somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজম খান, এক অদম্য যোদ্ধা!

০৫ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৪:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১৯৬৮ সাল। তাঁর বয়স তখন সতের কি আঠারো। ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে স্বভাবের, ভয়ডর কম। ‘ক্রান্তি’ শিল্পী গোষ্ঠীর হয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গান গাইতে গিয়ে একবারও বুক কাঁপেনি।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, “কত জেলায় জেলায় ঘুরেছি তখন। গান করেছি। আবার পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌড়ও দিছি। তার পরেও পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গান করা থামাই নাই। আমাদের দলে ছিল ফকির আলমগীর, মেসবাহ উদ্দিন সাবু সহ আরও অনেকে।”
তরুণ বয়সেই বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তান সরকার এদেশের মানুষদের ঠকাচ্ছে। তাই ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল সক্রিয়। ১৯৭০ এর নির্বাচন আর এর পরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাকে যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলে।



এরপর এলো ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ। সেদিন সকাল থেকেই সারা ঢাকা শহরের মানুষ টের পাচ্ছিল রাতে কিছু একটা হবে। আজম খানদের পৈতৃক বাড়ি কমলাপুরে। তিনি ও তার পাড়ার বন্ধুরা মিলে এলাকার আশে পাশে ব্যারিকেড তৈরি করলেন। বাসা থেকে এক নলা, দো’নলা বন্দুক, দা, বটি, লাঠি, বাঁশ ইত্যাদি জোগাড় করতে শুরু করলেন। মনে প্রতিজ্ঞা, পাকিস্তানি বাহিনী যখনই আসুক তারা এসব অস্ত্র দিয়েই প্রতিরোধ করবেন।
প্রথম প্রতিরোধর ব্যাপারে তিনি বলেন, “অস্ত্র যোগাড় করছিলাম, মিলিটারি ঠেকাব তাই। কিন্তু তখন কী আর জানতাম পাকিস্তানি মিলিটারি ট্যাঙ্ক নামাবে।”
রাতের বেলা শুরু হলো গোলাগুলি। ব্যারিকেড কোথায় উড়ে গেল। “আমাদের বাড়িটা গলির ভিতর বলে এই দিকে মিলিটারি সেই রাতে ঢুকে নাই। কিন্তু আশপাশের এলাকা, কমলাপুর রেল স্টেশন, রাজারবাগ পুলিশ লাইন সব কিছু দখল করে নিলো মিলিটারিরা। আমরা তো আর ঘরে বসে নাই। বন্ধু বান্ধবরা সবাই মিলে একেক সময় একেক বাসার ছাদে গিয়ে উঁকি দিয়ে মিলিটারিদের ধ্বংসযজ্ঞ দেখি। শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারলাম না বাসায়। ভোরের আগে আগে মসজিদে গেলাম। যাতে আমাদের মুসলমান মনে করে মিলিটারিরা গুলি না করে।”তখন মসজিদে গেলেন কী করে, মিলিটারি ছিল না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, “রাতের অন্ধকারেই চলে গেছিলাম। যাওয়ায় অসুবিধা হয় নাই। ভোরের আলো ফোটার পর দেখি কমলাপুর স্টেশনে মিলিটারিরা ঘাঁটি গাড়ছে।”
মসজিদ থেকেই উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখেন মিলিটারিরা বাসার ছাদের ওপর ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা গুলি করে ফেলে দিচ্ছে। তাঁদের বাসার ছাদেও উড়ছিল পতাকা। আজম জানান, “সেটা বাঁচানোর জন্য আমার বোন ছাদে ওঠে। পতাকা খুলতে চেষ্টা করে। আমি সেটা দেখে দৌড়ে বাসায় যাই। বোনরে বলি-নাম নাম গুলি লাগব। এই বলতে বলতেই তার মাথার পাশ দিয়া একটা গুলি চলে গেল। অল্পের জন্য বেঁচে গেল আমার বোনটা।”

