খেলাটির সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মোটামুটি সবাই খেলাটা সম্পর্কে জানে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে দুটো দল আছে। একদল ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান খেলে অন্যদল এটা নিয়ে ভ্রু
কুচকায়, ভেংচি কাটে এবং নাক সিটকায়। নাক সিটকানো দল থেকেও কৌতূহলবশত অনেকে খেলতে শুরু করে__ রেগুলার খেলোয়াড়দের দল ভারী হয়।
ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান খেলার পজিটিভ দিক জিজ্ঞেস করলে খেলোয়াড়রা প্রথমেই বলবে ব্যাপক বিনোদন। তারপরে বলবে ইউনিটি শেখায়, লনলিনেস দূর করে, অনেকের সাথে পরিচয় হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর আর খুব বেশিদূর যেতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা হল ভালো লাগে। ভালো লাগার ওপরে কোন কথা চলে না।
সারা বিশ্বে প্রায় ৩০ টির বেশি দেশে এই খেলাটি জনপ্রিয়। বাংলাদেশে ১০ লাখের বেশি মানুষ এই গেমসের প্লেয়ার। ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান এর একটা বাংলাদেশী গ্রুপে প্রায় লাখের ওপরে মেম্বার। মেইন ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান ভেরিফায়েড পেইজে ১৭ কোটির ওপরে লাইক। গুগল প্লে স্টোরে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে আছে ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৮ মিলিয়ন অর্থাৎ প্রায় কোটির কাছাকাছি মানুষ এই গেমস খেলে যা থেকে সুপারসেলের দিনপ্রতি আয় ৫.১৫ মিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৪০ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা।
অনলাইনে একটা রিউমর এলো। গেমসের ক্ল্যানে একটা অশুভ ছাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেটা অনেকটা লুসিফার বা শয়তানের আদল। অনেকেই স্ক্রিন শট নিয়ে সেটা পোষ্ট করেছে। BrunoNexoBrazil নামের একজন জুনিয়র মেম্বার সুপারসেলের ফোরামে ছবি সহ বিষয়টি উল্লেখ করে। “Have you noticed some strange designs on the base? Yes, they exist. Several players have found by yourself(sic) and were amazed,” BrunoNexoBrazil posted as caption to the pictures.
The junior member also said that the images “ensure that the supercell has a pact with the devil”; the reason why the game makes someone “increasingly addicted” creating the tendency “to forget the world and family.”
( সে এটাও বলে ‘এটা নিশ্চিত যে সুপারসেলের সাথে শয়তানের একটা চুক্তি আছে।’ সে কারনেই এই গেমস মানুষকে ক্রমবর্ধমান হারে আসক্ত করে এবং জগত ও পরিবার ভুলে থাকার প্রবনতা তৈরি করে।)
এই গুজবের পালে হাওয়া দিতে আরও অনেকেই স্ক্রিনশট দিয়ে সেই অশুভ ছাপ ওয়ালা ক্ল্যানের ছবি আপলোড দিল। বিভিন্ন গেইম বেসিস ফোরামে এটা নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হল। কেউ এটাকে সায় দিল আবার কেউ উত্তপ্ত মস্তিস্কের কল্পনা হিসেবে এড়িয়ে গেল। কিছুদিন পর থেকে সেই ছাপ আর আগের মত স্পষ্ট ভাবে চোখে পরে না। তবে এখনও অনেকে নাকি সেটা অস্পষ্ট ভাবে দেখতে পায়।
