সকালেই কেন বিষয়টা নিয়া লিখলাম না এইটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। আমি নিজেও এই মুহূর্তে নিজের কাছে প্রশ্নটা আরেকবার করলাম। হতে পারে যে সংবাদটার তাৎপর্য তখন পর্যন্ত মরমে পশে নাই। একটু আগে যখন বিষয়টা চিন্তা করলাম কেমন অদ্ভুত লাগল আমার কাছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নাই ভাবতেই নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকল। আসলে যেকোনো বিখ্যাত ব্যক্তির মৃত্যুতেই অনুভূতিটা এরকম হয়। শুধু ওপার বাংলা না, পূর্ব-পশ্চিম পুরাটা মিলেই জীবিতদের মধ্যে সে সবচেয়ে বড় মাপের লেখক ছিল বইলা মনে হয় আমার কাছে। কথাসাহিত্যে যেমন 'পূর্ব-পশ্চিম', 'সেই সময়', 'প্রথম আলো', 'একা এবং কয়েকজন' অসাধারণ সব পাঠ্য, তেমনি ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যে 'ছবির দেশে কবিতার দেশে।' ফরাসী দেশের বিখ্যাত সব আঁকিয়ে আর কবিদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম ঐ বইটার মাধ্যমে। তার কবিতার মধ্যে "কেউ কথা রাখে নি" কিংবা "চে- তোমার মৃত্যু আমাদেরকে অপরাধী করে দ্যায়"; মনের ভিতর অসাধারণ দ্যোতনার জন্ম লাভ হয়।
সত্যি কথা বলতে, সুনীলের খুব বেশি বই পড়া হয় নাই। অদূর ভবিষ্যতে পড়ব এরকম একশ' বইয়ের তালিকা তৈয়ার করেছি, সেখানে তার বেশ কয়েকটা বইয়ের নাম আছে। তার লেখা সর্বাধিক সংখ্যকবার পড়া বইয়ের নাম 'উল্কা রহস্য'- কাকাবাবু সিরিজের। কতোবার পড়েছি মনে নাই। ঐ সময় হাতের কাছে আর কোনো বই ছিল না বলেই বারবার পড়তাম। তবে কাকাবাবু সিরিজের বইগুলা আমার কাছে কখনোই খুব একটা ভালো লাগে নাই; 'কাকাবাবু হেরে গেলেন', 'কাকাবাবু বনাম চোরাশিকারী', 'খালি জাহাজের রহস্য' আরো কী কীসব যেন।
আর অনেকের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়, বাজারের কাছে আত্মসমর্পণের পর তার প্রতিভাও নষ্ট হয়ে গেছিল। তার বিখ্যাত বইগুলাও বাজারের কথা চিন্তা করেই লেখা; কিন্তু তার সাথে বাজারের ভিতর আত্মসাৎ হয়ে যাওয়ার পার্থক্য বিস্তর। একবার হারিয়ে গেলে নিজেকে আর খুঁজে পাওন যায় না। সম্প্রতি তার 'দুই নারী এক তরবারি' উপন্যাস থেকে বানানো সিনেমা 'অপরাজিতা তুমি' দেখে ফেসবুকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম নতুন করে তার আর কিছু দেয়ার নাই। কেবল নাম ভাঙিয়ে খেয়ে যাওয়া। লেখকেরা এইভাবে জনপ্রিয়তার একটা বিশেষ পর্যায়ে চলে গেলে ব্র্যান্ড-বিশ্বস্ততার সুযোগ নেয়। তখন নিছক নিজের লেখক-সত্তাটাকে কায়ক্লেশে বাঁচিয়ে রাখা আর উপার্জনের দিকে তাকিয়ে কলম চালিয়ে যাওয়া। এইভাবে অনেক শ্রেষ্ঠ প্রতিভাও বিনষ্ট হয়ে যায়। তবে সুনীল ছিল সেই শক্তিমান লেখক যার উপন্যাস থেকে মহাত্মা সত্যজিত রায়ও সিনেমা বানিয়েছে।
সুনীলের মৃত্যুতে "বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হলো" বলে একদল ভণ্ড কান্না জুড়ে দিয়েছে। যে কারো মৃত্যুতেই তারা এই ডায়লগ দ্যায়, শুধু পরিস্থিতি অনুযায়ী নামটা পাল্টে নেয়। মিছা কথা, সুনীলের মৃত্যুতে সাহিত্যের কোনো ক্ষতি হয় নাই, অপূরণীয় ক্ষতি হওয়া তো দূরের কথা। তার যেসব শ্রেষ্ঠ কীর্তি ছিল সেগুলা সে বহু আগেই বাঙালিরে দিয়া গেছে। সমস্যা হলো আরো কিছু সময় বেঁচে থাকলে নিজের অভ্যাসের বশে সে ক্রমাগত লিখে যেতো, এমন জিনিস লিখত যা তার মাপের একজন মানুষকে ক্রমশ ছোট করতে থাকত। আমি নিশ্চিত যে যারা বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি নিয়া চিন্তিত তারা খুব কমই তার নতুন বেরোনো বইগুলা পড়েছে। সুনীল বলতে যার মুখাবয়ব চোখের সামনে ভেসে ওঠে সে তো তার সেইসব লেখার জন্য স্মরণীয় যেগুলা পাঠকের জন্য আরো আগেই রেখে গেছে। সুনীল বলতে আমরা 'পূর্ব-পশ্চিমে'র সুনীলরে বুঝি, 'চে'-এর সুনীলরে চিনি। মানুষের পায়ের কাছে কুকুরের লাহান বসে থেকে ভিতরের কুকুরটারে দেখতে চাওয়া সুনীলরে খুঁজি।
এই বাংলায় বঙ্কিম মরেছে, রবীন্দ্রনাথ মরেছে; মাইকেল, তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতি, নজরুল, মীর মশাররফ, ইলিয়াস, ছফা, শহীদুল জহির কেউ বাঁচে নাই। কিন্তু তারা নাই বইলা বাংলা সাহিত্য এতিম হয়ে যায় নাই। কিন্তু তারা যা দিয়া গেছে সেইটা যদি না দিত তাহলে সাহিত্য দুর্দশাগ্রস্থ হতো এতে সন্দেহ নাই। সুনীলের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। তার হাত দিয়া বিভিন্ন মাত্রার ও মানের লেখা বের হইছে। একটা সময় পর্যন্ত সে সজ্ঞান প্রচেষ্টায় লেখালিখি করছে, পরবর্তীতে অনেকটা অভ্যাসের বশে রেলগাড়ির মতো তার কথামালার ইঞ্জিন চলছে। কিন্তু এই যে একটা পর্যায় পর্যন্ত উঠে আসা, পাঠকের মধ্যে অদ্ভুত তৃষ্ণার জন্ম দেয়া- তার মূল্য নাই বললে মিছা কথা বলা হবে। তার লেখা পঙক্তিমালা যে অদ্ভুত আবেশের সৃষ্টি করত মনের মধ্যে তার তো মৃত্যু নাই। যারা বর্তমানের ভগ্নদশাপ্রাপ্ত শরীরটার মৃত্যু নিয়া শোকগ্রস্থ তাদেরকে এই বিষয়গুলা নাড়া দ্যায় বইলা মনে হয় না।
শোকপ্রকাশের একটা বাণিজ্যমূল্য আছে। এই বাণিজ্যমূল্য বলতে শুধু পুঁজির অঙ্কে যা বোঝায় সেইটা না। এই যে কিছুদিনের জন্য মাতামাতি, পত্রিকার পাতাগুলি তার লেখার মূল্যমান নিয়া বিচার-বিশ্লেষণে ভরে তোলা (বেশির ভাগই মিছা কথা), ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার নামে কার লগে ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছিল, কিংবা কার কবিতা শুইনা পিঠ চাপড়ায়ে দিছে এইসব থাকবে। সুনীল এই দেশে আসলে অনেকেই গল্প-কবিতার খাতা নিয়া তার কাছে দৌড়ায়ে যেতো সামান্য স্বীকৃতির আশায় এইটা জানি। সুনীল তাদের বেশির ভাগরে পাত্তা দ্যায় নাই। এখন এই পাত্তা-না-পাওয়াদের স্মৃতিচারণও পত্রিকার পাতায় জায়গা ভরে তুলবে, কারণ ঐ পুঁজিমূল্য। এই পুঁজি শুধু নগদ লাভের অর্থ না, ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগযোগ্য মূলধনও বটে। মহাত্মা র্যাডক্লিফের সৌজন্যে এক বাংলা ভূ-খণ্ড বর্তমানে দুই রাষ্ট্রের অধীন। কাঁটাতারের ঐপারে যারা আছে তাদের মধ্যে একটা বড় অংশের জন্ম এইপারে। সুনীলও তার ব্যতিক্রম না। তার কাছে স্বীকৃতির পাওয়ার লাইগা যারা দৌড়ায় তারা এইটা ভুইলা যায়। নিজের স্বীকৃতির মূল্যে 'আন্তর্জাতিক' তকমা লাগানোর মোহে জাগ্রত অবস্থায় তাগো স্বপ্নদোষ ঘটে।
সুনীল নাই, কিন্তু তাতে দৌড়াদৌড়ির কমতি হবে না। আরেকজন আসবে, আমাদের উঠতি সাহিত্যসেবীরা তার কাছে যাবে। সুতরাং রোরুদ্যমানদের 'অপূরণীয় ক্ষতি'র বিষয়টা ফাঁকা বুলি ব্যতীত মনে হয় না। এইসব ভণ্ডামি বাদ দিয়া সুনীল তার ঐতিহাসিক লেখাগুলায় আমাদেরকে যেই জগতের সাথে পরিচয় করায়ে দিয়েছে যদি তার ভিতরে ডুব মেরে মণিমুক্তা যা পাওয়া যাবে সেগুলা নগদ উঠায়ে আনার ব্যবস্থা লওন যায় তাহলে বরং তার একটা জীবন লোকসানের ঘরে যায় না। তা নাহলে মরে গেলে যেই 'অপূরণীয়' ক্ষতি- বেঁচে থাকলেও ক্ষতি তার চাইতে বেশি বৈ কম না।