তের বেলা শুরু হলো গোলাগুলি। ব্যারিকেড কোথায় উড়ে গেল। “আমাদের বাড়িটা গলির ভিতর বলে এই দিকে মিলিটারি সেই রাতে ঢুকে নাই। কিন্তু আশপাশের এলাকা, কমলাপুর রেল স্টেশন, রাজারবাগ পুলিশ লাইন সব কিছু দখল করে নিলো মিলিটারিরা। আমরা তো আর ঘরে বসে নাই। বন্ধু বান্ধবরা সবাই মিলে একেক সময় একেক বাসার ছাদে গিয়ে উঁকি দিয়ে মিলিটারিদের ধ্বংসযজ্ঞ দেখি। শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারলাম না বাসায়। ভোরের আগে আগে মসজিদে গেলাম। যাতে আমাদের মুসলমান মনে করে মিলিটারিরা গুলি না করে।”
“রাতের অন্ধকারেই চলে গেছিলাম। যাওয়ায় অসুবিধা হয় নাই। ভোরের আলো ফোটার পর দেখি কমলাপুর স্টেশনে মিলিটারিরা ঘাঁটি গাড়ছে।”
মসজিদ থেকেই উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখি মিলিটারিরা বাসার ছাদের ওপর ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা গুলি করে ফেলে দিচ্ছে। আজম খানের বাসার ছাদেও উড়ছিল পতাকা। আজম জানান, “সেটা বাঁচানোর জন্য আমার বোন ছাদে ওঠে। পতাকা খুলতে চেষ্টা করে। আমি সেটা দেখে দৌড়ে বাসায় যাই। বোনরে বলি-নাম নাম গুলি লাগব। এই বলতে বলতেই তার মাথার পাশ দিয়া একটা গুলি চলে গেল। অল্পের জন্য বেঁচে গেল আমার বোনটা।”
“সময়টা মনে নাই। তবে তখনও বর্ষা শুরু হয় নাই।” বলতে থাকেন আজম খান, “প্রথম প্রথম বাড়িতেই থাকতাম। এরপর যখন পাকিস্তানি মিলিটারি তরুণ যুবকদের ধরা শুরু করলো তখন পলাইয়া থাকতাম।”


মুক্তিযুদ্ধের আজম খান


মিলিটারি এলেই বাড়ির পেছনের পাঁচিল টপকে অন্যদিকে চলে যেতাম। এভাবে কয়েক মাস যাওয়ার পর মনে হলো- এভাবে কতদিন, এরচেয়ে যুদ্ধে যাওয়াই ভালো। বেশ কয়েকজন বন্ধু আগেই যুদ্ধে গিয়েছিল। তাই একদিন মাকে গিয়ে বললাল, “আমি যুদ্ধে যাব।” শুনে আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন, “আমি জানিনা, তোর বাপকে জিজ্ঞেস কর।”
আজম খানের বাবা আফতাব উদ্দিন খান তখন সচিবালয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। মনে যুদ্ধে যাওয়ার ভয় নাই, কিন’ বাবা যদি যুদ্ধে যাওয়ার কথা শুনে থাপ্পড় মারে সেই ভয়ে কাতর হয়ে পরলেন আজম খান। শেষ পর্যন্ত সাহস করে বাবাকে বললেন কথাটা। “ভাবলাম এবার কপালে একটা লাথি পাওনা হয়ে গেল। কিন্তু না, আমার দিকে বাবা তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন- যুদ্ধে যাচ্ছিস ভালো কথা, কিন্তু দেশ স্বাধীন না করে ফিরতে পারবি না।”
এর পরের দিন ভোরে পায়ে হেঁটে রওনা হলাম। সঙ্গে আমার তিন বন্ধু। গন্তুব্য আগরতলা। হাঁটতে হাঁটতে পুবাইল, কালিগঞ্জ, ঘোড়াশাল, নরসিংদী, ভৈরব পার হয়ে গেলাম। পথে কোন সমস্যা হলো না। ব্রাক্ষণবাড়িয়া পৌছলাম মধ্যরাতে। সেখানে গ্রামের মধ্যে এক যুবককে পেলাম। সে গ্রামবাসীদের নিয়ে দেশপ্রেম সভা করছে। পরে জানলাম, সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা। নামটা মনে নাই। অত রাতে আমাদের দেখে সে সন্দেহ করে বসলো। পরে হাজার প্রশ্নর উত্তর দিয়ে তার সন্দেহ দূর করি। সে আমাদের থাকতে দেয় গোয়াল ঘরে। সারারাত গর”র পাশে মশার কামড় খেয়ে কাটিয়ে দিলাম। পরের দিনও হাঁটলাম সারা দিন। এরপর পৌঁছলাম আগরতলায়। সেখানের মেলাধর নামের এক জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের জন্য আসা তরুণদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বন্ধুরা যারা আগেই যুদ্ধে অংশ নিতে চলে আসছিল তাদের প্রায় সবার সঙ্গে মেলাঘর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে দেখা হল। আমাদের দেখে তারা হৈহৈ করতে করতে জড়িয়ে ধরলো।”



