somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কেমন ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ঈদের দিন?

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




দুই ঈদ তো আমরা প্রতিবছরই পালন করি, কিন্তু আমাদের সবচেয়ে গর্বের সময়টি মুক্তিযুদ্ধের ঈদের সময়টি কেমন থাকতে পারে এমন আগ্রহ থাকাটি দারুন। তবে আসুন দেখি আমাদের প্রাণের একাত্তরের ঈদটি কেমন ছিলো!

১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই সুমহান সময়ে ২০ নভেম্বর ঈদুল ফিতর এসেছিল বাঙালিদের জীবনে। এ রকম ঈদ আর কখনো বাঙালি দেখেনি। সেদিন ঈদের রূপ ছিল ভিন্ন। রণাঙ্গন, শরণার্থী শিবির আর দেশের ভেতরে আতঙ্কের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়েছিল সে ঈদ। ঈদের দিনেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত ছিল বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা।

মুজিব নগরে ঈদের জামাত। প্রথম সারিতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী

পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর—রাজাকার, আলবদর, আল শামস, শান্তিবাহিনীর ধর্মীয় অপ্রচারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঈদ ছিল এক কঠিন পরীক্ষা।

সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান রণাঙ্গন। সারাদেশের নিপীড়িত নির্যাতিত জনগণ গভীর প্রত্যাশা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাকিয়ে ছিল রণাঙ্গনের দিকে। রণাঙ্গনগুলোতেও সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা চালিয়ে গেছেন তাদের যুদ্ধ। বলা যায় একজন যোদ্ধা কখনো তার রণাঙ্গনকে ভুলতে পারে না। হাসি-কান্না সকল কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে তার রণাঙ্গন। মুক্তিযুদ্ধের সেই গৌরবোজ্জ্বল দুঃসহ দিনগুলোতে রণাঙ্গনে রচিত হয়েছে অসংখ্য ইতিহাস। ঈদের দিনে সারাদেশে যুদ্ধের মধ্যে শাহাদাত্ বরণ করেছেন অসংখ্য যোদ্ধা। ঈদের এই দিনে ভুরুঙ্গমারী রণাঙ্গনে সম্মুখ যুদ্ধে শাহাদাত্ বরণ করেন বীর উত্তম লে. আশফাকুস সামাদ। এই যুদ্ধের জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাব লাভ করেন।
’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলা যুদ্ধ করেছিলেন মাহবুব আলম। তাঁর লেখা ‘গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে’—গ্রন্থে উঠে এসেছে সেই অসাম্প্রদায়িক কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার স্মৃতি। তাঁর রণাঙ্গনে ঈদের দিনে হিন্দু সহযোদ্ধাদের নিরাপত্তায় ঈদ জামাত অনুষ্ঠানের এক অনুপম চিত্র পাওয়া যায়। গেরিলা কমান্ডার মাহবুব আলম তাঁর গ্রন্থে লেখেন—‘রমযান মাস শেষ হয়ে আসে। ঈদুল ফিতর এসে যায়। যুদ্ধের ভিতর দিয়েই একটা রোযার মাস পার হয়ে গেলো।... ঈদ এসে গেলো। ছেলেরা ঈদ উত্সব পালনের জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছে।
একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে এরকমের যে, ঈদের দিন পাক আর্মি ব্যাপকভাবে হামলা করবে সীমান্ত এলাকাগুলো জুড়ে। গুজবটা যেভাবেই ছড়াক, যথেষ্ট বিচলিত করে তোলে আমাদের। মুক্তিযোদ্ধারা যখন ঈদের নামাযের জন্য জামাতে দাঁড়াবে ঠিক সে সময়ই নাকি করা হবে এই হামলা!
যুদ্ধের মাঠে শত্রুবাহিনীর সম্ভাব্য কোনো তত্পরতাকেই অবিশ্বাস করা যায় না। ঈদের দিন মুক্তিবাহিনীর দল যখন ঈদ উত্সবে মেতে থাকবে, তারা নামায পড়তে দলবদ্ধভাবে কোথাও সমবেত হবে, তখুনি সুযোগ বুঝে তারা হামলে পড়বে অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। খবর যখন রটেছে, এ ধরনের হামলা তখন পাকবাহিনীর তরফ থেকে হওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই পাকবাহিনীর তরফ থেকে এ ধরনের সম্ভাব্য হামলাকে সামনে রেখে আমরা ঈদুল ফিতর উত্সব উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেই। ঈদ মুসলমানদের জন্য প্রধান উত্সবের দিন। জন্ম থেকেই সবাই এই উত্সব পালন করে এসেছে যার যেমন সঙ্গতি, সে অনুযায়ীই। এখানেও যুদ্ধের মাঠে ছেলেরা ঈদ উত্সব পালনের জন্য মেতে উঠেছে। ঈদের নামায পড়া হবে না, ঈদের উত্সব হবে না, ভালো খাওয়া-দাওয়া হবে না, ঈদের দিন সবাই হাতিয়ার হাতে শত্রুর অপেক্ষায় ওঁত্ পেতে বসে থাকবে, এরকম একটা কিছু কেউই যেন মন থেকে মেনে নিতে পারছে না।


