১।
শেক্সপিয়রের উপর কেউ বড় গবেষক হলে তাকে আমরা বিপুল সম্মান - শ্রদ্ধার পাত্র বলে বিবেচনা করি, এদিকে শেক্সপিয়র নিজে তত্ত্বালোচনা দূরে থাক, মহাকাব্য লেখাকেও নিজের ভবিতব্য হিসেবে বেছে নেন নি। লিখেছেন নাটক। জড়িত থেকেছেন তার আমলের সেরা এন্টারটেইনমেন্ট বিজনেসের সঙ্গে। এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে। সৃজনশীল সকল মানুষের অনুধাবনে এটা থাকা জরুরী যে - বিনোদন মাধ্যম কখনোই ফেলনা কোন ক্ষেত্র নয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বয়ান সাহিত্য - গান - সিনেমার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। শুষ্ক, জনবিমুখ তত্ত্বচর্চার চে' তার গুরুত্ব কম নয়। মুলত নিজেকে উৎসাহ দিতে এ বক্তব্য রাখলাম। একইসঙ্গে তাদের জন্যেও, যারা সৃজনশীল, এবং এ ভাবনার সঙ্গে রিলেট করতে পারেন।
২।
বেশীরভাগ মানুষের অন্যেরে নিয়া হিহিহাহা, বা হাসিতামাশার যে প্রয়াস, তার উৎস নিজের জীবন নিয়া ইনসিকিউরিটি, হীনমন্যতা। যারে হাইসা উড়ায়ে দেয়ার চেষ্টা করতেসে, তার তুলনায় নিজের ক্ষুদ্রতার ব্যাপারে ওয়াকেফহালিয়ত। এইটা বুঝার পর, যারা আমারে নিয়া অপ্রাসঙ্গিক হাসিতামাশা করে, পেছনে কথা বলে, আমি তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টিতে তাকানো শুরু করসি।
৩।
অনেকের কাছে তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা থেকে পরিচালিত উপনিবেশ বিরোধী লড়াইটা সিগনিফিকেন্ট। আমার কাছে তারচে অনেক বেশী সিগনিফিকেন্ট এবং শিক্ষণীয় ব্রিটিশ কামানের গোলায় তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা মাটির সঙ্গে মিশে যাবার ঘটনা। শক্ত ইকোনমি, টেকনোলজির দখল, আর প্রোপার প্ল্যানিং ছাড়া স্রেফ আবেগ আর জজবার উপর ভর করে সিদ্ধান্ত নিলে হারবেন তো বটেই, দিনের শেষে আপনি জামাতের একটা ফেসবুক পেইজে পরিণত হবেন। আর ওগুলির উপর দখল থাকলে, দেশভাগের পরেও ডানেবামে ছোটখাটো কিছু ইকোনমিক - কালচারাল কলোনি বানায়ে রাখা সম্ভব।
৪।
আপনি যা বিশ্বাস করেন, যা আপনার আইডেন্টিটি, তার জন্যে আপনি কতদূর লড়াই করতে পারেন? ফুঁকোরে সম্মান করবার একটা কারন এটাও যে - এই ভদ্রলোক নিজের সমকামী পরিচয়ের প্রতি হস্টাইল একটা সমাজের ধূতি ধরে টান দিয়েছিলেন, তাও গবেষণার মাধ্যমে। (এখন পরবর্তী শব্দগুলি সাবধানে চয়ন করতে হবে যাতে ফুঁকোর চিন্তা সম্পর্কীয় আমার জ্ঞানের খামতি উদাম না হয়ে পড়ে)। ধরেন, তিনি একদিকে দেখালেন - যৌনতা নিয়ে এই যে রাখ রাখ ঢাক ঢাক, এইটা পাশ্চাত্য সভ্যতায় এক নতুন আমদানি। তার আমলের চে' দেড় - দু'শো বছর আগেও যৌনতা এতটা ট্যাবু ছিল না ইউরোপে। আবার তিনি এও দেখালেন, এইযে সমাজ আমাদের সারাই করে, আমাদের বৈশিষ্ট্যগুলি কাটছাট করে আমাদের "সহজ - স্বাভাবিক- অন্য দশজনের মতো" একটা জীবন যাপন করতে প্রলুব্ধ করে, স্কুল - কলেজ - ইউনিভার্সিটি - হাসপাতাল - চার্চ, মসজিদ, মন্দিরের মতো বিবিধ সামাজিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা, এসমস্ত প্রতিষ্ঠান একদিকে যেমন ক্ষমতার কেন্দ্রে যে আছে, তার হয়ে সমাজের বাকি অংশের উপর নজরদারী করে, অন্যদিকে যারা ভিন্ন, যারা ব্যতিক্রম, তাদের "বিশেষ" বৈশিষ্ট্যসমূহ কেটে ছেঁটে জবাই করে তাদের সাইজ করে দেয়। এমন না ফুঁকোর সব সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমি (বুঝে বা পুরোপুরি না বুঝে) একমত। এমনও না যে ফুঁকোর লাইফের