somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রক্ত দিয়ে গোসল করানো একজন জননীর কথা

০১ লা এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আপন সন্তানের রক্তদিয়ে মাকে গোসল করিয়ে দিলো। মা নিরবালা দেবী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলেন বিহারির ছেলেরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, জয়বাংলা, আওয়ামী লীগকে বিশ্রী ভাষায় গালমন্দ করছে। আর তলোয়ার চালিয়ে যাচ্ছে। কচুগাছ কাটার মতো করে কাটছে দক্ষিণ কাট্টলী মধ্যম নাথপাড়ার হিন্দু পরিবারের মানুষজনদের। পালিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। চারদিকে অর্থাৎ গ্রামের চারদিকে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ঘেরাও দিয়ে রেখেছে। বিহারির ছেলেদের কারো হাতে বলম, কারো হাতে গরু জবাই করার ছুরি, কারো হাতে কিরিচ। বাঙালি নিধনে যারা দায়িত্ব পালন করছে তারা সবাই কসাই। হালিশহর এ ব্লক, বি ব্লকসহ বিভিন্ন ব্লকের অবাঙালি ছেলে।
সেদিন ছিলো ৩১ মার্চ ১৯৭১, দিনটি ছিলো বুধবার। হালিশহর ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি সৈন্যরা পাকিস্তানিদের জীবনপণ করে ২৫ মার্চ থেকেই প্রতিরোধ করে আসছিলেন। গ্রামের প্রতিটি ঘর থেকে যুদ্ধেরত সৈন্যদের জন্য খাদ্য, পানীয় সরবরাহ করে যার যার অবস্থান থেকে স্বাধীনতার জন্য ভূমিকা রেখেই চলেছিলেন। সাগর থেকে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ আকবর থেকে ইপিআর ক্যাম্পের উপর প্রচণ্ডভাবে শেলিং শুরু করে। ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে যুদ্ধেরত ইপিআর সৈন্যরা ভবিষ্যৎ যুদ্ধের কথা ভেবে কৌশলগত পিছিয়ে আসেন। আশ্রয় নেন যুদ্ধ স্থলের নিকটবর্তী গ্রামগুলোতে। গ্রামের মানুষ তাদের লুঙ্গি, প্যান্ট, জামাকাপড় এবং অর্থ দিয়ে পালিয়ে যেতে বা নিরাপদ স্থানে চলে যেতে সাহায্য করেছিলেন।
দুর্ভাগ্য মাইজপাড়ার নাথ পরিবারগুলোর। হঠাৎ করেই পুরো গ্রামের চারপাশে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঘিরে ফেলেছে। ঐ গ্রামে তখন প্রায় দুই শতাধিক ইপিআর সৈন্য আশ্রয় নিয়েছিলো। বিহারিরা ইপিআর ক্যাম্পে দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের নিকট পাকিস্তানি পতাকা হাতে নিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি তুলে উপস্থিত হয়। সাচ্চা উর্দুতে কথা বলে ইপিআর সৈন্যদের তথ্য এবং নাথ পাড়ার হিন্দুরা তাদের আশ্রয় দিয়েছে এমন কথা বলে এদের নিয়ে আসে। এসেই তারা গোলাগুলি শুরু করে। বিহারির ছেলেরা এলোপাতাড়ি ছুরি চালাতে থাকে। গ্রামের সব হিন্দু পরিবারগুলো নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে ছুটে আসে যুগল কৃষ্ণ নাথ মহাজনের বাড়িতে। মোটা মাটির দেয়ালের দোতলা বাড়ি, সামনে বড় মন্দির। গ্রামের অন্যান্য ঘরের তুলনায় নিরাপদ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রথম পর্যায়ে শতাধিক ইপিআর