যুদ্ধের মাঠে, দিনরাত ক্লান্তিহীন যুদ্ধ প্রক্রিয়ার ভেতর ছেলেদের রিক্রিয়েশান বলতে কিছু নেই। দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের একঘেয়ে কাজ। অপারেশন আর যুদ্ধ। এক হাইড আউট থেকে অন্য হাইড আউট। গোলাবারুদ আর হাতিয়ার বয়ে বেড়ানো। ছুটি নেই, আরাম নেই, বিশ্রাম নেই। বড়ো একঘেয়ে আর বিরক্তিকর জীবন সবার। এর মধ্যে ঈদের উত্সব একটা খুশির আবহ নিয়ে এসেছে। ছেলেদের এই খুশির ভাগ থেকে বঞ্চিত করতে ইচ্ছে করে না। পিন্টুসহ বসে তাই সিদ্ধান্ত নেই। আর সেটা এ রকমের : ঈদের দিন নামায হবে, বড়ো ধরনের আহার-বিহারের আয়োজন করা হবে। মোদ্দা কথা, ঈদ উত্সব পালন করা হবে যথাসাধ্য ভালোভাবেই। সে অনুযায়ী পরিকল্পনাও করে ফেলে সবাই একসঙ্গে বসে।


সিদ্ধান্ত হয় ঈদের আগের দিন সবগুলো দল দু’ভাগে ভাগ হবে এবং সমবেত হবে দু’জায়গায়। নালাগঞ্জ আর গুয়াবাড়িতে। ছেলেরা তাদের নিজেদের মতো করেই ঈদ উত্সব পালন করবে।
তবে নামায পড়বে একেবারে সীমান্তের ধার ঘেঁষে। গুয়াবাড়িতে সমবেত ছেলেরা ভারতীয় সীমান্তে উঁচু গড়ের পাদদেশে গিয়ে জামাত পড়বে। নালাগঞ্জে জামাত হবে আমগাছ তলায় পুকুরের পাড়ে।
মুসলমান ছেলেরা যখন ঈদের জামাতে দাঁড়াবে, তখন হিন্দু ছেলেরা কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে হাতিয়ার হাতে সতর্ক প্রহরায় থাকবে। হিন্দু সহযোদ্ধাদের দেয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে মুসলমান ছেলেরা নামায পড়বে।
এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয় গুয়াবাড়ি একরামুলের কাছে। সোনারবানে বকর ও শামসুদ্দিনের কাছে। নালাগঞ্জে মুসা আর চৌধুরীও সেভাবেই তৈরি হয়। হিন্দু ছেলেরা তাদের মুসলমান ভাইদের নামাযের সময় পাহারা দেবার দায়িত্ব পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়ে ওঠে। ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে এই যুদ্ধের মাঠে জীবন-মরনের মাঝখানেই সবার বসবাস। এক ধর্মের মানুষ ধর্মীয় আচরণ পালন করবে, আর তাদের নিরাপদ রাখার জন্য ভিন্ন ধর্মের মানুষ হাতিয়ার হাতে পাহারা দেবে, আমার কাছে এ এক অভাবনীয় আর মহামানবিক ঘটনা বলে মনে হয়। হিন্দু ছেলেদের সংখ্যা বেশি না হলেও ঈদের জামাতের সময় তাদের স্বল্পসংখ্যক সদস্য দিয়েই তারা তাদের মুসলমান ভাইদের কিভাবে নিরাপত্তা বিধান করবে, তার পরিকল্পনায় মেতে ওঠে।


