বাংলাদেশে লাস্ট পনেরো বছর ধরে গণতন্ত্রের সংকট চললেও এর কারণ এবং সমাধান এর উপায় নিয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেনি।
অসুখ না সারলে যেমন ডাক্তার এর কাছে যেতে হবে, ঠিক তেমনি পলিটিকাল ক্রাইসিস সমাধান না হলে পলিটিকাল সাইন্টিস্ট এর কাছেই যেতে হবে।
আর এর জন্য সঠিক ও যোগ্য ব্যাক্তি হচ্ছেন প্রফেসর ডঃ আলী রীয়াজ। তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পলিটিকাল সাইন্টিস্ট। প্রায় বিশ বছর যাবত আমেরিকার ইলিনয়েস স্টেইট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করছেন। ডঃ আলী রীয়াজ বাংলাদেশের এবং বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে বাংলা ও ইংরেজিতে অনেক বই লিখেছেন। তার পুরো সিভি দেখতে চাইলে ভিডিও ডেস্ক্রিপশন এ দেয়া লিঙ্ক ফলো করুন।
নিখোঁজ গণতন্ত্র বইতে ডঃ আলী রীয়াজ তিনটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন
• বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সঙ্কটের শুরু কবে এবং কোন ঘটনা থেকে?
• এই সংকট কেন সৃষ্টি হল?
• বাংলাদেশের ভবিষ্যত পরিনতি কি?
আপনি যদি জানতে চান নিখোঁজ গণতন্ত্র বই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংকট বুঝতে এবং এর সমাধান এর পথ খুজতে সাহায্য করবে কি না, তাহলে পুরো লেখা পড়ুন বা ভিডিও দেখুন।
নিখোঁজ গণতন্ত্র বইতে কি আছে?
নিখোঁজ গণতন্ত্র বইতে মোট ১৩টি চ্যাপ্টার আছে। প্রথম চ্যাপ্টারটাকে পুরো বই এর সামারি বা আউটলাইন বলতে পারেন যেখানে কীভাবে আমরা একটা গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হলাম তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
বিএনপি বনাম আওয়ামীলীগ, এই চিন্তাটা যদি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন তাহলে বুঝতে পারবেন ১৯৯১ সালে বিএনপি একার জোরে গণতন্ত্রের সুচনা করেনি, আবার ২০০৯ সালের পর থেকে আওয়ামীলীগ একার জোরে গণতন্ত্র হত্যা করেনি।
গণতন্ত্রের পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তিগুলোকে চিনিয়ে দিতে পারাটা হচ্ছে এই বই এর সবচেয়ে বড় সার্থকতা। কারণ শত্রু ও মিত্র না চিনলে লড়াইটা করবেন কীভাবে?
বাংলাদেশে গণতন্ত্র আর ফিরবে কিনা সেই নিয়ে যারা আশা ছেড়ে দিয়েছেন তারা যদি বিশ্বব্যাপি গত একশ বছরে গণতন্ত্রের উত্থান পতনের চিত্র দেখেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে প্রতিবার হোঁচট খাবার পর গণতন্ত্র আরো মজবুত হয়ে ফিরে এসেছে। সুতরাং আশা করা যায় যে বিশ্বব্যাপি গণতন্ত্রের জোয়ার ফিরে এলে বাংলাদেশেও তা শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবে। তবে এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং একনায়কতন্ত্র ফিরে আসার পথ বন্ধ করা হয়েছে, আমাদেরকেও সেই প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র কেন পিছিয়ে গেল?