এখানেই পরিচয় হয় জাহানারা ইমামের ছেলে রুমির সঙ্গে। খুব তাড়াতাড়িই দুজনে বন্ধু হয়ে যাই। “রুমিই আমাকে এলএমজি, রাইফেল চালানো, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করলো। আমাদের মধ্যে রুমিই ছিল সবচেয়ে এক্সপার্ট। একদিন সে চলে গেল যুদ্ধে। পরে খবর পেলাম সে শহীদ হয়েছে। মনটা খুবই খারাপ হলো।”
তবে বেশি দিন মন খারাপ করে থাকার সুযোগ পেলেন না। ততদিনে তাদের প্রশিক্ষণ শেষ। গেরিলা আক্রমণের জন্যই তাদের তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু মনোবল শক্ত করার জন্য একদিন তাদের দলকে পাঠানো হলো সম্মুখ যুদ্ধে। “কুমিল্লার সালদায় আমি প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করি।”
ভয় কী বস্তু তা ছেলেবেলা থেকেই অজানা ছিল তাঁর কাছে। সম্মুখ যুদ্ধেও লড়েছেন গান গাইতে গাইতে। তিনি বলেন, “আমি বেশির ভাগ সময় গান গাইতাম আর যুদ্ধ করতাম। সেসময় কিশোর কুমার ছিল হিট। তার গানই বেশি গাওয়া হতো। হিন্দি বাংলা কত গান করছি আর গুলি চালাইছি! এমনও হয়েছে গুলি করছি, গান গাইছি, আবার মুড়ি মুড়কি চিবাচ্ছি। আমার গান শুনে পাশ থেকে সহযোদ্ধারা বলত – ওই গান থামা, পাক সেনারা শুনলে বুইঝা যাইবো তুই কই আছস। তোর মরণের ভয় নাই নাকি। আমি বলতাম – আরে মরবই তো, ভয় পাওয়ার কী আছে! গান গাইয়া লই।”
গান গাইতে গাইতে যুদ্ধ করা এই গানওয়ালার এখনও মনে আছে যুদ্ধের সময়ের রোমাঞ্চকর অনেক কাহিনী। এর মধ্যে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধের কাহিনীটা তার স্মৃতিতে এরকম যেন গতকালের ঘটনা।
“কুমিল্লার সালদায় আমাদের ক্যাম্পটা ছিল নদীর পাড়ে। আমাদের ওস্তাদতো অনেক অভিজ্ঞ ছিল। তিনি জানতেন কবে পাক সেনাদের রসদ আসবে। একদিন দুপুরে তিনি আমাদের ডাক দিয়া বলেন, তোরা আজ চোখ রাখিস। আজ রসদ আসতে পারে। বলেই তিনি চোখের উপর গামছা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।”
ঘুমালেন না তাঁরা। তারা কিছুক্ষণ পরপর নদীর দিকে তাকান, আর নানান দুষ্টামি করেন। কেউ পেয়ারা গাছে উঠে পেয়ার খান, কেউ গান করেন। হঠাৎ দেখেন একটা নৌকা। প্রথমে সন্দেহ করেন নাই। তারপর দেখেন আরও দুইটা নৌকা। সঙ্গে সঙ্গে ওস্তাদকে ডাক দিলেন। তিনি দেখে বললেন, নাহ্* এইগুলা না। বলেই আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। একটু পরেই প্রায় বিশ ত্রিশটা নৌকা সারি চলে এলো দৃষ্টি সীমানায়। এবার আজম খান লাফিয়ে উঠলেন, “আবার ওস্তাদরে ডাক দিলাম। তিনি দেখে বললেন, খবরদার আমার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত কেউ গুলি করবি না। তারপর পজিশন মত আসতেই তিনি মেশিনগান দিয়া গুলি শুরু করলেন। আর আমরাও যার যার অস্ত্র দিয়া গুলি করতে থাকলাম। নৌকাগুলা সব ছাড়খাড় হয়ে গেল চোখের পলকে। আমরা ভাবতাম পাক সেনারা সাঁতার জানে না। কিন্তু দেখি কী, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাঁতার দিয়া পাড়ের দিকে আসছে। আমরা সেদিকে লক্ষ করে গুলি করা শুরু করলাম।”
ওই দিন বহু পাক সেনা মেরেছিলেন তারা। বিকালেই ওস্তাদ তাদের বললেন, এলাকা থেকে সরে যেতে। কারণ প্রতিশোধ নিতে অন্য পাক সেনারা আসবেই। হলোও তাই। সন্ধ্যা বেলা থেকেই শুরু হলো পাক সেনাদের আক্রমণ। “আমরা মাটিতে ক্রল করে, ক্ষেতের আইল আড়াল দিয়ে, মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে জান নিয়ে ওই এলাকা ছাড়লাম। এরপরই আমাদের পাঠিয়ে দেয় ঢাকার দিকে।” ঢাকায় এসে যোগ দিলাম ক্র্যাক প্লাটুনে।



