ট্রেনটা যখন চলে গেল আমি বেশ বিরক্তি নিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইলাম।কী লাভ হলো এভাবে দৌড়ে এসে? ঢাকার এই বিচ্ছিরি জ্যামটা আমার একশো পঞ্চাশ টাকার টিকিট মেরে দিলো! এই ভ্যাপসা গরমের দিনে এখন আমি বাসে যাবো? হতেই পারেনা।
হঠাৎ এক পিচ্চি ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে সম্ভবত তার সবগুলো দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বললো,"ট্রেন তো গেছেগা আপা,অহন কী করবেন?"
কী আপদ! এই ছোড়াটাও এখন আমায় নিয়ে মজা করছে! আশেপাশে ভালো করে তাকালাম।প্ল্যাটফর্মের প্রতিটা মানুষই বলা যায় আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমি কোনো চিড়িয়াখানার জন্তু!তাদের ভ্যাপসা গরমের একঘেয়ে দিনে আমাকে দিয়েই কেন বিনোদন পেতে হবে? খুব রাগ হলো।সব রাগ পিচ্চি ছোড়াটার উপর ঢেলে দিয়ে কটমট করে বললাম,"ভাগ এখান থেকে!" ছোড়াটা দ্বিগুণ হাসি দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে চলে গেলো।
ভারি ট্রলি ব্যাগটা টেনে নিয়ে বসে পড়লাম প্ল্যাটফর্মের ফ্যানের নিচে।যে করেই হোক,বাড়িতে তো যেতেই হবে।ভীষণ গরম আজ।কষ্ট হবে খুব!
হতাশ এবং বিরক্ত আমি যখন বসে আছি তখন হঠাৎ আমারই মতোন এক দুর্ভাগা দৌড়ে প্ল্যাটফর্মে এলো।তার চেহারা দেখে যা বুঝলাম তা হলো এও আমারই মতোন বাসে যাবার কথা ভেবে শিউরে উঠছে!
আর পাঁচ মিনিট পরই উঠবো,এই শপথ নিয়ে সবেমাত্র যখন ঘড়িটার দিকে তাকালাম ঠিক তখনই বাংলাদেশের সব আরজেদের হার মানিয়ে মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর একটি কন্ঠ বলে উঠলো, "এক্সকিউজ মি!"
আমি হকচকিয়ে গেলাম।সামনে তাকিয়ে যা দেখলাম তা হলো,অসম্ভব সুন্দর একটি ছেলে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।ছাইরঙা ফুলহাতা ফতুয়া তার গায়ে, সাথে মানিয়ে গেছে মেটে রঙের একটা প্যান্ট। ছেলেটির চুলগুলো ভীষণ সুন্দর।গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার ভদ্র গোছের ছেলেটি অনেক আশা নিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলো,"বারোটার ট্রেনটা কি লেট করেছে নাকি ছেড়ে গেছে? কাইন্ডলি একটু বলতে পারবেন?"
আমি মনে মনে খুব হেসে নিয়ে ছেলেটিকে হতাশ করে বললাম,"দুঃখিত! ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে!"
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ছেলেটিকে হতাশ করে দিয়ে আমি পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছি! আসলে মানুষের আদিম প্রবৃত্তি কি এটা? একটু আগেই তো আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল! মানুষকে নিরাশ করে মজা পাওয়াটা আসলে ঠিক কেমন? এটা কি একই কারণে নিজের হতাশা দূর করে দেয়?
সঠিক কোনো উত্তর না পেলেও বুঝতে পারলাম আমার আবারও হতাশ লাগছে!
ছেলেটি বললো, "যদি কিছু মনে না করেন, আপনিও কি ট্রেন মিস করেছেন?"
আমি মাথা নাড়লাম।ছেলেটি একটু ভরসা পেলো মনে হলো।তারপর ঢাকা শহরের জ্যাম নিয়ে দু এক লাইন বললো।আমি শুনছি না।কারণ আমার মাথায় আবারো বাস জার্নির কথা ঢুকে গেছে। আমি একটু হেসে তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, "আচ্ছা,আসি।"
ট্রলি ব্যাগ টেনে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটা দিলাম।ছেলেটি দেখলাম পানিওয়ালাকে ডাকতে এগিয়ে গেলো।এখন বাজছে বারোটা পঁচিশ।বাসে যেতে যেতে হয়তো ন'টা দশটা বেজে যাবে।অথচ ট্রেনে গেলে সাতটার মাঝে পৌঁছে যেতাম! সত্যিই ঢাকা শহরের জ্যাম বড় নিষ্ঠুর!
সেই পিচ্চি ছোড়া আবার সামনে পড়লো।আবারো তার বিশ পঁচিশটা দাঁত বের করে বললো,"আফা,বাসে যাইবেন নাকি?"
আমি কটমট করে চেয়ে হাঁটতে লাগলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১:৫৩