শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের নিচে সকল মানব সন্তানকে শিশু হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ১২২টির বেশি দেশ এসনদে অনুমোদন করলেও শিশু নির্যাতন সমূলে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। বরং বিগত ১০ বছরে সারাবিশ্বে আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে শিশু পাচার, শিশুর প্রতি সহিংসতা, শিশুশ্্রমসহ নানা ধরনের শিশু নির্যাতন। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে আমরা বিশ্বে শিশু নির্যাতনের যে চিত্র পাই তা সত্যি ভয়াবহ ও বেদনাদায়ক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র মতে বিশ্বে প্রায় ৪০ লক্ষ শিশু নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হচ্ছে
২০০৬ সালে জাতি সংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের ১.২ লক্ষ শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে
২০০৬ সালে জাতি সংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী শিশুশ্রমের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে বিশ্বের ২১৮ লক্ষ শিশু
২০০৬ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০% থেকে ৬৫% স্কুল পড়–য়া শিশু শারিরীক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে
শিশু নির্যাতনের এই চিত্র নি:সন্দেহে উদ্বেগজনক। বিশেষ করে পরিবারে ও স্কুলে শিশু নির্যাতনের বিষয়টি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। কারণ শিশুরা এবিষয়ে শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অগ্রগণ্য। অথচ দু:খজনক বিষয় হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশু সুরক্ষা ও শিশুর অংশগ্রহণের অধিকার বিঘিœত হয় পরিবারে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই। সাধারণত: শিশুরা অকারণে বকাঝকা, মারধর , গালমন্দ, বেত্রাঘাত, কানে চিমটি দিয়ে মারা, তর্জন - গর্জন, শিশুদের ছোট করা ইত্যাদি নানাভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশু নির্যাতনের খবর আমাদের অগোচরে রয়ে যায়। আর নির্যাতিত শিশুরা অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই বুঝতে পারে না সে নির্যাতিত হচ্ছে। আবার অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে এবিষয়ে কিছু প্রকাশ করতে চায় না। নির্যাতনের ফলশ্্রুতিতে পরবর্তীতে নির্যাতিত শিশুদের মধ্যে দেখা বিষণœতা, অবসাদ, দুৃর্বল স্মৃতিশক্তি, হীনমন্যতাবোধ, মানসিক ও আবেগ জনিত নানা মনস্তাত্বিক সমস্যা।
শিশুর জন্য চাই সুন্দর আগামী । আর তার জন্য প্রয়োজন নিরাপদ ও আনন্দময় শিক্ষার পরিবেশ। একারণে শিশু অধিকার সনদেও শিশুর সুরক্ষা ও অংশগ্রহণের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। একটি শিশুকে মানব প্রগতির অনিবার্য অংশীদার হিসাবে হিসাবে গড়ে তুলতে যেসব সুবিধা, নিরাপত্তা ও রক্ষা ব্যবস্থা থাকা দরকার তার সবকিছুই শিশু অধিকার সনদে বিদ্যমান। শিশু অধিকার সনদে বর্ণিত ৫৪টি ধারার প্রত্যেকটি শিশুর বিভিন্ন অধিকারসমূহকে নির্দেশ করে। শিশু অধিকারগুচ্ছের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘শিশুদের অংশগ্রহণের অধিকার এবং শিশুর সুরক্ষার অধিকার’। শিশুর সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা এবং সমাজে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করার প্রাথমিক শর্ত এই অধিকার। পরিবারে যে শিশুটি নির্ভয়ে নিজের কথা বলতে পারেনা, সে একইভাবে বিদ্যালয় বা পরিবারের বাইরেও কথা বলতে পারে না। তাই শিশুর অংশগ্রহণের অধিকারের প্রাথমিক স্তর হচ্ছে পরিবার ও বিদ্যালয়। পরিবারে বা বিদ্যালয়ে শিশুর কথা বলা, নির্ভয়ে তাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মতামত প্রদান এবং বাইরে কোনো সহায়ক শিক্ষা কার্যক্রম বিশেষ করে শিশুদের সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়ার পরিবেশ থাকতে হবে।