ক্র্যাক প্লাটুনকে বলা হয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাক্ষাৎ যম। ক্র্যাক প্লাটুনের নাম শুনলে জায়গায় ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে দিতো পাকিরা।
ঢাকায় আসার পর দায়িত্ব ছিল ঢাকার আশে পাশের এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করা। আমি ছিলাম দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইনচার্জ। আর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন পাকিদের যমদুত কর্নেল খালেদ মোশাররফ।
আজম জানালেন, “একবার ডেমরার দিকে তিতাস গ্যাসের একটা পাইপ লাইন বোমা মেরে উড়িয়ে দিলাম।”
এক লাইনে যে কথাটা বললেন সে কাজটা অতো সহজ ছিল না। “প্রথমে বোমার ফিতায় আগুন ধরাতে গিয়া সমস্যা। ম্যাচের কাঠি শুধু নিবে যায়। শেষে একসঙ্গে অনেকগুলা কাঠি জ্বালিয়ে বোমাতে আগুন দিলাম।” কিন্তু পালানোর জন্য যে সময় রেখেছিলেন তার আগেই বোমা গেল ফেটে। গ্যাসের লাইন ফেটে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। সেই আগুনে রাতের বেলাও আশেপাশের এলাকা দিনের মত পরিস্কার দেখা গেল। আর কী আওয়াজ! দুম দুম করে ফাটতে থাকলো গ্যাসের লাইন। আশেপাশের সব মানুষ পালানো শুরু করলো।
কিন্তু এলাকাটা যে রেকি করে এসেছিল সে হিসাবে একটু ভুল করছিলো। তাই পাইপ লাইন উড়িয়ে পালানোর সময় বিপদে পড়লেন আজম খানরা।
পাইপ লাইন উড়ালেন কেন জানতে চাইলে ব্যাখ্যা করলেন, “অভিজাত এলাকায় যাতে গ্যাস না থাকে, তারা যাতে চাপে পড়ে এই কারণে। তখন অভিজাত এলাকাতেইতো পাক আর্মিদের বড় বড় অফিসাররা থাকত।”
“আমাদের নৌকা ছিল নদীতে। আওয়াজ শুনে আমার সহযোদ্ধারা সবাই আগেই চলে গেছে। তাদের ওপর সেভাবেই নির্দেশ ছিল। কিন্তু আমার নৌকা নিয়া যখন পালাতে গেলাম, তখন দেখি আর দম নাই, শক্তিতে কুলোচ্ছে না। আমার সঙ্গে আরও দুই জন যোদ্ধা ছিল। নৌকায় আমাদের গোলা-বারুদ-অস্ত্র। আমরা তিনজন নৌকায় উঠতেই সেটাতে পানি উঠে গেল। ডুবে যায় যায় অবস্থা। শেষে আমরা তিনজনই পানিতে নেমে নৌকা ঠেলে এগুতে থাকলাম।”
দারুন টেনশনে ছিলেন তখন তারা। একদিকে জীবন আর অন্য দিকে অস্ত্র বাঁচানোর চিন্তা। কাছাকাছি আজম খানের পরিচিত একটা গ্রাম ছিল। সেখানের বেশ কিছু ছেলেকে তারা প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেখানে কোনমতে পৌঁছানোর পর আজম খান নিজেই এক হাতে টেনে নৌকা পাড়ে উঠালেন। লোকজন তাকে দেখতে ধরাধরি করে গ্রামে নিয়ে গেল। আজম খানের তখন চৈতন্য লোপ পাওয়ার দশা। “সেই রাতে আমার আর কিছু মনে নাই। পড়ে সকালে উঠে দেখি আমি খড়ের গাদার উপর শুয়ে আছি। আর হাত পা ছিলে গেছে।”
