somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শনিবারের চিঠিঃ পর্ব ৮ (ধারাবাহিক সাপ্তাহিক কলাম) .

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ৯:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শীতের রাতগুলোতে, খেয়াল করলে দেখবেন, শোনার ক্ষমতা বড় যন্ত্রণাদায়কভাবে প্রখর হয়ে ওঠে। যে শব্দগুলোকে বছরের বাকি সময় সাচ্ছন্দ্যে উপেক্ষা করে গেছেন, শীতের রাতগুলোতে তারা প্রবলভাবে আপনাকে ঝাঁকি দিয়ে জাগিয়ে তোলে বারবার। শীতের রাতগুলোতে ফ্যান বন্ধ থাকে। এয়ারকন্ডিশন থাকলে তাও সুইচ অফ। কৃত্রিম শব্দের উপকরনগুলো একসময় স্তিমিত হয়ে আসে। টেলিভিশন, কম্পিউটার, স্মার্টফোন। বন্ধ হয়ে যায় মানবীয় আলাপের পসরা। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে কেউ কেউ নাক ডাকে। ঘড় ঘড় শব্দে সে নাক ডাকার সঙ্গে রীতিমত যুঝতে হয় জেগে থাকা নিশাচর মানুষকে। ধীরে ধীরে সে শব্দও সয়ে আসে। এতটাই যে, চাইলে তাকে উপেক্ষা করা যায় সম্পূর্ণ। এরপর, কন্সট্যান্ট আওয়াজের মধ্যে থাকে ঘড়ির টিক টিক টিক। বেসিনে পানি পড়ার টুপ টাপ টুপ। হঠাৎ হুশহাশ শব্দ তুলে একটা প্রাইভেট কার, বা মিনি ভ্যান ছুটে যায় দূর রাস্তা দিয়ে। থেকে থেকে নিস্তব্ধতা চৌচির করে দেয় দলবদ্ধ কুকুরের ডাক। টিট্রিটি টিট্রিটি স্বরে ডেকে ওঠে নাম না জানা কোন এক রাতের পাখি। এই পাখির ডাক শুনে আপনার কান অভ্যস্ত নয়। প্রাথমিকভাবে এই পাখির ডাক শুনে মনে হবে, কিছু একটা বিষয় নিয়ে সে যারপরনাই ডিস্টার্বড।
.
পাখির ডাক নিয়ে আপনার চিন্তাভাবনায় যতিচিহ্ন পড়বে উপরের ফ্ল্যাটের কারো পানি ফ্ল্যাশ করার শব্দে। সে পানি, আজদাহা পাইপের মধ্যে ঝড় তুলে সশব্দে বয়ে চলে, আর আপনার মনে হয়, আপনার জীবনেও একটা ফ্ল্যাশবাটনের বড় প্রয়োজন ছিল। পাথরের মতো ভারী কতো শত অপ্রয়োজনীয় অনুভূতি মনের মধ্যে জেঁকে বসে আছে! তাদের এক বাটনের চাপে ফ্ল্যাশ করে দিতে পারলে বেশ হত। নাফিসা, আমার বউ, গতরাতে সিরিজ দেখতে দেখতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি প্যারালাল ইউনিভার্সে বিশ্বাস করি কি না। উত্তর দিতে পারি নি। কতো বিশাল এ পৃথিবী, কতো সংকীর্ণ আমার জানাশোনা। কি উত্তর দেবো? তবে এই শীতের নীরব নিস্তব্ধ রাতে, মনে ভাবনা আসে, শুধু অনুভূতির জন্যে এক প্যারালাল জগত হলে বেশ হত। এমন এক জগত হত সেটা, যেখানে আমাদের থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের অনুভূতিরা স্বাধীনভাবে বিচরন করে বেড়াতে পারতো। আমার একরকমের অনুভূতি, আর একজন মানুষের আরেকরকম অনুভূতির সঙ্গে ইন্টার‍্যাকশন করতে পারবে সে জগতে, আমাদের শরীরের প্রত্যক্ষ সংযোগ ছাড়াই। হয়তো কারো সঙ্গে আমার, বা আমার সঙ্গে কারো অভিজ্ঞতা খারাপ। আমাদের এই পারস্পারিক অপছন্দের অনুভূতিদ্বয় অনুভূতির জগতে একে অপরের আলাপে লিপ্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি দূর করে নেবে। চোখ মেলে জেগে ওঠার পর আমাদের মধ্যে আর কোন মনঃকষ্ট থাকবে না।
.