স্ট্রাগল, আর আমার ২০২১ সালের বাংলাদেশে বসে যে বৌদ্ধিক স্ট্রাগল, তা এক। কিন্তু আমি তার পাগলপনা, সাহস, কর্মমুখীনতা, যেরকমভাবে বাঁচতে চাই, তাকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দানের জন্যে কষ্ট স্বীকার করার আমৃত্যু প্রয়াসকে শ্রদ্ধা করি। ইউভাল নোয়াহ হারারিও, স্যাপিয়েন্সে একই কাজ করেছেন, ভিন্ন ভাবে। মানুষের সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের ক্লেইম / অবস্থান থেকে তার দাবী, যে কোন "যৌনবিকার", বা "ব্যতিক্রমি" যৌন পরিচয়, অন্তত সামাজিকভাবে রাখা উচিৎ না। ধরেন, সমকামিতার কথাই যদি বলি। বা উভমুখীনতা। হারারির স্যাপিয়েন্স পাঠের পর আমি যেটা বুঝেছি, উনিও একই ভাবে হোম স্যাপিয়েন্স নামক এই গোষ্ঠীর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হওয়ার দাবী খণ্ডন করে পৃথিবীর বুকে সবচে নিষ্ঠুর, অবিবেচক, এবং খুনে একটা স্পিসিস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আমাকে আপনাকে। এই তত্ত্বীয় প্রচেষ্টাগুলি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, এবং শিক্ষণীয়, যদি আপনি মাইনরিটি আইডেন্টিটিকে ইস্টাব্লিশ করবার লড়াইয়ে থাকেন।
৫।
ধর্মীয় উগ্রপন্থা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার সবচে যৌক্তিক এবং টেক্সচুয়াল জবাব আসার কথা ছিল লিবারেল এজুকেটেড, সেকুলার মুসলমান ঘরের ছেলেপিলেদের কাছ থেকে। কিন্তু আমরা ক্রমাগত তাঁদের শিখিয়েছি - মার্ক্স, সাত্র, ফুঁকোর পাঠ হচ্ছে আধুনিকতা, কিন্তু ইবন রুশদ, ইবন আরাবি মানে মধ্যযুগীয় পশ্চাৎপদ জ্ঞান; চর্যার পংক্তি, বা সংস্কৃত শ্লোক বলতে পারলে তা বাঙ্গালিয়ানা, কিন্তু কোরআন, হাদিসের লাইন উদ্ধৃত করলে সেটা ভিনদেশী সংস্কৃতির চর্চা; সকাল সকাল ধ্যান বা মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন করলে সেটা স্মার্টনেস, আর নামাজের টাইমে নামাজে দাঁড়ালে সেটা তুলনামূলক খ্যাত একটা কাজ। ফলে উগ্রবাদীদের মুখের উপর - 'লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন' বলার মত ঘিলু বা মজ্জাওয়ালা সেকুলার মুসলিম তরুণ এখন আর নাই।
.
বাংলাদেশী মুসলমান পরিবারে জন্ম নেয়া ছেলেপেলেদের তাঁদের মুসলমান পরিচয় নিয়া আত্মগ্লানিতে ভোগানোর এই প্রচেষ্টা সচেতনে - অবচেতনে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, এবং বাংলার অনলাইন - ব্লগস্ফিয়ারে প্রায় একদশক সক্রিয় থাকার ফলে জানি যে এই প্রচেষ্টা এখনো শতভাগ বিদ্যমান। এই পরিকল্পনা আত্মবিধ্বংসী, এই পরিকল্পনা ব্যাকফায়ার করবেই, এবং এর বিস্ফোরণ এমনভাবে ঘটবে যেইটার আঁচ থেকে বাংলার কোন ঘর অস্পৃষ্ট থাকবে না।
.
কারণ, ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া এই উপমহাদেশের রাজনীতিবিদরা কোনদিন ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা বন্ধ করবে না।
.
কাজেই ধর্মের ব্যাখ্যার সুযোগ রাজনীতিক বা উগ্রপন্থিদের হাতে ছেড়ে দেয়ার বদলে প্রত্যেক মানুষের উচিৎ বেদ - বাইবেল - কোরআন - ত্রিপিটক ঘরের সুউচ্চ আলমিরা থেকে নামায়ে এনে নিজের পড়ার টেবিলে এনে রাখা, নিজ নিজ ধর্মের সঙ্গে একটা ব্যক্তিগত বোঝাপড়া করা, এবং সম্ভব হলে অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে অন্যান্য ধর্মের স্ক্রিপচার ইত্যাদির সঙ্গে স্ব ধর্মগ্রন্থের তুলনামূলক পাঠ করা।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:৪৫