একইভাবে সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় শিশুর স্বাধীনভাবে মতামত ও ভাব প্রকাশ, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, সভা, সমাবেশের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ হওয়া এবং নিজ ভাষা ও ধর্মচর্চার স্বাধীনতা সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়াও শিশুদের অবাধে তথ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তাও থাকতে হবে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার সনদের অন্যতম স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্্র হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত এদেশে শিশু অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। শিশু অধিকার ফোরামের এক বুলেটিনের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৮ সালে এদেশে ২৭৬৫ জন শিশুর অধিকার বিভিন্নভাবে লংঘিত হয়েছে। এর মূল কারণ হলো অভিভাবক, শিক্ষক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ শিশু অধিকার বিষয়ে যেমন অসচেতন তেমনি শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিজেদের করণীয় বিষয়েও উদাসীন। জনসচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। তাই বিদ্যালয়ে নিরাপদ ও আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে শিশুর অংশগ্রহণ ও সুরক্ষার অধিকার নিশ্চিতকরণে গণমাধ্যমের ভূমিকা একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।
ম্যাস-লাইন মিডিয়া সেন্টার ও প্ল্যান বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে আগামী প্রকল্পের রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে আনন্দময় ও নিরাপদ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে :
ক) অবকাঠামোগত সমস্যা : পানি ও স্যানিটেশন সমস্যা, খেলার মাঠের অভাব, ল্যাব ও লাইব্রেরীর না থাকা, ছাত্রাবাসের অভাব, স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির অনুপস্থিতি, পর্যাপ্ত শ্্েরনী কক্ষের অভাব, কমনরুমের অভাব, পর্যাপ্ত টয়লেট না থাকা, স্কুল মেরামতের সমস্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিনষ্ট স্কুল দালান, নিরাপদ সড়কের অভাব ইত্যাদি।
খ) সামাজিক সুরক্ষার সমস্যা : শিক্ষক সংকট, ইভ টিজিং, বিনোদনের অভাব, শিক্ষকদের বেতন না দেওয়ার কারনে পাঠদানে অমনোযোগিতা, শিশুবান্ধব পরিবেশের অভাব, শিশুশ্্রম, বাল্য বিবাহ, মানসম্মত শিক্ষার অভাব, স্কুলের অভাব, শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, পাঠ্যপুস্তকের অপ্রতুলতা, স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির দ্বন্দ্ব, প্রাইভেট টিউশনীর দৌরাত্য, মৌলিক অধিকার সংরক্ষনের অভাব, অর্থনেতিক সংকট, সহপাঠীর দ্বারা খুনের চেষ্টা, মেয়েশিশুদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, নেতিবাচক উপায়ে স্কুল ফান্ড গঠন, স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুর প্রতি সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক সমস্যা, যৌন নির্যাতন ইত্যাদি।
সামাজিক মানুষ হিসাবে নিরাপদ ও আনন্দময় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আমাদেরও কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাই সমাজের সচেতন মানুষ, অভিভাবক, শিক্ষক ও সংবাদকর্মী হিসাবে আমাদের করণীয় হতে পারে :
শিশুর ওপর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকা
শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনমুক্ত শিশু বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করে শিশুর সৃজনশীলতা বিকাশের জন্য জন সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষে এ্যাডভোকেসি কাজে অংশগ্রহণ করা
নিরাপদ স্কুল বিষয়ে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ করা
শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনকারীর জন্য দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা
আসুন, আমরা সম্মিলিত ভাবে শিশুর সুন্দর আগামীর জন্য আমাদের করণীয় বিষয়ে সচেতন হই এবং নির্যাতন মুক্ত নিরাপদ ও আনন্দময় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখি।