somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কেন 'অসুখী দিন' ? (শাহীন আখতারের উপন্যাস অসুখী দিন পাঠের প্রতিক্রিয়া)

১৭ ই জানুয়ারি, ২০২২ রাত ১০:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১।

"How can there be a true History, when we see no Man living is able to write truly the History of the last week?" ~ T. Shadwell, The Squire of Alsatia (1688)

বুড়ো পৃথিবীর বিবিধ জ্ঞানকাণ্ডের মাঝে ইতিহাস - ননফিকশন / প্রবন্ধসাহিত্য জনরার স্বতঃসিদ্ধ একটি শাখা। কিন্তু আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে, আমার সবচে পছন্দের ফিকশন / কথাসাহিত্যের জনরা কি, আমি মুহূর্তেই উত্তর দেবো, ইতিহাস। জানি, আমার এ জবাব অনেক ভ্রুকুটির জন্ম দেবে। তবুও, পৃথিবীর ইতিহাসের গ্রাফে রথী - মহারথীদের আগমন - উত্থান, প্রস্থান - পতনের যে অবিশ্বাস্য উঁচুনিচু কার্ভ, তা বাস্তবতাকেও হার মানায়ে প্রায় সকল সময়ে। সপ্তদশ শতকের নাট্যকার থমাস শ্যাডওয়েলের নাটক 'দা স্ক্যুয়ার অফ আলসাতিয়া'র দ্বিতীয় অঙ্কের উপরুল্লেখিত বক্তব্যটির কথা চিন্তা করুন। সার তার এই যে - যেখানে কারো পক্ষে মাত্র এই গতসপ্তাহেরও প্রকৃত ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়, সেখানে যেকোনো ঘটনার হাজার বছরের প্রকৃত বা সত্য ইতিহাস খোঁজা অবান্তর। কারণ ইতিহাস বর্ণিত হয় নানা দৃষ্টিভঙ্গী, সে সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গীর মাঝেও আরও ক্ষুদ্রতর ফাঁকফোঁকর থেকে। ইতিহাস বয়ানকারীদের কাছে ইতিহাসের যে বাঁক বা বক্তব্যগুলি গুরুত্বপূর্ণ, তারা তাকেই মূলধারায় তুলে আনতে চান।

ইতিহাস, তাই যেকোনো চিন্তাশীল লেখকের পছন্দের জায়গা। তারা ইতিহাসের বিস্তীর্ণ পটভূমিতে বিচরণ করবার, অবগাহন করবার সুযোগটা নিতে পছন্দ করেন। চেষ্টা করেন রাজনৈতিক - সামাজিক - জাতিগত ইস্যুতে প্রতিষ্ঠিত বয়ানের পক্ষে বা বিপক্ষে, স্বমতাদর্শে তাড়িত হয়ে কাল্পনিক পৃথিবী নির্মাণ - বিনির্মাণের। এখন, ইতিহাসের গহীন বালুচর ছেনে ছুঁয়ে গল্প নির্মাণের প্রেক্ষাপটটা যদি হয় আরও সুনির্দিষ্টভাবে - উত্তর ঔপনিবেশিকতা, বা, লেন্স আরও সরু করে - দেশভাগ, বঙ্গভঙ্গ, তবে মুহূর্তেই তা যেকোনো বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল লেখকের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা আবেগের তারে ঝংকার দিয়ে ওঠে। হাসান আজিজুল হক সাহেবের আগুণপাখি থেকে নিয়ে অমিতাভ ঘোষের শ্যাডো লাইনস, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্বপশ্চিম থেকে নিয়ে খুশওয়ান্ত সিং এর ট্রেন টু পাকিস্তান। উদাহরণ শুধু কথা সাহিত্যে নয়, আছে চিত্রকলায়, সঙ্গীতে, সিনেমায়, তথা শিল্পকলার সকল মাধ্যমে।

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম লেখক শাহীন আখতারেরও কাজ করবার সবচে পছন্দের জায়গা ইতিহাস। 'তালাশ' (২০০৪), 'সখী রঙ্গমালা' (২০১০), 'ময়ূর সিংহাসন' (২০১৪) থেকে নিয়ে তার সর্বশেষ উপন্যাস 'অসুখী দিন' (২০১৮), তার সবগুলির প্রেক্ষাপট ইতিহাস। এমনকি, তার প্রথম উপন্যাস - 'পালাবার পথ নেই' (২০০০), ওটাকেও এক অর্থে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস বলেই বিবেচনা করা যায়। মোটা দাগে ষাটের দশকে যদি বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটে বলে আমরা ধরে নিই, তবে বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের অন্দরমহল থেকে জেনানারা ব্যাপক হারে বেরিয়ে এসে স্কুল - কলেজ - ইউনিভার্সিটি - অফিস - আদালতগুলো আবাদ করা শুরু করেন আশি - নব্বইয়ের দশকে। সে সময়ের সদ্য ইউনিভার্সিটি শেষ করা নারীর জীবন কেমন ছিল, তার ইতিহাস নিপুণভাবে বর্ণিত তার প্রথম উপন্যাসে।

