সময়টা রাত সাড়ে তিনটা।আমি বসে আছি।প্রতিদিনকার মতোই আমি আসলে জানিনা আমি কেন বসে আছি।এই না জানাটা খুব বিরক্তিকর।অনেক বেশিই বিরক্তিকর।
আমার ঘরটা খুব বেশি বড় না। হালকা একটু হাঁটাহাঁটি করার মত জায়গা যে নেই তাও না।আমি উঠে দাঁড়ালাম।এভাবে কিছু না করে বসে থাকতে অস্বস্তি লাগছে।তিনটা চৌত্রিশ।হতাশ হলাম।শুয়ে পড়া উচিত।আযান দেয়ার পর ঘুমোনো যায়না,জোর করে ঘুমাতে হয়।
লাইটটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বন্ধ করে আমি যখন ফোনটা হাতে নিলাম,তখন বাজছিলো চারটা পাঁচ। আমি অস্বস্তি নিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।কলেজ নেই,কোচিং নেই,কারুর সাথে দেখা-সাক্ষাত নেই।বড়ই একঘেয়ে জীবন।বড় করুণ জীবন!নিজেকে নিয়ে খুব হতাশ আমি।কাউকে বলতেও পারিনা।প্রতিদিন ভাবি , কী নেই আমার জীবনে! দিনশেষে আবিষ্কার করি সবকিছু আছে,আর সেইসাথে উপর দিয়ে "কিছু নেই কিছু নেই" ভাবটা যেন বাড়তি একটা বোঝা হয়ে আমাকে জাপটে ধরে আছে।
চোখ বন্ধ করলাম।ভাবাভাবি বন্ধ করে যা করা উচিত তা হলো ঘুমানো।বহুদিন ঘুমাইনা আমি।রোজই পড়ার টেবিলে চারটা পাঁচটা পর্যন্ত অযথা বসে থাকি।কিছু করিনা।মাঝে মাঝে বই খুলে বসে থাকি।মাঝেমাঝে এমনি এমনিই।নাহ,আর এমন করা যাবেনা।কাল থেকে ঘুমোতে হবে।অন্তত বারোটার মাঝে তো অবশ্যই।এমন জীবন নিয়ে আর চলা যাচ্ছেনা।সেদিনও ঘুম ভাঙলো সাড়ে বারোটায়।জেগে শুয়ে রইলাম আরো ঘন্টাখানিক।আচ্ছা,আমার কিছু ভালো লাগেনা কেন?
আমার ঘরের জানালাটা বেশ বড়।কিন্তু আলো বাতাস পায়না ঘরটা।ঘরের জানলার সামনে অন্য এক বাসার রান্নাঘরের জানলা উপহারস্বরূপ রাখা।বড়ই বিচ্ছিরি ব্যাপারস্যাপার।আমি খুব বেশি মানুষের সাথে মিশতে পারিনা।আমার একটা সমস্যা বলা যেতে পারে।তাই ওই বাসার কারুর সাথে কোনোদিন কথাও হয়নি।আচ্ছা,এটা নিয়ে ভাবাটা কি খুব জরুরি? আমি এসব ভাবছি কেন?