সৈন্যদের হত্যা করেছে, আর বিহারির ছেলেরা পাড়ার নারী-পুরুষদের হত্যা করেছে। মন্দির জ্বালিয়ে দিয়েছে, নারী পুরুষদের জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেছে। যারা বাড়ি থেকে পালিয়ে বের হয়েছে, কেউ কেউ পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছে। তাদেরকে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পুকুরেই হত্যা করেছে। কাউকে পেট্রোলের ড্রামে ঢুকিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, মার কোল থেকে শিশু নিয়ে তলোয়ার দিয়ে দেহ থেকে মাথা আলাদা করে দিয়েছে।
বাংলা অনার্স পড়ুয়া দুলাল কান্তি নাথ ও ম্যানেজমেন্টের ছাত্র বাদল কান্তি নাথকে মায়ের সামনে হত্যা করে সে রক্ত বালতিতে ভরে মা নিরবালা দেবির মাথায় ঢেলে দিয়েছে, গোসল করিয়ে দিয়েছে। দীনেশ কান্তি নাথ ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী। তিনি ছিলেন ৬ দফার পক্ষের মানুষ। তাঁকে ছয় টুকরো করে ঘাতক বিহারি কসাইরা বলেছে, এক এক টুকরো মানে এক দফা। প্রায় দুই শতাধিক বাঙালি নিধনের পর ঘাতকরা শহীদ মানুষগুলোকে একস্থানে এনে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারপর চলে লুণ্ঠন পর্ব। পাড়ার সব ঘর থেকে, মহিলাদের গলা, হাত, কান থেকে স্বর্ণালংকার খুলে নেয়। টাকা পয়সা এবং মূল্যবান সম্পদ লুটে নেয়। বাড়ির প্রায় প্রতিটি ঘরের মেঝ খুঁড়ে দেখেছে সম্পদ লুকিয়ে রেখেছে কিনা। প্রতিটি বাড়ির মালপত্র, দরজা, জানালা, ইট পর্যন্ত খুলে নিয়েছে ঘাতক বিহারিরা। এমনকি বড় বড় গাছগুলোও কেটে নিয়েছে। চট্টগ্রামের প্রথম বধ্যভূমি বোধকরি এটাই ছিলো বাংলাদেশের প্রথম বধ্যভূমি। বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই গ্রামের হিন্দু পরিবারগুলোর উপর হত্যাযজ্ঞ। এই হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষ দর্শী ক’জনের বিবরণ এখানে তুলে ধরা প্রয়োজনবোধ করছি।
নিহার বালা দেবী খুকু : সবাই ডাকেন কুকু রাণী দেবী। তখন তার বয়স ছিলো ১৫/১৬। পিএইচ আমিন একাডেমি থেকে ৮ম শ্রেণি পাস করে ৯ম শ্রেণিতে উঠেছেন। সেদিনের হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে বলেন, ২৬ মার্চ থেকে পাড়ার সবাই বেশ আনন্দে ছিলেন। রাজনীতি বুঝতাম না। বাঙালি সৈন্যরা বাড়ির আশেপাশে এসেছে। দেখার জন্য রাস্তাঘাটে ছুটাছুটি করেছি। গোলাগুলির শব্দ হয়েছে। তেমন ভয় পাইনি। ৩১ মার্চ বুধবার দুপুরের দিকে শুনি বিহারিরা আমাদের পাড়া ঘিরে ফেলেছে। ভয় পেতে শুরু করলাম। পাড়ার অন্যান্য বাড়ির মহিলা ও পুরুষ আমাদের বাড়ির দেয়াল দেয়া ঘরে এসেছেন। আমরা সবাই একঘরে ঢুকলাম। বিহারিরা এসে ঘরের দরজা খুলতে বললো। তারা বলছে ঘরে ইপিআর সৈন্য আছে। আমি চিৎকার দিয়ে বললাম, এখানে কোনো ইপিআর সৈন্য নেই। তারা বিশ্বাস করলো না। দরজা খুলতে বলে দরজায় প্রচণ্ড আঘাত করতে লাগলো। দরজা খুলতে হলো। তারপর ঘরের মানুষদের কচুগাছ কাটার মতো করে তলোয়ার চালালো। আমাদের দাদা দুলাল