তবে, সুলেখক শাহীন আখতারের সাহিত্যের অবগুণ্ঠনে ইতিহাসের বয়ান রচনায় এক বিশেষ ঝোঁক আছে, যা কেবল সচেতন পাঠে ধরা পড়ে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপন্যাসিক হিসেবে শাহীন আখতারের বিশেষত্বও এখানটায়। শাহীন আখতার ইতিহাসের যে ক্ষেত্র বাছাই করেন, তার উপন্যাসের প্রেক্ষাপট রচনা করবার জন্যে, সে ক্ষেত্রটি হয়তো বিখ্যাত, বহুল আলোচিত, এমনকি অনেকক্ষেত্রে সমাজের উচ্চকোটি বংশজাতদেরই, কিন্তু তিনি তার প্রতিটি উপন্যাসে নির্মিত চরিত্রগুলিকে ভাসিয়ে দেন ইতিহাসের প্রচলিত প্রেক্ষাপটের অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত, বা প্রায় আনকোরা একেকটি স্রোতে। সহজ করে বললে, তিনি ইতিহাসের প্রচলিত ন্যারেটিভের ঘেরে তার কাহিনী তৈরি করেন না। খুঁজে আনেন নতুন কিছু, প্রতিবার।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গত পঞ্চাশ বছরে উপন্যাস কম লেখা হয় নি, তাঁর তালাশ তবুও যেমন আমাদের নিয়ে যায় বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নাজুকতম জায়গা, বীরাঙ্গনাদের সামাজিক জীবনে; মুঘল সালতানাতের লাডলা শাহ সুজাকে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন আলাওলের সঙ্গে, আরাকানে নিয়ে, তাঁর ময়ূর সিংহাসন উপন্যাসে; প্রেক্ষাপট সেই ব্রিটিশ আমলের জমিদারীই, তবুও তাঁকে ঘিরে সমাজের নানাস্তরের রমণীদের আখ্যান তিনি রচনা করেন সখী রঙ্গমালায়। আর তার সর্বশেষ প্রকাশিত উপন্যাস 'অসুখী দিন' - এ তিনি তুলে আনেন ইতিহাসের সেই বহুবার পরিব্রাজিত জনপদ, '৪৭ এর দেশভাগ, কিন্তু প্রচলিত হিন্দুমুসলিম দ্বন্দ্বের বয়ান এ উপন্যাসে কাহিনীর অর্ধেক, বাকি অর্ধেকে তিনি দরদের সাথে, এবং নিপুণভাবে তুলে আনেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অল ইন্ডিয়া কম্যুনিস্ট পার্টির ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান, কর্মকাণ্ডের বয়ান। শুধু তাই নয়, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকেও তিনি প্রাসঙ্গিক করে তোলেন আমাদের জন্যে। তার রচিত এ উপন্যাস, অসুখী দিন, কখনো মনোরম, কখনো চাঞ্চল্যকর, কখনো আবেগি, কখনো হৃদয় বিদারক সব ঘটনার বর্ণনে দ্রুত গতিতে তার নিয়তির দিকে এগোয়। তাঁর সবটা এই প্রবন্ধের ছোট পরিসরে ফুটিয়ে তোলা হয়তো সম্ভব হবে না, কিন্তু চেষ্টা থাকবে অসুখী দিন উপন্যাসটির মূল ঝোঁক, এবং গল্পের ফাঁকে ফাঁকে পাঠকের দিকে ছুঁড়ে দেয়া প্রশ্নগুলোকে সাহিত্যের অবগুণ্ঠন থেকে উন্মুক্ত করে চাঁছাছোলা বাংলায় তুলে আনবার।

২।
আলোচনা শুরুর আগে উপন্যাসের সারাংশ বর্ণনায় অসুখী দিনের ব্যাকফ্লাপে দেয়া তথ্যের সাহায্য নেয়া যাক। ওতে লেখা আছে -

"অনিতা আর সাবিনা। দুই ভূগোলের দুই সময়ের মানুষ। শিলংয়ের আর বাংলাদেশের। দেশভাগের আর এই সময়ের। অনিতা সেনের স্মৃতিকথা পড়তে পড়তে সাবিনার সামনে ভেসে ওঠে তাঁর বাবার জীবন। বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগ। সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। বাংলা আর বাংলার সীমান্তের ওপারের দুই মানুষের জীবনে একই ইতিহাস এগিয়ে চলল ভিন্নতর দুই পথে।"

নিজের ভাষায় যদি একটু সংযুক্ত করি, সাবিনা নাম্নি ভদ্রমহিলা, যিনি অসুখী দিন উপন্যাসের মূল কথক, তাঁর কাঁধে দায়িত্ব অর্পিত হয় তাঁর নব্বই ঊর্ধ্ব পিতার একটি জীবনী রচনার। বইয়ের ভাষায় -

"প্রস্তাবিত বইটা আর কিছু নয়, সাবিনার মেজো ভাইয়ের ভাষায় - পরিবারের সোনালি ইতিহাস। ওদের বাবা মোয়াজ্জেম হক, যিনি গল্পের কেন্দ্রে, তিনি ছাত্রাবস্থায় পালিয়ে গিয়ে সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজে শামিল হন।" (১০)

উপন্যাসে প্রবেশ করলে বোঝা যায়, মোয়াজ্জেম হোসেনের জীবনালেখ্য এতোটাই চমকপ্রদ যে, তাকে উদ্দিষ্ট করে সহজেই অন্তত একটি উপন্যাস লেখা যায়। আর বাবার ওপর এই উপন্যাস লিখবার তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতেই সাবিনা তাঁর গ্রামের বাড়িতে যান, যেখানে তাঁর বাবার অতীত জানেন, এমন কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছেন। বাকরহিত অবস্থায় বেঁচে আছেন সাবিনার বাবা নিজে, এছাড়া সাবিনার মা, সাবিনাদের বাড়িতে ফাইফরমাশ খেটে বড় হওয়া 'দুর্ভিক্ষের শিশু' কাশেম মিয়া, এবং আরও কেউ কেউ। তাদের সঙ্গে দেখা হওয়া, কথোপকথন মিলিয়ে চলতে থাকে উপন্যাসের ঘটনা প্রবাহের একটি স্রোত।

উপন্যাসে বর্ণিত ইতিহাসের আরেকটি স্রোতে গতি সঞ্চারিত হয়, যখন গ্রামের বাড়িতে যাত্রার পথে ট্রেন ষ্টেশনে 'অনিতা সেন' নামে এক ভদ্রমহিলার আত্মজীবনী সাবিনার হাতে পড়ে - "সাবিনা পায়ের কাছে ব্যাগ নামিয়ে দ্রুত বইয়ের পাতা ওলটায় - কী নাই নীলিমা দাসের হাতের হলদে ছোপ লাগা জরাজীর্ণ বইটাতে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অল ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট পার্টি, আগস্ট আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগ ..." (৯)