সৃষ্টির শুরু থেকেই আমরা উন্নত সভ্যতার পেছনেই ছুটছি। সভ্য হবার চেষ্টা করছি। সভ্য ভাবে বাঁচার এনভায়রনমেন্ট তৈরি করছি। যার জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন শুভ চিন্তা।
গোঁড়ামি কিংবা গুজব এড়িয়ে একটু নিরপেক্ষ ভাবে চিন্তা করা যাক। এটা একটা গেইমস। একটা বিনোদনের মাধ্যম মাত্র। কিন্তু এই সাধারন একটা বিনোদনের এক্সপ্রেশনটা অশুভ কেন হতে হবে? এখানে গেইমটা বড় বিষয় না। মূল ব্যাপার হল এর থিমটা। শুধু মাত্র একটা অশুভ ছাপের গুজব না, একটু সচেতনভাবে লক্ষ্য করলে এর প্রত্যেকটা এলিমেন্টে অশুভ ছাপ চোখে পরবে।
Clash of Clans = (গোত্রসমূহের মধ্যে সংঘর্ষ) হতে পারে এটা একটা রোমাঞ্চকর গেমস। তাই নামটাও রোমাঞ্চপূর্ণ। সংঘর্ষ ছাড়া মনে হয় রোমাঞ্চ ঠিক জমে না।
Barbarian (অসভ্য, বর্বর) একজন প্লেয়ার সর্ব প্রথম যুদ্ধের জন্য বারবারিয়ান সৈন্য হিসেবে পায়।
Goblin (অপদেবতা) সবুজ রঙের বিদঘুটে এই এলিমেন্ট খুব দ্রুত লুট সংগ্রহ করে।
Wizard (জাদুকর) এই এলিমেন্ট আগুন ছুড়ে শত্রুপক্ষকে কাবু করে।
Hog Raider (এক বিশেষ ধরনের সৈন্য) এরা শুকরের পিঠে চলাফেরা করে। খুব দ্রুত বিভিন্ন প্রটেকশন ভেঙ্গে ফেলে।
Healer (বৈদ্য, জাদুকরী চিকিৎসক) সৈন্যদের ওপর হিলার ছেড়ে দিলে হিলারের বলয়ের ভেতর থাকা সৈন্য সহজে মরে না।
Witch (ডাইনি) শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে এরা বিশেষ পারদর্শী।
Valkyrie (নরওয়ে মিথলজির একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র) ক্ল্যানে সৈন্য হিসেবে এরা অত্যন্ত পারদর্শী।
হাতিয়ারের মধ্যে আরও আছে ওয়াল ব্রেকার,
বেলুন,
মিনিওন,
জেইন্ট, ড্রাগন, লাভা হাউন্ড, হিলিং স্পেলসহ অনেক কিছু। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে লেটেস্ট এবং পাওয়ারফুল সৈন্য হিসেবে আছে PEKKA.
P.E.K.K.A= Perfect Enraged Knight Killer of Assassins (হত্যাকারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ উন্মাদ হত্যাকারী নাইট) এর কদর প্লেয়ারদের কাছে সবচেয়ে বেশি।
ইট
আরচার টাওয়ার
ছবিগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রত্যেকটা এলিমেন্ট একেকটা অশুভ সিম্বল। এমনকি ইটগুলো এর ব্যতিক্রম না। এখানে যুদ্ধের প্রত্যেকটা ইলিমেন্ট কোন স্বাভাবিক যুদ্ধের ইলিমেন্ট না। মিথ অনুযায়ী এগুলো শয়তানের যুদ্ধের হাতিয়ার। ওয়্যার চলাকালীন মিউজিক, ওয়্যার ভিলেজের ডিজাইন থেকে শুরু করে খুঁটিনাটি সব বিষয় অত্যন্ত নিখুঁত। সবগুলো ইলিমেন্টের এই লজিক্যাল কম্বিনেশন কাকতালীয় ভাবে হয় না।
তবু ধরে নিচ্ছি এটা একটা সাধারন গেম। কিন্তু এর আসক্ত করার ক্ষমতা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। গুটিকয়েক বলবে আমরা অবসর সময়ে খেলি। যারা এই গেমের প্লেয়ার তারা প্রয়োজনের বাইরে কাজ বলতে আর কিছু বোঝে না। দৈনন্দিন কাজের বাইরের সবটুকু সময় নিয়ে নিচ্ছে ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান। ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যানের বাইরেও চিন্তা করার মত, সৃজনশীলতা কাজে লাগানোর মত আরও অনেক জায়গা আছে সেটা ভাববার সময় এই গেমের প্লেয়ারদের নেই। সৃজনশীলতা নষ্ট করার জন্য এই একটা গেমই যথেষ্ট।
মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা তার চিন্তাকে প্রভাবিত করে। এই গেইমের অশুভ প্রভাব কাউকে প্রভাবিত করবে না এমন কোন নিশ্চয়তা সুপারসেল কাউকে দেয় নি। গেইমের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে বাস্তবে কেউ যদি এই রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে চায় সেটা নিশ্চয় অস্বাভাবিক হবে না। সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবার একটা অন্যতম কারন হিসেবে মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের সাংঘর্ষিক গেমসকে দায়ী করেন।
কার্টুন এবং গেমসের বদৌলতে ঘৃণ্য ইঁদুরের প্রতিও মানুষের গদ গদ ভাব তৈরি হয়। গেমসের হিরো চরিত্র গুলো যত কুৎসিত হোক সেই চরিত্রে নিজেকে ভাবতে একজন প্লেয়ারের কোন দ্বিধা থাকে না। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র পাপাইয়ের কারনে বাচ্চাদের মধ্যে পালং শাক খওয়ার প্রবনতা অনেক গুন বেড়ে গিয়েছিল। একই ভাবে সুপারসেলের ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান খেলার মাধ্যমে যদি কারো মধ্যে বারবারিয়ান, ডাইনি কিংবা অপদেবতার প্রতি ভালোবাসা জন্মায় তাহলে কি ঘটবে?
কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে ম্যানিয়া মনোবিজ্ঞানের অনেক পরিচিত একটা অসুখ। মস্তিস্ক বিকৃতির উদাহরণও অনেক। সেখানে এই গেমের প্রত্যেকটা ইলিমেন্টের মিথলজিক্যাল হিস্ট্রি আছে। যা নিয়ে মানুষের মাতামাতি কুৎসিত ইতিহাস তৈরি করেছে। ডাকিনী, জাদুবিদ্যা ও শয়তানের উপাসনার প্রকাশ্য চর্চা বহুদিন আগেই বন্ধ করা হয়েছে। এখনও এই বিষয়গুলোকে সভ্যতার চোখে ঘৃণ্য হিসেবে দেখা হয়। অশুভ শক্তির দমন এবং শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠার লড়াই যুগ যুগান্তরের। সেই বিষয়গুলোকে সূক্ষ্মভাবে মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে স্বাভাবিক চোখে দেখার মানসিকতা তৈরিতে ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান হতে পারে সবচেয়ে চমৎকার মাধ্যম। কিংবা যে কোন সুস্থ চিন্তা থেকে মানুষকে সরিয়ে রাখতে ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান খেলা শিখিয়ে দেয়াই যথেষ্ট। কোন দিক বিবেচনা না করে ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান নিয়ে বর্তমান বাড়াবাড়ি এর প্রমান।
সুপারসেল কি করছে, মানুষকে শয়তানের পূজারি বানিয়ে ফেলছে, স্বাভাবিক জগত থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে এইসব বিতর্কিত আলোচনায় না গিয়ে নিজের ভালো মন্দ বোঝাটা জরুরী। কিন্তু আচ্ছন্ন আসক্ত মানুষ ঘোরের মধ্য থেকে বেরিয়ে ভালো মন্দ ঝামেলায় যেতে চায় না। তারা টান টান উত্তেজনার মধ্যে থেকে ওয়্যার অ্যাটাক দিতেই বেশি পছন্দ করে। রিয়েল লাইফ আপগ্রেড দেবার চেয়ে টাউন হল আপগ্রেড নিয়ে ব্যস্ত থাকা অনেক সুখের। এই সুখের শুভ কিংবা অশুভ প্রভাব তাদের জীবন থেকে কি নিয়ে যাচ্ছে সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় কোথায়?