আমার প্রেমিক আমাকে রোজ মনে করিয়ে দেয়,আমি নাকি পৃথিবীর অন্যতম সুন্দরী এক নারী।আর আশেপাশের মানুষ প্রতিদিন বোঝায় সুন্দরী হতে গেলে চেহারায় আরো কয়েকটা খুঁত কম থাকা দরকার!মাঝখানে আমি পড়ি দোটানায়।আচ্ছা,কার কথা শুনবো?আমার প্রেমিক সবসময় বলে,"কারুর কোনো কথা শুনে মন খারাপ কোরোনা।আমি তো আছি! "
আমি জানি সে আমার জন্য সব করতে রাজি আছে।কিন্তু আমি এতকিছু জানার পরও কেমন যেন উদাস।ছোটবেলা থেকেই আমার একটা প্রবণতা ছিলো।সবার মনের মত হবার প্রবণতা।এই ব্যাপারটাই হয়তো আমাকে জীবনে এতকিছু পেতে সাহায্য করেছে।অনেক মানুষের ভালোবাসা,বেশ ভালো রেজাল্ট,অর্ধেক শেল্ফভর্তি পুরষ্কার,অনেক মানুষের ঈর্ষা, চমৎকার একটা ফ্রেন্ডসার্কেল,অসাধারণ না অতিঅসাধারণ এবং পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর একজন প্রেমিক ইত্যাদি ইত্যাদি।আর আজকে এতকিছুর পর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় এসে আমি হতাশ।আসলে হতাশা জিনিসটা খুব অদ্ভুত!এটা পানি নাকি হাওয়া এই নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।এটা আমাকে ডোবাচ্ছে,নাকি উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে শুন্যতার দিকে তা বুঝতে পারছিনা।কেবল বুঝতে পারছি আমার সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।একটু একটু করে।
আমার নিজের বিষয়ে সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপারটা হচ্ছে,আমি যা-ই করিনা কেন,একদম মন থেকে করি।বন্ধুত্ব,পড়ালেখা,ছবি আঁকা,ভালোবাসা! এইযে আমার প্রেমিক,তাকে আমি অনেক ভালোবাসি।একটু বেশিই।তার জন্য এমন কিছুই নেই যা আমি করতে পারিনা।ভবিষ্যতেও থাকবেনা।আমি তার কানে কানে বারবার বলি,"শোনো,সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবেনা।" সে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে।ভরসার হাসি।ভালোবাসার হাসি।আমার ইচ্ছে করে এই হাসিমাখা মুখটা দেখতে দেখতে মরে যাই! সেদিন যখন ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলাম, ও বারবার বলছিলো, "তুমি এমন করলে আমার কী হবে?" কিন্তু সত্যি কথা,আমি পারছিনা।একদমই না।এই হতাশা থেকে আমার মুক্তি চাই।
সেদিন একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছিলাম।অদ্ভুত এক মেয়ের ছবি।যেই মেয়ে সবকিছু করতে পারে।অনেকটা আয়েশার মতো।এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো আমার মাঝেমাঝে নিজেকে আয়েশা মনে হয়।ছোটবেলা থেকেই আমার নিজেকে সবার থেকে আলাদা মনে হতো।তাই আমি সবার প্রিয় হতে চেষ্টা করতাম।চেষ্টা করতাম সবকিছু করতে।চেষ্টা করতাম সবাইকে বিশ্বাস করাতে যে,আমি সত্যিই একটু আলাদা।আর তারপর নিজের ভেতরের শ্রেষ্ঠত্বটাকে বোঝার চেষ্টা করতাম।ইদানিং নিজেকে আয়েশা ভাবতে ভালোই লাগে!এই ব্যাপারটা ঘটছে সেদিন থেকে,যেদিন থেকে আমি হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের "শী" আর "রিটার্ন অব শী" শেষ করেছি।কাকতালীয়ভাবে ছোটবেলা থেকেই শুনতাম মা আফসোস করতো আমার নাম কেন আয়েশা রাখলোনা।আমি বলতাম,"রাখতেই পারতে।" আমার মায়ের খুব শখ ছিলো আমার নাম আয়েশা রাখার।যদিও জানিনা কেন।তবে ইদানিং মনে হয় মায়ের ওই ইচ্ছেটার পেছনে ঐশ্বরিক কোনো ব্যাপার কাজ করেছিলো।কিন্তু পরে দুর্ভাগ্যক্রমে নামটা আমার হয়নি।কেননা আমার আয়েশা হবার পথে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।দাঁড়ানোটাই স্বাভাবিক।তাই আমি রাগ করিনি।কিন্তু আজকাল এই মাঝামাঝি পর্যায়ে আটকে থাকতে আমার আর ভালো লাগেনা।এই জায়গাটা খুব জটিল।বিশেষত কেউ যখন কোনো কোনো কথা বিশ্বাস করতে চায়না তখন খুব রাগ হয় আমার।
