দু'দিন আগে, বৃহস্পতিবার, বেলা সাড়ে তিনটার মতোন বাজে তখন। বসে আছি একথালা ফ্রাইড রাইস হাতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, আর কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের মধ্যে বসবার জন্য বানানো জায়গাটায়। বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি, একদম ভরভরন্ত, জমজমাট ক্যাম্পাস দেখে মন ভরে গেছে। কেবল পরিচিত মুখগুলো জায়গা মতো নেই। লাইব্রেরি, হাকিম চত্বর, ডাকসু - এ জায়গাগুলোকে তো কেবল বিক্ষিপ্তভাবে একেকটা দালান হিসেবে চিনি না আমরা। চিনি তাদের সাথে, সামনে , ভেতরে থাকা মানুষগুলোর সঙ্গে মিলে - মিশে। লাইব্রেরি - লাইব্রেরি কিসে, যদি তার সামনে রিডিং ক্লাব, বা বাংলাদেশ স্টাডি ফোরামের ছেলেপেলেগুলো আড্ডা না দেয়? হাকিম চত্বর - হাকিম চত্বর কীভাবে, যদি তার সামনে নাট্যকলা ডিপার্টমেন্টের বন্ধুগুলোকে আড্ডা দিতে না দেখি? ডাকসু ডাকসু কিসে, যদি তার সামনে ব্যাচ নাইনের ছেলেপেলেগুলোকে না দেখা যায়?
.
তবুও বসে আছি এক থালা ফ্রাইড রাইস হাতে। যেখানে বসেছি, সেখানে জায়গাটুকু জোগাড় করতে কষ্ট হয়েছে। থালা হাতে বসবার মতো জায়গার খোঁজে যে ঘুরপাক খেয়েছি, আমার পেছনে হাড়ের খোঁজে ঘুরতে থাকা কুকুরটা পর্যন্ত ততক্ষণে দিশেহারা হয়ে সঙ্গত্যাগ করে চলে গেছে। হতোদ্যম হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় দু'জন মানুষ খাবার শেষ করে উঠে যাবার পর, সমাজকল্যান ভবনের সামনে গরীবের যে ফোয়ারা, তাতে বসবার মতো জায়গা পেলাম।
.
ফ্রাইড রাইসের সঙ্গে দু'পিস চিকেন উইংস। ভেজিটেবল। কেন এই সেটমেন্যু বেছে নিলাম, জানি না। এখন মনে হচ্ছে, ভুল হয়েছে। এতো বড় চিকেন উইংস তো আগে দেখি নি কখনো। মুরগি না উটপাখির ডানা এগুলো? এতো মানুষের মাঝে বসে নাকে মুখে তেলঝোল ভরিয়ে খাওয়ার মতো অবস্থা নেই; আবার পেটে ক্ষুধা এতো, চিন্তা করার মতো অবকাশও নেই খুব একটা। মাথা নিচু করে শুরু করলাম হাপুস হুপুস খাওয়া।
.
অর্ধেকের মতোন খাবার পেটে ঢুকবার পর, টের পেলাম, মস্তিস্কের চিন্তা করবার সক্ষমতা ফিরে এসেছে। ডানে বামে তাকালাম। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। বেশীর ভাগই কাপল। এতো দিন পর খোলা ক্যাম্পাসে আড্ডা, মন ভরে তা উপভোগ করবার মতো সুযোগও নেই। হাতে সবার পুঁথিপত্র। সামনে পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দিয়েছে, ৮ মাসে বছর শেষ করা লাগবে। আনন্দ করবার সময় কোথায়।
.
বেশ খানিকটা দূরে, আমার ঠিক বিপরীতে, চিন্তাক্লিষ্ট চেহারায় বসে ছিলেন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়সের এক নারী। পায়ে কেডস, গায়ে খুবই সাধারণ সালোয়ার কামিজ। চুল ঝুটি করে বাঁধা, এতো টাইট করে, যেন এই ঝুটি কখনো খোলা হয় না। অথবা খোলা যায় না। কাঁধে কবিদের মতো এক ঝোলা। তবে ঝোলাখানার পেট ফোলা। বোঝা যায় ভেতরে অনেক কিছু আছে। কি কি? জানা সম্ভব নয়। নারীদের কাঁধের ব্যাগ বরাবরই প্যান্ডোরার বাকশো। যা হোক, এই ধরনের নারীরা কখনো কারো দৃষ্টি কাড়ে না। শীত গ্রীষ্মের ঝড় ঝাপটা চেহারার ওপর দিয়ে এতোবার গিয়েছে যে - তাতে লড়াকু ভাব যতই থাক, কমনীয়তার কিছুই বাকি নেই।
.