বইটি এভাবে সাবিনার সঙ্গী হয়ে যায়। এভাবে, উপন্যাসে একদিকে চলতে থাকে সাবিনার পিতা মোয়াজ্জেম হকের নেতাজি সুভাষ বোসের আজাদ হিন্দ ফৌজের ফৌজি পরিচয় পুনরুদ্ধারের তত্ত্বতালাশ; তাঁর সমান্তরালে চলতে থাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অল ইন্ডিয়া কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য অনিতা সেনের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েনের ইতিহাস। উপন্যাসের একদম শেষে গিয়ে নাটকীয়ভাবে এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয় অনিতা আর সাবিনার জীবন।

৩।
অসুখী দিন উপন্যাসের যে অংশটাকে আমি দেশভাগের (প্রায়) মূলধারার ইতিহাসের আলেখ্য বলে দাবি করছি, তাতে রয়েছে ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলা থেকে নিয়ে নবজাতক পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গের ভৌগলিক প্রেক্ষাপটে সংঘটিত রাজনৈতিক উথালপাথাল, এবং ক্ষমতার পালাবদলের আখ্যান। পূর্ব বাংলার অবদমিত রায়ত শ্রেণী কীভাবে পাকিস্তানের জন্মের পর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, আর এককালের জমিদার উচ্চকোটি বর্ণহিন্দুরা কীভাবে শোকে ও 'শক' - এ পাড়ি জমায় পশ্চিমবঙ্গে - তার স্পষ্টচিত্রণ এ অঙ্কে উপস্থিত।
গ্রামের খালেবিলে, বা ডোবার প্যাঁকে গা ডুবিয়ে মাছ ধরা মুসলিম রায়তের পো মোয়াজ্জেম হকের ভেতর তার সমবয়সী জমিদারতনয় জহর বকশি বুনে দেয় কোলকাতা গিয়ে পড়াশোনা করার স্বপ্ন। সে স্বপ্নে বিভোর হয়ে ডাক্তারি পড়তে মোয়াজ্জেম কোলকাতা যায় বটে, কিন্তু তখন স্বাধীনতার অপেক্ষায় গোটা ভারত অগ্নিগর্ভ। যার উত্তাপের আঁচ বাংলার কৌম মুসলিম সমাজের মাঝে, অজ পাড়াগাঁয়ে বসে বোঝা যায় না অতো সহজে। কোলকাতায় ডাক্তারির পাঠ নিতে থাকা মোয়াজ্জেমের চিত্ত ঝলসে যায় সে আগুণের আঁচে। 'ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মুসলমানরা কিছুই করে নাই' - মনে পড়ে গ্রামে বসে জহর বকশির দেয়া সেই অভিযোগ। ফলশ্রুতিতে মোয়াজ্জেম যোগ দেয় নেতাজী সুভাষ বোসের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আইএনএ) তে। কিন্তু তার ফলাফল শুভ হয় না মোয়াজ্জেমের জীবনে। ইঙ্গ মালয় রেঙ্গুন ঘুরে, ইম্ফলে ব্রিটিশ বিরোধী তুমুল লড়াইয়ে নিজের জীবন খোয়াতে খোয়াতে সে বাঁচে কোনক্রমে। ৪৭ এ দেশ স্বাধীন হবার এক বছর পর কুঁচকিতে বুলেটের দাগ নিয়ে যখন সে বিভক্ত বাংলায়, পশ্চিমবঙ্গের ভবানীপুরের চেম্বারে বাল্যসখা জহর বকশির মুখোমুখি হয়, তখন স্বরাজের জন্যে মুসলমানরা কি করছে - শৈশবে জহর বকশির ছুঁড়ে দেয়া এই প্রশ্নের বলিষ্ঠ জবাব থাকে মোয়াজ্জেমের হাতে। কিন্তু বিভক্ত দেশে, বিভক্ত বঙ্গে, পরিবর্তিত ভূ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা হারায় সবরকমের কথার লড়াই। মোয়াজ্জেম ফিরে আসে সদ্য স্বাধীন হওয়া পূর্ব পাকিস্তানে।

অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গে মোহাজের হয়ে যেতে নারাজ জহর বকশির ডাকাবুকো জমিদার বাপ দাশু বকশি দেশভাগের পরেও পূর্ব পাকিস্তানে ডাঁটের সঙ্গে নিজের জমিদারী চালাতে গেলে আক্ষরিক অর্থে বলৎকারের শিকার হয় তাঁর এক মুসলমান কামলার হাতে, গভীর রাতে, জমিদারী কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরবার পথে। দুদিনের জ্বরে ভুগে মারা গেলে অবশেষে তাঁদের জমিদারির পাততাড়ি গোটে পাকিস্তানে।

৪।
বঙ্গভঙ্গের পূর্ববর্তী অগ্নিগর্ভ সময় থেকে নিয়ে দেশভাগের মাধ্যমে হিন্দু মুসলিম বিবাদের আপাত স্তিমিত হয়ে আসা বাদ দিলে, ইতিহাসের অপেক্ষাকৃত চাপা যে স্রোত আধুনিক জাতীয়তাবাদী ন্যারেটিভে ভুলে গেছে প্রায় সবাই, তা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অল ইন্ডিয়া কম্যুনিস্ট পার্টির ফ্যাসিবাদ বিরোধী অবস্থান, এবং নিজস্ব অবস্থান থেকে চালিয়ে যাওয়া লড়াই। এ ভিন্নধাঁচের ইতিহাসের বর্ণনা আনুপুঙ্খিকভাবে উঠে আসে রেলস্টেশনে সাবিনার খুঁজে পাওয়া - কম্যুনিস্ট অনিতা সেনের ডায়রিতে।