আমি আমার হতাশা আর আয়েশা এই দুটো বিষয় নিয়ে ডাক্তারের কাছেও গেছি। তিনি বলেছেন,এটা ছোটখাটো আইডেন্টিটি ক্রাইসিস ধরণের ব্যাপার। বইয়ের রেশ কেটে গেলে ঠিক হয়ে যাবে।আমাকে অন্য বই পড়া শুরু করতে হবে।আমিও মজা পেয়েছি।তবে,সত্যিই আয়েশার সাথে আমার অনেক মিল।এটা উড়িয়ে দেবার মত ব্যাপার নয়।
আমি অনেককিছু বুঝতে পারি।বিশেষত কী ঘটবে বা কী ঘটতে চলেছে,এসব।ওইতো সেদিন আমার এক খালাতো ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছিলো।তার সাথে বেশ রাগ করেছিলাম অনেকদিন আগে।অথচ এমনভাবে তার কথা মনে পড়ছিলো,যেন কিছুই হয়নি,সব সুখের স্মৃতি। কয়েকদিন বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এই অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটছিলো।যেন ও মাথার ভেতর ঢুকে রাগ জল করে দিচ্ছে।মনেই ছিলোনা ওর উপর রেগে আছি।শেষ যেদিন এমন হলো তার পরদিন একটা খবর এলো।ও মারা গেছে।
এর কয়েকদিন আগের কথা,বাসায় মেহমান আসার কথা।মাকে ফোন দিয়ে বললো, তাঁরা রাস্তায়।আমার হঠাৎ কী যেন হলো।লেবু কাটা বন্ধ করে মার হাতে ছুরিটা দিয়ে এলাম।মা অবাক হয়ে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বললাম, ওরা আসবেনা।মা খুব হাসলো।আমার খুব রাগ হলো।কিন্তু কিছু না বলে চলে এলাম।
সেদিন ওনারা আসেননি।কী একটা অজুহাতে তাদের ছোট ছেলেটা বিদেশ থেকে হঠাৎ বাড়িতে হাজির হওয়ায় তাদের বাড়ি ফিরে যেতে হয়েছিলো।
এগুলো খুব সাধারণ ঘটনা।আরো নিখুঁত ঘটনাও আমার সাথে ঘটে।খেয়াল করিনা।তবে আজকাল চেষ্টা করছি।
সবচেয়ে বাজে লাগে যখন কেউ আমার সাথে মিছেমিছি মিশতে থাকে,আড়ালে অন্যকিছু করে।সবগুলো ঘটনা আজ পর্যন্ত আমার সামনে পড়েছে।কী যে বিব্রতকর! এটা আমার ভালো লাগেনা।একটা মানুষ আমার সাথে মিশছে জানলেই তো হলো।ঈশ্বর কেন আমাকে তাদের আসল চেহারা জানিয়ে দেন! এমন অনেক অনেক দিন অনেক অনেক কষ্টকর কথা আমাকে শুনতে হয়েছে,যা শুনে আমি চিৎকার করে কেঁদেছি।হিপোক্রেসি শব্দটা যে কতটা বাজে,তা আমাকে ঈশ্বর নিজ হাতে ধরে প্রতিবার দেখিয়ে এনেছেন।আর আমি বারবার বলেছি,ওখানে আর একটু পর আমি গেলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো আমার?
আমি অনেক বেশি হতাশ।আসলে মূল কারণটা এটাই।আমি আমার চারপাশকে অনেক সুন্দর ভাবতাম।কিন্তু ঈশ্বর আমার ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছেন।এখন আমার দমবন্ধ লাগে।আর আশেপাশের ঘটনাগুলো এত নিখুঁতভাবে কল্পনার সাথে মিশে যাচ্ছে যে নিজেকে আজকাল অসুস্থ মনে হয়।ঘুম নামক জিনিসটা যে কী তা ভুলেই গিয়েছি প্রায়।সামনে পরীক্ষা, পড়তেও পারছিনা কিছু। কেবল মনে হচ্ছে অশুদ্ধ একটা জায়গায় খুব একা হয়ে গেছি আমি।ভীষণ একা!