এই মহিলা আমাদের সবার নজর কাড়লেন।
.
২৮ অক্টোবর, ২০২১ সাল, বৃহস্পতিবার, বেলা তিনটা পয়ত্রিশ মিনিটের দিকে তিনি হেঁটে হেঁটে বসবার বৃত্তাকার স্পেসটার কেন্দ্রে যে ফোয়ারা, তার পাশে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে, বেশ সময় নিয়ে তার সালোয়ারটা খুললেন। শরীরে রইল কি? কেডস ( মুজো ছাড়া), আর কামিজ।
.
ছিটকে সরে গেলো প্রথমে মেয়েদের একটা গ্রুপ। তারপর দু' জোড়া কাপল। ছেলেদের একটা গ্রুপ থেকে মোবাইলে দৃশ্যটি ভিডিও করা আরম্ভ হল। আমি মাথা নিচু করে চুপচাপ, দ্রুতগতিতে খাবার শেষ করবার চেষ্টা করছি। মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকিয়ে অবস্থা বুঝবার চেষ্টা করছি।
.
মহিলাটি তার সালোয়ার ঝর্নার জমা হওয়া পানিতে ডুবিয়ে নিলেন কয়েকবার। টাঙ্গিয়ে দিলেন পরে, ওখানেই, ছোট একটা গাছের ডালে। কবিদের ঝোলার ভেতর থেকে বেরুলো একটা জগিং করবার পাজামা। পড়লেন। এবার সালোয়ার খোলার পালা। খুললেন। দেখা গেলো, শরীরে ব্রেসিয়ার আছে। তবে কি তিনি পুরো মস্তিষ্কহারা? পরিচিত, গতানুগতিক পাগলদের সঙ্গে তো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নিজেকে ধমকাবো, নিন্দা করবো, তিরস্কার করবো - পাগলদের মাঝেও স্টেরিওটাইপ করবার জন্য?
.
তিনি ততক্ষণে হলুদ রঙ্গা একটি গোলগলা টিশার্ট পড়ে জমিয়ে বসেছেন আবার, আগের জায়গায়। সালোয়ার কামিজ ঝুলছে গাছের ডালে। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনে গরীবের ফোয়ারায় পানি আগের মতো উপচে পড়ছে যেন এখানে কিছুই হয় নি। শুধু জলাশয়ের পাশে দাঁড়ানোর জায়গাটায় জলের কিছু ফোঁটা ইঙ্গিত দিচ্ছে, একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার।
.
এতক্ষণ ভালো করে তাকাই নি ভদ্রমহিলার দিকে। এবার তাকালাম। আবারও চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলো খুবই সাধারণ, গতানুগতিক এক মুখ। তাতে লাবণ্য, দীপ্তি, কামনাবাসনা কিছুই নেই। ক্লান্তি আছে হয়তো। হয়তো।
.
আমার খুব করে মনে চাইল তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে - আপা, আমাকে খুলে বলেন আপনার কি কষ্ট। আমার সময় আছে। আমি শুনতে রাজি আছি।
.
এটা রোম্যান্টিক ভাবনা। মনে চায় অনেকেরই। করা হয়ে ওঠে না।
.
মস্তিষ্কে সমস্যা নিয়ে রাস্তাঘাটে যারা ঘুরে বেড়ায় - এদের প্রতি আমি সবসময় আগ্রহ নিয়ে তাকাই। আমার এই দৃষ্টি অবশ্যই গেইজ। অপরাপর করবার, শূলবিদ্ধ করবার গেইজ। তাত্ত্বিক আলোচনা থাক। এসবকিছুর ভিড়ে আমার যে নরম একটা অন্তর, তা সবসময় উত্তর খোঁজে, জানতে চায় - একটা মানুষ কতোটুকু কষ্ট পেলে, মনের ওপর কতোটুকু চাপ অনুভব করলে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে। তারপর আর উঠতে পারে না। কোন সে মানুষ, কারা তারা - যাদের কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে আজ তার, তাদের এই অবস্থা। সেই মানুষগুলো আজ কেমন আছে? তারা জানে - তাদের এই পাগল হয়ে যাওয়া আত্মীয়র কথা? একদা আপনজনের কথা? তাদের কষ্ট হয় না?
.
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০২১ বিকাল ৫:২২