ঈদে বড় আয়োজনের আহারাদির বাজেট নিয়ে বসে মিনহাজ। সকালে রান্না হবে সেমাই। দুপুরে কোর্মা-পোলাও ইত্যাদি। আর সে অনুসারেই হিসাব-নিকাশ করে লম্বা একটা ফর্দ তৈরি করে ফেলে সে। হিন্দু ছেলেরা রয়েছে, সেহেতু গরু চলবে না। গ্রামের বন্ধুরা তাদের শুভেচ্ছাস্বরূপ পাঠিয়ে দেয় ৪টা খাসি। এরমধ্যে দুটো পাঠিয়ে দেয়া হয় গুয়াবাড়িতে সেখানকার ছেলেদের জন্য।...
ঈদের দিনের সকাল। উত্সবমুখর পরিবেশ। সবাই আনন্দে উচ্ছল। পাশাপাশি চরম উত্তেজনা পাকবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ হতে পারে। ভারতের নেতৃত্বে ৮-১০ জন হিন্দু ছেলে এগিয়ে খালের পাড়ে গিয়ে অবস্থান নেয়।


সকাল ন’টায় ঈদের জামাত শুরু হয় পুকুর পাড়ে। আমি নিজে দাঁড়াতে এবং লাঠি ধরে চলাফেরা করতে পারলেও নামায পড়তে পারি না। ওরা সবাই ঈদগাহের মতো জায়গায় পরম পবিত্র মনে নামাযে দাঁড়ায়। আমিও লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি জামাতের কাছাকাছি অবস্থানে। যা হোক, যুদ্ধের মাঠেও তাহলে আমরা নামায পড়তে পারছি। গভীর এক প্রশান্তিতে ভরে ওঠে মন। সতৃষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমি তাকিয়ে থাকি ঈদের জামাতের দিকে।’


মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল নুরুন্নবী খান বীর বিক্রম ছিলেন যুদ্ধরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিয়মিত বাহিনীতে। তাঁর ‘একাত্তরের ঈদের এই দিনে’ প্রবন্ধ থেকে ঈদের দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আপ্যায়নের বিষয়টি জানা যায়। তিনি তাঁর প্রবন্ধে লেখেন—
‘একাত্তরের ২০ নভেম্বর রোজ শনিবার ছিল পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের দিন। ঈদের এই দিনে আমি তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা, ইকো এবং ব্যাটেলিয়ন হেড কোয়ার্টার কোম্পানির সৈনিকদের নিয়ে সিলেটের তামাবিল-ডাউকি সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি রাধানগরকে ঘিরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত ছিলাম।

...২০ নভেম্বর পবিত্র ঈদের দিনে আমরা আশা করেছিলাম অন্তত এইদিন পাকিস্তানিরা আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপ বা সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে ছিল এর বিপরীত দৃশ্য। ঈদের দিন সকাল থেকেই পাকিস্তানিরা আমাদের প্রতিটি অবস্থানেই ব্যাপকভাবে আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। আমাদের কোনো অবস্থানেই মুক্তিযোদ্ধারা জামাতের সাহায্যে ঈদের নামায পড়ার সুযোগ পায়নি। তাছাড়া ঈদের দিনে গোসল করা, নতুন জামা-কাপড় পরা বা মিষ্টি-সুজি-সেমাই খাওয়া বা উন্নতমানের খাবারেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দুপুরের দিকে দূরবর্তী গ্রাম থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা কিছুটা উন্নতমানের খিচুড়ি ভার বয়ে নিয়ে এসেছিল। আর্টিলারির গোলা-গুলির মধ্যেই খিচুড়ির টুকরীগুলো বিভিন্ন প্রতিরক্ষা অবস্থানে পৌঁছানো হয়।


২০ নভেম্বর ঈদের দিনে দুপুর ১টার দিকে পাকিস্তানিরা গোয়াইন ঘাট থেকে আসা গ্রাম্য সড়কপথকে আড়াল করে ব্যাপক আর্টিলারি এবং মর্টারের গোলার ফায়ার কভারে আমাদের ছাত্তার গ্রামের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর এক ভয়াবহ আক্রমণ পরিচালনা করে। ধীরস্থির প্রকৃতির সুবেদার আলী আকবর ছিলেন ঐ এলাকার প্রতিরক্ষা কাজে নিয়োজিত। আমি ঐ সময় দুয়ারীখেল গ্রামের অবস্থানে বাংকারে বসে খিচুড়ি খাচ্ছিলাম। তড়িঘড়ি খাওয়া শেষ করে সুবেদার আলী আকবরের অবস্থানের উদ্দেশে রওয়ানা দিই। যাবার পথে ছিল সুবেদার বদির প্লাটুন। সুবেদার বদি এবং তার প্লাটুন থেকে দুটি সেকশনকে সাথে নিয়ে তড়িতে সুবেদার আলী আকবরের অবস্থানে পৌঁছি। একটি অবস্থান থেকে বাইনোকুলারের সাহায্যে দেখতে পাই যে রাস্তার ওপর দু’টি মেশিনগান স্থাপন করে তার ফায়ার কভারে পাকিস্তানিদের একটি বিশাল দল রাস্তাকে আড়াল করে দ্রুতগতিতে আমার ছাত্তার গ্রাম অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে। সুবেদার বদিকে সুবেদার আলী আকবরের সাহায্যে রেখে আমি পিছনে দুয়ারীখেল গ্রামে ৩ ইঞ্চি মর্টার দু’টির অবস্থানে দৌড়ে পৌঁছে যাই। মর্টার দুটির স্থান কিছুটা পরিবর্তন করে দ্রুত অগ্রসরমাণ পাকিস্তানিদের ওপর গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করি। ওদিকে সুবেদার বদি এবং সুবেদার আলী আকবরের অবস্থানগুলি থেকেও গোলা নিক্ষেপ শুরু হয়। মুহূর্তেই পাকিস্তানিরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পিছু হটতে শুরু করে। সুবেদার বদি গ্রাম্য রাস্তার কভারে গোয়াইন সড়ক পর্যন্ত পাকিস্তানিদের ধাওয়া করে ফিরে আসেন।’