ও বাদলকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে বললো, জয় বাংলা এখন তোমাদের বাঁচাতে আসে কিনা দেখি। তাদেরকে আমার সামনে হত্যা করলো। আমি আমার দাদার দেহকে বুকে নিয়ে খাটের নিচে পড়ে রইলাম। আমার দাদাদের রক্ত দিয়ে মাকে গোসল করিয়েছে। একে একে সবাইকে হত্যা করে ঘরে কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করেছে আমি মরে গেছি কিনা তা নিশ্চিত হতে। আমার জ্ঞান ছিলো না। পরে যখন জ্ঞান হলো দেখি পুরো ঘরে আগুন জ্বলছে। আমার দেহের বিভিন্ন অংশ জ্বলে গেছে। কেমন করে যেন জ্বলন্ত শরীর নিয়ে পাশের আবদুর পাড়ায় গেলাম। সেখানে তারা আমার সেবা করলো। পরে তারা আমাকে কোলে করে অনেক কষ্টে কুমিরায় নিয়ে যায়। দীর্ঘদিন আমার পোড়া ঘা শুকায়নি। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। যুদ্ধের পর বাড়িতে এসে দেখি বাড়িঘর কিছুই নেই। ঘরের ইটও নেই।
নারায়ণ চন্দ্র বৈষ্ণব : যুদ্ধের আগে থেকেই নারায়ণ চন্দ্র বৈষ্ণব প্রগতিশীল আন্দোলনে ছিলেন। ১৯৬৯-এ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা নিয়ে চাকুরির আশায় ছিলেন। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জন্য খাটেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেন। যুদ্ধ শুরু হলে ভূমিকা রাখেন। ৩১ মার্চ ১৯৭১ এর বুধবার তাদের পুরো পরিবার এবং পাড়ার উপর নেমে আসে বিহারিদের তান্ডব। সে তান্ডবের প্রত্যক্ষদর্শী এই নারায়ণ চন্দ্র বৈষ্ণব। সে ভয়াল দিনের চাক্ষুস দেখা ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেদিন পাকিস্তানি সৈন্য ও বিহারিরা আমাদের পাড়া ঘেরাও করে ফেলে। বাঙালি সৈন্যরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়লেও ভারী অস্ত্রের বিরুদ্ধে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। তাদের অনেকে আমাদের পাড়ায় প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে এবং পরবর্তী সময়ে আশ্রয় নেয়। আমাদের পাড়া আক্রান্ত হলে বাড়ির সবাই যুগল কৃষ্ণ মহাজনের বাড়িতে একত্রিত হয়। আমি আমার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচার চেষ্টায় হরিপদ বাবুদের মন্দিরের ছাদে আশ্রয় নেই। ছাদে শুয়ে শুয়ে শুনেছি পাড়ার আত্মীয়স্বজনদের মৃত্যুকালীন আর্তনাদ। বিকেল ৫টায় বিহারিরা চিৎকার দিয়ে মন্দিরের ওপর উঠতে চায়। এ অবস্থায় একজন ইপিআর সৈন্য দাঁড়িয়ে বলে, আমি মুসলমান। পাকবাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে। আমরা দু’জন অন্যকিছু চিন্তা না করে আগুনের ওপর নিচে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি। আগুনে পুড়ে আমাদের দেহ ও পা ঝলসে যায়। আমাদের সেদিকে খেয়াল নেই। ছুটে পালাতে থাকি। বিহারিরা আমাদের ধরতে চেষ্টা করে, গুলি ছোঁড়ে। কোনো রকমে পালিয়ে যাই পাশের আবদুর পাড়ায়। সেখানে তারা আমাদের সেবা করে। পরে লোকজন আমাকে উত্তর নাথ পাড়ায় নিয়ে যায় এবং আমার চিকিৎসা করে। সন্ধ্যার