হে খিচুড়ি তুমি মোরে............
গাঁটে কড়ির সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমিতেছে দেখিয়া আমি আর বন্ধু ফার্মগেটের কুখ্যাত ত্রিমুখী ব্রীজের উপর দাঁড়াইয়া হাপিত্যেশ করিতেছিলাম। বন্ধু কহিল- ক্ষুধায় প্রাণ ওষ্ঠাগত, বসুন্ধরায় চল।
আমি কহিলাম- রে বড়লোক, ওইসব বুর্জোয়া খাদ্য বিপণী আমার গাঁটে সইবে না। একখানা প্রলেতারিয়া খিচুড়িসম্ভার এর খোঁজ কর দেখি।
পাঠক, স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছি খিচুড়ির কথা শুনিয়াই তোমার চোখ বন্ধ হইয়া আসিয়াছে। মনে পড়িতেছে সেই সুঘ্রাণ যাহা তোমাকে প্লেটের পর প্লেট খিচুড়ি খাওয়ার পরেও ক্ষুধার্ত বানাইয়া তোলে। সকালবেলা ডিমভাজি আর খিচুড়ি, দুপুরে গরুর মাংস সহযোগে ভূনা খিচুড়ি, রাতে মুরগীর মাংস আর খিচুড়ির শেষাংশ লইয়া কাড়াকাড়ি এ সকলই রোজকার খিচুড়িকে নতুন নতুন মাত্রা দান করে। আর খিচুড়ি-ইলিশ ভাজার কথা নাইবা বলিলাম। মোজার্টের সিম্ফনী লইয়া কি সমালোচনা চলে?
এইসব কারণে আমি খিচুড়ি খাওয়া কে উপাসনার পর্যায়ে নিয়া গেছি। খিচুড়ি খাইতে হবে আস্তে আস্তে। চোখ বন্ধ করিয়া এক গ্রাস কে বত্রিশবার চিবাইয়া খিচুড়ির স্বাদ আহরণ করিতে হইবে। খিচুড়ি খাওয়া সমাপ্ত হইলে অর্ধ ঘন্টাকাল পানীয় পান করা যাইবে না। নইলে এতক্ষণ যে স্বাদ আহরণ করিলে তাহা বেমালুম গায়েব হইয়া যাইবে।
এমনি করিয়া আমি যখন অর্ধনিমীলিত চক্ষে খিচুড়ির স্বর্গের খাবার সুপারিটেন্ডেন্ট এর দায়িত্ব পালন করিতেছিলাম তখন বন্ধুর আচমকা চিৎকারে ঘোর ভাঙ্গিল। ‘স্বাদ তেহারী ঘরে চল। গরুর মাংস ভূনা খিচুড়ি।’
বন্ধুর টেলিগ্রাম মূলক ঘোষণার অনতিবিলম্বে আমি আসাদগেট মুখী হন্টন শুরু করিলাম। বন্ধু কহিল রিকশায় গেলে আরো তাড়াতাড়ি পৌঁছাইতে পারিব তাই লম্ফ দিয়া রিকশায় উঠিলাম। রিকশা যে আশংকাজনক ভাবে নড়িয়া উঠে নাই এমন কথা কহিতে পারিব না। রিকশা ভ্রমণ শেষে কিছুকাল হন্টন এবং পুনরায় রিকশা ভ্রমণ করিয়া স্বাদ রেস্তোরাঁয় পৌঁছাইলাম।
প্রথমে দেখিয়াই মনে পড়িল, প্রলেতাঁরিয়া ভাব আছে বটে। তারপরেই আমি স্মরণ করিলাম কত দীর্ঘকাল আমি এই রেস্তোরাঁকে পাশ কাটাইয়া আসা যাওয়া করিয়াছি। কখনো ঘুণাক্ষরে চিন্তাও করিনাই এই সেই দোকান যাহা খিচুড়িপ্রেমীরা অত্যন্ত ভালোবাসার সহিত স্মরণ করে। যাহ, আমার খিচুড়ি খাওয়াই বৃথা! বন্ধু সান্ত্বনা দিল এই বলিয়া যে অনতিবিলম্বে আমরা সেই মহান খিচুড়ির সাক্ষাৎ পাইতে যাইতেছি।
অবশেষে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করিলাম। আহ! ঘ্রাণ!
অতি কষ্টে একখানা খালি টেবিল পাইয়া সংলগ্ন চেয়ারে বসিতে বসিতে বন্ধু কহিল- বিয়া বাড়ীর খাবারের মত ঘ্রাণ পাওয়া যাইতেছেনা?