এই প্রশ্নের উত্তরে ডঃ আলী রীয়াজ তিনটি ফ্যাক্টরকে গুরুত্ব দিয়ে চিহ্নিত করেছেন।
প্রথমতঃ মধ্যবিত্ত সমাজের নির্লিপ্ততা
আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণী যেখানে ১৯৪৭ এ দেশভাগ, ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ, এবং ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছে সেখানে বর্তমানে কেউ কিছু বলছেনা কেন এই প্রশ্নের উত্তরে ডঃ আলী রীয়াজ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা বড় অংশকে আইডেন্টিফাই করেছেন এবং তাদের চুপ থাকার কারণ হিসেবে নিজে কিছু না বললেও অন্য সমাজবিজ্ঞানীদের থিসিস থেকে দেখিয়ে দিয়েছেন।
রাজনৈতিক বন্দোবস্তঃ লুটপাটের সমঝোতা
বাংলাদেশে গণতন্ত্র হোঁচট খাবার পেছনে দ্বিতীয় প্রধান ফ্যাক্টর হচ্ছে পাওয়ার এলিটদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগ বাঁটোয়ারার বোঝাপড়া। যাকে ডঃ আলী রীয়াজ বলছেন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।
পাকিস্তান আমলে একটা কথা ছিল যে দেশ চালায় ২২ পরিবার। অর্থাৎ ২২টি ধনী এবং অভিজাত পরিবারকে হাতে রাখতে না পারায় পাকিস্তানে হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দি এর গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে, অন্যদিকে এই ২২ পরিবারকে সন্তুষ্ট করেই আইউব খান দীর্ঘ ১০ বছর রাজত্ব করেছেন।
বর্তমানে ২২ পরিবার না থাকলেও শিল্পপতিদের গোষ্ঠী আছে, আছে সেনাবাহীনির কর্পোরেট ইন্টারেস্ট গ্রুপ, আরো আছে আমলাতন্ত্র।
আজ আপনি সরকারী দলের বিপক্ষে কথা বলতে পারবেন না, সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বলতে পারবেন না, সেনাবাহীনির এলিটদের বিপক্ষে বলতে পারবেন না, শিল্পপতিদের বিপক্ষে বলতে পারবেন না, এমন কি সরকারী সমর্থক সিভিল সোসাইটির বিপক্ষেও বলতে পারবেন না।
ইতিহাসের আর কোন সময়ে পাওয়ার এলিটদের সবাই একজোট হতে পারেনি। ফলে তখন একটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স ছিল। আর এখন ক্ষমতা নিরঙ্কুশ, কোন চেক এন্ড ব্যালান্স নেই, কোন চ্যালেঞ্জার নেই।
তবে হতাশ হবার কিছু নেই। ডঃ আলী রীয়াজ বলছেন যেকোন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সময়ের আবর্তে নিজ থেকেই দুর্বল হয়ে ভেংগে যায়। যেসব কারণে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা ক্ষমতার ভাগাভাগির এই আঁতাত ভেংগে যেতে পারে তাও উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এর স্ট্র্যাটেজি তৈরিতে এই চ্যাপ্টার বিশেষভাবে কাজে লাগবে বলে আমি বিশ্বাস করি। গণতন্ত্রের বিপক্ষের শত্রু চিহ্নিত করা গেছে, কীভাবে তাদের জোট দুর্বল হতে পারে তাও জানা গেছে। এখন কাজ হচ্ছে তাদের দুর্বলতার জায়গাগুলোতে বারবার আঘাত করা।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র ধ্বংসের জন্য তৃতীয় ফ্যাক্টর হিসেবে ডঃ আলী রীয়াজ ভারত এর ভুমিকার কথা বলেছেন।
তিনি দেখিয়েছেন ১৯৭২ থেকে ২০০৬ এই ৩৪ বছরে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে তেমন লাভবান হয়নি। অর্থাৎ শেখ মুজিব এর শাসনকাল এবং শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদেও ভারত খুব বেশি কিছু আদায় করতে পারেনি। তাই তাদের দরকার ছিল এমন একটা সরকার যারা তাদের সব চাওয়া পুরণ করবে। এই বিষয়ে শেখ হাসিনার উক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নিখোঁজ গণতন্ত্র বইটি সম্পর্কে পাঠক হিসেবে আমার ব্যাক্তিগত মতামত
