছেন। অন্যদিকে আপনার অফিস কোন ভুল করলে প্রতিপক্ষ তো তার লাভের সুযোগ নেবেই।
বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে আদালত আদেশ প্রদান শুরু করেন। ১০ মিনিটের আদেশে প্রসিকিউশন পক্ষকে (সরকার পক্ষ) আগামী ১৫ মার্চ তদন্ত কর্মকর্তার কেস ডকেট বা কেস ডায়েরি আদালতে উপস্থাপনের নির্দেশ দেন। একইসাথে কারা মহাপরিদর্শকের প্রতি ঐদিন মাওলানা সাঈদীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়।
পরে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, আদালত আটকাদেশ বর্ধিত করেনি। এটা যেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাই আমরা বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নজীর উপস্থাপন করে যুক্তি দেখিয়েছে যে, এই আদালত এ পর্যায়ে মাওলানা সাঈদীকে জামিন দিতে পারে।
সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে সরকার পক্ষের চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু বলেন, কেস ডায়েরি কেবলমাত্র আদালতই দেখাতে পারে। তিনি বলেন, আমরা আশ্চর্য হলাম প্রতিপক্ষ পুলিশের জিডির কপি চুরি করে এনে আদালতে দিয়েছে। এটা আইনসিদ্ধ নয়। আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আমরা শুধু আটকাদেশ বর্ধিত করারই আবেদন করি নাই, অগ্রগতি প্রতিবেদন দিয়েছি। তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ইন্টারনেটের কাগজ ফটোকপি করে আদালতে দেয়া বৈধ নয়।