ঈশ্ কত দেরি হয়ে গেল! বেচারাকে প্রতিদিন দাঁড় করিয়ে রাখি। ওর জায়গায় আমি হলে তো এতক্ষণ থাকতাম ই না।
বেচারা বারবার ফোন করছে। আমি বাসস্ট্যান্ডের দিকে দৌড়াচ্ছি বলে ফোন ধরতে পারছি না। টেলিপ্যাথিক যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকলে এই সমস্যা হতোনা। আমি ওর মাথার ভেতরে বলতাম, এইযে একটু পরেই আসছি তুমি একটু ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াও? তারপরও ও নির্ঘাত রোদের মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি এসেই যেন ওকে খুঁজে পাই। বেশ একটা standing under the spotlight ব্যাপার।
যাই হোক বিজ্ঞানীরা যেহেতু এখনো টেলিপ্যাথিক যোগাযোগের পদ্ধতি আবিষ্কার করেনি তাই আমি এখন ওকে কোনরকম আশ্বাস দিতে পারছি না। দারুণ মন খারাপ লাগছে।
ভীষণ ঝামেলা করে একটা লোক ঠাসাঠাসি বাসে উঠতে পারলাম। এক হাতে বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে ঝুলতে ফোন বের করে ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠালাম ‘আসছি। ২০ মিনিট’। ঢাকায় বাসে চড়া যেরকম- সারাক্ষণই কবিগুরুর কথা মনে পড়ে,
‘মনে হয় যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ’
বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশায় করে যাওয়া লাগে। রিকশায় উঠে ফোন করলাম। কীরকম দুঃখী দুঃখী গলায় বেচারা জিজ্ঞেস করলো- তুমি কই?
আমি মিনিট দুয়েকের মধ্যে আসার আশ্বাস দিয়ে রেখে দিলাম।
রিকশায় করে ওখানে পৌঁছে দেখি দারুণ জটলা। ওকে ঘিরে অনেকগুলো বাচ্চা-কাচ্চা লাফালাফি করছে। ঘটনা কী!
এখন শরৎকাল। আমি একদিন ওর কাছে অনেক আফসোস করছিলাম। শরতের আকাশ সারাদিনে কতবার রঙ পালটায়, কোন পাখি শরতে গান গায়, কাশফুলগুলো এখনো উড়ে উড়ে চুলে এসে পড়ে কিনা এসবের কোন খবরই আমি রাখতে পারিনি। যান্ত্রিক শহরের শরতও যান্ত্রিক হয়ে গিয়েছে। তীব্র গরম আর হাড় কাঁপানো শীত ছাড়া যেন আর কোন ঋতুর কাছ থেকে কিছুই পাওয়ার নেই।
আমার সেই দুঃখবোধের জন্যই বোধহয়, ও আমার জন্য একরাশ কাশফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাশফুল কণা উড়ে উড়ে ওর আর বাচ্চা-কাচ্চার দলের চারপাশে কেমন একটা স্বপ্ন স্বপ্ন পরিবেশ বানিয়ে ফেলেছে। ঘোর লাগা চোখে ওর কাছে হেঁটে যেতে যেতে মনে হল ভাগ্যিস ও আমার মনের কথা বুঝতে পারছেনা। তাহলে তো ধরাই পড়ে যেতাম। ওর জন্য যে তীব্র ভালোবাসাটা অনুভব করি তা নাহয় গোপনই থাকলো।
ও আমাকে দেখার পর কেমন বোকা বোকা একটা হাসি দিল। বাচ্চা-কাচ্চারা সব চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করলো- ‘আফা আইসে আফা আইসে’।
আমাকে বললো- আফা ফুলগুলা একবার ঝাঁকান। আমি ফুলগুলো ওদের মাথার উপর ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কাশফুল কণা ওড়ালাম। ওরা সেই কাশফুলের নিচে দাঁড়িয়ে লাফাতে লাগলো। একটা বাচ্চার হাতে ফুলগুলো দিয়ে দিলাম। বাচ্চাটা সেই ফুল নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলো। আর সবাই ওর পিছু পিছু। ওদের পেছনে কাশফুল উড়ে যাওয়া দেখে মনে মনে বললাম- যা ব্যাটা কাশফুল তোর জীবন সার্থক! ও বললো, দেখো দেখো ধূমকেতুর মত লাগছে না?
আমি উত্তর না দিয়ে ওকে আমার প্রিয় কবির একটা কবিতা শোনালাম।
‘ভিজে যায় কাশফুল কণা
বাতাসে ভাসে না আর,
তুষার পড়ার মত মিশে যায় না আর
আমার ভেজা আস্তিনে।
অথচ,
এই মেঘ সরে যাবে
বালিতে পুড়ে যাবে রোদ
বন্ধ চোখে
শুধু অনুভূতি হবে
বৃষ্টির মত
অবাক পতনের বোধ।’
এই দুঃখমূলক কবিতা শুনেও বেচারা একটা লজ্জা লজ্জা হাসি দিল। কেন? তা তো বলা যাবেনা।
[কত মানুষ শরৎ জুড়ে কাশফুলের ছবি তুলে দেখালো। আমি তো ভালো ছবি তুলতে পারিনা তাই ভাবলাম গল্প লিখে দেখি]