ঈদের দিন মুক্তিযোদ্ধারা দেশজুড়ে নতুন আক্রমণে ঝাপিয়ে পড়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দলিলপত্রে দেখা যায় বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী বা মুক্তিফৌজ এদিন বসন্তপুর সীমান্ত চৌকির দখল নেয়। আর হিঙ্গলগঞ্জ থেকে ভারতীয় বাহিনী ইছামতি নদী অতিক্রম করে যোগ দেয় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে, বসন্তপুর ও কালীগঞ্জকে মুক্ত করে। সাপ্তাহিক জয় বাংলা একজন বিদেশী সাংবাদিকের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে : সাত মাস পাক বাহিনীর দখলে থাকার পর কালীগঞ্জ মুক্ত হয়। ১৯ নভেম্বর উকসার দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে মুক্তিবাহিনী। পাকিস্তানীর পিছু হটে অবস্থান নেয় ইছামতির পূর্ব পারে। সারারাত লড়াই চলে। শনিবার বেলা ১২টার দিকে কালীগঞ্জ থেকে পালায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা। এ ব্যাপারে আরো ডিটেলে জানিয়েছেন ৯ নম্বর সেক্টরের যোদ্ধাদের একজন ওবায়দুর রহমান মোস্তফা। তার ভাষ্যমতে, কালীগঞ্জের ওয়াপদা কলোনীতে এক কোম্পানী পাকসেনার সঙ্গে পাকিস্তানী রেঞ্জার ও বেশ কিছু রাজাকার অবস্থান নিয়েছিলো।



উকসা বিওপি ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা এটি আক্রমণ করতে রওয়ানা হন। এক কলাম যোদ্ধা নিয়ে বসন্তপুর হয়ে কালীগঞ্জ পৌছান তিনি। দু প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কাছাকাছি অবস্থান নেন লে. আহসানউল্লাহ এবং নায়েক সুবেদার সোবহান। আরেক প্লাটুন যোদ্ধা নিয়ে তাদের সঙ্গী হন নায়েক সুবেদার গফুর। ভোর পাচটায় মুক্তিবাহিনী আক্রমণ শুরু করে। হিঙ্গলগঞ্জ থেকে তাদের আর্টিলারি সাপোর্ট দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৃতীয় রাজপুত। দুঘণ্টার এই যুদ্ধ শেষে ৪০ জন পাকিস্তানী সেনা বন্দী হয়।

এদিন উপলক্ষ্যে ইয়াহিয়া খানের বাণী ছিলো, ‘দেশের জনগণের দুর্দমনীয় সাহস ও সেনাবাহিনীর জেহাদী শক্তি আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার কবচ।’ পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধরত সৈনিকদের জাতির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পাশাপাশি ভারতে উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরার আহ্বান জানান। তাদের সব ধরণের নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের আশ্বাস দেন তিনি। গভর্ণর মালিক তার বাণীতে বলেন, ‘ঈদের শিক্ষার মাধ্যমেই আমরা জাতীয় সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম হবো। দেশরক্ষায় যুদ্ধরত যেসব সৈনিক তাদের পরিবার পরিজনদের সঙ্গে মিলিত হতে পারছেন না তাদের এই ত্যাগ জাতি চিরদিন স্মরণ করবে।’ পল্টন ময়দানে এদিন ঈদের জামাত পড়েন মালিক। সেখানে নামাজীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘এদেশের এক শ্রেণীর নেতারা জনগণকে বিপথে পরিচালনা করছে। জনগণের অধিকার আদায়ের নামে তারা জয় বাংলা ধ্বনি তুলছে, যা পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি ও অখন্ডতা বিপন্ন করে তুলছে।’ ঈদ উপলক্ষ্যে রাজাকারদের বেতন-ভাতা বাড়ার ঘোষণা আসে।পাকিস্তান অবজারভারে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায় কোম্পানি কমান্ডারদের বেতন নির্ধারিত হয় রেশনসহ ২৫৫ রুপি, রেশনছাড়া ৩০০ রুপি। প্লাটুন কমান্ডারদের রেশনসহ ও ছাড়া যথাক্রমে ১৩৫ ও ১৮৫ রুপি। সাধারণ রাজাকারদের ক্ষেত্রে অঙ্কটা দাড়ায় ৭৫ ও ১২০ রুপি।