এ বড় সিনেমেটিক অবস্থান। কমিউনিস্ট বোন এক ব্যারাকে, প্রতিপক্ষ যার জাপান সাম্রাজ্যের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারত স্বাধীন করতে মুহুর্মুহু বেগে ধেয়ে আসা সুভাষ বোসের আর্মির সৈন্য, অনিতার বড়দাদা নীরদচন্দ্র সেন। ছায়া রনাঙ্গনে মুখোমুখি অবস্থায় ভাই - বোন, অপরদিকে বাড়িতে অনিতার মা - বাবা অপেক্ষা করে বসে আছে, কবে ইম্ফলের পতন হবে, কবে ভারতে স্বাধীনতার পতাকা ওড়াবে নেতাজির আজাদি ফৌজ, কবে বাড়ি ফিরে আসবে নীরদ।

সত্য বলতে, উপন্যাসে অনিতা সেনের কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মকাণ্ড ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করলে, একহিসেবে ভালো লাগবে না অনিতার আলেখ্য। তা অবশ্যই বর্ণনার কারণে নয়। অনিতা সেনের অংশটুকু বড় দরদ দিয়ে তৈরি করেছেন লেখক। কিন্তু এটা আবিষ্কার করে সচেতন পাঠক হিসেবে আপনার আফসোসই হবে যে, বাংলাদেশে, বা অবিভক্ত ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস বারবার একই চোরাগলিতে এসে ঠোক্কর খায়। প্রতিবার ইতিহাসের ভুল পাঠ, অন্ধভাবে পার্টির ব্রিফিং ফলো করা, মার্ক্সবাদের মেকানিক্যাল ইমপ্লিকেশন, জনগণের পালস অনুভব করতে ব্যারথ হওয়া, দিনশেষে ব্যার্থ বিপ্লবীর সিল কপালে নিয়ে, বড়জোর একজন জীবনসঙ্গী (যে নিজেও ব্যার্থ বিপ্লবী, এক্স কমিউনিস্ট) জুটিয়ে বিপ্লবের অঙ্গন থেকে প্রস্থান। সাতচল্লিশের বা একাত্তরে, কম্যুনিস্ট পার্টি কখনোই নিজেদের প্রচলিত চিন্তার ছকের থেকে বেরিয়ে জনগণের হৃদযন্ত্রের অনুরণন পাঠ করতে পারে নি, বা তার প্রয়োজন বোধ করে নি।
তবুও, চল্লিশের অগ্নিঝরা দিনগুলিতে অল ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট পার্টিও যে নিজের মতো একটা ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছিল ভারতের স্বরাজ প্রতিষ্ঠায় - তাঁর ইতিহাস আবিষ্কার অবশ্যই আমাদের জন্যে এক নতুন অভিজ্ঞতা।

৫।
অসুখী দিনের রচয়িতা শাহীন আখতার আলাদাভাবে তারিফের প্রাপক নেতাজী সুভাষ বসুর রাজনীতি ও আত্মত্যাগকে বর্তমান প্রজন্মের বাংলাদেশী তরুণ - তরুণীদের কাছে প্রাসঙ্গিক করে তোলায়।

অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নেতাজী সুভাষ বোসের ব্রিটিশ বিরোধী স্বরাজ আন্দোলনে এমন জাদু ছিল, যা সেই উত্তুঙ্গ সাম্প্রদায়িকতার মুহূর্তেও শিক্ষিত হিন্দু - মুসলিম যুবাদের প্রাণিত করেছিল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গাইতে - "কদম কদম বাড়ায়ে যা, খুশীসে গীত গায়ে যা..."।

আমরা জানতে পারি, নতুন কোলকাতায়, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজোদ্দৌলার পতনের স্মারক হিসেবে নির্মিত হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙ্গার ডাক এসেছিল সুভাষ বোসের উদাত্ত কণ্ঠে। নেতাজির আজাদি ফৌজের যোদ্ধা মোয়াজ্জেম হকের সঙ্গে আমরাও উদ্বেলিত হই যখন জানতে পারি ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতাজির ফৌজিতে মুসলিম যুবকদের সংখ্যা ও আত্মত্যাগের কথা -

"বকশি তাহলে চাক্ষুষ করেছে স্বরাজ প্রতিষ্ঠায় মুসলমানেরা কতো দূর যেতে পারে! তাঁর মুখে শাহনেওয়াজ খানের নাম, লালকেল্লার সংক্ষিপ্ত বিচারে যে তিনজন আইএনএ অফিসারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তিনি তাঁদেরই একজন। মি. (সুভাষ) বসুর প্রবাসী সরকার আর সরকারের মন্ত্রীদের সিংহভাগই ছিল মুসলিম কথাটা বলার সময় আবেগের আতিশয্যে জহর ভুলেই যায় যে সে 'মায়ের কাছে মাসির গল্প' করছে। তা ছাড়া জার্মানি থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত ডুবোজাহাজে বসুর সঙ্গী হয়েছিলেন হায়দরাবাদের ছেলে বার্লিনপ্রবাসী ছাত্র আবিদ হাসান। নেতাজির অন্তিমযাত্রায়ও সঙ্গে ছিলেন মুসলমান আর্মি অফিসার হাবিবুর রহমান, সায়গন বিমানবন্দর থেকে জাপানি বম্বারে এক সঙ্গে উড়েছিলেন দু'জন।" (১৪৯ - ১৫০)

সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যে আইয়ুব শাহী শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের মানুষকে লড়াই করতে হয়েছে ষাটের দশকে, সেই আইয়ুব শাহের সৈন্যদের বিরুদ্ধে খোদ সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজকেও রেঙ্গুনে লড়াই করা লেগেছে, যখন আইয়ুব শাহ ব্রিটিশ তখতের ফরমাস খাটছিল।