পর আমার মা কাঁদতে কাঁদতে আসেন এবং বলতে থাকেন কাকে কি করে তার সামনে হত্যা করেছে। আমি বেঁচে আছি মা জানতেন না। আমার ছোট ভাই নিমাই বৈষ্ণব তখন ৮ বছরের। সে হত্যাযজ্ঞের সময় হারিয়ে যায়। পরে তাকে কুমিরায় পাওয়া যায়। বিহারিরা আমার ছোট ভাই বাসুদেব বৈষ্ণব (১৫) পিতামহ হরিমোহন বৈষ্ণব (৭০), পিসে মশাই নরহরি বৈষ্ণব (৫৫)-কে মায়ের সামনে হত্যা করেছে। মা আমাকে নিয়ে ভাটিয়ারী পৌঁছেন। আমার শরীর পোড়ার কারণে আর এগুতে পারিনি। জেলের নৌকায় করে চলে যাই সন্দ্বীপ। সেখানে মাইটভাঙা গ্রামে নবদ্বীপ গোসাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় পাই। সেখানে আশ্রয়দাতাদের সেবায় আমি সুস্থ হয়ে উঠি। দেশ স্বাধীন হলে নিজ ভিটায় ফিরে আসি। তখনকার সময়ে আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান ডা. বদিউল আমিনের সার্বিক সহযোগিতায় পোড়া ভিটায় বসতি স্থাপনের মাধ্যমে ফিরে আসি। দুঃখের বিষয় আমাদের অবৈধ একোয়ারের জমি এখনো ফিরে পাইনি। বিধিমোতাবেক আমাদের ফিরে পাওয়ার কথা। এখনো পায়নি শহীদ পরিবারের মর্যাদা।
বিকাশ কান্তি নাথ : ছয় দফাপন্থী দীনেশ কান্তি নাথ (২৫)-কে হত্যা করে ৬ টুকরো করে। সমীরণ চন্দ্র নাথকে হত্যা করে বর্ষা দিয়ে। সুনীল চন্দ্র মনু (১৭)-কে হত্যা করে গরুর ছাগলের মতো জীবিত অবস্থায় গায়ের চামড়া তুলে। বনমালী নাথের মেয়ে মিনু রাণী (৪) কে হত্যা করে তার মায়ের কোল থেকে নিয়ে। নরহরি বৈষ্ণবকে হত্যা করে টোটা দিয়ে। গণেশ চন্দ্র সাহা (৪০) ও হেমেন্দ্র লাল সাহা (৪৫) কে হত্যা করে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে। ডা. বাদল কান্তি নাথের বড় ভাই নারায়ণ চন্দ্র নাথকে হত্যা করে তেলের ড্রামের ভিতরে ঢুকিয়ে আগুন লাগিয়ে। অনিল বিহারী নাথকে পুকুরে গুলি করে হত্যা করে।
শেফালী প্রভা দেবী : সেদিন বাড়িতেই ছিলাম। রান্না করছিলাম। ইপিআরদের জন্য খাওয়া পাঠাতে হবে। গ্রামের সবাই যে যা পারছে ইপিআরদের জন্য পাঠাচ্ছে। এক সময় শুনতে পেলাম গোলাগুলি বেড়ে গেছে। গ্রামের মানুষের মাঝে হৈচৈ। ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। দেখি কোনো কোনো ঘরে আগুন জ্বলছে। কী করবো বুঝতে পারছি না। শুনতে পেলাম নারায়ে তকবির-আল্লাহু আকবর োগান। বিহারিরা গ্রামে ঢুকে গেছে। একদিকে আগুন অন্যদিকে গোলাগুলি। কোনদিকে যাবো, কি করবো বুঝতে পারলাম না। কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে ঝাঁপ দিলাম পুকুরে। সাথে আমার স্বামী বনমালী দেবনাথ। আমার কোলে ৪ বছরের মিনু রাণী দেবী এবং আমার স্বামী কোলে এক বছরের আলপনা দেবী। পানিতে নাক উচিয়ে রয়েছি। বিহারিরা দেখে ফেললো। গুলি করলো আমাকে। গুলি লাগলো আমার ৪ বছরের মেয়ে মিনুর মাথায়, সে পুকুরেই মারা গেলো। আমার স্বামীও মারা গেলেন।