ও আমাকে বারবার বলে,"আমি আছি তো!" কিন্তু আমার তাও কষ্ট হয়।মাঝেমাঝে মনে হয় ও যদি আমার কাছে থাকতো! রাতেরবেলা মাঝেমাঝেই একা একা খুব ভয় হয়।মনে হয় এখনই শেষ হয়ে যাবো এই দমবন্ধ করা পৃথিবীতে থাকলে! ওর বুকের গন্ধ পেলে একটু নিঃশ্বাস নেয়া যেত।কিন্তু ও তো আমার কাছে থাকেনা।এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা।মাঝেমাঝে ওকে ভোররাতে ফোন দিয়ে জাগিয়ে বলি,"শুনছো,আমার খুব ভয় করছে।" কোনোদিন বোঝে,কোনোদিন বোঝেনা।আমি তাও ওর নিঃশ্বাসের শব্দে শান্তি পাই।মাঝেমাঝে ফোনে কিছুই শোনা যায়না।সেদিনগুলোতে আমি পাগল হয়ে যাই।ডিসেক্টিং বক্সের দিকে হাত বাড়াই।তারপর একটু একটু হাত কাটি।এটা করলেও মাঝেমাঝে সব ভুলে যাওয়া যায়।নিজেকে শাস্তি দেয়া উচিত।কেন কেউ আমাকে নিয়ে উল্টোপাল্টা বলবে?কেন আমার আড়ালে এসব হবে? আর কেনই বা আমাকে ভুল করে শুনে ফেলতে হবে? কেন আমাকে কষ্ট দেবে কেউ?কোথাও না কোথাও আমার খুঁত আছে অবশ্যই!এসব ভাবতে ভাবতেই কাটি। হাত ব্যথা করতে থাকে যখন তখন থেমে যাই।তারপর সব ভুলে ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে ঘুমিয়ে যাই।
সেদিন সবচেয়ে রাগ হলো তখন,যখন আমার বান্ধবী আমাকে বললো ও নাকি আমাদের ক্লাসের কোন মেয়ের সাথে প্রেম করছে।আমি খুব বিরক্ত হলাম।এসব কী কথা! ওকে নিয়ে সবাই জল্পনা কল্পনা করে,দেখে আসছি।তাই বলে এসব!শেষমেশ ওই বান্ধবীকে বলেই দিলাম আমাদের প্রেমের কথা।ও হাসলো।বললো, "ও করবে তোর সাথে প্রেম? এটা স্বপ্ন হলেও একটা কথা ছিলো! " আমার বান্ধবী যা বললো একটা কথাও আমি বিশ্বাস করলাম না।সেই মেয়েটা নাকি ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী, ও সেই মেয়েটার জন্য পাগল।ও নাকি এখন ভার্সিটিতে উঠে গেছে-এমন অনেক অবিশ্বাস্য কথা।শেষমেশ আমি হেসে ফেললাম, আর পারছিলাম না।"তুই আমার কাছে আমাদের ব্যাপারে জানতে চাস বললেই পারতি।এত ফাজলামি করতে হতোনা!" -এই বলে আমি চলে এলাম।
বাসায় এসে ওকে দেখা করতে বললাম।ও কোনোদিন আমি আসতে বললে না করেনা! কী পাগল ছেলেই না ও! যখন আমার কাছে আসছিল তখন ওর সুন্দর চুলগুলো বাতাসে উড়ছিলো। হালকা বাদামী চুলগুলোতে রোদ পড়ে কত সুন্দরই না লাগছিলো ওকে! আর আমি ওর চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম এমন বাদামী সমুদ্রের মত গভীর চোখ আর কারুর থাকতে পারে কিনা। ও সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর যুবক।আমার প্রেমিক বলে বলছিনা।আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে দেখেই কিনা, আমি অসুস্থতার জন্য এক ক্লাস ড্রপ দিলাম বলে,সে ও সেই বছর আর পড়েনি।এবার একসাথে পরীক্ষা দেবো।ওর আর আমার কথা কেউ জানতোনা।