আবার এই হাইপোথিসিসের প্যারালাল হাইপোথিসিসো তো হতে পারে। আমার অনুভূতি যতক্ষণ আমার ভেতরে থাকে, ততক্ষণই তো সেটা আমার অনুভূতি। যখন সে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন, তখন সেই অনুভূতি কি আর বিশেষভাবে আমার অনুভূতি রইলো? আর, আমার থেকে আলাদা হবার পর যদি সে অনুভূতি পথ ভুলে যায় আমার পর্যন্ত ফিরে আসার? আমার চারপাশের মানুষ ও বস্তুর ব্যাপারে আমার স্থিরবদ্ধ অনুভূতিগুলো একবার হারিয়ে ফেললে, আমি কি আর আমি থাকবো? এতো যেন সেই প্রশ্ন যা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে দিনের পর দিন - মানুষ মারা যাওয়ার পর, তার অপূর্ণ স্বপ্নগুলোর কি হয়? তারা কি অতৃপ্ত অবস্থায় ভেসে বেড়ায় পৃথিবীতে?
.
এই চিন্তার ঘেরাটোপ থেকে আপনাকে বের করে আনতে সাহায্য করবে আবারো উপরের ফ্ল্যাটের কোন বাসিন্দা, ঘরঘর শব্দে কোন ভারী আসবাব পত্র টানাটানি, ঠোকাঠুকির মাধ্যমে। আপনি অনুভব করবেন, শীতের রাত তার কুয়াশার মায়াজাল বেছানো শুরু করেছে অবশেষে। তাতে আটকা পড়ছে বহুদিন আগে ভুলে যাওয়া সব স্মৃতি। বিবিধ অ্যাংজাইটি। নানান অনিশ্চয়তা। ক্রাইসিস। আপনি যাদের মুখোমুখি হতে চান না সচেতনভাবে।
.
ক'টা বাজে, এটা জানার জন্য ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাতে গিয়ে আপনি খেয়াল করবেন, ঘড়ির পাশে আর বাংলাদেশ ব্যাংকের নীল - সাদা ক্যালেন্ডারটা নেই। সারা ঘর খুঁজে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যালেন্ডার পাওয়া যাবে গোটা দুই। আম্মু বাংলাদেশ ব্যাংকে কাজ করবার সময়ে প্রতি বছর প্রায় ১৫টার মতো ক্যালেন্ডার এসে জমা হত ঘরে। মানুষকে বিলিয়ে কুল পাওয়া যেতো না। তিনি রিটায়ার করার পর প্রতিবছর সাকুল্যে দুটো ক্যালেন্ডার পান। রুমে রুমে আর ছেলেবেলার মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যালেন্ডার থাকে না। শুধু এই ক্যালেন্ডার না, আপনি টের পান, সামনের টিটেবিলের ওপর হাট করে খুলে রাখা প্রথম আলো পত্রিকায় বেসিক আলী কার্টুন আর ছাপায় না। সেলফোনের স্পিড ডায়ালের নম্বরগুলো বদলে গেছে। বেশী রাত করে পার্সোনাল নাম্বারে ফোন এলে এখন আপনার ভয় লাগে, যেখানে একটা সময় এমন ছিল - যখন মাঝরাত্রে কারো ফোন না এলে আপনার ভয় লাগতো। একা লাগতো।
.
