গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার স্মৃতি
গ্রাম আমার নিকট বেশি ভালো লাগলেও বছর ঘুরে আসার সাথে সাথে আম্মা যখন ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন তখন আবার ঢাকা যাবার জন্য আকাঙ্খা প্রবল হয়ে যেতো। খুব ভোরে আমাদের গ্রাম থেকে নৌকাযোগে ভৈরব যেয়ে রেলগাড়িতে উঠতে হতো। যে সকালে রওয়ানা করতে হতো তার আগের রাত বরবার ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দেখতাম সকাল হলো কিনা। দাদীর সাথে একই বিছানাই ঘুমাতাম। তাই উঠার সাথে সাথে টের পেয়ে ধরে এনে আবার শোয়াতেন আর বলতেন, সকাল হলে আমিই ডেকে দেবো, এখন ঘুমাও। যে শহরে সপ্তাহ দু সপ্তাহ থাকার পরেই গ্রামে আসার জন্য মন ছটফট করতোম, সে শহরেই যাবার জন্য এতো আগ্রহ কেনো সৃষ্টি হতো ঐ বয়সে সে বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করতাম বলে মনে পড়ে না। এখন বুঝতে পারি যে, মানুষ জীবনে বৈচিত্র চায়। একখানে কিছুদিন থাকার পর বেড়াবার উদ্দেশ্যে অন্যত্র যাওয়ার জন্য আগ্রহ স্বভাবিক।
ঢাকা শহরে আসার পথে প্রথমে নৌকা, এর পরে রেলগাড়ি। নৌকায় চলতে যথেষ্ঠ অভ্যস্ত ছিলাম। বর্ষার কয়েক মাস নৌকা ছাড়া চলারই উপায় ছিলো না। তাই নৌকা ভ্রমণটুকু এমন কোনো আকর্ষণীয় মনে হতো না। কিন্তু রেলগাড়িতে চড়ার পর খুবই ভালো লাগতও। রেল গাড়ি চলার সময় যে আওয়াজ হতো তা যেনো ছন্দের তালে মতো অনুভব করতাম এবং শরীরে মৃদু ঝাঁকুনিতে তৃপ্তি পেতাম। রেলগাড়ির ছন্দময় সে আওয়াজটা ক্রস করে যেতে হয়। অনেক সময়ই রেলগেট বন্ধ থাকলে গাড়িতে বসেই রেলগাড়ির অপেক্ষা করতে হয়। আমার সামনে দিয়ে যখন রেলগাড়ি যায় তখন বাল্যকালের শোনা সে ছন্দময় আওয়াজটা আবার আমার মনে তাজা হয় উঠে। চলন্ত রেলগাড়িতে অনেকেই কথাবার্তা বলতে থাকে কিন্তু আমার মনে পড়ে যাদের সাথে আমি ঢাকা যেতাম চলন্ত গাড়িতে তাদের কথা বলে সময় নষ্ট করতে ইচ্ছা হতো না। আমি একটানা বাইরে চেয়ে থাকতাম। কখনও কখনও মনে হতো বাইরের গাছ ও গ্রামগুলো যেনো উল্টোদিকে দৌড়াচ্ছে। এই যে দৃশ্যগুলো বদলাচ্ছে তা দেখতেযে কত ভালো লাগতো, তা বলার ঐষী কোথায় পাব? তাই গাড়িতে আমার ঘুমও পেতো না ঢাকা শহরের তখন রেল ষ্টেশনের নাম ছিলো ফুলবাড়ীয়া। ফুলবাড়ীয়া এখন বাস ষ্টেশন । ষ্টেশন থেকে নেমে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে নানা বাড়িতে যেতাম। ঐ ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন আজকাল আর নেই। ঘোড়ার গাড়িতে বসার জায়গাটা পাল্কির মতো ছিলো। দু জন করে মুখোমুখি করে চারজন বসার সিট ছিল। আর দুটো ঘোড়া টেনে নিয়ে যেতো। খুব দ্রুত চলতো না বলে সব দৃশ্য তৃপ্তি নিয়ে দেখা যেতো। ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সময় খুব সকালে ষ্টেশনে আসতে হতো। খালি পাকা রাস্তায় দু ঘোড়ার আটটি পায়ের একটি চমৎকার ছন্দময় আওয়াজ হতো। রেল গাড়ির ছন্দ থেকেও শুনতে ভালো লাগতো। পায়ের মধ্যেলোহা লাগানো থাকতো যাতে পা বেশী ক্ষয় না হয়ে যায়। এতে রাস্তার উপর চলার সময় পা ফেলার একটা চমৎকার শব্দ হতো । তখন ঢাকায় রিকশা ছিলোনা, স্কুটারও ছিলো না। কারের তো প্রশ্নই উঠে না। প্রচুর সংখ্যায় ঘোড়ার গাড়ি ছিলো এবং শহরের রাস্তাগুলো তাদেরই দখলে ছিলো।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৭ সন্ধ্যা ৭:০৬