কারণ আমরা চাইনি কেউ এখনই জানুক।ও এসেই আমার পাশে বসলো।তারপর মিষ্টি করে হাসলো। আমরা অনেক গল্প করলাম।হেসে কুটিকুটি হলাম আমার বান্ধবীর বানানো গল্পগুলো বলে।আমি ওকে পেয়ে অনর্গল কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে দেখলাম ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,যেমনটা প্রতিদিন করে।আমি আমার কথা চালিয়ে গেলাম।যাবার সময় ও আমাকে বলে গেলো,"তুমি জানোনা তুমি কতটা অসাধারণ। কী দুঃখের বিষয় কোনোদিন জানতেও পারবেনা! অথচ আমি কত ভাগ্যবান,তোমাকে নিজের চোখে দেখতে পারছি!" আমি ওর পাগলামিকে আশকারা দিলামনা।ওর চুলে হাত বুলিয়ে ওকে বিদায় দিলাম।হাতটা ছেড়ে দিতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো,তাও ছাড়তে হলো।আমি জানিনা আমি ওকে কেন এত ভালোবাসি।
ওর মত কাউকে ভালো না বেসে থাকা যায়?
কিন্তু আমার হতাশার সবচেয়ে বড় কারণই এখন ও।সেদিন আমি নিজের চোখে ওকে দেখেছি সুন্দরী একটা মেয়ের সঙ্গে।মেয়েটা সুন্দরী, সন্দেহ নেই।কিন্তু সাধারণ।ওর মতো না।ও কী ভীষণ চঞ্চল,দেবতার মত সুন্দর।হয়তো সৌন্দর্য্যের কোনো দেবতা থাকলে তিনিও ওকে হিংসা করবেন।সে সত্যিই ক্যালিক্রেটিসের সমতুল্য।কিছু ক্ষেত্রে ক্যালিক্রেটিস থেকেও অসাধারণ! কিন্তু কী দুঃখের বিষয়! সেই মেয়েটাকে ওর পাশে একদম মানাচ্ছেনা! আমি ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম সেদিনও।কিন্তু ওদের কাছে গেলামনা।কথা বলতেই পারে অন্য কারুর সাথে।কেন যেন ওকে না ডেকেই চলে এলাম।
এত নিষ্পাপ একটা ছেলেকে সন্দেহ করার কোনো কারণ থাকা উচিত না।
পরদিন ও আবার এলো আমার কাছে।আমার হাতের আঙুলগুলো দিয়ে ও অর্গান বাজানোর মত করে খেলছিল যখন,তখন ওকে থামিয়ে দিয়ে ওকে ওই মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করতেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,"মেয়েটাকে খুব বেশি চিনিনা,তবে মেয়েটা তোমার কথা খুব জিজ্ঞেস করছিলো!বলছিলো, আমাদের দুজনকে নাকি একসাথে স্বর্গীয় দেখায়।ঠিকই তো বলেছে,তাই না? আমার খুব ভালো লেগেছে কথাটা! " ওর কথা শুনে আমিও ওকে জড়িয়ে ধরলাম।খুব ভালোভাবে।কেননা,ওর মত আদুরে প্রেমিক এই পৃথিবীতে পাওয়া কোনোদিন সম্ভব নয়!
ও সত্যিই আমার লিও।আর আমি আয়েশা।আমাদের দুজনকে এক হতেই হবে।মৃত্যুও আসতে পারে। কিছু আসে যায়না। অমর প্রেমকাহিনীগুলো মৃত্যুর পরোয়া কবেই বা করেছে? আর আমরাই হয়তো শ্রেষ্ঠ! ওর রেশমী চুলগুলোতে হাত বোলাতে বোলাতে যখন ওর ঠোঁটে আমি চুমু খাবো,কী অদ্ভুত সুন্দর না জানি লাগবে আমাদের!হয়তো পৃথিবীর মানুষের জন্য না সে সৌন্দর্য,তাই খুব ইচ্ছে করলেও ওকে চুমু খাওয়া হয়নি এখনো!