উপন্যাসের এ দুই শক্তিশালী প্রবাহ - প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক বয়ান, আর ইতিহাসের অপেক্ষাকৃত অনালোচিত অংশের স্রোতের নীচে চোরাস্রোতের মতো প্রবাহিত হয়ে যায় আরও অনেক আখ্যান, যা মূল গল্পের কাঠামোকে আঁটসাঁট রাখে। পাঠক জানতে পারে দেশভাগের আগে পরে মুসলিম জেনানা মহলের হালচাল, বিহারী রমণীদের মুহাজের হয়ে দেশে আসার পর অবস্থা, কৌম বাঙ্গালী মুসলিমের গ্রামীণ জীবন যাপন থেকে নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ওহাবিজমের উত্থান পর্যন্ত আরও নানা চিন্তার উদ্রেককারী কেচ্ছা কাহিনী।

৬।
প্রশ্ন রয়ে যায়, কেন 'অসুখী দিন'? ভারত স্বাধীন হল, মুসলমানেরা পাকিস্তান নামে স্বাধীন রাষ্ট্র পেলো, তবে কে অসুখী? কেনই বা অসুখী? এটাই, আমার মতে, উপন্যাসে উত্থাপিত সবচে বড় প্রশ্ন। পাঠকের প্রতি উপস্থাপিত সবচে বড় ধাঁধাঁ, যার উত্তর পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গীর উপর নির্ভর করে একেকরকম হবে।

আমার পাঠ অভিজ্ঞতায় আমি যা অনুভব করেছি, উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো কোন জায়গা থেকে শুরু করে কোথায় গিয়ে তাদের জীবনযাত্রা শেষ করলো - এটা ঠিকমতো অনুসরণ করতে পারলে বোঝা যাবে কেন বেলাশেষে এ উপন্যাস অসুখী দিনেরই আখ্যান। স্পষ্ট হবে - সমষ্টিগত অর্জনের আশা, আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠতা ইত্যাদির ফলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বড় বড় আত্মত্যাগের পরেও মানুষ পরাজিত হয়। ব্যার্থতায় পর্যবসিত হতে পারে তার সারাজীবনের সাধনা।

মোয়াজ্জেম হকের কথা ধরা যাক, যার উপর উপন্যাস লেখার জন্যে কন্যা সাবিনার গঞ্জে গমন। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন রেঙ্গুনে '৪৭এর দেশভাগের আগে। সুভাষ বোস ছিল তার একমাত্র নেতা। দেশভাগের পর পাকিস্তানে ফিরে এসে প্রিয় নেতার স্মৃতিকে জাগরূক রাখার জন্যে একটা ডিসপেন্সারি খুলে বসেন নেতাজি ঔষধালয় নামে। আইয়ুব শাহী বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে তরুণ ছেলেপেলে তাঁকে মুখের ওপর প্রশ্ন করে - 'প্লেন - ক্র্যাশে কবে মরে ভূত হয়ে গেছেন! ওনারে আপনার কী দরকার?' দেশের স্বাধীনতায় নেতাজির ভূমিকার উপর বক্তব্য রাখতে গেলে তারা ধমকে থামিয়ে দেয় মোয়াজ্জেম হককে - 'কোন দেশের স্বাধীনতা?' তারা প্রশ্ন করে। এবং স্মরণ করিয়ে দেয়, তাদের, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষাভাষী জনগণের স্বাধীনতা সামনে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মোয়াজ্জেম হক ক্ষেপে উঠে প্রায় সে মুহূর্তেই নিজের পাতলুন খুলে কুঁচকিতে বুলেটের দাগ দেখাতে উদ্যত হন - যে এই বুলেটের দাগ তবে কিসের? এ লড়াই তিনি কার, কাদের জন্যে লড়েছেন? কার স্বাধীনতা এসেছে তার ব্রিটিশ বাহিনীর গুলি খাওয়ার বদলে? কিন্তু নিজেকে সামলে নেন তিনি। বোঝেন, পাতলুন খুলে গুলির দাগ দেখানো তাঁকে স্রেফ মাথাখারাপ ভাঁড়ে পরিণত করবে সবার চোখে। যে সম্মান, স্বাধীনতা যোদ্ধার যে মর্যাদার কথা মাথায় রেখে তিনি তার যৌবনে আজাদি ফৌজে নাম লিখিয়েছিলেন, ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীর সবচে চৌকশ ও ধূর্ত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াইয়ে, তার স্বীকৃতি তিনি পান নি কখনো, এবং তিনি তা পাবেনও না ভবিষ্যতে। এই সত্য বুকে চেপে রেখে, স্রেফ একজন পল্লীচিকিৎসকের পরিচয় নিয়েই তাঁকে তার বাকি জীবন কাটাতে হবে।

৭।
কেন অসুখী দিন? - এ প্রশ্নের জবাবে আরও তুলে আনা যায় কাশেম মিয়া চরিত্রটির বর্ণনা ও পরিণতি।

দুর্ভিক্ষের শিশু কাশেম মিয়াকে সাবিনার দাদা-দাদি, মেহের আলি ও সায়মা খাতুন কুড়িয়ে পান তাদের আঙ্গিনায় '৪৩ এর মন্বন্তরের দিনগুলোতে। যে পুরুষ লাশের পাশে তাঁকে পাওয়া যায়, সে লাশটি ছিল খতনাবিহীন, অর্থাৎ - হিন্দুধর্মের এক হতভাগ্য ব্যক্তি, যে ক্ষুধার যন্ত্রণায় প্রাণ হারায় সাবিনার দাদাবাড়ির চৌকাঠে। সে দুগ্ধপোষ্য শিশুকে সাবিনার দাদা দাদি বড় করেন পোশাক - খাবার দিয়ে। নাম রাখেন মুসলমানের, কাশেম মিয়া।

কাশেম মিয়া উপন্যাসে সাবিনার বাবা মোয়াজ্জেম হকের ব্যাপারে অনেক তথ্য জানতো। ছোটবেলা থেকেই মোয়াজ্জেম হককে দেখেছিলেন তিনি, মোয়াজ্জেম হক যখন ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই শেষে প্রথমবার বাড়ি ফেরেন ১৯৪৮ এ - সে সংবাদও বাড়ির সবাইকে সবার আগে দেয় সে। সাবিনা যখন তার পিতার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের জন্যে কাশেম মিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তখন কাশেম মিয়া নিজেও অসুস্থ, বয়োঃভারে ন্যুব্জ। তাঁকে দেখে সাবিনার উপলব্ধি হয়, হিন্দুর কাঁখে জন্ম নিয়ে মুসলমানের ঘরে মুসলিম পরিচয়ে বড় হওয়া লোকটি তার জীবনে থিতু হতে পারে নি এ দুটির কোন পরিচয়েই - "সাবিনার এখন মনে হয়, ঠিক বয়সে খতনা হলেও কাশেম মিয়া নিজেকে এ মজহাবের লোক ভাবত না। ভাবত, না ঘরকা না ঘাটকা। তাঁর পায়ের তলায় মাটি নাই, থিকথিকে শ্যাওলা, যেখানে সে না দাঁড়াতে পারে, না সাঁতরাতে পারে।" (১২১)

এই ঘরের কিংবা ঘাটের - কোনটাই না হয়ে উঠতে পারা কাশেম মিয়া আশ্রয় খুঁজে পায় মাজারে। সাবিনার উপলব্ধিতে -"মাজার এর বিকল্প ছিল। মাজারের যৌথ জীবন, কবরের শীতল ছায়া, মোমের আলো , আগরবাতি, ক্রন্দনরত দুঃখী মানুষ, পাগলের নৃত্য, মরমি গান, শাঁখা - পলার জোড়হাত করা নারী, টুপি পরিহিতের বিনীত তসলিম। আর গাঁজার মৌতাতে বাস্তবতা ছেড়ে চৌঠা আসমান বরাবর উড্ডয়ন তো অবশ্যই, যাতে সে আগে থেকেই আসক্ত ছিল।" (১২১)

সাবিনা যখন তার গ্রামের বাড়িতে, কাশেম মিয়ার সঙ্গে দেখা করে তার সাক্ষাৎকার নিচ্ছে মোয়াজ্জেম হকের ব্যাপারে - এমন এক সময় কাশেম মিয়াকে দুর্বৃত্তের দল চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে রেখে যায়। মৃত্যুকালে কাশেম মিয়া স্রেফ এতোটুকুই বলতে পারে - 'ওহাবি'।

হিন্দুর ঔরসে জন্ম নেয়া, মুসলমানের ঘরে লালিত পালিত ও বড় হওয়া, মাজারে ভাণ্ডারী গানের আখড়ায় শান্তি খুঁজে পাওয়া লোকটি যখন বেঘোরে প্রাণ হারায় সৌদি ভাবাদর্শে পুষ্ট ওহাবিদের ছুরি চাপাতির আঘাতে - উপন্যাস সহজেই হয়ে ওঠে অসুখী দিনের আখ্যান।

৮।
উপন্যাসের প্রেক্ষাপটকে অসুখী দিন বানিয়ে তুলবার পিছে প্রধানতম কুশীলব, আমার মতে অনিতা সেনের চরিত্রটি। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার চরিত্র যেসমস্ত হৃদয় বিদারক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়, তা পাঠককে কাঁপিয়ে তোলে ভেতর থেকে। উকিল পিতার একমাত্র কন্যা অনিতা সেন বড় হয়েছেন পরিবার থেকে পাওয়া 'সিম্পল লিভিং - হাই থিঙ্কিং' এর আদর্শ বুকে নিয়ে। বইয়ের ভাষায় - "অনিতা সেন যুদ্ধ দেখেছেন, মহাদুর্ভিক্ষ দেখেছেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন, যারা কট্টর নাস্তিক হওয়ায় ধর্ম দিয়ে মানুষকে বিচার করে নি, সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারটাকে সরলভাবে মোকাবিলা করেছিলেন।" (২৭২) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অনিতার পার্টির অবস্থান ছিল নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের বিরুদ্ধে, যে ফৌজের ফৌজি তার বড়দা' নীরদচন্দ্র সেন। অথচ অনিতা, বা তার পুরো পরিবারের কেন্দ্রবিন্দুতে নীরদ চরিত্রটি রয়ে যায় উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। তার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে মারা যায় অনিতার বাবা, মা। মারা যায় অনিতা নিজেও। তবে তার আগে তাঁকে হতে হয় ভয়াবহ খাসিয়া জাতীয়তাবাদী আক্রমণের শিকার।

"২১ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। খাসিয়া, জয়ন্তিয়া আর গারো পাহাড় নিয়ে বিনা রক্তপাতে মেঘালয় রাজ্যের জন্ম। ... মেঘালয় তো নিজস্ব রাজ্য শাসনের সনদ পেল, বহিরাগতদের ভাগ্যে কী আছে কে জানে। স্টেজে তখন বেজে উঠেছে - সুন্দরী রূপসী মেঘালয়, বন্ধনমুক্ত স্বাধীন মেঘালয়..." (২৫১)

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের একমাস পরেই ভারতে একটি অঞ্চল রাজ্যের সনদ লাভ করে। মেঘালয় তার নাম। শিলং - এ অনিতা আর তার স্বামী ও প্রাক্তন কমিউনিস্ট কমরেড অরুণ মিলে সংসার গুছিয়ে বসেছেন অনিতার পৈতৃক বাড়িতে। সেখানে, মেঘালয়কে স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করবার দিনকয়ের মধ্যেই শ্লোগান ওঠে - - "মেঘালয় ভূমিপুত্রদের, উডখাররা বিদায় হও।" (২৫৫) কিন্তু যে বাড়িতে তার বড়দা নীরদচন্দ্রের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তার বাবা - মা, ভূমিপুত্রদের তর্জন গর্জনে সে বাড়ি ছাড়তে কোনক্রমেই রাজি হয় না সে। ফলশ্রুতিতে, তার বাড়িতে ডাকাতি হয়, এবং খাসিয়া গুন্ডা, দাঙ্গাবাজদের দ্বারা অনিতা গণধর্ষণ শিকার হয়। অনিতার স্বামী কমরেড অরুণ তাঁকে ত্যাগ করে, যখন সে জানতে পারে, অনিতা তার এই ধর্ষণজাত সন্তানকে গর্ভপাত করাতে রাজি নয়। অনিতার শেষ দিনগুলো কাটে এই বাড়িতেই, তার দাদার স্মৃতি বুকে নিয়ে। মৃত্যুর আগে আরেকটি কষ্ট পান তিনি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনায়। তা তার কাছে প্রতিভাত হয় পুরাতন প্রেমিকের মৃত্যু হিসেবে।

পাঠক হিসেবে এ বড় আফসোসের আবিষ্কার, আমাদের জন্যে যে - যেকোন দাঙ্গা হোক, চাই সে সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে হোক বা জাতীয়তাবাদী, দিনের শেষে প্রতিটি দাঙ্গার নির্মমতর ভুক্তভোগী হন নারীরাই। এবং বাংলাদেশে বসে পার্বত্য অঞ্চলের ভূমিপুত্রদের যে দুঃখ দুর্দশার কথা আমরা শুনি, তার সঙ্গে মেলাতে কষ্ট হয় স্বাধীন মেঘালয়ে 'উডখার' বা বহিরাগতদের তাড়িয়ে দেবার জন্যে ভূমিপুত্র খাসিয়াদের সহিংসতার আখ্যান। উগ্র জাতীয়তাবাদের ছাদনাতলায় এসে দাঁড়ালে দিনশেষে সহিংস হয়ে ওঠে পৃথিবীর নিরীহতম মানুষটিও।

৯।
পোস্ট কলোনিয়াল সাহিত্যে ইতিহাস, বা ইতিহাসনির্ভর বাস্তবতাকে নির্মাণ - বিনির্মাণের অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে স্মৃতি। উত্তর ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটের চরিত্রগুলি তাদের স্মৃতির ভেলায় চড়ে ভেসে বেড়ায় ঔপনিবেশিক প্রভু, বা তাদের ছায়া সরকারদের নির্মিত ইতিহাসের স্রোতে। এই পুনঃভ্রমণের দ্বারা তারা বিবিধ প্রচলিত ঐতিহাসিক বক্তব্যকে খুঁটিয়ে দেখে, পর্যালোচনা করে, নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। ঠিক একাজটিই খুব সার্থকভাবে করেন শাহীন আখতার, তার জেমকন সাহিত্য পুরষ্কারে ভূষিত উপন্যাস অসুখী দিনে। লেখিকা তার সাহিত্যের গুণেই দুই বাংলায় খ্যাত। তবুও তিনি জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতার সমীকরণ পাশে সরিয়ে রেখে সাহসিকতার সঙ্গে দেশভাগ, বঙ্গভঙ্গের ঐতিহাসিক সত্যের ব্যাপারে নিজের মতামত দেন বলিষ্ঠ কণ্ঠে, যা বর্তমান ভারতের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেকের শিরঃপীড়ার কারণ হতে পারে।

ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয় উপন্যাসটি জায়গায় জায়গায় তথ্যের ভারে ন্যুব্জ। মোয়াজ্জেম হকের ইতিহাস মূলত মৌখিক বয়ান, আর অনিতা সেনের ইতিহাসের বাহন তার ডায়রি। মুখের কথা, আর ডায়রি লেখা - দুটোর কোনটিতেই আসলে তথ্যের প্রবাহ পরিকল্পিত আকারে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করা হয় না বাস্তবে, এভাবে বিষয়টির সুরাহা করতে পারি। এছাড়া, উপন্যাসে কিছু চরিত্রের আগমন ও প্রস্থান ঘটে যথেষ্ট বিকাশ ছাড়াই। পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের ছাড়াও উপন্যাসটি নিজের গতিতে এগিয়ে চলতে পারতো। আবার অনিতা সেনের ডায়রিটা হঠাৎ করে রেলস্টেশনে পেয়ে যাওয়া, এবং অনিতা সেনের দাদার সঙ্গে সাবিনার বাবার সংযুক্তি আবিষ্কারের বিষয়টি মিরাকুলাস, এবং ড্রামাটিক লাগে; যদিও মানুষের জীবন বা ইতিহাস তো বেলাশেষে অসংখ্য নাটকীয় ঘটনারই সমষ্টিবিশেষ।

পরিশেষে, আমার একটি পর্যবেক্ষণ হল, শাহীন আখতারের উপন্যাসগুলিতে সাধারণভাবে যেরকম নারীমানসের গহীনে থাকা খুঁটিনাটি বিষয়গুলি তিনি বইয়ের পৃষ্ঠায় তুলে নিয়ে আসেন অবলীলায়, তার কিছুটা ঘাটতি তার পুরুষ চরিত্রগুলির মানসকাঠামোর নির্মাণে দেখা যায়। বিশেষ করে তার উপন্যাসে যখন নারী - পুরুষের সম্পর্ক একটি দ্বান্দ্বিক অবস্থানে এসে হাজির হয়, তখন তিনি যতটা সাবলীলভাবে আক্রান্ত নারীর সাইকোলজি বর্ণনা করেন, বিপরীতে তার পুরুষ চরিত্রগুলির সাইকোলজির বর্ণনা খানিকটা সরলরৈখিক। উপন্যাসে স্বাধীন মেঘালয় রাজ্যের জন্মের সময়কাল থেকে নিয়ে অনিতা - অরুণের বৈবাহিক সম্পর্কের সুরাহাতাল যদি আমরা করি, আমার বক্তব্য আরও স্পষ্ট হবে।