হঠাৎ করে, পৌষের এক শীতের রাতে আপনার মনে হবে, অনেকটা পথ জীবনে আপনার পার করে আসা হয়েছে। এখনও জানালার কাঁচে শীতের রাতে কুয়াশার বাস্প জমে। তবে সে বাস্প পরিষ্কার করে জানালার ওধারে তাকালে ছোটবেলার মতো রানা ভাইয়াদের বাল্বের আলোয় ব্যাডমিন্টন খেলতে দেখা যায় না। যাবে না আর কখনো।
.
এই অপ্রিয় সত্যি থেকে পালানোর জন্যে আপনি চোখ বোজেন। চোখের পাতা বুজে আসার সঙ্গে সঙ্গে আপনি নিজেকে আবিষ্কার করেন এক টিনের চৌচালা ঘরে। এই ঘরের হদিস কেবল আপনি ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ জানে না। চারপাশে প্রবল ঝিঁঝিঁপোকার ডাক। পাতার ওপর শিশির পড়বার টুপটাপ শব্দ। আপনার হতাশ লাগে। বৃথাই নিজের জীবনকে এই ঝিঁঝিঁপোকাদের জীবনের চে' আলাদা করার জন্যে এতো হাপিতেশ্য, এতো ছোটাছুটি মানুষের। সব ঝিঁঝিঁপোকার ডাক একদিন থেমে যায়। থেমে যায় মানুষের কোলাহল। তারপর থাকে কেবল প্রবল শৈত্যের মাঝে গাছের পাতায় শিশির ঝরে পড়ার টুপটাপ আওয়াজ।
.
মৃদু ধাক্কায় আপনি খুলে ফেলেন ঘরের পেছনের দরজা। দিগন্ত জোড়া চাঁদের আলোয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে শিশির ভেজা, কুয়াসায় ঘেরা ঘাসের ওপর দিয়ে সরসর শব্দ তুলে এঁকে বেঁকে ছুটে যায় এক বাস্তুসাপ। ঐ যে নদী। বহুল আকাঙ্খিত নদী। যার কুলকুল শব্দ আপনি শোনার জন্যে ব্যাকুল। রুমের ভেতরে আলনার ওপর রাখা চাদর আলগোছে তুলে নিয়ে আপনি গায়ে মাথায় জড়ান। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেন নদীর দিকে। এই নদীর পরম সত্য। প্রকাণ্ড পূর্ণিমার চাঁদ গলে পড়ছে নদীর ওপর। কুয়াশার সঙ্গে পূর্ণিমার আলোর অপার্থিব লড়াই। আপনার কোন পক্ষ নিতে ইচ্ছে করে না। আপনি নদীর পাড়ে গিয়ে বসেন। অদূরে নদীর তীরে এক বজরা বাঁধা। বজরার কোন মাঝি নেই। এদিকে আপনি বজরা নৌকা চালাতেও পারেন না। টিপটিপিয়ে বৃষ্টি ঝরে পড়ে, না কুয়াশাই ভারী হয়ে দূর পৃথিবীর সব দুঃখ বুকে নিয়ে ঝরে পড়ছে, বোঝা সম্ভব হয় না। আপনি বরং এ পর্যায়ে সব হিসেবনিকেশের বাইরে এসে পড়েছেন। এখান থেকে আর ফেরার উপায় নেই। বজরা মৃদু ছন্দে দুলতে থাকে নদীর ওপর। সে দুলুনির সঙ্গে ভারী হয়ে আসে আপনার চোখের পাতা। কিন্তু আপনি চোখের পাতা বুজতে চান না। প্রবল চেষ্টা, নিজের সঙ্গে প্রবল ধস্তাধস্তির পর আপনি হাল ছেড়ে দেন একপর্যায়ে।
.
নিজেকে বলেন, আহ, সমর্পণেই মুক্তি - এতো দেরীতে বুঝলাম!

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ৯:৩৩
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×