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।উঠে দেখি বাজছে একটা দশ।ওকে ফোন দিলাম।ও ওর অদ্ভুত সুন্দর কন্ঠে আমাকে 'আয়েশা' বলে ডাকল।আমিও অবাক হলামনা।এত সুন্দর কন্ঠস্বর পৃথিবীতে আর একটাও নেই।এটা আমি বাজি ধরে বলতে পারি।
কিন্তু আজ সকালেও আমি খুব হতাশ।কেন যেন নিশ্চিত হতে পারছিনা।আমি কিছুই করতে পারিনা,কী হবে আমার?আর এদিকে মেয়েরা সব ওকে আর ওই মেয়েটাকে নিয়ে নানান গল্প বলেই যাচ্ছে।এসবের মানে কী?শুধুই মিথ্যে হলে এতদিন ধরে কেন সবাই এটা নিয়ে কথা বলবে?
আমি সন্ধ্যায় হাঁটতে বের হলাম।সেদিন যেখানে ওই মেয়েটাকে ওর সঙ্গে দেখেছিলাম সেখানে এসে বসলাম।জায়গাটা সুন্দর! হঠাৎ দেখি ও এদিকে আসছে।সাথে সেই মেয়েটাও।আমার খুব কষ্ট হলো কেন জানিনা।যত যাই হোক, ও তো আর আমাকে মিথ্যে বলেনি।ওরা এদিকেই আসছে।এগিয়ে এসে ও আমাকে ওর অদ্ভুত সুন্দর কন্ঠে বললো,"জায়গাটা ছেড়ে দেবেন? আমরা এখানে রোজ বসি।" আমি যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলাম।"তুমি কী বলছো?এভাবে কেন কথা বলছো লিও?" বলতে গিয়ে চোখে জল এসে গেলো।ও বললো, "আপনার কথা আমি বুঝতে পারছিনা।কিন্তু আপনি কি আমাকে চেনেন? আমার নাম কিন্তু লিও না।আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।"আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম আর ওই মেয়েটা অবাক হয়ে গেলো।"তোমার নাম লিও না।আমি জানি।কিন্তু ও কে?"
আমার প্রেমিক এবং তার প্রেমিকা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর লিও খুব শান্তভাবে আমাকে বললো,"দেখুন,আপনার সত্যিই কোথাও ভুল হয়েছে।আমি চাইবো আপনি এখন এখান থেকে চলে যান।মেরি আপনাকে ভয় পাচ্ছে।" আমি এখন সত্যিই নিজেকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম।ওকে স্যরি বলে আমি চলে এলাম।কী হচ্ছে আমার সাথে?
তাহলে কি লিও আমার কল্পনা? ছোটবেলা থেকে ওকে দেখে আসাটা তো সত্যিই।তবে কি ওর আর আমার প্রেমটা আমার কল্পনা? ওর সৌন্দর্য আর শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই কি ওকে আমি ভালোবেসে আমার প্রেমিকের জায়গাটা দিয়ে রেখেছি? আমাদের এতদিনের প্রেম কি শুধুই আমার কল্পনা?