স্বাধীন রাজ্য হিসেবে মেঘালয়ের জন্মের পর থেকে ক্রমাগত যখন অনিতা - অরুণকে তাদের ভিটেমাটি বিক্রি করে চলে যাবার জন্যে ভূমিপুত্র খাসিয়াদের সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হুমকি ধামকি পাঠাচ্ছিল, কখনো চিঠি - চিরকুট লিখে, কখনো দেয়াল লিখনের মাধ্যমে, অরুণ তখন সেসব চেতাবনি, বা হুমকির কাগজপত্র লুকিয়ে রাখে। নিজে থেকে বোঝানোর চেষ্টা করে অনিতাকে, বাড়ি বিক্রি করে অন্য কোথাও গিয়ে উঠতে। কিন্তু অনিতা রাজি হয় না মূলত দুটি কারণে। এক, তার দাদা নীরদচন্দ্রের ফিরে আসার ঠিকানা এ বাড়ি; দুই, তার রিফিউজির মতো ভেসে বেড়ানো জীবন শুরু করতে ইচ্ছে করে না পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে। এ বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে কুৎসিত ঝগড়াও হয়।

সবকিছুর একটা চূড়ান্ত বিলয় ঘটে, যখন একদিন দাঙ্গাবাজ সন্ত্রাসীরা অনিতা - অরুণের বাড়িতে আসলেই আক্রমণ করে। বাড়ি ডাকাতির ফাঁকে তিনজন মিলে ধর্ষণ করে অনিতাকে। এ ঘটনার পর, অনিতার মুখ থেকে আমরা জানতে পারি, অরুণ তার দুঃসময়ে স্টাফ কোয়াটারে লুকিয়ে ছিল। এমনকি বাড়িতে প্রবেশ করে অনিতার মুখোমুখি হবার পরেও তার প্রথম চিন্তার বিষয় থাকে, তাদের গয়নার আলমারির চাবির খোঁজ দস্যুরা পেয়েছে কি না। অরুণের সঙ্গে অনিতার সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের, বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে শিলং ছেড়ে চলে যাওয়ায় অরুণের যে আগ্রহ, তাতে তাদের স্বামী-স্ত্রী দুজনের নিরাপত্তার বিষয়টিই জড়িত ছিল, অনিতার লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার মাধ্যমে আমরা তা নিশ্চিত হই। তবুও, আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, কেন উপন্যাসের এ পর্যায়ে অনিতার রুমে প্রবেশ করে প্রথম দৃষ্টি দেয় ঘরের গুরুত্বপূর্ণ মালামালের দিকেই, তার স্ত্রীকে বাদ দিয়ে? সে ঘরে প্রবেশ করে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরতে পারতো। তার খবরাখবর নিতে পারতো। এতোটা হৃদয়হীন হয়ে গেলো কেন অরুণ?

দ্বিতীয়ত, অনিতা, খাসিয়া সন্তানকে পেটে ধারণ করেই খাসিয়া সমাজে মিশে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। অর্থাৎ, ধর্ষণের নারকীয় ঘটনাটি ঘটবার পর গর্ভপাতে অস্বীকৃতি জানায়। অরুণের গর্ভপাতের প্রস্তাবের জবাবে বলে - "এ শুধু গুন্ডা বদমাইশের, আমার নয়? আমি কি কখনো বলেছি, বাচ্চা চাই না?" (২৭৯)। এ জবাব শুনে বিশ বছর ধরে অনিতাকে কোন সন্তান দিতে না পারা অরুণের আর বলবার মতো কোন কথা থাকে না। আমরা আবিষ্কার করি, কোন শীতবস্ত্র ছাড়াই অরুণ শিলং এর বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে কোলকাতার উদ্দেশ্যে।

কমরেড অরুণের চরিত্রটি কম ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে যায় নি। কিন্তু সে অনুপাতে সহানুভূতিসুলভ বিস্তৃতি কি কিছুটা কম পায় নি সে, উপন্যাসে? আমরা অরুণের মুখ থেকে কোন ঘটনার বিবৃতি পাই? একজন পুরুষ, যে বিশ বছর ধরে সন্তান দিতে পারছে না তার স্ত্রীকে - সে যে ধরণের মানসিক কষ্টের মধ্য দিয়ে যায়, তার বর্ণনা কি আছে উপন্যাসে? আর বিশ বছরের নিস্ফলা জীবনের পর স্ত্রী যখন ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়, সে ধর্ষণের শিকার কি তার স্ত্রী একা হয়, নাকি সেও ধর্ষিত হয়?

প্রশ্ন রাখা যায়। তবে, দিনশেষে পাঠক হিসেবে একটা বোঝাপড়ায় আসা সম্ভব হয় এটা ভেবে যে - হয়তো এ কারণেই যার যার ইতিহাস, তার তারই রচনা করা লাগে। ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস ঔপনিবেশিক প্রভুদের, ঔপনিবেশিকতা উত্তর জনগোষ্ঠীর ইতিহাস তাদের নিজেদের। ধনীর ইতিহাস ধনীর, দলিতের ইতিহাস দলিতের। নারীর ইতিহাস নারীর, পুরুষের ইতিহাস পুরুষের। এরকম আরও অসংখ্য আত্মপোলব্ধির মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়ে পাঠককে ঋদ্ধ করে শাহীন আখতারের অন্যান্য সকল উপন্যাসের মতো, অসুখী দিন উপন্যাসটিও।

(লেখাটি কবি শাখাওয়াত টিপু সম্পাদিত তর্কবাংলায় প্রকাশিত)



সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০২২ রাত ১০:০৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটা গাছ কাঠ হলো, কার কী তাতে আসে গেলো!

লিখেছেন নয়ন বড়ুয়া, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:০৬



ছবিঃ একটি ফেসবুক পেইজ থেকে

একটা গাছ আমাকে যতটা আগলে রাখতে চাই, ভালো রাখতে চাই, আমি ততটা সেই গাছের জন্য কিছুই করতে পারিনা...
তাকে কেউ হত্যা করতে চাইলে বাঁধাও দিতে পারিনা...
অথচ... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×