ডঃ আলী রীয়াজ বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের চুপ থাকার নীতি ও তার পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তবে দেশে বাকস্বাধীনতা শুন্যের কোঠায় নেমে এলেও ছাত্রসমাজ কেন গর্জে উঠছে না, অথবা দারিদ্র্য ও বৈষম্য দুইটাই প্রকট হবার পরেও খেটে খাওয়া মানুষ, অর্থাৎ শ্রমিক সমাজ কেন বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেনা এই প্রশ্নের উত্তর দেননি।
এই সীমাবদ্ধতা সত্বেও নিখোঁজ গণতন্ত্র বইতে ডঃ আলী রীয়াজ তার মূল উদ্দেশ্যে সফল। বাংলাদেশে গনতন্ত্রের বিপক্ষের শক্তিগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। ফলে কাদের জন্য গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খাচ্ছে তা এখন পরিষ্কার। এর ফলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র উদ্ধারের লড়াইটা বিএনপি-বনাম-আওয়ামীলীগ এই সঙ্কীর্ণতা থেকে বের হয়ে সার্বজনীন হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ডঃ আলী রীয়াজ পলিটিকাল সাইন্সের অনেক মডেল এবং থিওরি ব্যবহার করলেও তিনি বইটি খুব সহজ ভাষায় লিখেছেন। গল্প বা উপন্যাস না হলেও এর চ্যাপ্টারগুলোর মধ্যে একধরণের ধারাবাহিকতা আছে। ফলে বই এর প্রথম চ্যাপ্টার পড়তে পড়তে আপনার মনে যে প্রশ্নগুলো জেগে উঠবে, ক্রমান্বয়ে শেষ চ্যাপ্টার পর্যন্ত পড়ে ফেলার পর তার অধিকাংশ জবাবই পেয়ে যাবেন।
এই বইতে যাবতীয় তথ্য উপাত্তগুলোকে গ্রাফ এবং টেবিল আকারে প্রেজেন্ট করায় বিষয়গুলো সহজে বুঝতে পারবেন এবং মনে রাখতে পারবেন।
বইটার খুবই ইউজফুল একটা ফিচার হচ্ছে সুচিপত্রে সমস্ত টেবিল আর গ্রাফ এর পেজ নম্বর লিস্ট করে দেয়া আছে।
ফলে নির্দ্রিষ্ট কোন ইনফরমেশন যদি আপনার খোঁজ করতে হয়, তা এই লিস্ট দেখে সহজেই বের করতে পারবেন।
নিখোঁজ গণতন্ত্র বইটি কোথায় পাওয়া যাবে?
ডঃ আলী রীয়াজের নিখোঁজ গণতন্ত্র বইটি পাবলিশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। বই এর কাগজ, প্রিন্ট ও বাঁধাই সবই আমার কাছে বেশ উন্নত বলে মনে হয়েছে। এর মুদ্রিত মুল্য ৫৫০ টাকা এবং বইটি কিনতে পারবেন রকমারি ডট কম এবং প্রথমা প্রকাশনীর ওয়েবসাইট থেকে।
রকমারী ডট কম এর লিঙ্ক
প্রথমা প্রকাশন লিঙ্ক
নিখোঁজ গণতন্ত্র বই কাদের পড়া উচিত?
আপনি যদি বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে খোঁজখবর রাখা সচেতন নাগরিক হন, পলিটিকাল বা হিউম্যান রাইটস একটিভিস্ট হন, সিভিল সোসাইটি বা থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এর সদস্য হন, তাহলে ডঃ আলী রীয়াজের লেখা নিখোঁজ গণতন্ত্র বইটি আপনার পড়া উচিত।
এই বই হয়ত আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না, কিন্তু এটি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে ঐক্যমত তৈরী করতে সাহায্য করবে।
আজকের মত বিদায় নিচ্ছি আমি অ্যাডাম নট্রিয়েল, মুখ খুলতেই মুখোশ পড়েছি। খোদা হাফিজ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০২১ দুপুর ১২:৪৬