হোক কল্পনা।লিও শুধুই আমার।আমি আজও ঘুমাতে পারছিনা।ছয়টা দুই বাজে।
আমার স্বপ্নের লিও।ভালোবাসার লিও।ওর ছেলেমানুষি ভরা হাসিটা দেখলে ওকে দোষ দিতে পারিনা আমি।ও শুধুই আমার। যাই হোক না কেন।বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছি আমি।লিও আমাকে শেষবার প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলো,তাই আমি আজ হাত কাটবোনা।
বিকেল হয়েছে।একটু ঘুমিয়েছি।আজ ল্যাব ছিলো।কেমিস্ট্রি ল্যাব।ল্যাব করে ক্লান্ত হয়ে ফিরছি।একটুও জোর নেই শরীরে।আমি কিছু খাবোনা,লিওর সাথে এই টানাপোড়েন নিয়ে আমি কীভাবে কী করি?কল্পনায়ও লিওকে পাচ্ছিনা।লিওর সেই নাম্বারটায় প্রতিদিনই কল দেয়া।একদিনও কল ডিউরেশন নেই,সব শূন্য।ভালো করে ঘেঁটে দেখলাম দেখলাম নাম্বারটা দশ ডিজিটের।
সারা সকাল ঘেঁটে নিজেকে পাগল প্রমাণ করা ছাড়া আর কিছুই পারিনি আমি।খুব অদ্ভুত লাগছে।সবচেয়ে বেশি যেটা ইচ্ছে করছে তা হলো লিওকে দেখার ইচ্ছে!লিওকে দেখতে ইচ্ছে করছে ভীষণ,সত্যি! আজ বিকেলে ওখানে গেলে আর লিওর দেখা পাওয়া যাবে।যদিও ওই মেয়েটার সাথে লিও আমার কাছে আসলে সহ্য হয়না আমার।খুব কষ্ট হয়।কিন্তু এটা তো লিও,ওকে দেখার জন্য এটুকু কষ্ট আমাকে করতেই হবে!
সন্ধ্যা হয়েছে।আমি বসে আছি সেই জায়গাটায়।একটু পর লিও আসবে।সবকিছু ঠিক করে রেখেছি।লিওকে দেখামাত্রই উঠে দাঁড়ালাম।লিপস্টিকটা বের করে সেজে নিলাম।শেষ ছোঁয়াটুকু দিতেই লিও আর লিওর প্রেমিকা অন্যদিকে যেতে লাগলো।পাঁচদিন ধরে না খেয়ে খেয়ে দুর্বল হয়ে গেছি,তাও বলা যায় প্রায় দৌড়েই ওর কাছে গেলাম! রাস্তা আগলে লিওর দিকে তাকালাম।কী সুন্দর লাগছে আমার ভালোবাসাকে! এই হয়তো ওর সাথে আমার শেষ দেখা! লিওকে জিজ্ঞেস করলাম, "আমাকে কেমন দেখাচ্ছে,লিও?" লিও বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকাল।লিওর বাদামী চোখগুলো নীলচে লাগছে। সব ঝাপসা হয়ে আসছে।আস্তে আস্তে মাথা ঘুরছে আমার।আর সামলাতে না পেরে আমি লিওর উপরই পড়ে গেলাম।লিও তার বলিষ্ঠ বাহু দিয়ে ঠিকই ধরে ফেললো আমায়।বললো,"কী হয়েছে আপনার?" আমি কোনো কথা না বলে লিওর রেশমী চুলগুলো ধরে আমার কাছে ওর ঠোঁট দুটো নিয়ে এসে গভীরভাবে চুমু খেলাম।
লিও বোধহয় বেশ অবাক হয়ে গেছিলো।কিন্তু আমার ঠোঁটের সাথে ওর ঠোঁটের অদ্ভুত মিশে যাওয়ার জন্যই কিনা,ও থামতে পারলোনা।ওর প্রেমিকাও বোধহয় ভীষণ অবাক হয়েছিলো।আর আমি অবাক হচ্ছিলাম জীবনে প্রথমবারের মত আমার প্রিয় যুবকটিকে চুমু খেতে পেরে। এটাই তো আমি চাইতাম এতদিন ধরে!এখন সত্যিই শান্তিতে মরতে পারবো।সাথে লিওকেও নিয়ে যাবো।ও শুধুই আমার।আর কারো না!
আমার ঠোঁটে বিষ ছিলো।মারাত্মক বিষ।লিও আস্তে আস্তে আমাকে নিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো,আর আমিও আধো অচেতন হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন আমাদের প্রেম অমর হবে।লিওকে জড়িয়ে ধরে ওর কানে কানে বললাম,"আমি তোমাকে ভালোবাসি, লিও।" আমাকে অবাক করে দিয়ে লিও-ও আস্তে আস্তে বলে উঠলো,"আমিও তোমাকে ভালোবাসি,আয়েশা!" ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলাম!
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ২:৩৫