somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভালো থেকো গুপিবাগ, ভালো থেকো রামকৃষ্ণ মিশন রোড

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কিছু রাস্তা দিয়ে আমরা প্রতিদিন চলাফেরা করি, হেঁটে বেড়াই। কিছু রাস্তা দিয়ে আমরা প্রতিদিন স্কুল কলেজ অফিসে যাই, আবার দিনান্তে বাসায় ফিরি। কিছু রাস্তা আমাদের নিয়ে যায় আমাদের পছন্দের কোন মানুষের কাছে, পছন্দের কোন জায়গায়। কিছু রাস্তা এই দৈনন্দিন জীবনের ক্রমাগত ব্যাবহারের ফলেই অঙ্গাঅঙ্গিভাবে মিশে যায় আমাদের অস্তিত্বের সাথে। কিছু রাস্তা আবার হুট করেই অপাংক্তেয় হয়ে যায় আমাদের জীবনে।

গুপিবাগ – রামকৃষ্ণ মিশন রোড ছেড়ে আসার একমাস পূর্ণ হল প্রায়। মুগদা বিশ্বরোড থেকে টিটিপাড়া, মতিঝিল হয়ে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা ছায়ানটে যাই এখন, খুব উৎসাহ নিয়ে টিটিপাড়া রেলগেটের দিকে তাকিয়ে থাকি। অফিস শেষে বাসে টিটিপাড়া রেলগেটে নেমে বিগত দুই বছর হেঁটে হেঁটে গুপিবাগ রেলগেট সংলগ্ন আমার বাসায় ফিরতাম।

গুপিবাগে বাসা ভাড়া নেবার পর থেকেই এই রেলগেট ছিল আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দিনের মধ্যে পাঁচ – সাতবার বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে ছুটে যেত দানবাকৃতির এক একটি ট্রেন। প্রথম প্রথম পথের পাঁচালীর অপুর প্রথম ট্রেন দেখার অভিজ্ঞতার সাথে তুলনা টেনে রোম্যানটিসাইজ করার চেষ্টা করতাম। পরে বিরক্তি ধরে গিয়েছিল কানে তালা লাগানো আওয়াজে। তারপর তো অভ্যাসই হয়ে গিয়েছিল। ‘শখের বাড়ি’ – বাড়ির নাম খুব ঢকের রাখলেও বাড়িওয়ালী ছিল এক মহা খাণ্ডারনি। তার প্যাঁড়ায় পড়ে একবার রাতে বাড়িতে ঢুকতে পারি নি একটু বেশী দেরী হয়ে যাওয়ায়। সে আলোচনা না হয় বাদই দিই। ফেলে আসা জায়গার ভালো দিকগুলিরই স্মৃতিচারনা হোক।

তো এই রেলগেট ছিল প্রায় সমগ্র বাংলার এক খণ্ডিত রূপ। সবসময় সবরকম লোকের ভারে গিজগিজ, ন্যুব্জ। হাটবাজার বসে গেছে রেললাইনের দু’পাশে। দৈনন্দিন জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় হেন জিনিস নেই যা এই রেললাইনের দু’ ধারে পাওয়া যেত না। গভীর রাত পর্যন্ত বাল্ব কিংবা হ্যালোজেন বাতির আলোতে কেনাবেচা চলতো। রেলগেট আমার বাসার পাশে এসে যেখানে শেষ হত, সে মোড়েই ছিল একটি হালিমের দোকান এবং সংলগ্ন চায়ের টং। সিগারেটের অভ্যেস নেই। নান দিয়ে একবাটি হালিম খেয়ে - চিনি ছাড়া এক কাপ দুধ চা, সাথে দুটো নোনতা বিস্কুট ছিল অফিস থেকে ফিরে প্রতিদিন সন্ধ্যার বাঁধা নাস্তা। বর্ষার দিন এই রেলগেটের নীচ থেকেই পুরো রাস্তায় জমে যেতো হাঁটু পানি। তা এড়াবার জন্যে কতরকমের ফন্দিফিকির! কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে হাঁটতে গিয়ে রেললাইনের ওপর একবার ট্রেনের নীচে প্রাণ খোয়াতে খোয়াতে বেঁচে গেছি।

ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টালে হয়তো টেনে টুনে দুটো বছর দেখাবে এই গুপিবাগ – রামকৃষ্ণ মিশন রোডে থাকার সময়কাল। কিন্তু এই অল্প সময়েই জীবনে ঘটে গেছে বেশ বড় কিছু ঘটনা, ভাড়াকৃত ফ্ল্যাটটি সাক্ষী হয়েছে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনার। ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকে শিক্ষকতা ছেড়ে ইষ্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করলাম, ঢাবির চারুকলায় খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পড়ানো শুরু করলাম, নিজের দুটো বইয়ের প্রকাশনা এই বাসায় বসে, ছায়ানটে ভর্তি হলাম , ফের কষে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রেওয়াজ শুরু হল, নিজের কয়েকটা অরিজিন্যাল গান রেকর্ড করলাম এখানে থাকতেই, বাবার একটা অপারেশন হল, নিজেও মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম একবার ২০১৭র শেষ দিকে। ব্যক্তিগত জীবনে প্রচণ্ড রকম অস্থির একটা সময় কাটিয়েছি এখানে।