আজ ঈদ। ঈদের কোনো আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারো জামাকাপড় কেনা হয়নি। দরজা জানালার পর্দা কাচা হয়নি। বসার ঘরের টেবিলে রাখা হয়নি আতরদান। শরীফ, জামি ঈদের নামাজও পড়তে যায়নি। কিন্তু আমি খুব ভোরে উঠে ঈদের সেমাই, জর্দা রেঁধেছি। যদি রুমীর সহযোদ্ধা কেউ আজ আসে এ বাড়িতে? বাবা-মা-ভাই-বোন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন গেরিলা যদি রাতের অন্ধকারে আসে এ বাড়ীতে? তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য আমি রেঁধেছি পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, কাবাব। তারা কেউ এলে আমি চুপিচুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াবো। তাদের জামায় লাগিয়ে দেবার জন্য একশিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি। (একাত্তরের দিনগুলি : জাহানারা ইমাম)



(ঈদের আগের দিন প্রকাশিত জয় বাংলা)

ঈদের আগের দিন কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র সাপ্তাহিক জয় বাংলার ২৮তম সংখ্যা।





যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বাণী এই উপলক্ষ্যে বক্স আইটেম করে পত্রিকাটি।


এই ঈদে আমাদের প্রার্থনা হোক এই শিরোনামে লেখা হয়, ‘আমাদের দেশে এবার ঈদ এসেছে অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিবেশে। দখলীকৃত এলাকায় শত্রুসৈন্যের তান্ডব চলছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন. মুক্ত এলাকায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, রক্তের বিনিময়ে মানুষ মাতৃভুমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম করছে। এবার ঈদে আনন্দ মুছে গেছে আমাদের জীবন থেকে, আছে শুধু স্বজন হারানোর শোক, দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের প্রবল সংকল্প।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং আমার নিজের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনসাধারণকে ঈদ উপলক্ষে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঈদের যে আনন্দ আজ আমরা হারিয়েছি, তা আমাদের জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে সেদিনই, যেদিন আমরা দেশকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করব। আমি আপনাদের আশ্বাস দিচ্ছি যে, যথাসর্বস্ব পণ করে যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা লিপ্ত, তার চূড়ান্ত সাফল্যের দিনটি নিকটতর হয়ে এসেছে। সেই মুহূর্তটিকে এগিয়ে আনার সংগ্রামে আমরা সকলে যেন নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের নিয়োগ করতে পারি, এই ঈদে তাই হোক আমাদের প্রার্থনা।




একাত্তরের ঈদের আগের দিন সাপ্তাহিক জয়বাংলার ২৮ তম সংখ্যায় সম্পাদকীয় কলামে 'উৎসবের ঈদ নয়, ত্যাগের ঈদ' শিরোনামে' ঈদ উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর বাণী প্রচার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বাণীর একটি অংশ ছিল: আমি নিজেকে বাঙালী ভাবতে গর্ববোধ করি। বহতা নদীর মতো আমাদের সংস্কৃতির ধারাও বেগবতী ও প্রাণাবেগপূর্ণ। আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হলে বাঙালী আবার বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়াবে। বাঙালী হওয়ার সঙ্গে ধর্মে মুসলমান থাকার কোন বিরোধ নেই। একটি আমার ধর্ম। অন্যটি জাতি পরিচয়। ধর্ম আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচার। জাতি পরিচয় আমার সমষ্ঠিগত ঐতিহ্য। একজন হিন্দু বাঙালী ও মুসলমান বাঙালী অথবা, বৌদ্ধ বা, খ্রীষ্টান বাঙালীর মধ্যে পার্থক্য এটুকুই যে, তাদের ধর্মমত শুধু আলাদা কিন্তু খাদ্য, রুচি, ভৌগলিক পরিবেশ, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, বর্ণ ও রাজনৈতিক লক্ষ্যের দিক থেকে তারা অভিন্ন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:০৫
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×