আরে তাই তো! তারপরই বন্ধুর কী যেন হইয়া গেল। সে নিজের বিবাহ নিয়া সবিস্তারে পরিকল্পনা করিতে লাগিল। কিন্তু আমার খাদ্য তালিকার দিকে অধিক মনোযোগ দেখিয়া বন্ধু অত্যন্ত রাগত হইল। বন্ধুর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করিয়া খাদ্য তালিকা দেখিতে লাগিলাম।
পাঠক, তুমি কি জান বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়াঁ রেস্তোরার মূল পার্থক্য কোথায়? আইস তোমার জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করি।
বুর্জোয়া রেস্তোরাঁয় তুমি মূলত যাই খাইতে যাও না কেন তাহা খাইবার আগে এক প্রকার স্বাদবর্ধক (আপেটাইজার) তোমাকে খাইয়া লইতে হইবে। কিন্তু প্রলেতারিয়াঁ রেস্তোরায় ওসবের বালাই নাই। মনোযোগ সহকারে খাদ্য তালিকাখানায় চোখ বুলাইতে বুলাইতে দেখিবে তোমার মুখগহ্বরে জারক রস উথাল পাথাল করিতেছে।
এহেন দুর্বল মূহুর্তে এক আপা আসিয়া খাবারের নির্দেশ চাইলেন। আমরা নির্দেশ দিলাম। গরুর মাংসের খিচুড়ি, তেহারি, বোরহানী আর মুরগীর ঝালফ্রাই। হাত ধুইয়া আসিয়া আমি আর বন্ধু খিচুড়ি খাইতে অধিক সুস্বাদু হইবে না তেহারি ইত্যাদি জল্পনা কল্পনা আরম্ভ করিলাম। অপেক্ষা পীড়াদায়ক হইয়া উঠিবার আগ মূহুর্তে খিচুড়ি হাজির হইল। আমি আর বন্ধু চুপ। আস্তে আস্তে আমাদের টেবিল ভরিয়া উঠিল।
আমি আস্তে করিয়া খিচুড়ির উপরের শামী কাবাব খানা ভাঙ্গিয়া দেখিলাম। আহা! দেখিতে এত সুস্বাদু খাইতে না জানি কেমন হইবে! এক গ্রাস খিচুড়ি মুখে নিয়া ঝিম মারিয়া বসিয়া থাকিলাম। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নিচু হইয়া আসিল। ভাগ্যিস মানুষ হিসেবে পাঠাইয়াছো। নইলে খিচুড়ি কোথা পাইতাম!
আমি আর বন্ধু কোন কথা না বলিয়া নিজ নিজ খাবার খাইতে লাগিলাম। এহেন মহান খাদ্যের সামনে নিজেদের সব কথাকেই কীরূপ ক্ষুদ্র মনে হয়! নিঃশব্দেই আমার খিচুড়ি একটু তাহাকে দিলাম আর তাহার তেহারিতে ভাগ বসাইলাম। তেহারিটা ছিল ভালো। আমি যদি খিচুড়ির জন্য উন্মাদপ্রায় না হইতাম তবে তাহা দিয়াও উত্তমরূপে ভোজনকার্য সমাধা করা যাইতো। আর যে বোরহানী দিয়া তৃষ্ণা মিটাইয়াছিলাম তাহাও ছিল অপানপূর্ব।
কিন্তু সে খিচুড়ির কথা কি আর বলিব! মহাকাব্য ভাই মহাকাব্য। কিংবা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পও বলিতে পারেন। মুখে দিয়া কেমন একটা আকাশে উড়ার অনুভূতি পাইতেছিলাম। খিচুড়ির স্বাদ দীর্ঘ সময় স্থায়ী করিবার লক্ষ্যে আইস কিরিম খাইবার ইচ্ছা ত্যাগ করিলাম।
খাওয়া শেষে আমি আর বন্ধু খাবার দাবারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হইয়া গেলাম।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলাম- খিচুড়ি!
বন্ধু দীর্ঘতর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিল- কাবাব!
বলিলাম- যাহ তোর বিবাহে এরূপ কাবাবের ব্যবস্থা করিব। বন্ধু জিজ্ঞেস করিল- কিন্তু ততকাল কি অপেক্ষা করিয়া থাকা সম্ভব?
এইখানে কবি নীরব!
বাহির হইবার সময় এ মহান রেস্তোরাঁর একখানা ফোটো তুলিয়া রাখিলাম। এইখানে যে বারেবার ফিরিয়া আসিব তাহা নিশ্চয় বলার অপেক্ষা রাখেনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১১:২৫