আমাকে প্রচণ্ডভাবে রাইফেল দিয়ে মেরেছে। মরার মতো পড়ে রইলাম। তারা মনে করেছিলো আমি মারা গেছি। তাই তারা চলে যায়। দেখেছি গ্রামের মানুষকে কীভাবে জবাই করে হত্যা করেছে। জ্ঞান তেমন ছিলো না। কেমন করে যেন চলে এলাম আমি উত্তর নাথ পাড়ায়। পরে জেনেছি, আমার ঘরের দুই দেবরকেও তারা হত্যা করেছে। কিছুদিন পর অনেক কষ্টে চলে আসি কুমিরা, সীতাকুণ্ড হয়ে ভারতে। সেখানে সাব্রম হাসপাতালে চিকিৎসা হয়। উন্নত চিকিৎসা হয় আগরতলার জিবি হাসপাতালে। কোনো স্বজন পরিজন ছিলো না। ডান চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। তিন মাস চিকিৎসার পর একদিন দেখি আমার গ্রামের ভাই নীলু দেবনাথ সেও হাসপাতালে। তাঁকে পেয়ে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরেছি। তাকেই প্রথম পেলাম তার বয়স তখন ১৪/১৫ হবে। পুরো যুদ্ধে অরন্ধতি ক্যাম্পে ছিলাম। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসেছেন দেখতে। অনেকে সাক্ষাতকার নিয়েছেন। একমাত্র মেয়ে আলপনাকে নিয়ে এখনো বেঁচে আছি। ঘর নেই, বর নেই, সংসার নেই। এ অবস্থায় এখনো বেঁচে আছি স্বাধীন বাংলার মাটিতে।
নিলু দেবনাথ : তখন বয়স ১৪ হবে। ৮ম শ্রেণি থেকে ৯ম শ্রেণিতে উঠেছি। গোলাবর্ষণ হচ্ছিলো। চারদিকে গ্রামের মানুষ হৈ চৈ করছে, আগুন জ্বলছে। বাবা মুকুন্দ লাল নাথ সাবধান করছেন। গুলি থেকে বাঁচার জন্য পরিখায় ঢুকলাম। শোরগোল আরো বেড়ে গেলো। বুঝতে পারলাম গ্রামের ভিতরে বিহারিরা ঢুকেছে। বেরিয়ে আসলাম। পালানোর চেষ্টা করলাম। কে কোন দিকে গেলো বুঝতে পারলাম না। আটকা পড়ে গেলাম বিহারি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। এমন সময় দেখি একজন সৈন্য রাইফেলের নল ঘুরাচ্ছে অন্যদিকে। এ ফাঁকে প্রচণ্ড শক্তিতে দৌঁড়াতে শুরু করলাম। তারা আমাকে ব্রাশ ফায়ার করলো। আমার হাতে গুলি লাগলো, পড়ে গেলাম। জ্ঞান তখনো ছিল। তবে কোনো রকম নড়ানড়ি না করে চুপ হয়ে মৃতের মতোই রইলাম। তারা মনে করলো মরে গেছি। পাকিস্তানি ঘাতকরা সরে গেলে ঝুলন্ত হাতকে চেপে ধরে চলে যাই পাশের আবদুর পাড়ায়। সে গ্রামের আবদুর রহমান আমাকে বাঁচাতে এসে তিনিও আহত হন। এরপর চলে যাই ডা. যোগেশ চন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে, তিনি আমার চিকিৎসা করান। তারপর উত্তর কাট্টলী, সীতাকুণ্ড, মীরসরাই হয়ে আসি জোরারগঞ্জ। সেখানে শুধাংশ মাস্টারের বাড়িতে ১৫ দিন থেকেছি। পাকিস্তানি বাহিনী সে এলাকায় এলে চলে যাই ভারতে। রেডক্রসের সহযোগিতায় আসি জিবি হাসপাতালে। এরই মধ্যে আমাদের দেখতে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি আমাদের কাপড়-চোপড় ও অর্থ প্রদান করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম আমাদের ইন্টারভিউ গ্রহণ করে। মোটামুটি সুস্থ হয়ে হাঁটা-চলা করতে পারছিলাম। একদিন বিকেলে হাসপাতালের ছাদে উঠে দেখি পাশের বিল্ডিং এ আমাদের দিদি শেফালী প্রভা দেবীকে। তিনিও আমাকে দেখেন। পাগলের মতো ছুটে এসে আমরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরি।