যুদ্ধের ফাঁকে বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে “আসতাম। চুপি চুপি। তখন পকেটে থাকতো টুপি। ওটা ছিল ক্যামোফ্লেজ। ঈদে বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। অনেক ঘুরে ঘুরে বাড়ি আসলাম। ঢুকলাম। বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করে কোনরকমে এক চামচ সেমাই আর এক গ্লাস পানি মুখে দিয়েই বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।”
ছেলে মুক্তিযুদ্ধে থাকার কারণে এসময় তাঁর পরিবারের লোকজনকেও অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। বললেন আবার পুরনো গল্প “পাড়ার সামনে এক বুড়ো দোকানদার আমার কাছে দেড়শো টাকা পেতো। সেই টাকা ফেরত না পেয়ে দোকানদার পাক সেনাদের আমার বাসা চিনিয়ে দেয়।”
পাক সেনারা অনেক ঝামেলা করতো। তারা তাঁর বাবার কাছে গিয়ে বলতো -আজম কাহা হ্যায়? বাবা বলতেন- আজম নেহি হ্যায়। মা হিন্দি উর্দুতে ভালো বলতে পারতেন। তিনিই পাক সেনাদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতেন। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। “আমার ছোট ভাইকে তারা বাসার ছাদে নিয়া কাপড় খুলে উল্টা করে ঝুলিয়ে অনেক মেরেছে, আমার ব্যাপারে কথা বের করার জন্য।”
পাক সেনাদের অত্যাচার তাঁর পরিবার যে কতটা সহ্য করেছে সেটার উদাহরণ দিতে গিয়ে খান বললেন চরম এক মুহূর্তের কথা, “একবার তো আমার দুই ভাই মারাই যাচ্ছিল। বাড়ির পেছনে একটা কূয়া ছিল। সেখানে আমার বড় দুই ভাই আলম খান (সুরকার) ও মোহন খানকে খালি গায়ে দাঁড় করিয়ে জেরা শুরু করলো। আমার খোঁজ না দিলে তাদেরকে মেরে ফেলবে। সেটা দেখে আমার বাবাও শার্ট খুলে তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন – আমার ছেলেদের মেরে ফেললে আমার বেঁচে থেকে কী লাভ। কপাল ভালো, ঠিক এ সময় শুরু হলো ভারতীয় বিমান বাহিনীর বোমা বর্ষণ। তখন পাক সেনারা আমার বাবা ভাইদের ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।”


তারপরের গল্প মুক্তিযুদ্ধের ময়দান থেকে মঞ্চে ফেরা। পপ সম্রাটের চলে যাওয়ার আজ ছয় বছর। ওপারে ভালো থাকুন গুরু।

সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৪:৩০
৬টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×