আমাদের পাশের বিল্ডিং এ সরাসরি পাশের ফ্ল্যাটে যে হিন্দু পরিবারটি থাকতো তারা ছিল প্রথাগত সনাতন ধর্ম্যালম্বী। প্রতি সকাল সন্ধ্যা শঙ্খের আওয়াজের সাথে উলু ধ্বনি, সকাল বেলা বাড়ির কর্তা পুরুষটির বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যপ্রণাম, সন্ধ্যেবেলা বারান্দায় রাখা তুলসি গাছের গোঁড়ায় সন্ধ্যেপ্রদীপ জ্বালানো – এ সবই তারা করতেন সুচারুরূপে, প্রতিটিদিন। এই করতে করতেই ভোরবেলা দেখা হত তাদের বাড়ির কন্যাটির দিকে। মেয়েটি এসে ভক্তি ভরে প্রণাম করতো তুলসি গাছকে। তারপর, সে মুখো হয়েই দু’হাত জড়ো করে প্রার্থনা করতো ওদের ভাষায়। প্রার্থনা শেষে কিছুক্ষণ বারান্দায় পায়চারি করে চলে যেত ভেতর বাড়িতে। ঐ ভোরবেলার সময়টুকু ছাড়া আর কখনো বারান্দায় আসতে দেখি নি তাকে। হয়তো বাড়ি থেকেই নিষেধ ছিল, পাশেই পুরুষমানুষের রুম বলে হয়তো। আত্মসম্ভ্রম ও স্বভাবজনিত লজ্জায় জানালা দিয়ে তাকিয়ে তার মুখদর্শন করা হয় নি কখনো। শঙ্খধ্বনি আর প্রার্থনার আওয়াজেই অনুভব করতাম তার উপস্থিতি। তার এক ছোটভাই ছিল যে আমার সাথে পাল্লা দিয়ে গানা বাজানা করতো গিটার বাজিয়ে। শুরুর দিকে গিটার একদিকে দৌড়াতো, কণ্ঠ আরেকদিকে। বাড়ি ছাড়ার আগে শুনেছিলাম দুটো প্রায় অ্যাডজাস্ট হয়ে এসেছিল।

একদিকে রেলগেট, অপরদিকে – টিকাটুলির মোড় হয়ে এলে বিসমিল্লাহ মসজিদের গলির শেষ মাথায় ছিল আমাদের বাড়িটি। এই যে বিসমিল্লাহ মসজিদ – একটা জুমার নামাজও এর ভেতরে পড়ার সৌভাগ্য হয় নি, এতই সংকীর্ণ ছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে জুমা পড়তে হত। বৃষ্টির দিন দুর্ভোগের শেষ ছিল না।

এ সবকিছুই অনেক পেছনে ফেলে মুগদা গ্রিন মডেল টাউনে নিজেদের বাড়িতে উঠছি আজ একমাস। স্বপ্নের মত একটা জায়গা। গুপিবাগের বাসাটি নিয়ে একটা কমন কমপ্লেন ছিল ঢাকার অন্যান্য সব ভাড়াটের মতই, দিনের বেলাও বাতি জ্বালিয়ে রাখা লাগতো। সূর্যের আলো বারোমাসে কখনোই প্রবেশ করতো না ঘরের ভেতর। সরকারী চাকুরীজীবী মায়ের সারাজীবনের সঞ্চয় খরচ করে বানানো দো’তালা বাড়িতে নিজের রুমে শুয়ে এখন সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, পূর্ণিমার চাঁদের মাতাল করা জোছনা সবই দেখতে পারি, আলহামদুলিল্লাহ। সে সুখস্মৃতির আলোচনা আর একদিন করা যাবে।

আজকাল যে প্রশ্নগুলো প্রায়ই মাথায় ঘোরে, তা হল – এই যে গুপিবাগে ফেলে আসা আমাদের ভাড়া বাসার চার দেয়াল আমাদের এতসব ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে রইলো, দুটি বছরের আমার প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস, চিন্তাচেতনা বিচরণ করে বেড়ালো যে জায়গাটি – সে কি খানিকটা হলেও দুঃখ পেয়েছিল যখন আমরা তাকে ছেড়ে যাই? এই সমস্ত জড়বস্তু, একটা বাড়ি – যেখানে আমি থাকতাম, একটা রাস্তা – যা দিয়ে আমি প্রতিদিন চলাফেরা করতাম , একটা বাস – যাতে করে আমি প্রতিদিন আমার গন্তব্যে পৌঁছুতাম, বাড়ির পাশের একটা দোকান – অথবা একটা বাজার যাতে গলা চড়িয়ে ঝগড়াঝাটি – দরদাম করে নিত্যকার প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনতাম, যে হকারের কাছ থেকে পত্রিকা রাখতাম , যে সেলুনে বসে চুল কাটতাম বা শেভ করতাম – এদের কি মনে থাকবে আমার কথা? কিছুদিনের আন্তরিকতা, কিছুদিন একসাথে থাকা, পরস্পরের সুখ দুঃখের সাথী হওয়া, ফের একদিন কোনদিনই কেউ কাউকে চিনতাম না এমন একটা ভাবে আলাদা হয়ে যাওয়া – এই সব ছোট ছোট বিচ্ছেদ জীবনের ক্ষণস্থায়ীতের মহাদর্শনটিই যেন চোখের সামনে আরও স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলে।

এই রাস্তাগুলো, যারা একদিন খুব আপন ছিল , এখন আর অধিকার নিয়ে যাদের ওপর হাঁটা হয় না – দূর থেকে দেখে অপরিচিত লাগে, এরা যেন ঠিক নিজ নিজ জীবনে থিতু হয়ে যাওয়া প্রাক্তন প্রেমিকাদের মত।

ভালো থেকো বিসমিল্লাহ মসজিদের গলি, ভালো থেকে রামকৃষ্ণ মিশন রোড, ভালো থেকো গুপিবাগ।

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১১:১১
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×