এই প্রথম আমরা স্বজনের দেখা পেলাম। তারপর জানতে পারলাম গ্রামের হত্যাযজ্ঞের আরো কথা। দিদির একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। তিনিও ঐ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে আসি। ছিলাম হাজী ক্যাম্পে। পরে নিজের বাড়িতে এসে দেখি কুকুরে মরা মানুষ টেনে টেনে তুলছে। পুরো বাড়িতে মানুষের হাঁড়গোড় পড়ে রয়েছে। ভয়ে চলে যাই। পরদিন কাউকে না বলে আবারো চলে যাই ভারতে। ভয়ে আর গ্রামে ফিরিনি।
আবদুর রহমান : যুদ্ধের সময় বয়স ছিলো ২৫ বছর। পান দোকান করতাম। ৩১ মার্চ ১৯৭১ বুধবার মধ্যম নাথ পাড়ায় যাই। আটকে পড়ি। আমাকে গুলি করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। গুলি হাতে লাগে। বেঁচে গেছি কিন্তু পঙ্গু হয়ে যাই। আমার সাথে নাথ পাড়ায় মারা যায় আবুল হাশেম পটল।
মধ্যম নাথপাড়ার সেই তলোয়ার : বিহারী ঘাতকরা বেশ কিছু তলোয়ার হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করেছিল। দুটি তলোয়ার তারা হত্যাকান্ডের পর নিকটস্থ ডোবায় ফেলে যায়। এই তলোয়ারটি শহীদ হরিরঞ্জন নাথের বাড়ির পুকুর কাটার সময় তার জীবিত দুই পুত্র সুনীল কান্তি নাথ ও মৃণাল কান্তি নাথ উদ্ধার করে ১৯৯৭তে। এই তলোয়ারের দৈর্ঘ্য ৪২ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ৩ ইঞ্চি। এই তলোয়ারটি খুুকু রাণী ৩১ মার্চ ১৯৭১ সালে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এই তলোয়ারের আঘাতে অনেকের মাথা থেকে দেহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
মধ্যম নাথ পাড়া হত্যাকাণ্ড শেষ পর্যায়ে বিহারির ছেলেরা পার্শ্ববর্তী আবদুর পাড়া আক্রমণ করে। নাথদের পাড়া আক্রমণের সংবাদ পেয়ে আবদুর পাড়ার প্রায় সবাই পালিয়ে যায়। এই পাড়াও অনেক ইপিআর সৈন্য আশ্রয় নিয়েছিলো। এখানে মানুষজন না পেয়ে ঘাতকরা বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রাশ ফায়ার করে। এতে শহীদ হন আজগর আলী, মোহাম্মদ ইসহাক, সিদ্দিক আহমদ, বাবুল হক, আবুল খায়ের প্রমুখ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এলাকাবাসী গ্রামটির নামকরণ করেন শহীদ মধ্যম নাথ পাড়া। পূর্বে নাম ছিলো মাইজপাড়া। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এখানে ৪২ জন শহীদের নাম নিয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করে। এই স্মৃতিসৌধের জন্য জমিদান করেছেন বিমল কান্তি নাথ, শ্যামল কান্তি নাথ ও নির্মল কান্তি নাথ। স্থপতি ছিলেন ঢালি আল মামুন। এখানে শহীদ হওয়া ইপিআর সৈনিক ও বাইরের মানুষের নামগুলো পাওয়া যায়নি।

তথ্য কৃতজ্ঞতা -
১. নিহার বালা দেবী খুুকু, অগ্নিকুণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া, তখন বয়স ছিলো ১৪ বছর।
২. সুনীল কান্তি নাথ, তখন বয়স ছিলো ৮ বছর, বাইরে ছিলেন বলে বেঁচে যান।
৩. একাত্তরের বধ্যভূমি মধ্যম নাথপাড়া ও আবদুর পাড়া, বুকলেট, সাখাওয়াত হোসেন মজনু
৪ দৈনিক আজাদী
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১২:০৪
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×